ছেলেমেয়ের বিয়ের ব্যাপারে পিতামাতার দায়িত্ব ???
ছেলেমেয়ের জৈবিক স্বাস্থ্য রক্ষা ও জৈবিক পূরণ তথা সুষ্ঠু লালন-পালনের যেমন দায়িত্ব হচ্ছে পিতামাতার, তেমনি তাদের যৌন প্রয়োজন পূরণ করে তাদের নৈতিক স্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্বও পিতামাতার। এজন্যে বিয়ের বসয় হলেই তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করা আবশ্যক এবং এ দায়িত্ব প্রধানত তাদের পিতামাতার আর তাদের অবর্তমানে অন্য অভিভাবকের।
নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী*************************************)
যার কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, তার উচিত তার জন্যে ভালো নাম রাখা এবং তাকে ভারো আদব-কায়দা শিক্ষা দেয়া। আর যখন সে বালেগ –পূর্ণ বয়স্ক ও বিয়ের যোগ্য হবে, তখন তাকে বিয়ে দেয়া কর্তব্য। কেননা বালেগ হওয়ার পরও যদি তার বিয়ের ব্যবস্থা করা না হয়, আর এ কারণে সে কোনো গুনাহের কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তাহলে তার গুনাহ তার পিতার ওপর বর্তাবে।
এ হাদীসে প্রথমত ছেলেমেয়ের ভালো নাম রাখা ও তাকে ভালো আদব-কায়দা শেখানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তার পরই বলা হয়েছে যে, ছেলে সন্তান –ছেলে বা মেয়ে –বালেগ হলে অনতিবিলম্বে যদি তার বিয়ের ব্যবস্থা করা না হয়, তার বিয়ের ব্যাপারে যদি পিতামাতা-অভিভাবক কোনোরূপ অবহেলা ও উপেক্ষা প্রদর্শন করে আর তার ফলে তার বিয়ে বিলম্বিত হওয়ার দরুন যদি তার দ্বারা কোনো গুনাহের কাজ সংঘটিত হয়, তাহলে সে গুনাহের দায়িত্ব থেকে পিতামাতা বা অভিভাবক কিছুতেই রেহাই পেতে পারে না। মওলানা ইদরীস কান্ধেলুভী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ
(আরবী**************************************************)
অর্থাৎ তার গুনাহের শাস্তি তার পিতাকে ভোগ করতে হবে। কেননা এই ব্যাপারটি তারই ত্রুটি ও অবহেলার দরূন হতে পেরেছে।
অতঃপর লিখেছেনঃ
(আরবী************************************************)
এ হাদীস থেকে ছেলেমেয়ের বিয়ের ব্যাপারে অবহেলা করার জন্যে পিতার প্রতি অতিরিক্ত শাসন, ধমক ও কঠোর বাণী জানা যায় এবং এ সম্পর্কে যথেষ্ট তাগিদ রয়েছে বলেও বোঝা যায়।
হযতর উমর ও আনাস ইবনে মালিক (রা) থেকে বর্ণিত অপর এক হাদীস থেকে জানা যায়, নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী***************************************************************)
তওরাত কিতাবে লিখিত রয়েছে, যার কন্যা বারো বছর বয়সে পৌঁছেছে আর তখনো যদি তার বিয়ের ব্যবস্থা না করে, এর ফলে যদি সে কোনো গুনাহ করে বসে তবে এ গুনাহ তার পিতার ওপর বর্তাবে।
এ দুটি হাদীস থেকেই প্রমাণিত হয় যে, সন্তান বালেগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা পিতামাতার দায়িত্ব ও কর্তব্য। আর সেই সঙ্গে বয়স্ক ছেলেমেয়েরও কর্তব্য হচ্ছে এজন্যে নিজেকে সর্বতোভাবে প্রস্তুত করা।
এ পর্যায়ে হাদীসে আরো কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। অপর এক হাদীসে রাসূলে করীম (ষ) পিতামাতাকে সম্বোধন করে বলেছেনঃ
(আরবী**********************************************************)
তোমাদের নিকট যদি এমন কোনো বর বা কনের বিয়ের প্রস্তাব আসে, যার দ্বীনদারী ও চরিত্রকে তোমরা পছন্দ করো, তাহলে তাঁর সাথে বিয়ে সম্পন্ন করো। যদি তা না করো, তাহলে জমিতে বড় বিপদ দেখা দেবে এবং সুদূরপ্রসারী বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে।
অর্থাৎ বিয়ের ব্যাপারে বর বা কনের শুধু দ্বীনদারী ও চরিত্রই প্রধানত ও প্রথমত লক্ষণীয় জিনিস। এ দিক দিয়ে বর বা কনেকে পছন্দ হলে ও যোগ্য বিবেচিত হলে অন্য কোনো দিকে বড় বেশী দৃষ্টিপাত না করে তার সাথে বিয়ে সম্পন্ন করা কর্তব্য। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ এসব দিক দিয়ে যোগ্য বর বা কনে পাওয়া সত্ত্বেও যদি তোমরা তার বিয়ের ব্যবস্থা না কর –তার সাথে বিয়ে সম্পন্ন করতে রাজি না হও, তাহলে তার পরিণাম অত্যন্ত খারাপ হবে। আর সে খারাপ পরিণামের রূপ হচ্ছে ভয়ানক বিপদ ও ব্যাপক বিপর্যয়। এর ব্যাখ্যা করে মওলানা ইদরীস কান্ধেলুভী লিখেছেনঃ
(আরবী*******************************************************)
যার দ্বীনদারী তোমরা পছন্দ করো, সে ছেলের বা মেয়ের সাথে যদি তোমরা বিয়ে সম্পন্ন না করো বরং তোমাদের দৃষ্টি উদগ্রীব হয়ে তাকে ধন-মাল ও সম্মান সম্ভ্রম সম্পন্ন কোনো বর বা কনের সন্ধানে যেমন দুনিয়াদার লোকেরা করে থাকে –তাহলে বহুসংখ্যক মেয়ে স্বামীহীনাএবং বহু সংখ্যক পুরুষ স্ত্রীহীনা অবিবাহিত হয়ে থাকতে বাধ্য হবে। আর এরই ফলে জ্বেনা-ব্যভিচার ব্যাপক হয়ে দেখা দেবে এবং সমাজে দেখা দেবে নানারূপ ফিতনা-ফাসাদ ও বিপদ-বিপর্যয়।
বিয়ের বয়স
ছেলে বা মেয়ের বিয়ের জন্যে কোনো বয়স-পরিমাণ নির্দিষ্ট আছে কি? কত বয়স হলে পরে ছেলেমেয়েকে বিয়ে দেয়া যেতে পারে, আর কত বয়ষ পূর্ণ না হলে বিয়ে দেয়া উচিত হতে পারে না আধুনিক যুগের সমাজ-মানসে এ এক জরুরী জিজ্ঞাসা। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ছেলে ও মেয়ের বিয়ের জন্যে একটা বয়স পরিমাণ আইনের সাহায্যে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয় এবং বলা হয় যে, এত বয়স না হলে ছেলে বা মেয়ের বিয়ে দেয়া চলবে না, এ সম্পর্কে ইসলামের অভিমত কি?
এই পর্যায়ে হযরত আয়েশা (রা)-র নিম্নোক্ত উক্তি থেকে কিছুটা পথের সন্ধান লাভ করা যায়। তিনি বলেছেনঃ
(আরবী*******************************************************)
রাসূলে করীম (স) আমাকে বিয়ে করেন যখন আমার বয়স মাত্র ছয় বছর, আর আমাকে নিয়ে ঘর বাঁধেন যখন আমি নয় বছরের মেয়ে।
অপর এক হাদীসে এক সাহাবীর উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে। তিনি বলেছেনঃ
(আরবী************************************************)
রাসূলে করীম (স) হযরত আয়েশাকে বিয়ে করেন, যখন তাঁর বয়স নয়।
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ
(আরবী*****************************************************)
নবী করীম (স) হযরত আয়েশাকে বিয়ে করেছিলেন যখন তিনি ছোট্ট ছিলেন, তাঁর বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর।
নবী করীম (স) নিজে যখন হযরত আয়েশাকে ছয় কিংবা নয় বছর বয়সে বিয়ে করলেন তখন এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ইসলামে ছেলেমেয়ের বিয়ের জন্য কোনো নিম্নতম বয়স নির্ধারণ করা হয়নি। যে-কোনো বয়সের ছেলেমেয়েকে যে-কোনো সময় অনায়াসেই বিয়ে দেয়া যেতে পারে।
এই পর্যায়ে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী মনীষী ইবনে বাত্তালের নিম্নোক্ত উক্তি উদ্ধৃত করেছেনঃ
(আরবী**************************************************************)
ইসলামের বিশেষজ্ঞগণ এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, পিতার পক্ষে তার ছোট্ট বয়সের মেয়েদের বিয়ে দেয়া সম্পূর্ণ জায়েয –বৈধ, যদিও সে মেয়ে দোলনায় শোয়া শিশুই হোক না কেন। তবে তাদের স্বামীদের পক্ষে তাদের নিয়ে ঘর বাঁধা কিছুতেই জায়েয হবে না, যতক্ষণ তারা যৌন সঙ্গম কার্যের জন্যে পূর্ণ যোগ্য এবং পুরুষ গ্রহণ ও ধারণ করার সামর্থ্যসম্পন্না না হচ্ছে।
ইমাম নববী লিখেছেনঃ
(আরবী*******************************************)
পিতার পক্ষে তার ছোট্ট মেয়েকে বিয়ে দেয়া জায়েয হওয়া সম্পর্কে সমস্ত মুসলমানই একমত হয়েছে।
তবে এ ব্যাপারে কোনো বয়স নির্দিষ্ট করা চলে না এজন্যে যে, সব মেয়েই স্বাস্থ্যগত অবস্থা ও দৈহিক শক্তি-সামর্থ্যের দিক দিয়ে সমান হয় না, হয় বিভিন্ন রকমের ও প্রকারের। এমন কি বংশ-গোত্র, পারিবারিক জীবন-মান ও আবহাওয়ার পার্থক্যের দরুনও এদিক দিয়ে মেয়েদের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য হয়ে থাকে। এজন্যে কোনো এক নীতি বা কোনো ধরাবাঁধা কথা এ ব্যাপারে বলা যায় না। তাই বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ
(আরবী***************************************************************)
মেয়েদের জন্মগত পরিমিতি ও স্বাস্থ্যগত সামর্থ্য, যোগ্যতা এবং ক্ষমতা বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে।
অতএব ঠিক কত বয়সে যে মেয়েদের বিয়ে দেয়া উচিত আর কত বয়সে নয়, তা নির্দিষ্ট করে বলা এবং এজন্যে কোনো বয়স নির্দিষ্ট করে দিয়ে তার পূর্বে বিয়ে নিষিদ্ধ করে আইন জারি করা আদৌ যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না।
তাছাড়া বিয়ে বলতে কি বোঝায়, তাও ভেবে দেখা দরকার। কেননা ‘বিয়ে’ বলতে যদি স্বামী-স্ত্রী যৌন মিলন ও তদুদ্দেশ্যে ঘর বাঁধা বোঝায়, তাহলে তা যে, ছেলেমেয়ের পূর্ণ বয়স্ক (বালেগ) হওয়ার পূর্বে আদৌ সম্ভব হতে পারে না, তা বলাই বাহুল্য। আর যদি বিয়ে বলতে শুধু আকদ ও ঈজাব-কবুলমাত্র বোঝায় তাহলে তা যে কোন বয়সেই হতে পারে। এমন কি দোলনায় শোয় বা দুগ্ধপোষ্য শিশুরও হতে পারে তার পিতার নেতৃত্বে। ইসলামী শরীয়তে এ বিয়ে নিষিদ্ধ নয় এবং এতে অশোভনও কিছু নেই।
এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামবিদ ড. মুস্তফা আস-সাবায়ী লিখেছেনঃ
(আরবী*********************************************)
চারটি মাযহাবের ইজতিহাদী রায় এই যে, ‘বালেগ’ হয়নি –এমন ছোট ছেলেমেয়ের বিয়ে সম্পূর্ণ শুদ্ধ ও বৈধ।
কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা এবং নবী করীম (স)-এর যুগে ও তাঁর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ঘটনাবলীর ভিত্তিতে উপরিউক্ত কথার যৌক্তিকতা ও প্রামাণিকতা অনস্বীকার্য।
অবশ্য কিছু সংখ্যক ফিকাহবিদ; যেমন –ইবনে শাবরামাতা ও আল-বাতী উপরিউক্ত কথার বিরোধিতা করেছেন। তাঁদের মতে ছোট বয়সের ছেলেমেয়ের কোনো রকম বিয়েই আদৌ জায়েয নয়। আর তাদের অভিভাবকগণ তাদের পক্ষ থেকে উকীল হয়ে যেসব বিয়ে সম্পন্ন করে থাকে, তা সম্পূর্ণ বাতিল, তাকে বিয়ে বলে ধরাই যায় না।
বস্তুত শরীয়তে বিয়ের আদেশ এবং এ সম্পর্কিত যাবতীয় বিধান উপদেশ এই শেষোক্ত মতকেই সমর্থন করে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়েকে বিয়ে দেয়ার বাস্তব কোনো ফায়দাই নেই, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বরং অনেক ক্ষেত্রে ছোট বয়সের বিয়ে ছেলেমেয়েদের নিজেদের জীবনে কিংবা উভয় পক্ষের অলী-গার্জিয়ানদের জীবনে নানা প্রকারের জটিলতারই সৃষ্টি করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। যে বিয়েতে ছেলেমেয়ে বড় হয়ে নিজেদেরকে এমন এক বিয়ের বন্ধনে বন্দী-দশায় দেখতে পায়, যে বিয়েতে তাদের কোনো মতামত নেয়া হয়নি। আবার অনকে বিবাহিত ছেলেমেয়ে বড় ও বয়স্ক হওয়ার পর মন-মেজাজ ও স্বভাব-চরিত্রে পরস্পরে এমন পার্থক্য দেখতে পায়, যাতে করে দাম্পত্য জীবনের প্রতি তারা কোনো আকর্ষণই বোধ করতে পারে না। ফলে উভয় পক্ষের গার্জিয়ানদের মধ্যেও যথেষ্ট তিক্ততা এবং শেষ পর্যন্ত পরস্পরে প্রবল বিরোধ ও প্রকাশ্য শত্রুতা দেখা দেয়াও বিচিত্র কিছু নয়।
প্রাচীনকালে ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থার পতন ও ভাঙ্গনের পর এমন এক সময় ছিল, যখন ছেলেমেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে তাদের কোনো মতামত নেয়া হতো না, আর তা ব্যক্ত করার জন্যেও অনুকূল পরিবেশ বর্তমান ছিল না। ফলে এ কাজ অলী-গার্জিয়ানরাই নিজেদের একচ্ছত্র অধিকার হিসেবে একান্তভাবে নিজেদের মতে এ কাজ সম্পন্ন করত। শেষ পর্যন্ত তারা এ কাজ ছেলেমেয়েদের অত্যন্ত ছোট বয়সকলেই সম্পন্ন করে ফেলতে শুরু করল। কিন্তু ইসলামী শরীয়ত এ ধরনের কাজকে ‘খুব ভালো কাজ’ বলে কখনোই ঘোষণা করেনি, না পারিবারিক ও দাম্পত্য সুখ-শান্তির দৃষ্টিতে এ কাজ কখনো কল্যাণকর হতে পারে। ছোট বয়সের বিয়েতে ছেলেমেয়েদের জীবনে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভ করা গেছে, তদ্দরুন এর প্রতি বর্তমান সমাজ-মানসে অতি যুক্তিসঙ্গতভাবেই তীব্র ঘৃণা ও প্রতিরোধ জেগে উঠেছে। এ কাজকে আজ কেউই ভালো ও শোভনীয় বা সমর্থনীয় মনের করতে পারছে না।
কিন্তু তাই বলে বিয়ের একটা বয়স নির্দিষ্ট করা এবং তার পূর্বে বিয়ে অনুষ্ঠানকে আইনের জোরে নিষিদ্ধ করে দেয়া, এমন কি যদি কেউ তা করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযুক্ত জেল-জরিমানার দণ্ডে দণ্ডিত করা কিছুতেই সমর্থন করা যায় না। ইসলামী শরীয়তে ছোট বয়সে ছেলেমেয়েকে বিয়ে দিতে হুকুম করা হয়নি কিংবা স জন্যে উৎসাহও দেয়া হয়নি। কিন্তু এ কাজ যদি কোনো পিতা –গার্জিয়ান করেই –করা অপরিহার্য বলে মনে করে নানা বৈষয়িক বা সামাজিক কারণে, তাহলে তাকে জেল-জরিমানার দণ্ডে দণ্ডিত করার আইন প্রণয়নের অধিকার ইসলামী শরীয়তে কাউকেই দেয়া হয়নি।
বস্তুত ইসলামী আদর্শের দৃষ্টিকোণ এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট। ইসলাম ব্যাপারটিকে উন্মুক্ত রেখে গিয়েছে এবং সমাজ-সংস্থার শান্তি-শৃঙ্খলার দৃষ্টিতে তাই থাকা উচিত সর্বত্র। বিয়ে-শাদী সম্পর্কে ইসলামের সাধারণ আদেশ উপদেশ দাবি করে যে, পূর্ণ বয়সে ও কার্যত যৌন-সঙ্গমে সক্ষম হওয়ার পরই বিয়ে সম্পন্ন হওয়া উচিত। তবে তার পূর্বে বিয়ে অনুষ্ঠান করাকে নিষেধও করা হয়নি। কেননা ব্যাপারটি পিতা ও সমাজের সাধারণ অবস্থার ওপর অনেকখানি নির্ভর করে যদি কোনো পিতা বা দাদা তার মেয়ে বা নাতনীকে ছোট বয়সে –বালেগা হওয়ার পূর্বেই বিয়ে দিয়ে দেয় আর বালেগা হওয়ার পর যদি সে স্বামী তার পছন্দ না হয় তাহলে সে সেই বিয়েকে অস্বীকার করতে পারবে –শরীয়তে তার অবকাশ রয়েছে। ইমাম নববী উল্লেখ করেছেনঃ
(আরবী***********************************)
ইরাকী ফকীহগণ বলেছেন, ছোট্ট বয়সে বিয়ে দেয়া মেয়ে বালেগা হয়ে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়ার অধিকার রাখে। (নববী শরহে মুসলিম)
তিনি আরও লিখেছেনঃ
(আরবী*************************************)
ইমাম আওযায়ী, আবূ হানীফা ও পূর্ববর্তী ফকীহগণ বলেছেন, ছোট্ট মেয়ে বিয়ে দেয়া সব কর্তৃপক্ষের জন্যেই জায়েয। তবে সে যখন বালেগা হবে, তখন সে বিয়ে রক্ষা করা কি ভেঙ্গে দেয়ার পূর্ণ ইখতিয়ার তার নিজের। ইমাম আবূ ইউসুফ অবশ্য এ থেকে ভিন্ন মত পোষণ করেন।
এমতাবস্থায় ছোট্ট মেয়ে বিয়ে দেয়ার অনুমতি থাকায় মেয়েদের জন্যে কোনো ক্ষতিকারক হবে না। বালেগা হলে পরে তার বিয়ের প্রকৃত মালিক তো সে নিজেই। ইচ্ছা হলে ভেঙ্গে দিতে পারে। বিয়ের জন্যে ছেলেমেয়ের কোনো বয়স নির্দিষ্ট করে দিয়ে ইসলাম পিতা বা গার্জিয়ানকে একটা বিশেষ বাধ্যবাধকতার মধ্যে বেঁধে দেয়নি। এ হচ্ছে বিশ্বমানবতার প্রতি ইসলামের বিশেষ অনুগ্রহ।
তাই একথা বলা যায় যে, বিয়ের কোনো বয়স নির্দিষ্ট করে দেয়া, তার পূর্বে বিয়ে নিষিদ্ধ এবং তার জন্যে দণ্ড দান করা ইসলামের পরিপন্থী। মানবীয় নৈতিকতার দৃষ্টিতেও এ কাজ অত্যন্ত অসমীচীন। ইসলামের কোনো ফিকাহবিদই এ বিষয়টি সমর্থন করেন নি। বরং এ হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে ইউরোপীয় সমাজ-আদর্শ এবং সেখান থেকেই এর অনুকূলে মতবাদ ও আইনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে দুনিয়ার বিভিন্ন মুসলিম দেশ ও রাষ্ট্রে। এ হচ্ছে ইউরোপের সাংস্কৃতিক গোলামীর এক লজ্জ্বাকর দৃষ্টান্ত।
বর-কনের পারস্পরিক বয়স পার্থক্য
বর-কনের পারস্পরিক বয়স পার্থক্য ও সামঞ্জস্য সম্পর্কে ইসলামের সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী রয়েছে। এ সম্পর্কে প্রথম কথা এই যে, সাধারণভাবে এ দুয়ের বয়সে খুব বেশী পার্থক্য হওয়া উচিত নয়। তাতে দাম্পত্য জীবনে অনেক ধরনের দুঃসাধ্য জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। এ হচ্ছে সাধারণ অবস্থার কথা। আর ইসলামে এ সাধারণ অবস্থার প্রতিই দৃষ্টি রেখে বলা হয়েছে যে, বর-কনের বয়স সাধারণত সমান-সমান হলেই ভালো হয়। নাসায়ী শরীফে উদ্ধৃত হাদীসের একটি অধ্যায় রচিত হয়েছে এ ভাষায়ঃ
(আরবী********************************************)
সমান-সমান বয়সে বর-কনের বিয়ের অধ্যায়।
এবং এর পরে হযরত ফাতিমা (রা)-কে হযরত আলী (রা)-র নিকট বিয়ে দেয়ার প্রসঙ্গ আলোচনা করা হয়েছে।
অপরদিকে পিতা বা অলীকে বলা হয়েছে যে, তারা যেন নিজেদের মেয়েকে বয়সেরদিক দিয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এমন লোকের কাছে বিয়ে না দেয়। এজন্যে ফিকাহবিদগণ তাগিদ করে বলেছেনঃ
(আরবী*********************************************************)
পিতা বা অলী যেন তার যুবতী মেয়েকে খুনখুনে বুড়ো বা কুৎসিৎ চেহারার লোকের নিকট বিয়ে না দেয়।
তবে সেই সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, এ ব্যাপারেও ব্যতিক্রম হতে পারে। কেননা দুনিয়ার সব পুরুষই এক রকম হয় না। অনেক বয়স্ক লোকও এমন হতে পারে –হয়ে থাকে, যারা পূর্ণ স্বাস্থ্যবান, সামর্থ্যবান ও দাম্পত্য জীবনের দায়িত্ব পালনে সক্ষম। আর অনেক বুড়োও স্বীয় যুবতী স্ত্রীকে প্রেম-ভালোবাসা, যৌন সুখ-তৃপ্তি ও আনন্দ-উৎসাহের মাদকতায় অনেক যুবকের তুলনায় অধিক মাতিয়ে রাখতে পটু হয়ে থাকে। হযরত আয়েশার বয়স যখন ছয় বছর, তখন নবী করীম (স)-এর সাথে তাঁর বিয়ের আক্দ হয়েছিল এবং নবী করীম (স) তাঁকে নিয়ে ঘর বেঁধেছিলেন যখন তাঁর বয়স হয়েছিল নয় বছর, একথা পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে। আর রাসূলে করীমের বয়স ছির এ সময় পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও এতদুভয়ের দাম্পত্য জীবনের সুখ ও আনন্দের কথা বিশ্বের সকল যুবতীর আদর্শ হয়ে রয়েছে।
কিন্তু তাই বলে দুনিয়ার উপস্থিত কোনো স্বার্থের বশবর্তী হয়ে যদি এরূপ কাজ করা হয়, তাহলে তার পরিণাম অত্যন্ত মারাত্মক হতে বাধ্য। বর্তমান ক্ষয়িষ্ণু ও বিপর্যস্ত মুসলিম সমাজে এর দৃষ্টান্ত কিছু মাত্র বিরল নয়। অনেক খুনখুনে বুড়ো –যে দাম্পত্য জীবনের দায়িত্ব পালনে আদৌ সামর্থবান নয়, তার নিকট যুবতী মেয়েকে বিয়ে দেয়া হয় বিপুল পরিমাণ টাকা-পয়সার বিনিময়ে, ফলে সে মেয়ে বুড়ো স্বামীর নিকট দাম্পত্য সুখলাভে বঞ্চিতা থাকে। তখন সে মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করতে শুরু করে অথবা পাপোর পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়। ইসলামী শরীয়ত এ ধরনের বিয়েকে যদিও স্পষ্ট ভাষায় হারাম করেদেয়নি, কিন্তু শরীয়তের ঘোষিত দাম্পত্য জীবনের আদর্শ ও লক্ষ্যের ভিত্তিতে অনায়াসেই বলা যায় যে, এরূপ কাজ অত্যন্ত আপত্তিকর ও অভিসম্পাতের ব্যাপার। কোনো কোনো ফিকাহবিদ অবশ্য এ ধরনের বিয়েকে হারাম মনে করেন। ‘কালইউবী’ আল-মিনহাজ গ্রন্থের টীকায় লিখেছেনঃ
(আরবী*****************************************)
ছোট মেয়েকে বৃদ্ধ ও অন্ধ প্রভৃতির নিকট বিয়ে দেয়া যদিও শুদ্ধ; কিন্তু এরূপ বিয়ে করা তার পক্ষে হারাম। অধিকাংশ ফিকাহবিদই একথা বলেছেন।
হযরত আয়েশা (রা) পূর্বে অবিবাহিত মেয়ে বিয়ে করার গুরুত্ব প্রকাশের উদ্দেশ্যে একদা নবী করীম (স)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ
(আরবী********************************************)
হে রাসূল, আপনি যদি কোনো চারণভূমিতে জন্তু-জানোয়ার নিয়ে অবতীর্ণ হন, আর সেখানে এমন গাছ দেখতে পান, যার পাতা খাওয়া হয়ে গেছে এবং এমন গাছ পান যা থেকে এখনো কিছু খাওয়া হয়নি, তাহলে তখন আপনি আপনার উটকে কোন গাছ থেকে পাতা খাওয়াতে চাইবেন?
এ জবাবে নবী করীম (স) বললেনঃ
(আরবী**********************************)
খাওয়াব সেই গাছ থেকে, যার থেকে এখনো কিছু খাওয়া হয়নি।
হাদীস বর্ণনাকারী নিজেই বলেন, একথার মানে তিনি নিজেই সেই গাছ, যা থেকে পূর্বে ‘খাওয়া’ হয়নি অর্থাৎ নবী করীম (স) কেবলমাত্র হযরত আয়েশা (রা)-কেই বাকারা (কুমারী) অবস্তায় বিয়ে করেছেন। এ বিয়ের পূর্বে তাঁর কোনো বিয়ে হয়নি, তাঁকে কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি। যেমন হযরত ইবনে আব্বাস (রা) একদা হযরত আয়েশাকে সম্বোধন করে বলেছিলেনঃ
(আরবী*********************************************)
নবী করীম (স) আপনাকে ছাড়া ‘বাকারা’ কুমারী অবস্থায় আর কাউকে বিয়ে করেন নি।
‘বাকারা’ –পূর্বে বিয়ে হয়নি এমন মেয়ে অনাঘ্রাত কুসুমের ন্যায়। তাকে কেউ স্পর্শ করেনি, তার ঘ্রাণ কেউ গ্রহণ করেনি, তার মুখের ও বুকের মধু কেউ ইতিপূর্বে আহরণ করে নেয়নি। সবই যথাযথ পুঞ্জীভূত রয়েছে। কাজেই এ ধরনের মেয়ে বিয়ে করার জন্যে ইসলামে উৎসাহ দান করা হয়েছে।
এজন্যে নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী***************************************************)
পূর্বে বিয়ে হয়নি –এমন (বাকারা) মেয়ে বিয়ে করাই তোমাদের উচিত হবে। কেননা এ ধরনের মেয়েরা মিষ্টিমুখ ও মিষ্টভাষিনী, পবিত্র যৌনাঙ্গসমন্বিতা ও অল্পে তুষ্ট হয়ে থাকে।
হাফেয ইবনে কাইয়্যেম লিখেছেনঃ
(আরবী*********************************************)
নবী করীম (স) তাঁর উম্মতকে পূর্বে-অবিবাহিতা সুন্দরী ও দ্বীনদার স্ত্রী গ্রহণের জন্যে সব সময় উৎসাহ দিতেন।
একথা থেকে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর তা হচ্ছে, বিয়ে শুদ্ধ হওয়া এবং তারই আবার হারাম হওয়া –এ দুয়ের মাঝে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বুড়োদের নিকট যুবতী বা ছোট্ট বয়সের মেয়েকে বিয়ে দিলে বিয়ে শুদ্ধ হবে বটে; তবে এরূপ বিয়ে করা এ ধরনের বুড়োদের পক্ষে হারাম কাজের তুল্য হবে, এই হচ্ছে ফিকাহবিদদের পূর্বোক্ত কথার তাৎপর্য।
কিন্তু যেহেতু এ ধরনের বিয়ে হারাম হওয়া সত্ত্বেও অনেক খুনখুনে বুড়ো টাকার অহংকারে যুবতী মেয়েকে বিয়ে করতে উদ্ধুদ্ধ হয়ে থাকে আর অনেক গরীব পিতাও টাকার লোভে পড়ে নিজের কাঁচা বয়সের মেয়েকে বুড়ো বরের নিকট বলি দিতেও দ্বিধা বোধ করে না, তাই আইনের সাহায্যে এ কাজ বন্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
জুড়ি গ্রহণের ব্যাপারে বর-কনের প্রতি উপদেশ
ইসলামী শরীয়তের ছেলে বা মেয়েকে তার নিজের জুড়ি গ্রহণের ব্যাপারে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখার জন্যে কিছু কিছু উপদেশ দেয়া হয়েছে। তার মধ্য থেকে কয়েকটি জরুরী কথা এখানে উল্লেখ করা যাচ্ছেঃ
প্রথমত বলা হয়েছে, পূর্বে অবিবাহিত ছেলে বা মেয়ে বাছাই করে নিতে। হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (র) বলেন, নবী করীম (স) আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ (আরবী**********) –তুমি কি বিয়ে করেছ? জবাবে আমি বললামঃ হ্যাঁ। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘সাইয়েবা’ না ‘বাকারা’ –মানে পূর্বে-বিবাহিতা মেয়ে বিয়ে করেছ, না পূর্বের অবিবাহিতা কোনো মেয়ে? তখন আমি বললাম, ‘সাইয়েবা’ বিয়ে করেছি।তখন তিনি বললেনঃ
(আরবী***************************************)
বাকারা অর্থাৎ কোনো পূর্বে-অবিবাহিতা মেয়েকে কেন বিয়ে করলে না? তাহলে তুমি তাকে নিয়ে আনন্দের খেলায় মত্ত হতে পারতে, আর সেও তোমাকে নিয়ে।
মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত হাদীসটির ভাষাঃ
(আরবী******************************************)
‘বাকারা’ মেয়ে বিয়ে করলে না কেন? তাহলে পারস্পরিক আনন্দ-স্ফুর্তি ও হাসি খুশীতে জীবন কাটাতে পারতে।
এ কথার জবাবে হযরত জাবির ‘সাইয়েবা’ বিয়ে করার কারণ রাসূলের খেদমতে বর্ণনা করেছেন। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল, রাসূলে করীম (স) সাধারণত এমন মেয়ে বিয়ে করাই পছন্দ করেন, যার পূর্বে কোনো বিয়ে হয়নি। আরবী ভাষায় ‘বাকারা’ বা ‘বাকের’ বলা হয় এমন মেয়েকেঃ
(আরবী*************************************************)
যার পূর্বে বিয়ে হয়নি, কেউ তার স্বামী হয়নি এবং কারোর সাথেই হয়নি কোনো যৌন সম্পর্ক স্থাপন।
আর ‘সাইয়েবা’ হচ্ছে এর বিপরীত অর্থাৎ যার বিয়ে হয়েছিল। যার স্বামী ছিল এবং তার সাথে যৌন সম্পর্কও স্থাপিত হয়েছিল।
তার মানে হচ্ছে দ্বীনদারীর সঙ্গে রূপ ও সৌন্দর্যের লাভের জন্যে চেষ্টা করাও আবশ্যক্
কিন্তু উপরের কথা থেকে একথা যেন কেউ মনে না করেন যে, বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা মেয়েকে বিয়ে করা বুঝি ইসলামের দৃষ্টিতে অনুচিত বা নাজায়েয। কেননা তা আদৌ ঠিক নয়। নবী করীম (স) ও সাহাবায়ে কিরামের অনেকেই বিধবা ও পরিত্যক্তা মহিলাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেছেন এবং তাদের পূর্ন মর্যাদা ও অধিকার দিয়ে শান্তিরূপে দাম্পত্য জীবন যাপন করেছেন।
বিশেষত ও সুযোগ-সুবিধার দৃষ্টিতে অনেক সময় ‘বাকারা’ মেয়ের পরিবর্তে ‘সাইয়েবা’ মেয়েকে বিয়ে করা অধিকতর যুক্তিবহ। রাসূলে করীম (স)-এর কাছ থেকেও এর সমর্থন পাওয়া গিয়েছে। হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহর ব্যাপারটিই এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তাঁকে যখন রাসূলে করীম (স) বিয়ে করেছ কিনা এবং কি ধরনের মেয়ে বিয়ে করেছ জিজ্ঞেস করলেন তখন জবাবে তিনি বললেন, ‘সাইয়েবা’ –‘পূর্ব-বিবাহিতা মেয়ে’। রাসূলে করীম (স) এ ব্যাপারে কিছুটা আপত্তি ও নিরুৎসাহ প্রকাশ করলে তখন তার কারণ প্রদর্শনস্বরূপ হযরত জাবির (রা) বললেনঃ
(আরবী***************************************************)
আমার পিতা ওহুদের যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন এবং রেখে গেছেন সাতটি কন্যা। এমতাবস্থায় তাদের সাথে এনে এমন আর একটি মেয়েকে একত্র করা আমি পছন্দ করিনি, (যে হবে সংসার-অনভিজ্ঞা, যে নিজ হাতে কাজ কর্ম করবে না –করতে পারবে না। বরং দরকার ছিল এমন এক বয়স্কা মেয়েলোকের, যে তাদের (পিতার কন্যাদের) চুল আঁচড়ে দেবে এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণ ও অন্যান্য যাবতীয় কাজ-কর্ম করে দেবে।
এ বিবরণ শুনে নবী করীম (স) বললেঃ (আরবী*******) ‘তুমি ঠিকই করেছ’। অপর এক বর্ণনায় রাসূলের জবাব ছিলঃ (আরবী***************) ‘হ্যাঁ, তুমি যা ভালো মনে করেছ তা ঠিকই হয়েছে’। (মুসনাদে আহমাদ)
নবী করীম (স) বিশেষ গুরুত্ব সহকারে এই পর্যায়ে আর একটি উপদেশ দিয়েছেন। আর তা হচ্ছে অধিক সন্তানবতী ও অধিক প্রেমময়ী মেয়েলোক বিয়ে করা।
এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (স)-এর খেদতে হাজির হয়ে জিজ্ঞেস করলঃ
(আরবী************************************************)
উচ্চ বংশজাত ও সুন্দরী একটি মেয়ে পেয়েছি, কিন্তু দোষ হচ্চে এই যে, সে সন্তান প্রসব করে না (বন্ধ্যা), তাকে কি আমি বিয়ে করব?
জবাবে রাসূলে করীম (স) বললেনঃ ‘না’। লোকটি তার পরও দুই-তিনবার এসে সেই একই প্রম্ন জিজ্ঞেস করে এবং প্রত্যেকবারই তিনি নিষেধ করেন। শেষবারে রাসূল (স) বললেনঃ
(আরবী***************************************)
তোমরা বিয়ে করবে প্রেম-ভালোবাসাময়ী ও অধিক সন্তানবতী মেয়েলোককে। কেননা আমি তোমাদের বিপুল সংখ্যা নিয়ে গৌরব করব।
অপর একটি বর্ণনায় রাসূলের কথাটির ভাষা এইঃ
(আরবী***********************************************)
তোমরা বিয়ে করো অধিক প্রেম-প্রীতিসম্পন্না ও বেশি সংখ্যক সন্তান দাত্রী মেয়ে। কেনান আমি কেয়ামতের দিন অন্যান্য নবীর মুকাবিলায় তোমাদের বিপুল সংখ্যা নিয়ে গৌরব করব।
বিয়ের মতামত জ্ঞাপনের অধিকার
বিয়ের পূর্বে কনেকে দেখে নেয়ার যে ব্যবস্থা ইসলামে করা হয়েছে, তা থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, বিযের ব্যাপারে শরীয়তের নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকে পুরুষের পক্ষে ভাবী স্ত্রী এবং মেয়েদের পক্ষে ভাবী স্বামীকে বাছাই করার –মনোনীত করার স্থায়ী অধিকার রয়েছে। কুরআন মজীদে পুরুষদের সম্বোধন করে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*****************************************************)
অনন্তর তোমরা বিয়ে করো যেসব মেয়েলোক তোমাদের জন্যে ভালো হবে ও ভালো লাগবে।
আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা জামালুদ্দীন আল-কাসেমী লিখেছেনঃ
(আরবী*************************************************************************)
অর্থাৎ রূপ-সৌন্দর্য, জ্ঞান-বুদ্ধি ও পারিবারিক ব্যবস্তাপনা ও কল্যাণ ক্ষমতার দিক দিয়ে যে সব মেয়ে তোমাদের নিজেদের জন্যে ভালো বিবেচিত হবে –মনমতো হবে, তোমরা তাদের বিয়ে করো।
অথবা এর অর্থঃ
(আরবী*****************************************************)
তবে বিয়ে করো সেসব মেয়ে, যারা তোমাদের জন্যে পাক-পবিত্র, যারা তোমাদের জন্যে হালাল, নিষিদ্ধ নয়, যারা তোমাদের জন্যে হবে কল্যাণকর ও পবিত্র।
এ আয়াতে বিয়ের যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তার দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত বিয়ে করবে সেসব মেয়েলোক, যা হালাল, মুহাররম নয়। কেননা কতক মেয়েলোককে যেমন রক্তের সম্পর্কের নিকটাত্মীয়া ও ভিন্ন ধর্মের মেয়েলোক –বিয়ে করা শরীয়ত স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ তাদের ছাড়া প্রায় সব মেয়েলোকই এমন যাদের মধ্য থেকে যে-কাউকে বিয়ে করা যেতে পারে।
আর দ্বিতীয় দিক হচ্ছে এই যে, বিয়ের জন্যে একটি মেয়েলোক হওয়াই যথেষ্ট নয়, বরং তাকে অবশ্য দুটি দিক দিয়ে যোগ্য হতে হবে। প্রথম দিক এই যে, সে নিজে হবে পবিত্র, চরিত্রবতী, কল্যাণময়ী। সর্বদিক দিয়ে ভালো। আর দ্বিতীয় দিক এইযে, যে পুরুষ তাকে বিয়ে করবে, তার জন্যেও সে হবে প্রেমময়ী, কল্যাণময়ী সর্বগুণে গুণান্বিত ও তার মনমত মনোনীত। এ ধরনের মেয়ে বাছাই করেবিয়ে করারই নির্দেশ দেয়া হয়েছে উপরোক্ত আয়াতে। আর এসব কথা নিহিত রয়েছে আয়াতের (আরবী**********) শব্দের মধ্যে। অন্যথায় শুধু (আরবী***************) –‘মেয়েলোক বিয়ে করো’ বলে দেয়াই যথেষ্ট ছিল। এ জন্যে শায়খ মুহাম্মদ নববী এ আয়াতের তাফসীর লিখেছেন নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ
(আরবী********************************************)
অর্থাৎ অপরিচিতা বা সম্পর্কহীনা মেয়েলোকদের মধ্যে যাদের প্রতি তোমাদের মন আকৃষ্ট হয় এবং যাদের পেলে তোমাদের দিল সন্তুষ্ট, আনন্দিত হবে ও যাদের ভালো বলে গ্রহণ করতে পারবে, তোমরা তাদেরকেই বিয়ে করো।
উপরন্তু বিভিন্ন তাফসীরে এ আয়াতটির নাযিল হওয়ার যে উপলক্ষ বর্ণিত হয়েছে, সে দৃষ্টিতেও আয়াতটির উপরোক্ত অর্থ তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা এ আয়াতের শানে নুজুল হচ্ছে –লোকেরা বাপ-দাদার লালিতা-পালিতা ইয়াতীম মেয়েদের বিয়ে করত শুধু তাদের রূপ-যৌবন ও ধন-মালের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে। ফলে বিবাহিত জীবনে তার প্রতি দেখাত মনের বিরাগ, উপেক্ষা ও অযত্ন। কেননা মেয়েটিকে মনের আকর্ষণে ও ভালো লাগার কারণে বিয়ে করা হয়নি, করা হয়েছে অন্যসব জিনিস –রূপ, যৌবন ও ধনমাল সামনে রেখে, সেগুলো অবাধে ভোগ করার সুযোগ লাভের উদ্দেশ্যে। এ কারণে ইয়াতীম মেয়েদের প্রতি যে জুলুম ও অবিচার হতো, তারই নিরসন ও বিদূরণের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’আলা এ নির্দেশ দিয়েছেন। কাজেই যাকে বিয়ে করা হচ্ছে, তার নিজস্ব গুণ-গরিমার কারণেই তাকে বিয়ে করা উচিত। অপর কোনো লক্ষ্য থাকা উচিত নয় বিয়ের পেছনে। বস্তুত নিছক টাকা পয়সা লাভ কিংবা একজন নারীর নিছক রূপ-যৌবন-ভোগের লালসায় পড়ে যেসব বিয়ে সংঘটিত হয়, তা কিছু কাল যেতে না যেতেই কিংবা লক্ষ্যবস্তুর ভোগ-সম্ভোগে তৃপ্তি লাভের পরই সে বিয়ে ভেঙ্গে যেতে বাধ্য। এর বাস্তব দৃষ্টান্তের কোনো অভাব নেই আমাদের সমাজে।
পূর্বেই বলেছি, কনে বাছাই করার যে অধিকার এ আয়াতে পুরুষদের দেয়া হয়েছে, তা কেবল পুরুষদের জন্যেই একচেটিয়া অধিকার নয়। বরং পুরুষদের ন্যায় কনেরও অনুরূপ অধিকার রয়েছে। ‘বর’ বাছাই করে খরিদ করা হয়, তখন বিয়ের মতো একটা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও সারা জীবনের ব্যাপার খুব সহজেই সম্পন্ন হওয়া ও হতে দেয়া উচিত হতে পারে না। বরং যথাসম্ভব জানা-শুনা করে, খবর নিয়ে দেখে-শুনে ও ছাঁটাই-বাঁছাই করেই এ কাজ সম্পন্ন হওয়া নারী-পুরুষ উভয়ের পক্ষেই কল্যাণকর। আর এর অধিকার কেবল পুরুষদেরই একচেটিয়াভাবে হতে পারে না। এ অধিকার তাদের ন্যায় নারীদেরও অবশ্যই থাকতে হবে এবং ইসলাম তা দিয়েছে। পুরুষ যেমন নিজের দিক দিয়ে বিচার-বিবেচনা করবে কনেকে, তেমনি কনেরও উচিত অনুরূপভাবে বুঝে-শুনে একজনকে স্বামীরূপে বরণ করা। এজন্যে বিবাহেচ্ছু নর-নারীর ইচ্ছা, পছন্দ ও মনোনয়ন এবং সন্তোষে অভিমত বা সমর্থন ব্যক্ত করার গুরুত্ব সর্বজন স্বীকৃত। ইসলামী শরীয়তেও উপযুক্ত বয়সের ছেলেমেয়েকে অন্যান্য কাজের ন্যায় বিয়ের ব্যাপারেও নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। পিতামাতা ও অন্যান্য নিকটাত্মীয় লোকেরা নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে পরামর্শ অবশ্যই দেবে; কিন্তু তাদের মতই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত ও একমাত্র শক্তি (Only factor) হতে পারে না। তারা নিজেদের ইচ্ছেমতোই ছেলেমেয়েদেরকে কোথাও বিয়ে করতে বাধ্য করতেও পারে না। বয়স্ক ছেলেমেয়ের বিয়ে তাদের সুস্পষ্ট মত ছাড়া সম্পন্ন হতেই পারে না। নবী করীম (স) এই পর্যায়ে যে ঘোষণা দিয়েছেন তা যেমন খুব স্পষ্ট তেমনি অত্যন্ত জোরালো।
(আরবী*************************************)
পূর্বে বিবাহিত এখন জুড়িহীন ছেলেমের বিয়ে হতে পারে না, যতক্ষণ না তাদের কাছ থেকে স্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া যাবে এবং পূর্বে অবিবাহিত ছেলেমেয়ের বিয়ে হতে পারে না, যতক্ষণ না তার কাছ থেকে স্পষ্ট অনুমতি পাওয়া যাবে”? তখন তিনি বললেন, জিজ্ঞেস করার পর তার চুপ থাকাই তার অনুমতি।
এ হাদীসের ওপর ভিত্তি করেই ইমাম আবূ হানিফা (রহ) বলেছেনঃ
(আরবী***********************************)
অলী পূর্বে বিবাহিত ও অবিবাহিত ছেলেমেয়েকে কোনো নির্দিষ্ট ছেলেমেয়েকে বিয়ে করতে বাধ্য করতে পারে না। অতএব পূর্বে বিবাহিত ছেলেমেয়ের কাছ থেকে বিয়ের জন্যে রীতিমত আদেশ পেতে হবে এবং অবিবাহিত বালেগ ছেলেমেয়ের কাছ থেকে যথারীতি অনুমতি নিতে হবে।
ইমাম আবূ হানীফা উপরোক্ত হাদীসের ভিত্তিতে এতদূর বলেছেন যে, কোনো পূর্ন বয়স্ক ও সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্না মেয়ে অলীর অনুমতি ব্যতিরেকে নিজ ইচ্ছায় কোথাও বিয়ে করে বসলে সে বিয়ে অবশ্যই শুদ্ধ হবে। যদিও ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদের মতে অলীর অনুমতির অপেক্ষায় সে বিয়ে মওকুফ থাকবে। আর ইমাম শাফিয়ী, মালিক ও আহমাদ বলেছেনঃ
(আরবী*************************************************)
কেবলমাত্র মেয়ের অনুমতিতেই বিয়ে সম্পন্ন হতে পারে না।
কেননা রাসূলে করীম (স) অন্যত্র বলেছেনঃ
(আরবী*********************************)
অলীর অনুমতি ছাড়া বিয়েই হতে পারে না।
কিন্তু পূর্বোক্ত হাদীস দ্বারা তাদের এ মত খণ্ডিত হয়ে যায়। বিশেষত এই শেষোক্ত হাদীস সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে। ইমাম বুখারী ও ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন প্রমুখ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস এ হাদীস সম্পর্কে বলেছেনঃ
(আরবী*******************************************************)
অলীর মত ছাড়া বিয়ে হতে পারে না। এ ধরনের শর্তের কোনো হাদীসই সহীহ নয়।
আর তিরমিযী শরীফে এই পর্যায়ে যে হাদীষটি উদ্ধৃত হয়েছে তা হচ্ছেঃ
(আরবী***********************************************)
পূর্বে বিবাহিতা ছেলেমেয়েরা তাদের নিজেদের বিয়ে সম্পর্কে মত জানানোর ব্যাপার তাদের অলীর চেয়েও বেশি অধিকারসম্পন্ন। আর পূর্বে অবিবাহিত ছেলেমেয়েদের নিকট তাদের বিয়ের ব্যাপারে তাদের মতামত অবশ্যই জানতে চাওয়া হবে এবং তাদের চুপ থাকাই তাদের অনুমতি নামান্তর।
আর দ্বিতীয় হাদিসটি হচ্ছেঃ
(আরবী*************************************************)
পূর্বে বিবাহিত ছেলেমেয়েরা তাদের নিজেদের বিয়েতে মত জানানোর ব্যাপারে তাদের অলী অপেক্ষাও বেশী অধিকার রাখে। আর পূর্বে অবিবাহিত ছেলেমেয়েদের নিকট তাদের পিতা বিয়ের মত জানতে চাইলে, তবে তাদের চুপ থাকাই তাদের অনুমতিজ্ঞাপক।
হাদীসসমূহের ভাষা, শব্দ, সুর ও কথা বিশেষ লক্ষণীয়। বিয়ের ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা স্ত্রীলোকদেরকে মতামত জ্ঞাপনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন নি; বরং তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দ ও মতামতকে পূর্ণ মাত্রায় স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তাদের মরজী ছাড়া কোনো পুরুষের সাথে জবরদস্তি তাদের বিয়ে দেয়া ইসলামী শরীয়তে আদৌ জায়েয নয়।
এ ব্যাপারে অলী-গার্জিয়ানদের কর্তব্য হচ্ছে ছেলেমেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে তাদের মতামত জেনে নেয়া এবং তারপরই বিয়ের কথাবার্তা চালানো বা চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
কিন্তু ইসলামে যেখানে মেয়ের মতের গুরুত্ব স্বীকার করা হয়েছে, সেখানে তাদের স্বাভাবিক লজ্জা-শরমকেও কোনো প্রকারে ক্ষুণ্ন হতে দেয়া হয়নি। এজন্যে পূর্বে বিয়ে হয়নি –এমন মেয়ের (বাকরার) অনুমতি দানের ক্ষেত্রে চুপ থাকাকেও ‘মত’ বলে ধরে নেয়া হয়েছে। শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী লিখেছেনঃ
(আরবী*******************************************)
ইমাম আবূ হানীফার মতে পূর্বে-অবিবাহিতা পূর্ণ বয়স্কা মেয়েকে অলীর মতে বিয়ে করতে বাধ্য করা অলীর পক্ষে জায়েয নয়। তাই তার কাছে যখন অনুমতি চাওয়া হবে, তখন যদি সে চুপ থাকে কিংবা হেসে ওঠে তাহলে তার মত আছে ও অনুমতি দিচ্ছে বলে বোঝা যাবে।
কিন্তু পূর্বে বিয়ে হওয়া (সাইয়েবা) মেয়ের পুনর্বিবাহের প্রশ্ন দেখা দিলে তখন সুস্পষ্ট ভাষায় তার কাছ থেকে এজন্যে আদেশ পেতে হবে।
উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী লিখেছেনঃ
(আরবী***************************************************)
পূর্বে বিবাহিতা মেয়ে মত জানাবার ব্যাপারে বেশি অধিকারসম্পন্না –এ কথার অর্থ এই যে, মত জানানোর অধিকারে সেও শরীক রয়েছে। আর তার মানে, তাকে কোনো বিয়েতে রাজি হতে জোর করে বাধ্য করা যাবে না; স্বামী নির্বাচন নির্ধারণে সে-ই সবচেয়ে বেশি অধিকারী।
এ ব্যাপারে মেয়ের মতের গুরুত্ব যে কতখানি, তা এক ঘটনা থেকে স্পষ্ট জানতে পারা যায়। হযরত খানসা বিনতে হাজাম (রা)-কে তাঁর পিতা এক ব্যক্তির নিকট বিয়ে দেন। কিন্তু এ বিয়ে খানসার পছন্দ হয় না। তিনি রাসূলের দরবারে হাযির হয়ে বললেনঃ
(আরবী********************************************)
তাঁর পিতা তাঁকে বিয়ে দিয়েছেন, তিনি পূর্ব বিবাহিত; তিনি এ বিয়ে পছন্দ করেন না।
হাদীস বর্ণনাকারী বলেনঃ (আরবী*************) রাসূলে করীম (স) তাঁর এ কথা শুনে তাঁর বিয়ে প্রত্যাহার ও বাতিল করে দেন।
ইমাম আবদুর রাজ্জাক এ ঘটনাটিকে অন্য ভাষায় বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণনা হচ্ছে, একজন আনসারী খানসাকে বিয়ে করেন। তিনি ওহুদের যুদ্ধে শহীদ হন, অতঃপর তাঁর বাবা তাঁকে অপর এক ব্যক্তির নিকট বিয়ে দেন। তখন তিনি রাসূলের দরবারে হাযির হয়ে বললেনঃ
(আরবী************************************)
আমার পিতা আমাকে বিয়ে দিয়েছেন অথচ আমার সন্তানের চাচাকেই আমি অধিক ভালোবাসি (তার সাথেই আমি বিয়ে বসতে চাই)।
তখন নবী (স) তাঁর বিয়ে ভেঙ্গে দেন।
এ পর্যায়ে আর একটি ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে। হযরত জাবির বলেনঃ
(আরবী******************************)
এক ব্যক্তি তাঁর ‘বাকেরা’ মেয়েকে বিয়ে দেন তার বিনানুমতিতে। পরে সে নবী করীমের নিকট হাজির হয় ও অভিযোগ দায়ের করে। ফলে নবী করীম (স) তাদের বিয়ে বিচ্ছিন্ন করে দেন।
হযরত ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেনঃ
(আরবী**************************************************)
একটি পূর্ব-অবিবাহিতা মেয়েকে তার পিতা এমন একজনের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল, যাকে সে পছন্দ করে না। পরে রাসূলে করীম (স) সে মেয়েকে বিয়ে বহাল রাখা-না-রাখা সম্পর্কে পূর্ণ ইখতিয়ার দান করেন।
অপর একটি ঘটনা থেকে জানা যায়, চাচাতো ভাইয়ের সাথে পিতা কর্তৃক বিয়ে দেয়া কোনো মেয়ে রাসূলের দরবারে হাযির হয়ে বললঃ
(আরবী**************************************************)
আমার পিতা আমাকে তার ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। সে নীচ শ্রেণীর লোক; আমাকে বিয়ে করে তার নীচতা দূর করতে চায়।
এ অবস্থায় রাসূলে করীম (স) তাকে বিয়ে বহাল রাখা-না-রাখার স্বাধীনতা দান করেন। তারপরে মেয়েলোকটি বলেঃ
(আরবী*********************************************************)
আমি তো পিতার করা বিয়েতেই অনুমতি দিয়েছি।
কিন্তু তবু এ অভিযোগ নিয়ে আসার উদ্দেশ্য হলোঃ
(আরবী*****************************************)
আমি চাই যে, মেয়েলোকেরা একথা ভালো করে জেনে নিক যে, বিয়ের ব্যাপারে বাপদের কিছুই করণীয় নেই।
এসব হাদীস থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, বয়স্কা মেয়েদের বিয়েতে তাদের নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও পছন্দ-অপছন্দ হচ্ছে শেষ কথা। পিতা বা কোনো অলীই কেবল তাদের নিজেদেরই ইচ্ছায় বিয়ে করতে কোনো মেয়েকে বাধ্য করতে পারে না। এজন্যে রাসূল করীম (স) সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেনঃ
(আরবী***********************************)
মেয়েদের বিয়েতে তাদের কাছ থেকে তোমরা আদেশ পেতে চেষ্টা করো। ইয়াতীম মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারেও এই নির্দেশই প্রযোজ্য ও কার্যকর। হাদীসে এ সম্পর্কে বিশেষ নির্দেশ রয়েছে। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী***********************************************)
ইয়াতীম মেয়ের কাছে তার নিজের বিয়ের ব্যাপারে স্পষ্ট আদেশ পেতে হবে। জিজ্ঞেস করা হলে সে যদি চুপ থাকে, তবে সে অনুমতি দিয়েছে বলে বুঝতে হবে। আর সে যদি অস্বীকার করে, তবে তাকে জোরপূর্বক বাধ্য করা যাবে না।
অপর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ
(আরবী**************************************************)
ইয়াতীম মেয়েকে তার সুস্পষ্ট অনুমতি ব্যতিরেকে বিয়ে দেয়া যেতে পারে না।
এ হলো সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে ইসলামের মৌলিক বিধান ও দৃষ্টিকোণ। নারী পুরুষের জীবনের বৃহত্তর ও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে বিয়ে। ইসলাম তাতে উভয়কে যে অধিকার ও আজাদি দিয়েছে, তা বিশ্বমানবতার প্রতি এক বিপুল অবদান, সন্দেহ নেই। কিন্তু বড়ই দুর্ভাগ্যের বিষয়, বর্তমান অধঃপতিত ও বিপর্যস্ত মুসলিম সমাজে ছেলেমেয়েদের এ অধিকার ও আজাদি বাস্তা ক্ষেত্রে কার্যকর নয়। এর অপর একটি দিক বর্তমানে খুবই প্রাবল্য লাভ করেছে। আধুনিক ছেলেমেয়েরা তাদের বিয়ের ব্যাপরে বাপ-মা-গার্জিয়ানদের কোনো তোয়াক্কাই রাখে না। তাদের কোনো পরোয়াই করা হয় না। ‘বিয়ে নিজের পছন্দে ঠিক’ এ কথার সত্যতা অস্বীকার করা হচ্ছে না, তেমনি একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আধুনিক যুবক-যুবতীরা যৌবনের উদ্দাম স্রোতের ধাক্কায় অবাধ মেলামেশার গড্ডালিকা প্রবাহে পড়ে দিশেহারা হয়ে যেতে পারে এবং ভালো-মন্দ, শোভন-অশোভন বিচারশুন্য হয়ে যেখানে-সেখানে আত্মদান করে বসতে পারে। তাই উদ্যম-উৎসাহের সঙ্গে সঙ্গে সুস্থা বিচার-বিবেচনারও বিশেষ প্রয়োজন। কেননা বিয়ে কেবলমাত্র যৌন প্রেরণার পরিতৃপ্তির মাধ্যম নয়; ঘর, পরিবার, সন্তান, সমাজ, জাতি ও দেশ সর্বোপরি নৈতিকতার প্রশ্নও তার সাথে গভীরভাবে জড়িত। তাই বিয়ের ব্যাপারে ছেলেমেয়ের পিতা বা অলীর মতামতের গুরুত্বও অনস্বীকার্য। ইমাম নববী উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় যে মত দিয়েছেন, তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
তিনি বলেছেনঃ
(আরবী******************************************************)
হাদীসে উক্ত ‘সবচেয়ে বেশি অধিকার’ কথাটিতে শরীকদারী রয়েছে। তার মানে, মেয়ের নিজের বিয়ের ব্যাপারে যেমন তার অধিকার রয়েছে, তেমনি তার অলীরও অধিকার রয়েছে। তবে পার্থক্য এই যে, মেয়ের অধিকার অলীর অধিকার অপেক্ষা অধিক তাগিতপূর্ণ ও কার্যকর। তাই অলী যদি কোনো কুফু’তেও মেয়ের বিয়ে দিতে চায়, আর সে মেয়ে তা গ্রহণ করতে রাজি না হয়, তাহলে তাকে জোর করে বাধ্য করা যাবে না। কিন্তু মেয়ে নিজে যদি কোনো কুফু’তে বিয়ে করতে ইচ্ছে করে; কিন্তু অলী তাতে বাধ্য না হয়; তাহলে অলী তাকে তা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করতে পারে।
কেননা সাধারণত অলী-পিতা-দাদা নিজেদের ছেলেমেয়ের কখনো অকল্যাণকামী হতে পারে না। তাই বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পিতামাতার মতের গুরুত্ব কিছুতেই অস্বীকার করা চলে না।
মতবিরোধের মীমাংসা
ইমাম নববীর উপরে উদ্ধৃত কথার শেষাংশ অবশ্য পূর্ব-বিবাহিত ছেলেমেয়ের ব্যাপারে স্বীকার করে নেয়া মুশকিল। অলীর মতে ও ছেলেমেয়ের মতে বিয়ের ব্যাপারে যদি মতবিরোধ দেখা দেয়, তাহলে তখন অলীর মতের ওপর ছেলেমেয়ের মতকেই প্রধান্য দেয়া যুক্তিযুক্ত –যদি তা ভালো পাত্র বা পাত্রীর সাথে সম্পন্ন হতে দেখা যায়। কেননা বিয়ে হচ্ছে তার, অলীর নয়। আর বিয়ের বন্ধনজনিত যাবতীয় দায়িত্ব তাকেই পলন করতে হবে, অলীকে নয়। কুরআন মজীদে নিম্নোক্ত আয়াত থেকেও একথা প্রমাণিত হয়। বলা হয়েছেঃ
(আরবী**************************************)
তাদের ইদ্দত পূর্ণ হলে পরে তারা তাদের নিজেদের সম্পর্কে শরীয়ত মুতাবিক ও প্রচলিত রীতি অনুযায়ী যে সিদ্ধান্তই গ্রহণ করুক না কেন, সেজন্যে তোমরা –অলী-গার্জিয়ানদের কিংবা সমাজপতিদের কোনো দায়িত্ব নেই (কিছুই করণীয় নেই)।
এ আয়াতের তাফসীরে ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী*************************************************************)
যখন কোনো মহিলা তালাকপ্রাপ্তা হবে কিংবা তার স্বামী মারা যাওয়ার কারণে বিধবা হবে, তখন ইদ্দত উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর সে যদি সুসাজে সজ্জিতা হয়, দেহে রং লাগায়, আর বিয়ের জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করে ও কথাবার্তা চালায়, তবে তাতে তার কোনো দোষ হবে না।
এ আয়াত পূর্বে-বিবাহিতা স্ত্রীলোকদের তাদের নিজেদের বিয়ের ব্যাপারে শরীয়ত মুতাবেক যে-কোন স্থানে, যে কোন পাত্রের সাথে বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক করার অধিকার দিচ্ছে।
নওয়াব সিদ্দীক হাসান তাঁর তাফসীরে এ আয়াতের নীচে লিখেছেনঃ
(আরবী*******************************************************)
ইমাম আবূ হানীফার সঙ্গী-সাথী ও তাঁর মাযহাবের আলেমগণ এই আয়াতের ভিত্তিতে বলেছেন যে, অলী ছাড়াও বিয়ে হতে পারে। কেননা আয়াতে ‘মেয়েরা যে কাজ করে’ বলা হয়েছে। তার মানে, শরীয়ত মুতাবেক যে-কোনো ‘কাজ’ করার তাদের জন্যে অনুমতি আছে।
আল্লামা ইবনে রুশদ লিখেছেনঃ
(আরবী*************************************************)
ইমাম আবূ হানীফা, যুফর, শা’বী ও জুহরী বলেছেনঃ একজন মেয়েলোক যখন তার বিয়ে অলী ছাড়াই সম্পন্ন করে ফেলে এবং তা কুফু অনুযায়ী হয় তবে তা অবশ্যই জায়েয বিয়ে হবে।
এমতাবস্থায় দুই ধরনের দলীলের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপনের পন্থা এই হতে পারে যে, যেসব হাদীসে ‘অলী ছাড়া বিয়ে হতেই পারে না’ বলা হয়েছে, তার মানে হবেঃ
(আরবী**********************************************)
সুন্নত তরীকা মতো বিয়ে অলীর মত ছাড়া হতে পারে না।
আর যেসব দলীল থেকে প্রমাণিত হয় যে, মেয়ের নিজের ইচ্ছায় বিয়েতে অলী বাধা দিতে পারে, তার মানে হবে সেই বিয়ে, যা মেয়ে করতে চাইবে কুফু’র বাইরে। মওলানা সানাউল্লাহ পানীপতি লিখেছেনঃ
(আরবী**********************************************************************************)
এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিয়ের ব্যাপারে পূর্বে বিবাহিতা মেয়র মতের প্রতিবন্ধক কিছু হতে পারে না। প্রতিবন্ধক হতে পারে কেবল অলীর অধিকার, যা রাসূলে হাদীস ‘পূর্ব-বিবাহিতা মেয়েরা তাদের নিজেদের বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার অলীর তুলনায় অধিক অধিকারী’ থেকে জানা গেছে। আর অলীর অধিকার হচ্ছে কুফু’র বাইরে বিয়ে হতে থাকলে শুধু আপত্তি জ্ঞাপন, যেন সামাজিক লজ্জা অপমান থেকে বাঁচা যায়।
তাহলে সুষ্ঠুরূপে বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার একমাত্র পথ এই যে, অলী নেজই মেয়ের জন্যে উদ্যোগী হবে। মেয়ের নিজস্ব কোনো মত –কোনো দৃষ্টি যদি থাকে, আর তাতে শরীয়তের দৃষ্টিতে কোনো আপত্তির কারণ না থাকে, তাহলে সে অনুযায়ী বিয়ে সম্পন্ন করে দেবে। কোনো ছেলের সাথে বিয়েতে রাজি না হলে তার ওপর কোনো প্রকারেই জোর প্রয়োগ করা চলবে না। প্রসিদ্ধ ফিকাহবিদ ইমাম সরখসী রচিত ‘আল-মবসূত’ গ্রন্থে লিখিত হয়েছেঃ
বিয়ের সময় মেয়ের অনুমতি নিতে হবে। কেননা তার কোনো অভ্যন্তরীন রোগ বা দৈহিক কোনো অসুবিধা থাকতে পারে। অথবা তার মন অন্য কারো দিকে আকৃষ্ট হয়ে থাকতে পারে। এরূপ অবস্থায় তার মত না নিয়ে বিয়ে দিলে সে তার স্বামীর ঘর সুষ্ঠুরূপে করতে পারবে না। তখন সে মেয়ে বিপদে পড়ে যাবে, কেননা তার মন অন্যত্র বাধা রয়েছে। আর প্রেমের রোগ অপেক্ষা বড় রোগ কিছু হতে পারে না। (৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯৭)
শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী এ বিষয়টির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ
(আরবী*************************************************************)
জেনে রাখো, বিয়ের ব্যাপারে কেবলমাত্র মেয়েদেকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী বানানো সঙ্গত হয়। কেননা তাদের বুদ্ধি অসম্পূর্ণ, চিন্তা-বিবেচনা দুর্বল। অনেক সময় তারা ভালো দিকটি জানতেই পারে না। সামাজিক মর্যাদার দিকেও তাদের প্রায়ই লক্ষ্য থাকে না। তাতে করে অনেক সময় তারা অনুপযুক্ত ক্ষেত্রেই মন দিয়ে বসে আর তাতে সমাজের লোকদের অনেক লজ্জা-অপমানের কারণ হতে পারে। এজন্যে এ ব্যাপারে অলীর কিছুটা দখল থাকা বাঞ্ছনীয়, যেন উপরোক্ত আশঙ্কার পথ বন্ধ করা যায়।
তিনি আরো বলেছেনঃ
(আরবী***********************************************)
তাই বলে কেবল অলীর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দ্বারা বিয়ে সম্পন্ন হওয়াও জায়েয নয়। কেননা মেয়েরা তাদের নিজেদের বিষয় যতটা বুঝে ততটা তারা বুঝে না এবং বিশেষ করে যখন বিয়ের ভালো-মন্দ ও সুখ-দুঃখ তাদেরই ভোগ করতে হয়।
বিয়ে অনুষ্ঠানের প্রচার
বিয়ে একটি সামাজিক অনুষ্ঠান। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে –যারা সমাজেরই লোক –বিবাহিত হয়ে পরস্পরে মিলে দাম্পত্য জীবন যাপন করতে ইচ্ছুক, কাজেই তাদের ঐক্য ও মিলন সৃষ্টি ও সুষ্ঠু মিলিত জীবন যাপনের পশ্চাতে সমাজের আনুকূল্য ও সমর্থন-অনুমোদন একান্তই অপরিহার্য। এ কারণে কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতে গোপনে নারী-পুরুষের মিলনকে স্পষ্ট অসমর্থন জানানো হয়েছে। পুরুষদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
(আরবী********************************************)
বিবাহের বন্ধনে বন্দী হয়ে স্ত্রী গ্রহণ করবে জ্বেনাকারী হিসেবে নয়।
মেয়েদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
(আরবী************************************)
বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পুরুষদের সাথে মিলিত হবে, জ্বেনাকারিণী কিংবা গোপনে প্রণয়-বন্ধুতাকারিণী হয়ে নয়।
প্রথম আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী******************************************************)
আল্লাহ তা’আলা এখানে প্রকারান্তরে মুসলিমদের আদেশ করেছেন যে, তারা মেয়েদের মোহরানা দিয়ে বিয়ে করে গ্রহণ করবে, জ্বেনা-ব্যভিচারের উদ্দেশ্যে নয়।
আর দ্বিতীয় আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ
আরববাসীরা জ্বেনা-ব্যভিচারের প্রচার হলে খুবই আপত্তি করত, দোষের মনে করত, কিন্তু গোপন বন্ধুত্ব গ্রহণে কোনো আপত্তি তাদের ছিল না। ইসলাম এসে এসব কিছুর পথ বন্ধ করে দিয়েছে। (ঐ)
আল্লামা ‘জুজাজ’ বলেছেনঃ
(আরবী****************************************)
কোনো বিশুদ্ধ বিয়ে ব্যতিরেকে যৌন চর্চার উদ্দেশ্যে কোনো মেয়ে যদি কোনো পুরুষের সাথে একত্র বসবাস করে, তবে তাকেই বলা হয়, ‘মুসাফিহাত’ আর তা সুস্পষ্ট হারাম।–[এই দ্বিতীয় আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনুল আরাবী লিখেছেনঃ
জাহিলিয়াতের যুগে ব্যভিচারী মেয়েরা ছিল দু’ধরনের। কেউ প্রকাশ্যভাবে ব্যভিচার করত এবং কেউ গোপন-বন্ধুত্ব ও প্রণয়-প্রীতি হিসেবে করত। আর তারা নিজেদের বুদ্ধিতেই প্রথম প্রকারের ব্যভিচারকে হারাম ও দ্বিতীয় প্রকারের ব্যভিচারকে হালাল মনে করত।]
কাজেই একজন পুরুষ ও একজন মেয়ে পরস্পরের সাথে কেবল বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমেই মিলত হতে পারে এবং এ বিয়ের মাধ্যমেই মিলিত হতে পারে এবং এ বিয়ের মাধ্যমে মিলিত হওয়ার বিষয়ে সমাজের লোকদেরকে জানতে হবে, তার প্রতি তাদের সমর্থনও থাকতে হবে। আর এজন্যে দরকার হচ্ছে মিলনকারী নারী-পুরুষের বিয়ে এবং সে বিয়ে গোপনে অনুষ্ঠিত হলে চরবে না, হতে হবে প্রকাশ্যে সকলকে জানিয়ে, সমাজের সমর্থন নিয়ে। এজন্যে ইসলামের বিবাহ অনুষ্ঠানের প্রচার হওয়ার অনুকূলে স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং গোপন বিয়েকে স্পষ্ট নিষেধ করা হয়েছে।
ইমাম মালিক বর্ণনা করেছেন, হযরত উমর ফারূকের সম্মুখে এমন এক বিয়ের ব্যাপারে পেশ করা হয়, যার অনুষ্ঠানে কেবলমাত্র একজন পুরুষ ও একজন মেয়েলোক উপস্থিত ছিল। তিনি বললেনঃ
(আরবী*********************************************************)
এ তো গোপন বিয়ে এবং গোপন বিয়েকে আমি জায়েয মনে করি না। আমি তার অনুমতিও দিচ্ছি না। এ ব্যাপারটি পূর্বে আমার নিকট এলে আমি এ ধরনের বিয়েকারীকে ‘রজম’ করার হুকুম দিতাম।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ
(আরবী****************************************************************)
অধিকাংশ ইসলামবিদের মতে অকাট্য প্রমাণ ছাড়া কোনো বিয়ে প্রমাণিত হতে পারে না, আর তা অনুষ্ঠিত হতে পারে না, যতক্ষণ না তাতে তবিয়ের সময় সাক্ষিগণ উপস্থিত থাকবে।
বিয়ের অনুষ্ঠান যাতেকরে ব্যাপক প্রচার লাভ করে তার নির্দেশ এবং তার উপায় বলতে গিয়ে রাসূলে করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী**********************************************************)
এ বিয়ে অনুষ্ঠানের ব্যাপক প্রচার করো এবং সাধারণত এর অনুষ্ঠান মসজিদে সম্পন্ন করো, আর এ সময় একতারা বাদ্য বাজাও।
বিয়ে অনুষ্ঠানের প্রচার সম্পর্কিত আদেশ স্পষ্ট ও অকাট্য। এর ব্যতিক্রম হলে সে বিয়ে শুদ্ধ হতে পারে না। আর প্রচার অনুষ্ঠানের জন্যে মসজিদে বিয়ে সম্পন্ন করতে আদেশ করেছেন। বিয়ের অনুষ্ঠান মসজিদ করা যদিও ওয়াজিব নয়; কিন্তু সুন্নত –ভালো ও পছন্দনীয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা মসজিদ হচ্ছে মুসলমানদে মিলন কেন্দ্র। মহল্লার ও আশেপাশের মুসলমানগণ দৈনিক পাঁচবার মসজি জমায়েত হয়ে থাকে। এখানে বিয়ে অনুষ্ঠিত হলে তারা সহজেই এতে শরীক হতে পারে, আপনা-আপনিই জেনে যেতে পারে অমুকের ছেলে আর অমুকের মেয়ে আজ বিবাহিত হচ্ছে ও স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একত্রে জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। এতে করে সামাজিক সমর্থন সহজেই লাভ করা যায়।
এছাড়া মসজিদ হচ্ছে অতিশয় পবিত্র স্থান, বিয়েও অত্যন্ত পবিত্র কাজ। মসজিদ হচ্ছে আল্লাহর ইবাদতের জায়গা, বিয়েও আল্লাহর এক অন্যতম প্রধান ইবাদত, সন্দেহ নেই।
দ্বিতীয়ত, বিয়ে অনুষ্ঠানের সময় ‘দফ’-[ (আরবী****) টি ইংরেজী হচ্ছে Tambourine খঞ্ছনি বা তম্বুরা।] বা একতারা বাদ্য বাজাতে বলা হয়েছে। এ বাধ্য নির্দোষ রাসূলে করীম (স) বিয়ে অনুষ্ঠাতের সময় এ বাধ্য বাজানোর শুধু অনুমতিই দেন নি, সুস্পষ্ট নির্দেশও দিয়েছেন। যদিও তা বাজানো ওয়াজিব নয়; কিন্তু সুন্নত –অতি ভালো তাতে সন্দেহ থাকতে পারে না। বিশেষত এজন্যে যে, নবী করীম (স) চুপেচাপে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হওয়াকে আদৌ পছন্দ করতেন না। এমনি এক বিয়ে অনুষ্ঠান সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) লোকদের জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ
(আরবী******************************************)
তোমরা সে বিয়েতে কোনো মেয়ে পাঠাও নি, যে বাধ্য বাজাবে আর গান গাইবে?
এসব হাদীসের আলোচনা করে ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী***********************************************************)
এ হাদীস থেকে ‘দফ’ বাজিয়ে ও নির্দোষ গান গেয়ে বিয়ের প্রচার করা জায়েয হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় এবং সমাজপতিরও উচিত বিয়ে অনুষ্ঠানে শরীক হওয়া, যদিও তাতে আনন্দ-উৎসব ও খেল-তামাসাই হোক না কেন –যদি তা শরীয়তের জায়েয সীমালংঘন করে না যায়।
রুবাই বিনে মুওয়ায (রা) বলেনঃ আমার যখন বিয়ে হচ্ছিল, তখন নবী করীম (স) আমার ঘরে এসে উপস্থিত হলেন এবং আমার বিছানায় আসন গ্রহণ করলেন। তখন ছোট ছোট মেয়েরা ‘দফ’ বাজাচ্ছিল আর গান করছিল। এই সময় মেয়ে গায়িকা গান বন্ধ করে বললঃ ‘সাবধান, এখানে নবী করীম (স) উপস্থিত হয়েছেন, কাল কি হবে, তা তিনি জানেন’। একথা শুনে নবী করীম (স) বললেনঃ
(আরবী**************************************************)
এসব কথা ছাড়ো, বরং তোমরা যা বলছিলে, তাই বলতে থাকো।
(আরবী*************************************************)
তোমরা যুদ্ধ-সংগ্রাম ও বীরত্বের কাহিনী সম্বলিত যেসব গীত-কবিতা পাঠ করছিলে ও গাইতেছিলে, তা-ই করতে লেগে যাও।
এসব হাদীস থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, বিয়ে অনুষ্ঠানের প্রচারের উদ্দেশ্যে একতারা বাধ্য বাজানো আর এ উপলক্ষ্যে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নির্দোষ, ঐতিহাসি কাহিনী ও জাতীয় বীরত্বব্যক গীত-গজল গাওয়া শরীয়তের খেলাফ নয়। কিন্তু তাই বলে এমন সব গীত-গান গাওয়া কিছুতেই জায়েয হতে পারে না যাতে অন্যায়-অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতার প্রচার হয়, যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়, রূপ ও সৌন্দর্যের প্রতি অন্ধ আবেগ উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। কেননা এ ধরনে গান-গজল বিয়ের সময়ও হারাম, যেমন হারাম সাধারণ সময়ে। এ সম্পর্কে মূলনীতি হচ্ছেঃ
যেসব গান-গজল-বাজনা-আনন্দানুষ্ঠান সাধারণ সময়ও হারাম, তার অধিকাংশই হারাম বিয়ের অনুষ্ঠানেও। কেননা এ সম্পর্কে যে নিষেধাবানী উচ্চারিত হয়েছে, তা সাধারণভাবে প্রযোজ্য।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ ‘দফ’ বাজানো সম্পর্কে লিখেছেনঃ
(আরবী***************************************************************)
একতারা বাদ্য বাজানোর জন্যে আদেশ করার মূলে একটি ভালো দিক রয়েছে। তা এই যে, বিয়ে এবং গোপনে বন্ধুত্ব-ব্যভিচার উভয় ক্ষেত্রেই যখন যৌন স্পৃহার পরিতৃপ্তি ও নর-নারী উভয়ের সম্মতি সমানভাবে বর্তমান থাকে, তখন উভয়ের মধ্যে প্রথম দৃষ্টিতেই পার্থক্য করার মতো কোনো জিনিসের ব্যবস্থা করার আদেশ দেয়া একান্তই অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যেন বিয়ে সম্পর্কে কারো কোনো কথা বলবার না থাকে এবং না থাকে কোনো গোপনীয়তা।
নবী করীম (স) নারী-পুরুষের হারাম মিলন ও হালাল মিলনের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টির জন্যে বিয়ের সময় দফ বাজাতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেনঃ
(আরবী**************************************************)
হালাল বিয়ে ও হারাম যৌন মিলনের মথ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে একতারা বাজনার বাদ্য ও বিয়ে অনুষ্ঠানের শব্দ ও ধ্বনি।
আল্লামা আমদুল বান্না এ সম্পর্কে লিখেছেনঃ
(আরবী*************************************************)
সুন্নত তরীকা হচ্ছে বিয়ের সময় দফ বাজানো, নির্দোষ গান গাওয়া ও এ ধরনের অন্যান্য কাজ। হাদীসে বিয়ের শব্দ প্রচারের যে কথা বলা হয়েছে, তার অর্থ তিনি বলেছেনঃ
(আরবী**************************************************)
শব্দ করার অর্থ হচ্ছে নির্দোষ কথা সম্বলিত গান-গীতি গাওয়া।
আল্লামা ইসমাঈল কাহলানী সনয়ানী লিখেছেনঃ
বিয়ের প্রচারের আদেশ হাদীসে উল্লিখিত হয়েছে। প্রচার করা- গোপন বিয়ের বিপরীত। এ সম্পর্কে বহু হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। তার সনদ সম্পর্কে কিছু কথা থাকলেও সব হাদীস থেকেই মোটামুটি একই কথা জানা যায় এবং একটি অপরটিকে শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য করে দেয়। আর ‘দফ’ –একতারা বাদ্য বা ঢোল –বাজানো জায়েয এজন্যে যে, বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রচারের ব্যাপারে এটা অতিশয় কার্যকর।
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ
(আরবী*****************************************************)
বিয়ে অনুষ্ঠানে ‘ঢোল’ খঞ্জনি বাজানো ও অনুরূপ কোনো বাদ্য বাজানো জায়েয হওয়া সম্পকে সব আলেমই একমত। আর বিয়ে অনুষ্ঠানের সাথে তার বিশেষ যোগের কারণ হচ্ছে এই যে, এতে করে বিয়ের কথা প্রচার হবে ও এ খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। আর তার ফলেই বিয়ে সংক্রান্ত যাবতীয় অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে।
ইমাম মালিক বলেছেনঃ
(আরবী******************************************************)
বিয়ের অনুষ্ঠানে ঢোল ও তবলা বাজানোতে কোনো দোষ নেই। কেননা আমরা মনে করি, তার আওয়াজ খুব হালকা, আর বিয়ের অনুষ্ঠান ছাড়া অপর ক্ষেত্রে তা জায়েয নয়।
ইমাম মালিকের বাঁশী বাজিয়ে আনন্দ-স্ফুর্তি করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস হলে জবাবে তিনি বলেনঃ
(আরবী**************************************************)
তার আওয়াজ যদি বিকট ও প্রচণ্ড হয়, চারদিককে প্রকম্পিত ও আলোড়িত করে তোলে, তাহলে তা আমি পছন্দ করি না –মাকরূহ মনে করি। পক্ষান্তরে সে আওয়াজ যদি ক্ষীণ হয় তবে তাতে দোষ নেই।
কুরজা ইবনে কায়াব আনসারী ও আবূ মাসঊদ আনসারী বলেনঃ
(আরবী********************************************************)
বিয়ের অনুষ্ঠানে বাদ্য ও বাঁশী বাজিয়ে আনন্দ-স্ফুর্তি করার অনুমতি দিয়েছেন আমাদের।
পূর্বেই বলা হয়েছে, রাসূলে করীম (স)-এর বাদ্য বাজানো সংক্রান্ত অনুমতি ফরয-ওয়াজিব কিছু নয়। কিন্তু তবুও এর যথেষ্ট তাৎপর্য রয়েছে। আর এ ব্যাপারে ধর্মীয় গোঁড়ামীও যেমন সমর্থনীয় নয়, তেমনি অশ্লীল নাচ-গানের আসর জমানো, ভাড়া করা কিংবা বাড়ির যুবক-যুবতীদের সীমালংঘনকারী আনন্দ-উল্লাস এবং তার মধ্যে যৌন-উত্তেজনা বৃদ্ধিকারী কাজের অনুষ্ঠান কিছুতেই সমর্থনযোগ্য নয়। বর্তমাতে মুসলিম সমাজ আদুনিকাতর সয়লাবে যেভাবে ভেসে চলেছে, তা অনতিবিলম্বে রোধ করা না গেলে জাতীয় ধ্বংস ও অধোগতি অবধারিত হয়ে দেখা দেবে, তাতে সন্দেহ নেই।
বিয়ের সময় বর-কনেকে সাজানো
বিয়ের সময় বর ও কনেকে নতুন চাকচিক্যময় পোশাক-পরিচ্ছদে সুসজ্জিত করা এবং ছেলেমেয়ের গায়ে হলুদ মাখা ইসলামী শরীয়তের সম্পূর্ণ জায়েয। হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) বলেনঃ হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা) একদিন রাসূলে করীমের চিহ্ন লাগানো ছিল।
(আরবী*******************) –এবং তখন তাঁর গায়ে হলুদের চিহ্ন লাগানো ছিল।
রাসূলে করীম (স) তার কারণ জিজ্ঞেস করলে হযরত ইবনে আওফ জানালেনঃ
(আরবী**********************************************)
তিনি আনসার বংশের এক মহিলাকে বিয়ে করেছেন (এবং এ বিয়েতে লাগানো হলুদের রং-ই তাঁর গায়ে লেগে রয়েছে)। (বুখারী)
এ ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিয়ের সময় বর ও কনে –ছেলে ও মেয়ে –উভয়কেই সাজানো এবং তাদের গায়ে হলুদ লাগানো প্রাচীনকালেও –রাসূলের ও সাহাবীদের সমাজেও –প্রচলিত ছিল। হলুদ, জাফরান ইত্যাদি যে কোন জিনিস দিয়েই বর-কনের শরীর রঙীন করা যেতে পারে এবং এর সঙ্গে সুগন্ধি ব্যবহারেরও অনুমতি রয়েছে। কেননা হযতর আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা) এসব লাগিয়ে রাসূলের সম্মুখে হাযির হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর এ কাজকে অপছন্দ করেন নি, সেজন্যে তিরস্কারও করেন নি। এ সম্পর্কে ইসলামের মনীষীদের মত হচ্ছে এইঃ
(আরবী************************************************)
যে লোক বিয়ে করবে, সে যেন বিয়ে ও আনন্দ-উৎসবের নিদর্শনস্বরূপ হলুদ বর্ণের রঙীন কাপড় পরিধান করে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেনঃ
(আরবী***************************************************)
সমস্ত রং ও বর্ণের মধ্যে হলুদ বর্ণই হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম ও সুন্দর।
এর কারণস্বরূপ তিনি কুরআনের নিম্নোক্ত বাক্যাংশ পাঠ করেছিলেনঃ
(আরবী***********************************************)
উজ্জ্বল হলুদ বর্ণ সম্পন্ন, যার রঙ চকচকে, দর্শকদের মনকে আনন্দে উৎফুল্ল করে দেয়।
এখানে পরিচ্ছন্ন ও চকচকে হলুদ বর্ণকেই লক্ষ্য করা হয়েছে, যা দেখলে চোখ ঝলসে যায়, রঙের সৌন্দর্য দেখে দর্শক মুগ্ধ-বিমোহিত হয়।
রাসূলে করীম (স) নিজে কি সব রং পছন্দ করতেন, এ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে হযরত আনাস (রা) বলেছেনঃ
(আরবী**************************************************************)
নবী করীম (স) হরিৎ বর্ণ লাগাতেন, আমিও তা-ই লাগিয়ে থাকি এবং তা-ই আমি পছন্দ করি, ভালোবাসি।
আল্লামা ইবনে আবদুল বার ইমাম জুহরী থেকে বর্ণনা করেছেনঃ
(আরবী**********************************************)
সাহাবায়ে কিরাম হলুদ বর্ণের সুগদ্ধি ব্যবহার করতেন এবং তাতে কোনো দোষ দেখতেন না।
ইবনে সুফিয়ান বলেনঃ
(আরবী***********************************************)
এ রঙ কাপকে ব্যবহার করা আমাদের মনীষীদের মতে জায়েয, দেহ ও শরীরের লাগানো নয়।
অবশ্য ইমাম আবূ হানীফা, শাফিয়ী ও তাঁদের সঙ্গী-সাথীদের মতে কাপড়ে কিংবা দাঁড়িতে জাফরানের রঙ লাগানো মাকরূহ।
দেন-মোহর
বিয়েতে দেন-মোহর বা ‘মহরানা’ অবশ্য দেয় হিসেবে ধার্য করার এবং তা যথারীতি আদায় করার জন্যে ইসলামে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ‘এনায়া’ গ্রন্থে ‘মহরানা’ বলতে কি বোঝায় তার সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ
(আরবী******************************************************)
দেনমোহর বলতে এমন অর্থ-সম্পদ বোঝায়, যা বিয়ের বন্ধনে স্ত্রীর ওপর স্বামীত্বের অধিকার লাভের বিনিময়ে স্বামীকে আদায় করতে হয়, হয় বিয়ের সময়ই তা ধার্য হবে, নয় বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার কারণে তা আদায় করা স্বামীর ওপর ওয়াজিব হবে।
বিয়ের ক্ষেত্রে মহরানা দেয়া ফরয বা ওয়াজিব। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
(আরবী**************************************************)
তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের কাছ থেকে যে যৌন-স্বাদ গ্রহণ করো, তার বিনিময়ে তাদের ‘মহরানা’ ফরয মনে করেই আদায় করো।
তাফসীরের কিতাবে এ আয়াতের তরজমা করা হয়েছে নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ
(আরবী**************************************)
অর্থাৎ তোমরা পুরুষরা বিবাহিতা স্ত্রীদের সাথে কার্য সম্পাদন করে যে স্বাদ গ্রহণ করেছ, তার বিনিময়ে তাদের প্রাপ্য মহরানা পুরাপুরি তাদের নিকট আদায় করে দাও, আদায় করো এ হিসেবে যে, তা পূর্ণমাত্রায় দেয়া আল্লাতর তরফ থেকে তোমাদের ওপর ফরয করা হয়েছে।
অপর আয়াতে বলা হয়েছেঃ
(আরবী***************************************************)
এবং মেয়েদের অলি-গার্জিয়ানের অনুমতি নিয়ে তাদের বিয়ে করো এবং তাদের ‘মহরানা’ প্রচলিত নিয়মে ও সকলের জানামতে তাদেরকেই আদায় করে দাও।
এ আয়াতদ্বয়ে বিয়ের ক্ষেত্রে দেয়ার স্পষ্ট নির্দেশ ঘোষিত হয়েছে। এজন্যে ‘মহরানা’ হচ্ছে বিয়ে শুদ্ধ হওয়ার একটি জরুরী শর্ত। প্রথম আয়াতে আজাদ ও স্বাধীন মহিলাকে বিয়ে করা সম্পর্কে নির্দেশ এবং দ্বিতীয় আয়াতে দাসী বিয়ে করা সম্পর্কে বলা হয়েছে। আর দু’জায়গায় বিয়ের বিনিময়ে মহরানা দেয়ার স্পষ্ট নির্দেশ উল্লিখিত হয়েছে।
আল্লামা ইবনুল আরাবী লিখেছেনঃ
(আরবী***************************************************)
মহান আল্লাহ মহরানাকে বিনিময় স্বরূপ ধার্য করেছেন এবং যাবতীয় পারস্পরিক বিনিময়সূচক ও একটা জিনিসের মুকাবিলার আর একটা জিনিস দানের কারবারের মতোই ধরে দিয়েছেন।
অতএব এটাকে স্বামীর ‘অনুগ্রহের দান’ মনে না করে একটার বদলে একটা প্রাপ্তির মতো ব্যাপার মনে করতে হবে। অর্থাৎ মহরানার বিনিময়ে স্ত্রীর যৌন অঙ্গ ব্যবহারের অধিকার লাভ।
আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ
(আরবী***********************************************************)
এবং মুহাররম মেয়েদের ছাড়া আর সব মহিলাকেই তোমাদের জন্যে হালাল করে দেয়া হয়েছে এজন্যে যে, তোমরা তাদের গ্রহণ করবে তোমাদের ধন-মালের বিনিময়ে।
ইবনুল আরাবী লিখেছেনঃ
(আরবী*************************************)
আল্লাহ মহান হুকুমদাতা স্ত্রীর যৌন অঙ্গ ব্যবহার হালাল করেছেন ধন-মালের বিনিময়ে ও বিয়ের মাধ্যমে পবিত্রতা রক্ষার্থে, জেনার জন্যে নয়। আর একথা প্রমাণ করে যে, বিয়েতে মহরানা দেয়া ওয়াজিব অর্থাৎ ফরয নয়।
কুরআনে আবার বলা হয়েছেঃ
(আরবী*******************************************************)
এবং মুসলমান ও আহলি কিতাব বংশের সতীত্ব-পবিত্রতাসম্পন্না মহিলারাও তোমাদের জন্যে হালাল, যখন তোমরা তাদের মহরানা আদায় করে বিয়ে করবে।
অন্যত্র এ কথারই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ
(আরবী******************************************************)
তোমরা যদি সে মহিলাদের বিনিময় –মহরানা –দিয়ে বিয়ে করো, তবে তোমাদের কোনো গুনাহ হবে না।
এ আয়াত দুটি উদ্ধৃত করে ইবনুল আরাবী লিখেছেনঃ
(আরবী************************************************************)
এসব আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, মহরানা দেয়া সকল বিয়েতে ও সকল অবস্থায়ই ওয়াজিব (ফরয)। এমনকি আকদ-এর সময় যদি ধার্য করা নাও হয় তবুও সে স্ত্রীর সাথে যৌন মিলন হওয়ার সাথে সাথে মহরানা দেয়া ওয়াজিব (ফরয) হয়ে যাবে।
শুধু তা-ই নয়, মহরানা আদায় করতে হবে অন্তরের সন্তোষ ও সদিচ্ছা সহকারে এবং মেয়েদের জন্যে আল্লাহর দেয়া এক নেয়ামত মনে করে। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
(আরবী******************************)
এবং স্ত্রীদের প্রাপ্য মহরানা তাদের আদায় করে দাও আন্তরিক খুশীর সাথে ও তাদের অধিকার মনে করে।
আয়াতে উদ্ধৃত (আরবী********) শব্দের অর্থ ব্যাপক। তার একটি মানে হচ্ছে (আরবী********) কোনো বিনিময় ও বদলা ব্যতিরেকেই কিছু দিয়ে দেয়া। আয়াতের আর একটি অর্থ হচ্ছেঃ
(আরবী******************************)
মহরানা দিয়ে মনকে পবিত্র ও নিষ্কলুষ করে নাও, মহরানা দেয়ার জন্যে মনের কুণ্ঠা কৃপণতা দূর করো।
আর এর তৃতীয় অর্থ হচ্ছেঃ
(আরবী***********) –আল্লাহর তরফ থেকে বিশেষ দান।
কেননা জাহিলিয়াতের যুগে হয় মহরানা ছাড়াই মেয়েদের বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যেত, নয় মহরানা বাবদ যা কিছু আদায় হতো তা সবই মেয়েদের বাপ বা অলি-গার্জিয়ানরাই লুটে পুটে খেয়ে নিত। মেয়েরা বঞ্চিতাই থেকে যেত। এজন্যে ইসলামে যেমন মহরানা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে, তেমনি এ জিনিসকে একমাত্র মেয়েদেরই প্রাপ্য ও তাদের একচেটিয়া অধিকারের বস্তু বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং এতে বাপ বা অলী-গার্জিয়ানের কোনো হক নেই বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। বস্তুত মহরানা যখন মেয়েদের জন্যে আল্লাহর বিশেষ দান, তখন তা আদায় করা স্বামীদের পক্ষে ফরয এবং স্বামীদের ওপর তা হচ্ছে স্ত্রীদের আল্লাহর নির্ধারিত অধিকার।
প্রশ্ন উঠতে পারে, স্বামী-স্ত্রী উভয়ই তো উভয়ের কাছে থেকে যৌন সুখ ও পরিতৃপ্তি লাভ করে থাকে। ‘মহরানা’ যদি এরই ‘বিনিময়’ হয় তাহলে তা কেবল স্বামীই কেন দেবে স্ত্রীকে, তা কি স্বামীদের ওপর অতিরিক্ত ‘জরিমানা’ হয়ে যায় না?
এর জবাবে বলা যায়, প্রকৃত ব্যাপার এই যে, স্বামী বিয়ের মাধ্যমে স্ত্রীর ওপর এক প্রকারের কর্তৃত্ব বা নেতৃত্ব লাভ করে থাকে। স্বামী স্ত্রীর যাবতীয় অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরনের দায়িত্ব গ্রহণ করে আর স্ত্রী নিজেকে –নিজের দেহমন, প্রেম-ভালবাসা, যাবতীয় সম্পদ-ঐশ্বর্য –একান্তভাবে স্বামীর হাতে সোপর্দ করে দেয়। এর বিনিময়স্বরূপই মহরানা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কেননাঃ
(আরবী*************************************************************)
অতঃপর স্ত্রী স্বামীর মত ও অনুমতি না নিয়ে –না নফল রোযা রাখবে, না হজ্জ করবে। আর না তার ঘর ছেড়ে কোথাও চলে যাবে।
শাফিয়ী মাযহাবের আলেমগণ মহরানার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেনঃ
(আরবী******************************************************)
বিয়ে হবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিনিময়মূলক একটি বন্ধন। বিয়ের পর একজন অপরজনকে নিজের বিনিময়ে লাভ করে থাকে। প্রত্যেক অপরজনের থেকে যেটুকু ফায়দা লাভ করে, তাই হচ্ছে অপর জনের ফায়দার বিনিময় –বদল। আর মহরানা হচ্ছে এক অতিরিক্ত ব্যবস্থা। আল্লাত তা’আলা তা স্বামীর ওপর অবশ্য দেয় –ফরয করে দিয়েছেন এজন্যে যে, বিয়ের সাহায্যে সে স্ত্রীর ওপর খানিকটা অধিকারসম্পন্ন মর্যাদা লাভ করতে পেরেছে।
অতএব বিয়ের আকদ অনুষ্ঠিত হওয়ার সময়ই মহরানা নির্ধারণ এবং তার পরিমাণের উল্লেখ একান্ত কর্তব্য। নবী করীম (স) অত্যন্ত জোরের সাথে বলেছেনঃ
(আরবী***************************************************)
বিয়ের সময় অবশ্য পূরণীয় শর্ত হচ্ছে তা, যার বিনিময়ে তোমরা স্ত্রীর যৌন অঙ্গ নিজের জন্যে হালাল মনে করে নাও।
-আর তা হচ্ছে মহরানা বা দেন-মোহর।
বিয়ের পর স্ত্রীকে কিছু না দিয়ে তার কাছে যেতেও নবী করীম (স) স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছেন। হযরত আলী (রা) হযরত ফাতিমা (রা)-কে বিয়ে করার পর তাঁর নিকটে যেতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। তখন নবী করীম (স)-
(আরবী**************************************)
তাকে কোনো জিনিস না দেয়া পর্যন্ত তাঁর নিকট যেতে তাঁকে নিষেধ করলেন।
আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী*********************************************************)
নবী করীম (স) স্ত্রীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও তার মনকে স্বামীর প্রতি আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে স্ত্রীকে কিছু না-কিছু আগে-ভাগে দেবার জন্যে স্বামীকে আদেশ করেছেন।
প্রসঙ্গত মনে রাখতে হবে, বিয়ের সময় দেন-মোহর ছাড়া অপর এমন কোনো শর্ত আরোপ করা চলবে না, যা শরীয়তের বিরোধী।
নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী********************************************)
কোনো মহিলা তার বিয়ের জন্যে তারই অপর এক বোনকে তালাক দেয়ার শর্ত আরোপ করতে পারবে না।
বুখারী শরীফে এ হাদীসটির পূর্ণ ভাষণ নিম্নরূপঃ
(আরবী*****************************************)
কোনো মেয়েলোকের জন্যে তার অপর এক বোনকে তালাক দেয়ার দাবি করা –যেন সে তার ভোগের পাত্র সে নিজের জন্যে পূর্ণভাবে আয়ত্ত করে নিতে পারে –হালাল নয়। কেননা সে তা পাবেই, যা তার জন্যে নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে।–[ইবনে হাবীব বলেছেনঃ
(আরবী*************************************)
মনীষীগণ এ নিষেধকে অবশ্য পালনীয় মনে করেন না; বরং এ কাজ বাঞ্ছনীয়-ও মনে করেন না। তা সত্ত্বেও এরূপ শর্ত যদি কেউ আরোপ করে, তবে তাতে তার বিয়ে ভেঙ্গে যাবে না –যদিও ইবনে বাত্তাল এ কথার ওপর জোর আপত্তি জানিয়েছেন।]
‘তার অপর এক বোন’ বলতে আপন সহোদরাও হতে পারে, অনাত্মীয় কোনো মেয়েলোকও হতে পারে। কেননা সে তার আপন সহোদরা বোন না হলেও মুসলিম হিসেবে সে তার দ্বীনী বোন অর্থাৎ কোনো পুরুষ –যার স্ত্রী রয়েছে –যদি অপর কোনো মেয়ে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়, মেয়ে সে বিয়েতে রাজি হয়ে পুরুষটিকে একথা বলতে পারবে না যে, তোমরা আগের (মানে বর্তমান) স্ত্রীকে আগে তালাক দাও, তারপর আমাকে বিয়ে করো। এরূপ শর্ত আরোপ করার তার কোনো অধিকার নেই। সে ইচ্ছে করলে এ বিয়ের প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করতে পারে। কিন্তু একজনের বর্তমান স্ত্রীকে তালাক দেয়ার শর্ত আরোপ করা এবং সে তালাক হয়ে যাওয়ার পর তার নিকট বিয়ে বসতে রাজি হওয়ার কারো অধিকার থাকতে পারে না। এরূপ শর্ত আরোপ করা ইসলামী শরীয়তের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। রাসূলে করীম (স) এ পর্যায়ে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেনঃ
(আরবী*******************************************)
আল্লাহর কিতাবে নেই –এমন কোনো শর্ত আরোপ করা হলে তা অবশ্যই প্রত্যাখ্যান হবে।
মহরানা না দিয়ে স্ত্রীর নিকট গমন করাই অবাঞ্ছনীয়। হযরত ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন, হযরত আলী যখন হযরত ফাতিমাকে বিয়ে করলেন, তখন নবী করীম (স) তাঁকে বললেনঃ
(আরবী***************************)
তুমি ওকে কিছু একটা দাও।
হযরত ইবনে উমর বললেনঃ
(আরবী**********************************************************)
কোনো মুসলমানেরই মহরানা বাবদ কম বা বেশি কিছু অগ্রিম না দিয়ে তার স্ত্রীর নিকট গমন করা জায়েয নয়।
মালিক ইবনে আনাস বলেছেনঃ
(আরবী***************************************************************)
স্ত্রীকে তার মহরানার কিছু-না-কিছু না দিয়ে স্বামী যেন তার নিকট গমন না করে। মহরানার কম-সে-কম পরিমাণ হলো একটি দীনারের এক চতুর্থাংমে কিংবা তিন দিরহাম। বিয়ের সময় এ পরিমাণ নির্দিষ্ট হোক আর নাই হোক, তাতে কিছু আসে যায় না।
দেন-মোহরের কি হওয়া উচিত, ইসলামী শরীয়তে এ সম্পর্কে কোনো অকাট্য নির্দেশ দেয়া হয়নি, নির্দিষ্টভাবে কোনো পরিমাণও ঠিক করে বলা হয়নি। তবে একথা স্পষ্ট যে, প্রত্যেক স্বামীর-ই কর্তব্য হচ্ছে তার আর্থিক সামর্থ্য ও স্ত্রীর মর্যাদার দিকে লক্ষ্য রেখে উভয় পক্ষের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো পরিমাণ নির্দিষ্ট করে বেঁধে দেয়া। আর মেয়ে পক্ষেরও তাতে সহজেই রাজি হয়ে যাওয়া উচিত। এ ব্যাপারে শরীয়ত উভয় পক্ষকে পূর্ণ আজাদি দিয়েছে বলেই মনে হয়। এ বিষয়ে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী যা লিখেছেন, তা নিম্নোক্ত ভাষায় প্রকাশ করা হচ্ছেঃ
নবী করীম (স) মহরানার কোনো পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেন নি এ কারণে যে, এ ব্যাপারে লোকদের আগ্রহ-উৎসাহ ও ঔদার্য প্রকাশ করার মান কখনো এক হতে পারে না। বরং বিভিন্ন যুগে, দুনিয়ার বিভিন্ন স্তরের লোকদের আর্থিক অবস্থা এবং লোকদের রুচি, দৃষ্টিভঙ্গি, কার্পণ্য ও উদারতার ভাবধারায় আকাশ-ছোঁয়া পার্থক্য হয়ে থাকে। বর্তমানেও এ পার্থক্য বিদ্যমান। এজন্যে সর্বকাল যুগ-সমাজ স্তর, অর্থনৈতিক অবস্থা ও রুচি-উৎসাহ নির্বিশেষে প্রযোজ্য হিসেবে একটি পরিমাণ স্থায়ীভাবে নির্দিষ্ট করে দেয়া বাস্তব দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অসম্ভব। যেমন করে কোনো সুরুচিপূর্ণ দ্রব্যের মূল্য সর্বকালের জন্যে নির্দিষ্ট করে দেয়া যায় না –দেয়া অবৈজ্ঞানিক ও হাস্যকর। কাজেই এর পরিমাণ সমাজ, লোক ও আর্থিক মানের পার্থক্যের কারণে বেশিও হতে পারে, কমও হতে পারে। তবে শুধু শুধু এবং পারিবারিক আভিজাত্যের দোহাই দিয়ে এর পরিমাণ নির্ধারণর বাড়াবাড়ি ও দর কষাকষি করাও আদৌ সমর্থনযোগ্য নয়। তার পরিমাণ এমন সামান্য ও নগণ্য হওয়া উচিত নয়, যা স্বামীর মনের ওপর কোনো শুভ প্রভাবই বিস্তার করতে সমর্থ হবে না। যা দেখে মনে হবে যে, মহরানা আদায় করতে গিয়ে স্বামীকে কিছুমাত্র ক্ষতি স্বীকার করতে হয়নি, সেজন্যে তাকে কোনো ত্যাগও স্বীকার করতে হয়নি।
শাহ দেহলভীর মতে, দেন-মোহরের পরিমাণ এমন হওয়া উচিত, যা আদায় করা স্বামীর পক্ষে কষ্টসাধ্য হবে এবং সেজন্যে সে রীতিমতো চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বে। পক্ষান্তরে তার পরিমাণ এমনও হওয়া উচিত নয়, যা আদায় করা স্বামীর পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এজন্যে নবী করীম (স) একদিকে গরীব সাহাবীকে বললেনঃ
(আরবী********************************************)
কিছু-না-কিছু দিতে চেষ্টা করো। আর কিছু না পার, মহরানা বাবদ অন্তত লোহার একটি আঙ্গুরীয় দিতে পারলেও সেজন্যে অবশ্য চেষ্টা করবে।
আর যে নিঃস্ব সাহাবী তাও দিতে পারেন নি, তাঁকে তিনি বলেছেনঃ
(আরবী************************************************)
কুরআন শরীফের যা কিছু তোমরা জানা আছে, তা তুমি তোমার স্ত্রীকে শিক্ষা দেবে –এই বিনিময়েই আমি মেয়েটিকে তোমার নিকট বিয়ে দিলাম।
এ ধরনের মহরানার সম্পর্কে ফিকাহবিশারদ মকহুল বলেছেনঃ
(আরবী**********************************************)
এ ধরনের মহরানার বিনিময়ে বিয়ে সম্পন্ন করার ইখতিয়ার রাসূলে করীম (স)-এর পরে আর কারো নেই।
ফিকাহবিদ লাইস বলেছেনঃ
(আরবী*************************************************************************************)
রাসূলের তিরোধানের পর এই ধরনের মহরানা নির্দিষ্ট করার অধিকার আর কারো নেই।
ইবনে জাওজী বলেছেনঃ ইসলামের প্রথম যুগে স্বাভাবিক দারিদ্র্যের কারণে প্রয়োজনবশতই এ ধরনের মহরানা নির্দিষ্ট করা জায়েয ছিল। কিন্তু এখন তা জায়েয নয়।
একটি হাদীস থেকে জানা যায়, এক জোড়া জুতার বিনিময়ে অনুষ্ঠিত বিয়েকেও রাসূলে করীম (স) বৈধ বলে ঘোষণা করেছিলেন। তিনি মেয়েলোকটিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি মহরানা বাবদ যা পেয়েছ, তাতে বিয়ে করতে কি তুমি রাজি আছ?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ’। তখন রাসূলে করীম (স) সে বিয়েতে অনুমতি দান করেছিলেন।
অপরদিকে কুরআন মজীদে এই মহরানা সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
(আরবী****************************************************)
এবং তোমরা মেয়েদের এক-একজনকে ‘বিপুল পরিমাণ’ ধন-সম্পদ মহরানা বাবদ দিয়ে দিয়েছ।
এ আয়াতের ভিত্তিতে বিপুল পরিমাণ সম্পদ মহরানা বাবদ দেয়া জায়েয প্রমাণিত হচ্ছে। হযরত উমর (রা) উম্মে কুলসুমকে বিয়ে করেছিলেন এবং মহরানা বাবদ দিয়েছিলেন চল্লিশ হাজার দিরহাম। চল্লিশ হাজার দিরহাম তদানীন্তন সমাজে বিরাট সম্পদ। নবী করীম (স) স্বয়ং হযরত উম্মে হাবীবাকে মহরানা দিয়েছিলেন চারশত দীনার –চার শতটি স্বর্ণমুদ্রা। এক বর্ণনা থেকে জানা যায়, তাঁর মহরানার পরিমাণ ছিল আটশ’ দীনার। (আরবী****************)
এ আলোচনা থেকে একদিকে যেমন জানা যায় মহরানার সর্বনিম্ন পরিমাণ, অপর দিকে জানা যায় সর্বোচ্চ পরিমাণ। ইসলামী শরীয়তে এ দু’ধরনের পরিমাণই জায়েয।
কিন্তু জাহিলিয়াতের যুগে পরিমাণে মহরানা ধার্য করা হতো। পরিমাণ বৃদ্ধির জন্যে কন্যাপক্ষ খুবই চাপ দিত। ফলে দুপক্ষের মধ্যে নানারূপ দর কষাকষি ও ঝগড়াঝাটি হতো। এর পরিণামে সমাজে দেখা দিত নানা প্রকারের জটিলতা। বর্তমানেও মুসলিম সমাজে মহরানা ধার্যের ব্যাপারে অনুরূপ অবস্থাই দেখা দিয়েছে। বলা যেতে পারে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা-সংস্কৃতির চরমোন্নতির এ যুগে পুরাতন জাহিলিয়াত নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এখন নতুন করে স্মরণ করা আবশ্যক বোধ হচ্ছে নবী করীম (স)-এর পুরাতন বাণী। বলেছেনঃ
(আরবী***************************************)
সবচেয়ে উত্তর পরিমাণের মহরানা হচ্ছে তা, যা আদায় করা খুবই সহজসাধ্য।
এজন্যে একান্ত প্রয়োজন হচ্ছে অবস্থাভেদে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ পরিমাণের মধ্যে সহজ দেয় একটা পরিমাণ বেঁধে দেয়া এবং এ ব্যাপারে কোনো পক্ষ থেকে অকারণ বাড়াবাড়ি করা কিছুমাত্র বাঞ্ছনীয় নয়।
মহরানা বাঁধার মান মধ্যম পর্যায়ে আনার প্রচেষ্টা রাসূলে করীম (স)-এর সময় থেকেই শুরু হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে একটা ভুল দৃষ্টি যেন মুসলমানদের মধ্যে থেকেই গিয়েছে। হযরত উমর ফারূক (রা) পর্যন্ত এ সম্পর্কে বিশেষ যত্নবান হয়েছিলেন। তিনি একদা মিম্বরের ওপর দাঁড়িয়ে লোকদের নসীহত করছিলেন এবং মহরানা সম্পর্কে বিশেষভাবে বলেছিলেনঃ
(আরবী****************************************)
সাবধান হে লোকেরা, স্ত্রীদের মহরানা বাঁধতে কিছুমাত্র বাড়াবাড়ি করো না। মনে রেখো, মহরানা যদি দুনিয়ায় মান-সম্মান বাড়াতে কিংবা আল্লাহর নিকট তাকওয়ার প্রমাণ হতো। তাহলে অতিরিক্ত মহরানা বাঁধার কাজ করার জন্যে রাসূলে করীমই ছিলেন তোমাদের অপেক্ষাও বেশি অধিকারী ও যোগ্য। অথচ তিনি তাঁর স্ত্রীদের ও কন্যাদের মধ্যে কারো মহরানাই বারো ‘আউকিয়া’ (চার শ’ আশি দিরহাম কিংবা বড়জোর একশ’ কুড়ি টাকা)-র বেশি ধার্য করেন নি। মনে রাখা আবশ্যক যে, এক-একজন লোক তার স্ত্রীকে দেয় মহরানার দরুন বড় বিপদে পড়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত সে নিজের স্ত্রীকে শত্রু বলে মনে করতে শুরু করে।
এমনি এক ভাষণ শুনে উপস্থিতদের মধ্য থেকে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে বললেনঃ
(আরবী*****************************************************)
আল্লাহ তো আমাদের দিচ্ছেন, আর তুমি হারাম করে দিচ্ছ? তুমি লোকদেরকে মেয়েদের মহরানার পরিমাণ চরশ’ দিরহামের বেশি বাঁধতে নিষেধ করছো? …তুমি কি শোননি, আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ
তোমরা তোমাদের এক এক স্ত্রীকে মহরানা দিচ্ছ বিপুল পরিমাণে?
তখন উমর (রা) বললেনঃ
(আরবী********************************)
একজন মেয়েলোক ঠিক বলতে পারল; কিন্তু ভুল করল একজন রাষ্ট্রনেতা।
বললেনঃ
(আরবী**********************************)
হে আল্লাহ মাফ করে দাও, -সব লোকই কি উমরের তুলনায় অধিক সমঝদার?
অপর বর্ণনায় হযরত উমরের কথাটি এভাবে উদ্ধৃত হয়েছেঃ
(আরবী*******************************************************)
প্রত্যেকটি ব্যক্তিই উমরের অপেক্ষা বেশি ফিকাহবিদ –এমনকি মেয়েলোকরা পর্যন্ত।
বাহ্যত মনে হয়, হযতর উমর (রা) অধিক পরিমাণে মহরানা বাঁধার কাজকে নিষেধ করা থেকে ফিরে গিয়েছেন। বস্তুত হযরত উমরের কথার অর্থ এই ছিল না যে, তিনি অধিক পরিমাণে মহরানা ধার্য করাকে হারাম মনে করতেন, আর তাকে হারাম করে দেওয়াও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। বরং বলা যায়, তিনি অধিক পরিমাণে মহরানা ধার্য করা ভালো মনে করতেন না। বস্তুত মহরানা পরিমাণের কোনো সর্বোচ্চ পরিমাণ নেই, এ কথার ওপরই মনীষীদের ইজমা হয়েছে।
(আরবী**************************)
কাজেই শরীয়তে না সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে, না সর্বোচ্চ পরিমাণ। যার পক্ষে যতটুকু আদায় করা সহজসাধ্য, তার সেই পরিমাণই ধার্য করা উচিত।–[তবে সহজ হওয়ার অর্থও নিশ্চয়ই এই নয় যে, মহরানার পরিমাণটা এতই সামান্য হবে যে, মনে হবে সে ভিখারীকে ভিক্ষা দিচ্ছে। বস্তুত শরীয়তে মহরানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তার পরিমাণটাও তেমনি গণনার যোগ্য হওয়া উচিত।] তার চেয়ে কম করা যেমন স্বামীর উচিত নয়, তেমনি তার চেয়ে বেশি করতে চেষ্টা করাও উচিত নয় মেয়ে পক্ষের।
কোনো কোনো সাহাবী ও তাবেয়ীন নিজেদের ইজতিহাদের ভিত্তিতে মহরানার একটা সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্ধারণ করতে চেষ্টা করেছেন। হযতর আলী (রা) বলেছেনঃ
(আরবী***************************)
দশ দিরহাম পরিমাণের কমে মহরানা হতে পারে না।
শা’বী, ইবরাহীন নখয়ী ও অন্যান্য তাবেয়ীও এ মতই প্রকাশ করেছেন। ইমাম আবূ হানীফা, আবূ ইউসুফ, মুহাম্মাদ, জুফর, হাসান ইবনে জিয়াদেরও এই মত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত আবূ সাইদ খুদরী (রা), হাসান, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব ও আতা প্রমুখ ফকীহ বলেছেনঃ
(আরবী**************************************************)
বিয়ে কম পরিমাণ মহরানায়ও শুদ্ধ হয়, শুদ্ধ হয়ে বেশি পরিমাণ মহরানায়ও।
হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা) এক ‘নাওয়াত’ পরিমাণ স্বর্ণ মহরানা বাবদ দিয়েছিলেন। তার মূল্য বড়জোর তিন দিরহাম মাত্র। আর কেউ বলেছেন পাঁচ, কেউ বলেছেন দশ দিরহাম। ইমাম মালিক বলেছেনঃ
(আরবী******************************************************)
নিম্নতম মহরানার পরিমাণ হচ্ছে এক দীনারের এক-চতুর্থাংশ।
পূর্বেই বলেছি, এসব হচ্ছে ইসলামের বিশেষজ্ঞ মনীষীদের নিজস্ব মতামত ও নিজস্ব ইজতিহাদ। এর মূলে কুরআন ও সুন্নাহর কোনো অকাট্য দলীল নেই।
আসলে বিয়েতে দেন-মোহরের ব্যবস্থা করা হয়েছে কেবল আনুষ্ঠানিকভাবে একটা কিছু বেঁধে দেয়ার উদ্দেশ্যে নয়। বরং যা কিছু ধার্য করা হবে তা একদিকে যেমন স্ত্রীর প্রাপ্য আল্লাহর দেয়া অধিকার, অপরদিকে স্বামীর শ্রেষ্ঠত্ব ও ব্যক্তিত্বের প্রমাণস্বরূপ স্ত্রীর অঙ্গের অধিকার হালাল করার একটি পুরস্কারও বটে। অতএব তা ধার্য করতে হবে তাকে ঠিক ঠিকভাবে ও যথাসময়ে স্ত্রীর নিকট আদায় করে দয়োর উদ্দেশ্যে। স্ত্রীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানও এর একটা বিশেষ লক্ষ্য। কিন্তু শুধু করে দেয়ার উদ্দেশ্যে। স্ত্রীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানও এর একটা বিশেষ লক্ষ্য। কিন্তু শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে যদি একটা বিরাট পরিমাণ বেঁধেও দেয়া হয় কিংবা স্বামীকে তা স্বীকার করে নিতে বাধ্যও করা হয়, অথব তা যদি সঠিকভাবে আদায়ই না করা হয়, তাহলে স্ত্রীর কার্যত কোনো ফায়দাই তাতে হয় না। আর পরিমাণ যদি এত বড় হয় যে, তা আদায় করা স্বামীর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়, তাহলে তার পরিমাণ পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। স্বামী যদি বিয়ের উদ্দেশ্যে মেয়ে পক্ষের অসম্ভব দাবির নিকট মাথা নত করে দিয়ে তাদের মর্জি মতো বড় পরিমাণের মহরানা স্বীকার করে নেয়, আর মনে মনে চিন্তা ও সিদ্ধান্ত করে রাখে যে, কার্যত সে তার কিছুই আদায় করবে না, তা হলেও ব্যাপারটি একটি বড় রকমের প্রতারণার পর্যায়ে পড়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে আদায় করার নিয়ত না থাকা সত্ত্বেও একটা বড় পরিমাণের মহরানা মুখে স্বীকার করে নেয়া যে কত বড় গুনাহ তা রাসূলে করীম (স)-এর উদ্ধৃত বাণী থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি ঘোষণা করেছেনঃ
(আরবী****************************************************)
যে লোক কোনো মেয়েকে কম বেশি পরিমাণের মহরানা দেয়ার ওয়াদায় বিয়ে করে অথচ তার মনে স্ত্রীর সে হক আদায় করার ইচ্ছা থাকে না, সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সম্মুখে ব্যভিচারীরূপে দাঁড়াতে বাধ্য হবে।
হযরত সুহাইব ইবনে সানান (রা) বর্ণনা করেছেন, রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ
(আরবী**********************************************)
যে লোক কোনো মেয়েকে কম বেশি পরিমাণের মহরানা দেয়ার ওয়াদায় বিয়ে করে অথচ তার মনে স্ত্রীর সে হক আদায় করার ইচ্ছা থাকে না, সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সম্মুখে ব্যভিচারীরূপে দাঁড়াতে বাধ্য হবে।
হযরত সুহাইব ইবনে সানান (রা) বর্ণনা করেছেন, রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ
(আরবী***********************************************)
যে-লোক তার স্ত্রীর জন্যে কোনো মহরানা ধার্য করবে অথচ আল্লাহ জানেন যে, তা আদায় করার কোনো ইচ্ছাই তার নেই, ফলে আল্লাহর নামে নিজের স্ত্রীকেই প্রতারিত করল এবং অন্যায়ভাবে ও বাতিল পন্থায় নিজ স্ত্রীর যৌন অঙ্গ নিজের জন্যে হালাল মনে করে ভোগ করল, সে লোক আল্লাহর সাথে ব্যভিচারী হিসাবে সাক্ষাৎ করতে বাধ্য হবে। (আরবী*******************************)
দান –জেহাজ
ছেলেমেয়ের বিবাহ উপলক্ষে মেয়ে পক্ষ থেকে দান –জেহাজ দেয়ার প্রশ্নটিও ইসলামে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ পর্যায়ে দুটি প্রশ্ন বিচার্য। একটি হচ্ছে ইসলামে দান-জেহাজের রীতি প্রচলিত কিনা, আর দ্বিতীয় তার পরিমাণ কি হওয়া উচিত।
দান –জেহাজের রেওয়াজ যে ইসলামে রয়েছে এবং শরীয়তে তা অসমর্থিতও নয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হাদীসে গ্রন্থসমূহে এ সম্পর্কে এক স্বতন্ত্র অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে।
হাদীস থেকে স্পষ্ট জানা যায়, জেহাজ বা যৌতুক দেয়ার রেওয়াজ রাসূরে করীম (স)-এর যুগেও বর্তমান ছিল এবং নবী করীম (স) নিজে তাঁর কন্যাদের বিয়ের সময় যৌতুক দান করেছেন। হযরত আলী (রা) বলেছেনঃ
(আরবী********************************************************)
রাসূলে করীম (স) ফাতিমাকে যৌতুক হিসেবে দিয়েছিলেন একটি পাড়ওয়ালা কাপড়, একটি পানির পাত্র, আর একটি চামড়ার তৈরী বালিশ –যার মধ্যে তীব্র সুগন্ধিযুক্ত ইযখির খড় ভর্তি ছিল।
হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত অপর একটি হাদীস থেকে জানা যায়, নবী করীম (স) এই কয়টি জিনিস ছাড়াও দুটি যাঁতা এবং পাকা মাটির একটি পাত্র ফাতিমা (রা)-কে জেহাজ হিসেবে দিয়েছিলেন।
এসব হাদীসের ভিত্তিতে আল্লামা আহমাদুল বান্না লিখেছেনঃ
(আরবী********************************************)
এ পর্যায়ের যাবতীয় হাদীস প্রমাণ করে যে, জেহাজ দানের ব্যাপারে মধ্যম নীতি অবলম্বন করা এবং তাতে বিপুল প্রাচুর্যের বাহুল্য না করা বরং প্রত্যেক যুগের দৃষ্টিতে নিতান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেয়াকেই যথেষ্ট মনে করা আবশ্যক।
বস্তুত যৌতুক দেয়া কনের পিতা বা গার্জিয়ানের কর্তব্য। কিন্তু তাতে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি, প্রাচুর্য ও আতিশয্য করা ইসলামী আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। বিশেষত এ ব্যাপারে মানুষ প্রাচুর্য ও বাহুল্য দেখায় শুধু নাম ডাক আর খ্যাতি অর্জনের উদ্দেশ্যে –এ উদ্দেশ্যে যে, চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে, সকলে জানতে পারবে যে, অমুকে তার কন্যাকে এত শত বা এত হাজার টাকার জিনিসপত্র যৌতুক হিসেবে দিয়েছে।
তবে একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মেয়েকে বিয়ে দিলে সাময়িকভাবে এবং হঠাৎ করে পিতার ঘর-সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং সম্পূর্ণ নতুন মানুষের নিতান্তই অপরিচিত পরিবেশে এক নতুন ঘর ও সংসার রচনা করতে শুরু করে। এ সময় তার সংসার গঠনে বহু রকমের জিনিসপত্রের প্রয়োজন দেখা দেয়া আবশ্যম্ভাবী। এ এক সংকটময় সময় বলতে হবে। কাজেই কন্যার পিতা যদি জরুরী কিছু জিনিসপত্র দিয়ে নিজ কন্যার সংসার গঠনে বাস্তবভাবে সাহায্য করে, তবে তা মেয়ের প্রতি কল্যাণই শুধু হবে তা না, পিতার এক কতর্বব্যও পালিত হবে।
কিন্তু সেই সঙ্গে একথাও মনে রাখতে হবে যে, দান-জেহাজ যেমন পিতার অবস্থানুপাতে মধ্যম মানের ও মাঝামাঝি পর্যায়ের হওয়া উচিত, কোনো বাড়বাড়ির অবকাশ দেয়া উচিত নয়, তেমনি তা বিয়ের শর্ত হিসেবে দাবি করে নেয়ার ব্যাপারও নয়। বর্তমান সময় সেকালের হিন্দু সমাজের ন্যায় মুসলিম সমাজেও দাবি ও শর্ত করে যৌতুক আদায়ের একটা মারাত্মক প্রচলন ব্যাপক ও প্রকট হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। আজকের বিবাহেচ্ছু বা বিবাহোপযোগী যুবকদের মধ্যে যত বেশি সম্ভব যৌতুক আদায়ের একটা লজ্জাকর প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এর ফলে অনেক ঠিক করা-বিয়েও শুধু যৌতুকের পরিমাণ নিয়ে দর-কষাকষি হওয়ার কারণে ভেঙে যেতে দেখা যাচ্ছে। আর বহু বিবাহোপযোগী মেয়ের বিয়ে হতে পারছে না শুধু এ কারণে যে, মেয়ের পিতা ছেলের বা ছেলে পক্ষের দাবি অনুযায়ী যৌতুক দেয়ার সামর্থ্য রাখে না। অনেক ছেলে জোর করে, মেয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করে, এমন কি অনেক সময় তালাক দেয়ার ভয় দেখিয়েও যৌতুক আদায় করে। বাবার নিকট থেকে দাবি অনুযায়ী যৌতুক আনতে না পারার দরুন কত নব বিবাহিতাকে যে প্রাণও দিতে হয়েছে ও হচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। আবার অনেক ক্ষেত্রে পিতারও চরম উপেক্ষা অনমনীয় মনোভাব দেখা যায়। সামর্থ্য থাকলেও আর মেয়ের নতুন সংসারের জন্যে প্রয়োজন হলেও কিছু দিতে পিতা রাজি হয় না।
হযরত হাফসা (রা) রাসূলের অন্যান্য বেগমের সাথে একত্রিত হয়ে একদিন রাসূলে করীম (স)-এর নিকট নানা জিনিস দাবি করেন। তাতে রাসূলে করীম (স) খুবই অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েন। হযতর উমর ফারূক (রা) একথা শুনতে পেয়ে দ্রুত হাফসার নিকট উপস্থিত হয়ে বললেনঃ
(আরবী************************************************************)
তুমি রাসূলের সঙ্গে বাড়াবাড়ি করবে না এবং তাঁর কাছে কখনই কিছু চাইতে পারবে না। (সহীহ হাদীসের শব্দ –যা তাঁর কাছে নেই তা চাইতে পারবে না।) বরং তোমার যা কিছু প্রয়োজন তা আমার নিকটই চাবে।
এ ঘটনা দান –জেহাজ সম্পর্কে ইসলামী আদর্শবাদী ব্যক্তির জন্যে এক উজ্জ্বল ও গৌরবদীপ্ত দৃষ্টান্ত পেশ করছে।
ওয়ালীমার জিয়াফত
বিয়ে অনুষ্ঠান প্রচারের দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে ওয়ালীমার জিয়াফত করা। এ অনুষ্ঠান মেয়ে পক্ষেরও যেমন করা উচিত, তেমনি করা উচিত ছলে পক্ষেরও। নিজেদের ছেলে বা মেয়ের বিয়েতে আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের একত্রিত করা একান্তই বাঞ্ছনীয়। ইসলামে এ ওয়ালীমা-জিয়াফতের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। রাসূলে করীম (স) ওয়ালীর রীতি ইসলামী সমাজে বিশেষভাবে চালু করেছেন।
‘ওয়ালীমা’ শব্দের আসল অর্থ হল একত্রিত করা। কেননা একজন পুরুষ ও একজন মেয়ের বিবাহিত জীবনের মিলিত হওয়ার উপলক্ষে নিকটাত্মীয়দের একত্রিত করা হয় এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। এজন্য এর নামকরণ করা হয়েছে ‘ওয়ালীমা’।
আর শরীয়তের দৃষ্টিতে ওয়ালীমার জিয়াফত বলতে বোঝায়ঃ
(আরবী**********************************************************)
বিয়ে-অনুষ্ঠানের সময়কালীন আয়োজিত খানা, যার জন্যে লোকদের দাওয়াত দেয়া হয়।
হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা) বিয়ে করলে পরে রাসূলে করীম (স) তাকে বলেনঃ
(আরবী****************************************)
আল্লাহ এ কাজে তোমাকে বরকত দিন। এখন তুমি বকরী দিয়ে হলেও ওয়ালীমার জিয়াফত করো।
রাসূলে করীম (স) নিজে যখন হযরত যায়নাব বিনতে জাহাশ (রা)-কে বিয়ে করলেন, তখন তিনি একটি বকরী জবাইকরে ওয়ালীমার জিয়াফত করেছিলেন। সে সম্পর্কে হযরত আনাস (রা) বলেছেনঃ
(আরবী*****************************************************)
রাসূলে করীম (স) যখন যায়নাব বিনতে জাহাশকে বিয়ে করে ঘর বাঁধলেন, তখন তিনি লোকদের রুটি ও গোশত খাইয়ে পরিতৃপ্ত করে দিয়েছিলেন।
তিনি যখন হযরত সফীয়া (রা)-কে বিয়ে করেছিলেন, তখন খেজুর (রা)-কে বিয়ে করেছিলেন, তখন খেজুর দিয়ে এই ওয়ালীমার জিয়াফত করেছিলেন। অপর এক বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে, নবী করীম (স) খায়বর ও মদীনার মাঝখানে একাদিক্রমে তিন রাত্রি পর্যন্ত অবস্থান করেছিলেন। তার মধ্যে একদিন সঙ্গীর সব সাহাবীদের ওয়ালীমার দাওয়াত দিলেন। এ দাওয়াতে না ছিল গোশত না ছিল রুটি। বরং রাসূলে করীম (স) সকলের সামনে খেজুর ছড়িয়ে দিলেন। হযরত সফীয়ার সাথে বিয়ের ওয়ালীমা এমনি অনাড়ম্বরভাবে সম্পন্ন হয়ে গেল। (আরবী************************************)
ওয়ালীমা সম্পর্কে কুরআন মজীদেও তাগিদ রয়েছে। সূরা আন-নিসা’য় বলা হয়েছেঃ
(আরবী*******************) –‘তোমরা তোমাদের অর্থ-সম্পদের বিনিময়েই স্ত্রী গ্রহণ করতে চাবে’। বিয়ের পরে ওয়ালীমা অনুষ্ঠানের নির্দেশও এরই মধ্যে রয়েছে বলে মনে করতে হবে। কেননা ‘ওয়ালীশা’ বিয়ে উপলক্ষেই হয়ে থাকে এবং তাতে অর্থ ব্যয় হয়।
রাসূলে করীম (স) হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফকে যে ওয়ালীমার জিয়াফত করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তার ভিত্তিতে আল্লামা সানয়ানী কাহলানী লিখেছেনঃ
(আরবী**********************************)
এ নির্দেশ থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিয়েতে ওয়ালীমার জিয়াফত করা ওয়াজিব।
হযরত আলী (রা) যখন বিবি ফাতিমার সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তখন নবী করীম বলেছিলেনঃ
(আরবী********************************)
এ বিয়েতে ওয়ালীমা অবশ্যই করতে হবে।
একথা থেকে ওয়ালীমা সম্পর্কে পূর্বোক্ত মতেরই সমর্থন পাওয়া যায়। ইমাম তাবরানী হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে রাসূলে করীম (স)-এর নিম্নোক্ত ঘোষণা বর্ণনা করেছেনঃ
(আরবী******************************)
ওয়ালীমা করা হচ্ছে একটা অধিকারের ব্যাপার, একান্তই কর্তব্য। ইসলামের স্থায়ী নীতি। অতএব যাকে এ জয়াফতে শরীক হওয়াদর দাওয়াত দেয়া হবে, সে যদি তাতে উপস্থিত না হয়, তাহলে সে নাফরমানী করল।
ইমাম বায়হাকী বলেছেনঃ
(আরবী**********************************************)
রাসূলে করীম (স) বিয়ে করে ওয়ালীমা জিয়াফত করেন নি –এমন ঘটনা জানা নাই।
এ থেকেও ওয়ালীমা করা যে ওয়াজীব, তাই প্রমাণিত হচ্ছে।
ওয়ালীমা জিয়াফতের আকার কি হবে, কত হবে তাতে ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ, তা শরীয়তে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। তবে একথা মনে রাখা আবশ্যক যে, ব্যক্তির সামর্থ্য এবং তার মনের উদারতা অকৃপণতা অনুপাতেই তা করতে হবে। আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী*************************************************)
সচ্ছল অবস্থায় লোকের পক্ষে একটি বকরী জবাই করে খাওয়ানোই হচ্ছে ওয়ালীমার কম-সে-কম পরিমাণ।
তবে নবী করীম (স) যে বকরীর চাইতেও কম মূল্যের জিনিস দিয়ে ওয়ালীমার জিয়াফত করেছিলেন, তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।
আল্লামা কাযী ইয়াজ লিখেছেনঃ
(আরবী**********************************************************)
ওয়ালীমার জিয়াফতে কত বেশি খরচ করা হবে, এ সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ নেই বলেই বিশেষজ্ঞগণ মত প্রকাশ করেছেন। আর কমেরও কোনো শেষ পরিমাণ নির্দিষ্ট করা যায় না। যার পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব ও সহজ, তা করাই যথেষ্ট। তবে স্বামীর আর্থিক সঙ্গতি অনুপাতেই যে এ কাজে অর্থ ব্যয় হওয়া বাঞ্ছনীয়, তাতে সন্দেহ নেই।
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী ইবনে বাত্তালের উক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেনঃ
(আরবী************************************************************************)
ওয়ালীমা জিয়াফত করা স্বামীর আর্থিক সামর্থ্যানুযায়ী হওয়া উচিত এবং তা করা ওয়াজিব বিয়ে অনুষ্ঠানের প্রচারের উদ্দেশ্যে।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী লিখেছেনঃ
(আরবী************************************************)
ওয়ালীমার জিয়াফত করায় অনেক প্রকারের কল্যাণ ও যৌক্তিকতা নিহিত রয়েছে।
এরপর তিনি দুটো কল্যাণের উল্লেখ করেছেন। একটি হচ্ছেঃ
(আরবী*******************************************************)
এতে করে খুব সুন্দরভাবে বিয়ের প্রচার হয়ে যায়। ……কেননা বিয়ের প্রচার হওয়া এ কারণেও জরুরী যে, তাদের কোনো সন্তান হলে তার সদজাত হওয়া ও তার বংশ সাব্যস্ত হওয়ায় কোনো সন্দেহকারীর সন্দেহ করার কোনো অবকাশই যেন না থাকে।
আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, স্ত্রী এবং তার আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও তাদের প্রতি শুভেচ্ছা ও সদাচরণ প্রকাশ করা। তিনি বলেছেনঃ
(আরবী**********************************************************)
নববধুর জন্যে স্বামী যদি অর্থ খরচ করে ও তার জন্যে লোকদের একত্রিত করে, তবে তা প্রমাণ করবে যে, স্বামীর নিকট তার খুবই মর্যাদা রয়েছে এবং সে তার স্বামীর নিকট রীতিমত সমীহ করার যোগ্য।
এবং এ করে স্বামী এমন এক নেয়ামত লাভ করেছে বলে শোকরিয়া আদায় করেচে, যা সে ইতিপূর্বে কখনো লাভ করেনি। এ কারণে তার মনে অনাবিল আনন্দ ও স্বতঃস্ফূর্ত পুলক বোধ করছে। এজন্যেই সে এত অর্থ খরচ করছে আর এসব তারই জন্যে।
এর ফলে নববধূর মনেও জাগবে পরম পুলক, স্বামীর প্রতি অকৃত্রিম প্রেম-ভালোবাসা। আর এর দরুন উভয় পক্ষের আত্মীয়-স্বজনের সাথেও পরম মাধুর্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে।
ইসলামে বিয়ে উপলক্ষে ওয়ালীমার জিয়াফতের গুরুত্ব এতখানি যে, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবকে এ দাওয়াত কবুল না করার ইখতিয়ার দেয়া হয়নি। বরং এ দাওয়াতে হাজির হওয়াকে শরীয়তে ওয়াজিব করে দেয়া হয়েছে। নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী**********************************************)
তোমাদের কেউ যদি বিয়ের ওয়ালীমায় নিমন্ত্রিত হয়, তবে সে যেন সে দাওয়াত কবুল করে ও উপস্থিত হয়।
অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ
(আরবী*****************************************************************)
তোমাদের কেউ ওয়ালীমার দাওয়াতে নিমন্ত্রিত হলে সে যেন অবশ্যই তাতে যায়।
হযরত জাবির বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছেঃ
(আরবী***********************************************************)
তোমাদের কেউ কোনো খাবার দাওয়াতে নিমন্ত্রিত হলে তার সেখানে অবশ্যই যাওয়া উচিত, তারপরে খাওয়া তার ইচ্ছাধীন।
হযরত আবূ হুরায়রা বর্ণিত হাদীসের ভাষা নিম্নরূপঃ
(আরবী**********************************************************)
যে লোক ওয়ালীমার দাওয়াতে শরীক হয় না, সে আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করে।
হযরত ইবনে উমর বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছেঃ
(আরবী**********************************************************)
ওয়ালীমার দাওয়াতে যদি তোমরা নিমন্ত্রিত হও তবে অবশ্যই তাতে শরীক হবে।
এসব হাদীস থেকে স্পষ্টত প্রমাণিত হয় যে, ওয়ালীমার দাওয়াত হলে তা কবুল করা এবং তাতে শরীক হওয়া প্রত্যেকটি মুসলমানের পক্ষে ওয়াজিব। কোনো কোনো ফিকাহবিদ ওয়ালীমার দাওয়াত এবং সাধারণ খাবার দাওয়াদের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তাদের মধ্যে ইবনে আবদুল বার্র, কাযী ইয়াজ ও ইমাম নববী একমত হয়ে রায় দিয়েছেন যে, বিয়ে-ওয়ালীশার দাওয়াতে হাজির হওয়া ওয়াজিব। আর শাফিয়ী ও হাম্বলী মতের অধিকাংশ মনীষীর মতে এ হচ্ছে ফরযে আইন। আবার কেউ কেউ ‘ফরযে কিফায়া’ও বলেছেন। ইমাম শাফিয়ীর মতে তা ওয়াজিব এবং এ ব্যাপারে কোনো ‘রুখছাত’ নেই। কেননা হাদীসে যেখানে কথাটির বারবার তাগিদ এসেছে, সেভাবে অপর কোনো ওয়াজিব কাজ সম্পর্কেই বলা হয়নি। (আরবী*********************)
ওয়ালীমার যিয়াফতে কি ধরনের লোক দাওয়াত করা হবে, এ সম্পর্কে হাদীসে বিশেষভাবে উল্লেখ পাওয়া যায়। হযরত আবূ হুরায়রা বর্ণনা করেছেন, রাসূলে করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী*****************************************************)
সেই ওয়ালীমার খানা হচ্ছে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম, যেখানে কেবল ধনী লোকদেরকেই দাওয়াত দেয়া হবে। আর গরীব লোকদেরকে বাদ দেয়া হবে।
অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ
(আরবী*************************************************)
ওয়ালীমার সেই খানা অত্যন্ত নিকৃষ্ট, যেখানে যারা আসবে তাদের তো নিষেধ করা হবে বা দাওয়াত দেয়া হবে না, আর দাওয়াত দেয়া হবে কেবল তাদের, যারা তা কবুল করে না বা আসবে না।
এ হাদীস দুটি থেকে প্রমাণিত হলো যে, ওয়ালীমার জিয়াফতে বেছে বেছে কেবল ধনী লোকদেরকেই দাওয়াত দেয়া আর গরীব ফকীরদের দাওয়ান তা দেয়া মহা অন্যায়। বরং কর্তব্য হচ্ছে, গরীব-ধনী নির্বিশেষে যতদূর সম্ভব সব শ্রেণীর আত্মীয়-স্বজনকে নিমন্ত্রণ করা। যেখানে কেবলমাত্র ধনী বন্ধু বা আত্মীয়দের দাওয়াত দেয়া হয় আর গরীবদের জন্যে প্রবেশ নিষেধ করে দেয়া হয়, সেখানকার খানায় আল্লাহর কোনো রহমত-বরকত হতে পারে না। বরং সেই খানা হয়ে যায় নিকৃষ্টতম। এজন্যে যে, আল্লাহর নিকট তো গরীব-ধনীর মাঝে কোনো পার্থক্য নেই; কিন্তু ওয়ালীমার দাওয়াতকারী ব্যক্তি বিয়ে করে, কিংবা নিজের ছেলে বা মেয়ের বিয়ে দিয়ে স্ফূর্তিতে মেতে গিয়ে গরীব-ধনীর মাঝে আকাশ-ছোঁয়া পার্থক্য সৃষ্টি করেছে।
বিয়ের উৎসবে আর ওয়ালীমার জিয়াফতে কেবল যে বয়স্ক পুরুষদেরই দাওয়াত করা হবে, এমন কথাও ঠিক নয়। বরং তাতে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের মধ্য থেকে মেয়েলোক ও শিশুদেরও নিমন্ত্রণ করতে হবে, -করা কিছুমাত্র দোষের নয়। বরং সত্যি কথা এই যে, এ উপলক্ষে মেয়েদের শিশুদের বাদ দেয়া খুবই আপত্কির। নিম্নোদ্ধৃত হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিয়ে ও ওয়ালীমার উৎসবে মেয়েলোক ও শিশুদেরও দাওয়াত দেয়া খুবই সঙ্গত হযরত আনাস ইবনে মালিক বলেনঃ
(আরবী*****************************************************)
নবী করীম (স) এক বিয়ের উৎসবে বহু মেয়েলোক ও ছেলেপেলে পরস্পর মুখোমুখি বসে থাকতে দেখলেন। তিনি তাদের দেখে খুবই আনন্দ বোধ করে তাদের প্রতি সন্তোষ প্রকাশার্তে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ালেন এবং তিনি তাদের জন্যে দো’আ করতে গিয়ে বললেনঃ ‘তোরমাই তো আমার নিকট সবার তুলনায় অধিকতর প্রিয়জন।
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ
(আরবী********************************************************)
এ হাদীস থেকে জানা যায় যে, বিয়ের উৎসবাদিতে মেয়েলোক ও শিশুদের উপস্থিত হওয়া বা করা খুবই ভালো ও পছন্দনীয়। কেননা এসব উৎসবই তো হচ্ছে আমাদের পরস্পরের নিকট আসার উপলক্ষ। আর এ কাজে বিয়ের প্রচারকার্যও পরামাত্রায় সুসম্পন্ন হয়ে থাকে।
ওয়ালীমার জিয়াফত কখন করা হবে –বিয়ে অনুষ্ঠানের সময়, না তার পরে, কিংবা নব দম্পতির ফুল-শয্যা বা মধুমিলনের রাতে, এ সম্পর্কে নানা মতের উল্লেখ পাওয়া যায়।
মালিকী মাযহাবে কেউ কেউ বলেছেন, ওয়ালীমা বিয়ে অনুষ্ঠানের সময় অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। কারো মতে মধুমিলনের পরে। ইমাম মাওয়ার্দীর মতে তা হওয়া উচিত মধুমিলনের রাতে। এর দলীল হিসেবে তিনি হযরত আনাসের নিম্নোদ্ধৃত উক্তির উল্লেখ করেছেনঃ
(আরবী*******************************************************)
নবী করীম (স) হযরত জয়নবের সাথে মধুমিলনের রাত যাপনের পর সকালের দিকে লোকদের দাওয়াত দিয়েছিলেন।
দাম্পত্য জীবনের শর্ত
স্বামী ও স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন –মাধুর্যময় ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে পরিপূর্ণ করে তোলবার জন্যে ইসলামে কতগুলো জরুরী বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে তার বিশেষ কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করা যাচ্ছে।
প্রেম ভালোবাসা
বিয়ের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা ও মনের পরম প্রশান্তি লাভই হচ্ছে বিয়ের প্রধানতম উদ্দেশ্য। কেননা এ জিনিস মানুষ মাত্রেই প্রয়োজন –স্বভাবের ঐকান্তিক দাবি। পুরুষ ও নারী উভয়ের এক নির্দিষ্ট বয়স পূর্ণ হলেই বিপরীত লিঙ্গ (Opposite sex) সম্পন্ন ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার এক তীব্র ইচ্ছা ও বাসনা স্বতঃস্ফূর্তভাবে জেগে ওঠে। উভয়ের দেহমনে যৌবনের সর্বপ্লাবী জোয়ারের সৃষ্টি হয়। তখন যৌন মিলনের অপেক্ষাও প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা লাভের জন্যে নর নারীর মন অধিকতর উদ্দাম হয়ে ওঠে। এ কারণে ঠিক এই সময়েই ছেলেমেয়ের বিয়ের ব্যবস্তা করার তাগিদ করা হয়েছে ইসলামী শরীয়তে। আর এ বিয়েকে কুরআন মজীদে ‘প্রেম-ভালোবাসার জীবন’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বস্তুত বিয়ের প্রকৃত বন্ধন হচ্ছে প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধন। এ বন্ধন শিথিল হলে অন্য হাজারো বন্ধন ছিন্ন হতে কিছুমাত্র বিলম্ব লাগবে না। এ কারণে পরস্পরের প্রতি অকৃত্রিম প্রেম ও ভালোবাসা সৃষ্টিও তাকে স্থায়িত্ব ও গভীরতা দানের জন্যে স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই বিশেষভাবে যত্নবান হতে হবে।
একটি নর ও একটি নারীর বিবাহ-সূত্রে একত্রিত হয়ে সুষ্ঠু পারিবারিক জীবন যাপনকেই বলা হয় দাম্পত্য জীবন। দুজন সম্পূর্ণ ভিন্ন বংশ, ভিন্ন পরিবার ও পরিবেশের লোক, পরস্পরের নিকট সম্পূর্ণ অপরিচিত, একজনের নিকট অপরজন সম্পূর্ণ নতুন –আনকোরা। প্রত্যেকের মন-মগজ-চিন্তা-ভাবনা, স্বভাব-অভ্যাস পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও ভিন্ন প্রকারের। সাধারণত এ-ই হয়ে থাকে এবং এ-ই স্বাভাবিক। অনেক সময় এসব দিক দিয়ে পরস্পরের মধ্যে বিরাট পার্থক্যও হতে পারে –হয়ে থাকে। এ দুজনের মধ্যে পূর্ণ মিলন ও সামঞ্জস্য হয়ে যাওয়াও প্রায় অসম্ভব। উভয়ের প্রকৃতি ও মেজাজ এমন পার্থক্য থাকা খুবই স্বাভাবিক, যার দরুন এদের মিলেমিশে জীবন কাটানো অসম্ভব বলে প্রথম মনে হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। এসব দিকে লক্ষ্য রেখে ইসলাম স্বামী-স্ত্রীকে কতগুলো জরুরী বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছে। নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন উভয়ের জন্যে কিছু কিছু অধিকার এবং তা যেমন স্বামীর জন্যে অবশ্য পালনীয়, তেমনি স্ত্রীর পক্ষেও।
আমরা এখানে প্রথমে স্বামীর কর্তব্য ও অধিকার সম্পর্কে আলোচনা করছি। কিন্তু তার আগে ইসলামের দৃষ্টিতে স্বামী-স্ত্রীতে গভীর একাত্মবোধ জাগ্রত হওয়া যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা অনুধাবন করা আবশ্যক। প্রথম লক্ষ্য করার বিষয় হলো এই যে, কুরআন মজীদের আয়াতসমূহে স্বামী বা স্ত্রী উভয়ের জন্যে (আরবী*******) ‘যাওজ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লামা আহমাদ মুস্তফা আল-মারাগী লিখেছেনঃ
(আরবী****************************************************************)
‘যাওজ’ শব্দটি পুরুষ নারী উভয়ের জন্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে –এর আসল অর্থ এমন একটি সংখ্যা যা এমন দুটি জিনিসের সমন্বয়ে রচিত ও গঠিত যেখানে সে দুটি জিনিসই একাকার হয়ে রয়েছে এবং বাহ্যত তারা দুটি হলেও মূলত ও প্রকৃতপক্ষে তারা পরস্পরের সাথে মিলেমিশে একটিমাত্র জিনিসে পরিণত হয়েছে। অতঃপর এ শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে স্বামী ও স্ত্রী –উভয়ের জন্যে। ব্যবহার করা হচ্ছে একথা বোঝাবার জন্যে যে, স্বামী তার স্ত্রীর সাথে এবং স্ত্রী তার স্বামীর সাথে অন্তরের গভীর একাত্মপূর্ণ ভাবধারা ও ভেদহীন কল্যাণ কামনার সাহায্যে একাকার হয়ে থাকবে, তা-ই হচ্ছে স্বাভাবিকতার ঐকান্তিক দাবি। তারা একাকার হবে এমনভাবে যে, একজন ঠিক অপরজনে পরিণত হবে।
ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, ক্ষমা
স্বামী-স্ত্রীর মধে মন কষাকষি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। আর এ সুযোগে শয়তা পরস্পরের মনে নানারূপ বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে কম চেষ্টা করে না। আর এরই ফলে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কে ফাটল ধরতে কিছু বিলম্ব হয় না। বিশেষ করে এজন্যেও অনেক সময় জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যে, মেয়েরা সাধারণই নাজুক স্বভাবের হয়ে থাকে। অল্পতেই রেগে যাওয়া, অভিমানে ক্ষুব্ধ হওয়া এবং স্বভাবগত অস্থিরতায় চঞ্চলা হয়ে ওঠা নারী চরিত্রের বিশেষ দিক। মেয়েদের এ স্বাভাবিক দুর্বলতা কিংবা বৈশিষ্ট্যই বলুন –আল্লাহর খুব ভালোভাবেই জানা ছিল। তাই তিনি স্বামীদের নির্দেশ দিয়েছেনঃ
(আরবী************************************)
তোমরা স্ত্রীদের সাথে খুব ভালোভাবে ব্যবহার ও বসবাস করো। তোমরা যদি তাদের অপছন্দ করো তাহলে এ হতে পারে যে, তোমরা একটা জিনিসকে অপছন্দ করছ, অথচ আল্লাহ তার মধ্যে বিপুল কল্যাণ নিহিত রেখে দেবেন।
মওলানা সানাউল্লাহ পানিপত্তী এ আয়াতের তাফসীরে লিখেছেনঃ
স্ত্রীদের সাথে ভালো ব্যবহার ও তাকে নিয়ে ভালোভাবে বসবাস করার মানে হচ্ছে কার্যত তাদের প্রতি ইনসাফ করা, তাদের হক-হকুক রীতিমত আদায় করা এবং কথাবার্তায় ও আলাপ-ব্যবহারে তাদের প্রতি সহানুভূতি ও শুভেচ্ছা প্রদর্শন। আর তারা তাদের কুশ্রীতা কিংবা খারাপ স্বভাব-চরিত্রের কারণে যদি তোমাদের অপছন্দনীয় হয়ে পড়ে, তাহলে তাদের জন্যে ধৈর্য ধারণ করো, তাদের না বিচ্ছিন্ন করে দেবে, না তাদের কষ্ট দেবে, না তাদের কোনো ক্ষতি করবে। (আরবী*************************)….
স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এ আয়াতে স্বামীদেরকে এক ব্যাপক হেদায়েত দেয়া হয়েছে। স্বামীদের প্রতি আল্লাহর প্রথম নির্দেশ হচ্ছেঃ তোমরা যাকে বিয়ে করে ঘরে তুলে নিলে, যাকে নিয়ে ঘর বাঁধলে তার প্রতি সব সময়ই খুব ভালো ব্যবহার করবে, তাদের অধিকার পূর্ণ মাত্রায় আদায় করবে। আর প্রথমেই যদি এমন কিছু যদি এমন কিছু দেখতে পাও যার দরুন তোমার স্ত্রী তোমার কাছে ঘৃণার্হ হয়ে পড়ে এবং যার কারণে তার প্রতি তোমার মনে প্রেম-ভালোবাসা জাগার বদলে ঘৃণা জেগে ওঠে, তাহলেই তুমি তার প্রতি খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করো না। বুদ্ধির স্থিরতা ও সজাগ বিচক্ষণতা সহকারে শান্ত থাকতে ও পরিস্থিতিকে আয়ত্তে আনতে চেষ্টিত হবে। তোমাকে বুঝতে হবে যে, কোনো বিশেষ কারণে তোমার স্ত্রীর প্রতি যদি তোমার মনে ঘৃণা জেগে থাকে, তবে এখানেই চূড়ান্ত নৈরাশ্যের ও চিরবিচ্ছেদের কারণ হয়ে গেলো না। কেননা হতে পারে, প্রথমবারের হঠাৎ এক অপরিচিতা মেয়েকে তোমার সমগ্র মন দিয়ে তুমি গ্রহণ করতে পারো নি। তার ফলেই এই ঘৃণার সৃষ্টি হয়েছে কিংবা তুমি হয়তো একটি দিক দিয়েই তাকে বিচার করেছ এবং সেদিক দিয়ে তাকে মনমতো না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছ। অথচ তোমার বোঝা উচিত যে, সেই বিশেষ দিক ছাড়া আরো সহস্র দিক এমন থাকতে পারে, যার জন্যে তোমার মনের আকাশ থেকে ঘৃণতর এ পুঞ্জিত ঘনঘটা দূরীভূত হয়ে যাবে এবং তুমি তোমার সমগ্র অন্তর দিয়ে তাকে আপনার করে নিতে পারবে। সেই সঙ্গে একথাও বোঝা উচিত যে, কোনো নারীই সমগ্রভাবে ঘৃণার্হ হয় না। যার একটি দিক ঘৃণার্হ, তার এমন আরো সহস্র গুণ থাকতে পারে, যা এখনো তোমার সামনে উদঘাটিত হতে পারে নি। তার বিকাশ লাভের জন্যে একান্তই কর্তব্য। এ কারণেই নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী********************************************************)
কোনো মুসলিম পুরুষ যেন কোনো মুসলিম মহিলাকে তার কোনো একটি অভ্যাসের কারণে ঘৃণা না করে। কেননা একটি অপছন্দ হলে অন্য আরো অভ্যাস দেখে সে খুশীও হয়ে যেতে পারে।
কেননা, কোনো নারীই সম্পূর্ণরূপে খারাবীর প্রতিমূর্তি না হয়। কিছু দোষ থাকলে অনেকগুলো গুণও তার থাকতে পারে। সেই কারণে কোনো কিছু খারাপ লাগবে অমনি অস্থির, চঞ্চল ও দিশেহারা হয়ে যাওয়া উচিত নয়। তার অপরাপর ভালে দিকের উন্মেষ ও বিকাশ লাভের সুযোগ দেয়া এবং সেজন্যে অপেক্ষা করা স্বামীর কর্তব্য। আল্লামা আহমাদুল বান্না এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ
(আরবী*******************************************************)
এ হাদীসের মানে হচ্ছে এই যে, কোনো মু’মিনের উতি নয় অপর কোনো মু’মিন স্ত্রীলোক সম্পর্কে পূর্ণ মাত্রায় ঘৃণা পোষণ করা, যার ফলে চূড়ান্ত বিচ্ছেদের কারণ দেখা দিতে পারে। বরং তার কর্তব্য হচ্ছে মেয়েলোকটির ভালো গুণের খাতিরে তার দোষ ও খারাবী ক্ষমা করে দেয়া আর তার মধ্যে ঘৃণার্হ যা আছে, সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করা; বরং তার প্রতি ভালোবাসা জাগাতে চেষ্টা করা। হতে পারে তার স্বভাব-অভ্যাস খারাপ; কিন্তু সে বড় দ্বীনদার কিংবা সুন্দরী রূপসী বা নৈতিক পবিত্রতা ও সতীত্ব সম্পন্না অথবা স্বামীর জন্যে জীবন সঙ্গিনী।
আল্লাম শাওকানী এ হাদীস সম্পর্কে লিখেছেনঃ
(আরবী*********************************************)
এ হাদীসে স্ত্রীদের সাথে খুব ভালো ব্যবহার ও ভালোভাবে বসবাস করার নির্দেশ যেমন আছে, তেমনি তার কোনো এক অভ্যাস স্বভাবের কারণেই তার প্রতি ঘৃণা পোষণ করতে নিষেধও করা হয়েছে। কেননা তার মধ্যে অবশ্যই এমন কোনো গুণ থাকবে, যার দরুন সে তার প্রতি খুশী হতে পারবে।
এজন্যে নবী করীম (স) স্বামীদের স্পষ্ট নসীহত করেছেন। বলেছেনঃ
(আরবী************************************************************)
তোমরা স্ত্রীদের সাথে সব সময় কল্যাণময় ব্যবহার করার জন্যে আমার এ নসীহত কবুল করো। কেননা নারীরা জন্মগতভাবেই বাঁকা স্বভাবের হয়ে থাকে। তুমি যদি জোরপূর্বক তাকে সোজা করতে যাও, তবে তুমি তাকে চূর্ণ করে দেবে। আর যদি অমনি ছেড়ে দাও তবে সে সব সময় বাঁকা থেকে যাবে। অতএব বুঝে-শুনে তাদের সাথে ব্যবহার করার আমার এ উপদেশ অবশ্যই গ্রহণ করবে।
এ হাদীসের মানে বদরুদ্দীন আইনীর ভাষায় নিম্নরূপঃ
(আরবী******************************************)
আমি মেয়েলোকদের প্রতি ভালো ব্যবহার করার জন্যে তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি, তোমরা তাদের সম্পপের্ক আমার দেয়া এ নসীহত অবশ্যই কবুল করবে। কেননা তাদের সৃষ্টিই করা হয়েছে পাঁজরের হাঁড় থেকে।
মেয়েলোকদের ‘হাড়’ থেকে সৃষ্টি করার মানে কি? –বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ
(আরবী**********************************************)
‘পাঁজর থেকে সৃষ্টি’ কথাটা বক্রতা বোঝার জন্যে রূপক অর্থে বলা হয়েছে। তার অর্থ হচ্ছে যে, মেয়েদের এমন এক ধরনের স্বভাব দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে যে, সে সৃষ্টির মধ্যেই রয়েছে বক্রতা –বাঁকা হওয়া অর্থাৎ মেয়েদের এক বাঁকা মূল থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অতএব তাদের দ্বারা কোনোরূপ উপকারিতা লাভ করা সম্ভব কেবল তখনি, যদি তাদের মেজাজ স্বভাবের প্রতি পূর্ণরূপে সহানুভূতি সহকারে লক্ষ্য রেখে কাজ করা হয় এবং তাদের বাঁকা স্বভাবের দরুন কখনো ধৈর্য হারানো না হয়। (ঐ)
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*******************************************)
মেয়েলোক পাঁজরের হাড়ের মতো। তাকে সোজা করতে চাইবে তো তাকে চূর্ণ করে ফেলবে, আর তাকে ব্যবহার করতে প্রস্তুত হলে তার স্বাভাবিক বক্রতা রেখেই ব্যবহার করবে।
এ হাদীস থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলো যে, নারীদের স্বভাবে বক্রতা স্বভাবগত ও জন্মগত। এ বক্রতা স্মপূর্ণরূপে দূর করা কখনো সম্ভব হবে না। তবে তাদের আসল প্রকৃতিকে বজায় রেখেই এবং তাদের স্বভাবকে যথাযথভাবে থাকতে দিয়েই তাদেরকে নিয়ে সুমধুর পারিবারিক জীবন গড়ে তোলা যেতে পারে, সম্ভব তাদের সহযোগিতায় কল্যাণময় সমাজ গড়া। আর তা হচ্ছে, তাদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা, তাদের সাথে অত্যন্ত নম্রতা ও সদিচ্ছাপূর্ণ ব্যবহার করা এবং তাদের মন রক্ষা করতে শেষ সীমা পর্যন্ত যাওয়া ও যেতে রাজি থাকা।
আল্লামা শাওকানী এ হাদীসের পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছেনঃ
মেয়েলোকদের পাঁজরের বাঁকা হাড়ের সাথে তুলনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে এ কথা বোঝানো যে, (আরবী******************) মেয়েরা স্বভাবতই বাঁকা,তাদের সোজা ও ঋজু করা সম্ভব নয়। যদি কেউ তাকে ঠিক করতে চেষ্টা করে, তবে সে তাকে ভেঙে-চুরে ফেলবে, নষ্ট করবে। আর যে তাকে যেমন আছে তেমনিই থাকতে দেবে, সে তার দ্বারা অশেষ কল্যাণকর কাজ করাতে পারবে, ঠিক যেমন পাঁজবের হাড়। তাকে বানানেই হয়েছে বাঁকা, তাকে সোজা করতে যাওয়ার মানে তাকে ভেঙে ফেলা –চূর্ণ করা। আর যদি তাকে বাঁকাই থাকতে দেয়া হয়, তবে তা দেহকে সঠিক কাজে সাহায্য করতে পারে। শেষ পর্যন্ত তিনি লিখেছেনঃ
(আরবী************************************************)
এ হাদীসে নির্দেশ করা হয়েছে, মেয়েলোকদের সাথে সব সময়ই ভালো ও আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার করতে হবে। তাদের স্বভাব-চরিত্রে বক্রতা থাকলে (সেজন্যে) অসীম ধৈর্য অবলম্বন করতে হবে। আর সাবধান করে দেয়া হয়েছে যে, মেয়েরা এমন এক স্বভাবের সৃষ্টি, যাকে আদব-কায়দা শিখিয়ে অন্যরকম কিছু বানানো সম্ভব নয়। স্বভাব-বিরোধী নসীহত উপদেশও সেখানে ব্যর্থ হতে বাধ্য। কাজেই ধৈর্য ধারণ করে তার সাথে ভালো ব্যবহার করা, তাকে ভৎসনা করা এবং তার সাথে রূঢ় ব্যবহার করা সম্পূর্ণ বর্জন করা ছাড়া পুরুষদের গত্যন্তর নেই।
নারীদের স্বভাব ও প্রকৃতি সম্পর্কে রাসূলে করীম (স)-এর এ উক্তিতে তাদের অসন্তুষ্ট বা ক্রুব্ধ হওয়ার কোনো কারণ নেই। এই কথা বলে তাদের অপমান করা হয়নি, না এতে তাদের প্রতি কোনো খারাপ কটাক্ষ করা হয়েছে। এ ধরনের কথার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নারী সমাজের জটিল ও নাজুক মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে পুরুষ সমাজকে অত্যধিক সতর্ক ও সাবধান করে তোলা। এ কথার ফলে পুরুষরা নারীদের সমীহ করে চলবে, তাদের মনস্তত্ত্বের প্রতি নিয়ত খেয়াল রেখেই তাদের সাথে আচার-ব্যবহার করতে উদ্ধুদ্ধ হবে। এ কারণে পুরুষদের কাছে নারীরা অধিকতর আদরণীয়া হবে। এতে তাদের দাম বাড়ল বৈ কমল না একটুকুও।
আল্লামা ইবনে হাজার আল-আসকালানী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ নারীদের এ বাঁকা স্বভাব দেখে তাদের এমনি ছেড়ে দেয়া উচিত নয়, বরং ভালো ব্যবহার ও অনুকূল পরিবেশ দিয়ে তাদের সংশোধন করতে চেষ্টা পাওয়াই পুরুষদের কর্তব্য। দ্বিতীয়ত, নারীদের প্রতি ভালো ব্যবহার করা সব সময়ই প্রয়োজন, তাহলেই স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক প্রেম-ভালোবাসার বন্ধন দৃঢ় হবে। সেই সঙ্গে মেয়েদের অনেক ‘দোষ’ ক্ষমা করে দেয়ার গুণও অর্জন করতে হবে স্বামীদের। খুটিনাটি ও ছোটখাটো দোষ দেখেই চটে যাওয়া কোনো স্বামীরই উচিত নয়।
নারী সাধারণত একটু জেদী হয়ে থাকে। নিজের কতার ওপর অটল হয়ে থাকা ও একবার জেদ উঠলে সবকিছু বরদাশত করা নারী-স্বভাবের একটি বৈশিষ্ট্য। অনেক ক্ষেত্রে মেয়েরা খুঁতখুতে মেজাজেরও হয়ে থাকে। কাজেই পুরুষ যদি কথায় কথায় দোষ ধরে, আর একবার কোনো দোষ পাওয়াগেলে তা শক্ত করে ধরে রাখে- কোনোদিন তা ভুলে যেতে রাজি না হয়, তাহলে দাম্পত্য জীবনের মাধুর্যটুকুই শুধু নষ্ট হবে না –তার স্থিতিও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
তার কারণ, নারীদের এই স্বভাবগত দোসের দিক ছাড়া তার ভালো ও মহৎ গুণের দিকও অনেক রয়েছে। তারা খুব কষ্টসহিষ্ণু, অল্পে সন্তুষ্ট, স্বামীর জন্যে জীবন-প্রাণ উৎসর্গ করতে সতত প্রস্তুত। সন্তান গর্ভে ধারণ, সন্তান প্রসব ও সন্তান লালন-পালনের কাজ নারীরা –মায়েরা যে কতখানি কষ্ট সহ্য করে সম্পন্ন করে থাকে, পুরুষদের পক্ষে তার অনুমান পর্যন্ত করা সহজ নয়। এ কাজ একমাত্র তাদের পক্ষেই করা সম্ভব। ঘর-সংসারের কাজ করায় ও ব্যবস্থাপনায় তারা অত্যন্ত সিদ্ধহস্ত, একান্ত বিশ্বাসভাজন ও একনিষ্ঠ। তাইবলা যায়, তাদের মধ্যে দোষের দিকের তুলনায় গুণের দিক অনেক গুণ বেশি।
একজন ইউরোপীয় চিন্তাবিদ পুরুষদের লক্ষ্য করে বলেছেনঃ
গর্ভ ধারণ ও সন্তান প্রসবজনিত কঠিন ও দুঃসহ যন্ত্রণার কথা একবার চিন্তা করো। দেখো, নারী জাতি দুনিয়ায় কত শত কষ্ট ব্যথা-বেদনা ও বিপদের ঝুঁকি নিজেদের মাথায় নিয়ে বেঁচে থাকে। তারা যদি পুরুষের ন্যায় ধৈর্যহীনা হতো, তাহলে এতো সব কষ্ট তারা কি করে বরদাশত করতে পারত? প্রকৃত পক্ষে বিশ্বমানবতার এ এক বিরাট সৌভাগ্য যে, মায়ের জাতি স্বভাবতই কষ্টসহিষ্ণু, তাদের অনুভূতি পুরুষদের মতো নাজুক ও স্পর্শকাতর নয়। অন্যথায় মানুষের এসব নাজুক ও কঠিন কষ্টকর কাজের দায়িত্ব পালন করা সম্পূর্ণ অসম্ভব ছিল।
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ক্ষমাশীলতা দাম্পত্য জীবনের মাধুর্য ও স্থায়িত্বের জন্যে একান্তই অপরিহার্য। যে স্বামী স্ত্রীকে ক্ষমা করতে পারে না, ক্ষমা করতে জানে না, কথায় কথায় দোষ ধরাই যে স্বামীর স্বভাব, শাসন ও ভীতি প্রদর্শনই যার কথার ধরন, তার পক্ষে কোনো নারীকে স্ত্রী হিসেবে সঙ্গে নিয়ে স্থায়ীভাবে জীবন যাপন করা সম্ভব হতে পারে না। স্ত্রীদের সম্পর্কে সাবধান বাণী উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রতি ক্ষমাসহিষ্ণুতা প্রয়োগেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে কুরআন মজীদের নিম্নোদ্ধৃত আয়াতেঃ
(আরবী**********************************************************)
হে ঈমানদার লোকেরা, তোমাদের স্ত্রীদের ও সন্তানদের মধ্যে অনেকেই তোমাদের শত্রু। অতএব তাদের সম্পর্কে সাবধান! তবে তোমরা যদি তাদের ক্ষমা করো, তাদের ওপর বেশি চাপ প্রয়োগ না করো বা জোরজবরদস্তি না করো এবং তাদের দোষ-ত্রুটিও ক্ষমা করে দাও, তাহলে জেনে রাখবে, আল্লাহ নিজেই বড় ক্ষমাশীল ও দয়াবান।
নবী করীম (স) তাঁর স্ত্রীদের অনেক বাড়াবাড়িই মাফ করে দিতেন। হযরত উমর ফারূকের বর্ণিত একদিনের ঘটনা থেকে তা বাস্তববাবে প্রমাণিত হয়।
হযতর উমর (রা) একদিন খবর পেলেন, নবী করীম (স) তাঁর বেগমগণকে তাঁদের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কারণে তালাক দিয়েছেন। তিনি এ খবর শুনে খুব ভীত হয়ে রাসূলের নিকট উপস্থিত হলেন। জিজ্ঞেস করলেনঃ আপনি আপনার বেগমদের তালাক দিয়েছেন? রাসূল (স) বললেনঃ না। পরে রাসূল (স) তাঁর সাথে হাসিমুখে কথাবার্তা বলেছেন। -বুখারী।
এ হাদীসকে ভিত্তি করে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ
(আরবী*****************************************************)
এ ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রীদের পীড়ন ও বাড়াবাড়িতে ধৈর্য ধারণ করা, তাদের দোষ-ত্রুটির প্রতি বেশি গুরুত্ব না দেয়া এবং স্বামীর অধিকারের পর্যায়ে তাদের যা কিছু অপরাধ বা পদঙ্খলন হয়, তা ক্ষমা করে দেয়া স্বামীর একান্ত কর্তব্য। তবে আল্লাহর হক আদায় না করলে সেখানে ক্ষমা করা যেতে পারে না।
স্ত্রীদের অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলবে না
ইসলামে নারীদের কোনোরূপ অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে তাদের বিব্রত করে তুলতে নিষেধ করা হয়েছে। প্রয়োজন হলে তাদের অবসর দিতে হবে –প্রস্তুতির জন্যে সময় দিতে হবে। দীর্ঘদিন পর হঠাৎ করে রাতের বেলা বাড়িতে উপস্থিত হলে স্ত্রী নিজেকে অপ্রস্তুত ও বিব্রত বোধ করতে পারে। এজন্যে রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী**************************************************************)
তোমাদের কেউ যদি দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাড়িতে অনুপস্থিত থাকার পর ফিরে আসে, তাহলে পূর্বে খবর না দিয়ে রাতের বেলা হঠাৎ করে বাড়িতে পৌঁছে যাওয়া উচিত নয়।
হযরত জাবির (রা) বললেনঃ ‘আমরা এক যুদ্ধে রাসূলে করীম (স)-এর সঙ্গে ছিলাম। পরে যখন আমরা মদীনায় ফিরে এলাম, তখন আমাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ ঘরে চলে যেতে ইচ্ছা করল। কিন্তু নবী করীম (স) বললেনঃ
(আরবী******************************************************)
কিছুটা অবসর দাও। রাতে ঘরে ফিরে যেতে পারবে। এই অবসরে তোমাদের স্ত্রীরা প্রয়োজনীয় সাজ-সজ্জা করে নেবে, গোপন অঙ্গ পরিস্কার করবে এবং তোমাদের গ্রহণ করার জন্যে প্রস্তুতি নিতে পারবে।
মেয়েরা সাধারণত অপ্রস্তুত অবস্থায় থাকে, তাদের মাথায়ও হয়ত ঠিক মতো চিরুণী করা হয় না। প্রয়োজনীয় সাজ-সজ্জায় সুজজ্জিত হয়েও তারা সব সময় থাকে না। বিশেষত স্বামীর দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতিতে মেয়েরা নিজেদের সাজ-সজ্জার ব্যাপারে খুবই অসতর্ক হয়ে পড়ে। নবী করীম (স) সাহাবিগণকে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘদিন পরে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেও সঙ্গে সঙ্গেই সকলকে নিজের নিজের ঘরে ফিরে যেতে দিলেন না। তাদের প্রত্যাবর্তনের খবর সকলের জানা হয়ে গেছে। স্ত্রীরা নিজের নিজের স্বামীকে সাদরে গ্রহণ করার জন্যে প্রস্তুতি নিতে পারছে এই অবসরে। এ দৃষ্টিতে রাসূলে করীম (স)-এর উপরোক্ত কথার তাৎপর্য স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে। স্বামীর দীর্ঘদিন অনুপস্থিতির কারণে স্ত্রী হয়ত ময়লা দেহ ও মলিন বসন পরে রয়েছে। তার মাথার চুলও হয়ত আঁচড়ানো হয়নি। এরূপ অবস্থায় স্বামী যখন তাকে দেখতে পাবে দীর্ঘদিনের বিরহের পর, তখন স্বামী যে নিরাশ ও নিরানন্দের বেদনায় মুষড়ে পড়বে এবং স্ত্রীও যে এরূপ অবস্থায় দীর্ঘদিনের অপেক্ষার পরও অন্তরঢালা আনন্দ সহকারে স্বামীকে গ্রহণ করতে কুণ্ঠিত হবে, তা বুঝতে পারা দুনিয়ার স্বামী ও স্ত্রীদের পক্ষ কঠিন নয়। বস্তুত এর দরুন স্বামীদের মন স্ত্রীর প্রতি বিরূপ ও তিক্ত-বিরক্ত হয়ে যেতে পারে, আর স্ত্রীর মনও স্বামীর কাছে ছোট হয়ে যেতে পারে। এরূপ অবস্থায় স্বামী-স্ত্রী কারো মন খারাপ হয়ে যাবার কোনো কারণ যাতে না ঘটতে পারে, এজন্যেই রাসূলে করীম(স) সাহাবীদের উক্তরূপ নির্দেশ দিয়েছিলেন। অন্যথায় যারা সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আর সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আসে, তাদের জন্যে এ রকম কিছু করণীয় নেই।
স্ত্রীদের ওপর জুলুম অত্যাচার করা নিষেধ
স্ত্রীদের প্রতি অত্যাচার জুলুম করা তো দূরের কথা, বারে বারে তালাক দিয়ে আবার ফেরত নিয়ে স্ত্রীকে কষ্ট দেয়া ও দাম্পত্য জীবনকে বিনষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্ত করাও ইসলামে নিষিদ্ধ। এ সম্পর্কে কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতটি উল্লেখ করা যেতে পারে। বলা হয়েছেঃ
(আরবী**********************************************************************)
তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের নানাভাবে কষ্টদান ও উৎপীড়নের উদ্দেশ্যে আটক করে রেখ না। যে লোক এরূপ করবে, সে নিজের ওপরই জুলুম করবে। আর তোমরা আল্লাহর আয়াতসমূহকে খেলনার বস্তুতে পরিণত করো না। (সূরা বাকারাঃ ৩৩)
যদিও আরবে প্রচলিত কুসংস্কার –স্ত্রীকে বারবার তালাক দিয়ে বারবার ফেরত নেয়ার রেওয়াজ নিষিদ্ধ করে এ আয়াত নাযিল হয়েছিল; কিন্তু স্ত্রীকে কোনো প্রকার অকারণ কষ্ট দেয়া বা তারক্ষতি করা যে নিষেধ, তা এ আয়াত থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। আয়াত থেকে একথাও বোঝা যাচ্ছে যে, নিজের স্ত্রীকে যে লোক কষ্ট দেবে, জুলুম-পীড়ন করবে, পরিণামে তার নিজের জীবনই নানাভাবে জর্জরিত হয়ে উঠবে, সে নিজেই কষ্ট পাবে, তার দাম্পত্য জীবনই দুঃসহ তিক্ততায় পূর্ণ হয়ে যাবে এবং স্ত্রীর সাথে মধুর সম্পর্ক বজায় রাখলে যে শান্তিপূর্ণ সুখময় জীবন যাপন সম্ভব, তা থেকে সে বঞ্চিত হয়ে যাবে। দুনিয়ায় তার প্রতি একদিকে যেমন আল্লাহর অসন্তোষ জেগে উঠবে, তেমনি জনগণ ও স্ত্রীলোকদের সমাজেও তার প্রতি জাগবে রুদ্র রোষ ও ঘৃণা।
বস্তুত স্ত্রীদের সাথে মিষ্টি ও মধুর ব্যবহার করা এবং তাদের কোনোরূপ কষ্ট না দিয়ে শান্তি ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দান করা সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও যদি কেউ তার স্ত্রীকে অকারণ জ্বালা-যন্ত্রণা দেয়, ক্ষতিগ্রস্থ করতে চেষ্টিত হয়, তবে সে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার কারণে আল্লাহর গজব পড়ার যোগ্য হবে। আল্লাম আ-লুসরি মতে তার নিজের কষ্ট ও ক্ষতি হবে।
(আরবী********************************************************************)
এভাবে যে, সে মধুর পারিবারিক জীবন যাপনের ফলে লভ্য সওয়াব থেকে বঞ্চিত হবে বলে সে দ্বীনের ফায়দা হারাবে আর দুনিয়ার ফায়দা হারাবে এভাবে যে, তার এ বীভৎস কাজের প্রচার হয়ে যাওয়ার কারণে নারী সমাজ তার প্রতি বিরূপ ও বিরাগভাজন হয়ে পড়বে।
নবী করীম (স) তাঁর নিজের ভাষায় স্ত্রীদের মারপিট করতে স্পষ্ট নিষেধ করেছেন। বলেছেনঃ
(আরবী***************************************)
তোমার স্ত্রী –অঙ্কশায়িনীকে এমন নির্মমভাবে মারধোর করো না, যেমন করে তোমরা মেরে থাকো তোমাদের ক্রীতদাসীদের।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জামায়াতা (রা) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ
(আরবী*******************************************************)
তোমাদের কেউ যেন তার স্ত্রীকে ক্রীতদাসদের মারার মতো না মারে, আর মারধোর করার পর দিনের শেষে তার সাথে যেন যৌন সঙ্গম না করে।
অর্থাৎ স্ত্রীর সাথে যৌন-সঙ্গম করা তো এক স্বাভাবিক কাজ, কিন্তু স্ত্রীকে একদিকে মারধোর করা আর অপরদিকে সেদিনই তার সাথে যৌন সঙ্গম করা অত্যন্ত ঘৃণার্হ কাজ। এ দুয়ের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য নেই। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ
(আরবী**********************************************************************)
স্ত্রীকে প্রচণ্ডভাবে মারধোর করা এবং সে দিনের বা সে রাতেরই পরবর্তী সময়ে তারই সাথে যৌন সঙ্গম করা –এ দুটো কাজ এক সঙ্গে সম্পন্ন হওয়া যে কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তির দ্বারাই সম্ভব হতে পারে না –হওয়া বাঞ্চনীয় নয়, যৌন সঙ্গম সুন্দর ও মাধুর্যপূর্ণ হতে পারে যদি তা মনের প্রবল ঝোঁক ও তীব্র অদম্য আকর্ষণের ফলে সম্পন্ন হয়। কিন্তু প্রহৃতের মন প্রহারকারীর প্রতি যে ঘৃণা পোষণ করে, তা সর্বজনবিদিত।
বস্তুত স্ত্রীকে মারধোর না করা, তার ত্রুটিবিচ্যুতি যথাসম্ভব ক্ষমা করে দেয়া ও তার প্রতি দয়া অনুগ্রহ প্রদর্শন করাই অতি উত্তম নীতি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। স্বয়ং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) এই নীতি ও চরিত্রেই ভূষিত ছিলেন। হযরত আয়েশা (রা) বলেনঃ
(আরবী*******************************************)
রাসূলে করীম (স) তাঁর কোনো স্ত্রীকে কিংবা কোনো চাকর-খাদেমকে কখনো মারধোর করেন নি –না তাঁর নিজের হাত দিয়ে, তা আল্লাহর পথে। তবে যদি কেউ আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ করে, তবে সেই আল্লাহর জন্যে তার প্রতিরোধ গ্রহণ করতেন। (আরবী*********)
স্ত্রীদের মারধেঅর করা, গালাগাল করা এবং তাদের সাথে কোনোরূপ অন্যায় জুলুম জাতীয় আচরণ গ্রহণ করতে নিষেধ করে রাসূলে করীম (স) স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনঃ
(আরবী********************************************************************)
তোমরা স্ত্রীদের আদৌ মারধেঅর করবে না এবং তাদের মুখমণ্ডলকে কুশ্রী ও কদাকার করে নিও না।
তিনি আরো বলেছেনঃ
(আরবী*******************************************)
আল্লাহর দাসীদের তোমরা মারধোর করো না।
লক্ষণীয় যে, স্ত্রীদেরকে এখানে ‘আল্লাহর দাসী’ বলা হয়েছে, পুরুষদের বা স্বামীদের দাসী নয়। তাই তাদের অকারণ মারধোর করা কিংবা তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করার কোনো অধিকার স্বামীদের নেই।
অপর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ
(আরবী**********************************************************)
তোমরা স্ত্রীদের মুখের ওপর মারবে না, মুখমণ্ডলের ওপর আঘাত দেবে না, তাদের মুখের শ্রী বিনষ্ট করবে না, অকথ্য ভাষায় তাদের গালাগাল করবে না এবং নিজেদের ঘর ছাড়া অন্য কোথাও তাদের বিচ্ছিন্নাবস্থায় ফেলে রাখবে না।
তবে কি স্ত্রীদের মারধোর করা আদৌ জায়েয নয়? উপরোক্ত হাদীসের ভিত্তিতে ইমাম খাত্তাবী লিখেছেনঃ
(আরবী******************************************************)
রাসূলের ‘মুখের ওপর মারবে না’ উক্তি থেকে প্রমাণিত হয় যে, মুখমণ্ডল ব্যতীত দেহের অন্যান্য অংশের ওপর স্ত্রীকে মারধোর করা সঙ্গত। তবে শর্ত এই যে, তা মাত্রার বেশি, সীমালংঘনকারী ও অমানুষিক মার হতে পারবে না।
ওপরে উদ্ধৃত হাদীসের ভিত্তিতে ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল কাহলানী বুখারী লিখেছেনঃ
(আরবী*************************************************) হাদীসটি থেকে প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রীকে খুব হালকাভাবে সামান্য মারধোর করা জায়েয।
কিন্তু স্ত্রীকে মারধোর করা কখন ও কি কারণে করা সঙ্গত? ……এ পর্যায়ে প্রথমে কুরআন মজীদের নিম্নোদ্ধৃত আয়াত পাঠ করা যেতে পারে। আয়াতটি হলোঃ
(আরবী********************************************************)
আর যেসব স্ত্রীলোকের অনানুগত্য ও বিদ্রোহের ব্যাপারে তোমরা ভয় করো, তাদের ভালোভাবে বুঝাও, নানা উপদেশ দিয়ে তাদের বিনয়ী বানাতে চেষ্টা করো। পরবর্তী পর্যায়ে মিলন-শয্যা থেকে তাদের দূরে সরিয়ে রাখ। আর (শেষ উপায় হিসেবে) তাদের মারো। এর ফলে যদি তারা তোমাদের অনুগত হয়ে যায়, তাহলে তাদের ওপর অন্যায় ব্যবহারের নতুন কোনো পথ খুঁজে বেড়িও না। …..নিশ্চয় আল্লাহই হচ্ছেন সর্বোচ্চ, সর্বশ্রেষ্ঠ।
এ আয়াতে দুনিয়ার মুসলিম স্বামীদের সম্বোধন করে বলা হয়েছে। ‘ভয় করা’ মানে জানতে পারা অথবা নিঃসন্দেহে বুঝতে পারা যে, স্ত্রী স্বামীকে মানছে না, অথচ স্বামীকে মেনে চলাই স্ত্রীর কর্তব্য। এরূপ অবস্থায় স্বামী কি করবে, তা-ই বলা হয়েছে এ আয়াতে। এখানে প্রথমে বলা হয়েছে স্ত্রীকে ভালোভাবে বোঝাতে, উপদেশ দিতে ও নসীহত করতে, একথা তাকে জানিয়ে দিতে যে, স্বামীকে মান্য করে চলা, স্বামীর সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলা ও তা বজায় রাখার জন্যে আল্লাহ তা’আলাই নির্দেশ দিয়েছেন। এ নির্দেশ তাকে অবশ্যই পালন করতে হবে। অন্যথায় তার ইহকালীন দাম্পত্য জীবন ও পারিবারিক জীবন তিক্ত-বিষাক্ত হয়ে যাবে, আর পরকালেও তাকে আল্লাহর আযাব ভোগ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত বলা হয়েছে, অমান্যকারী স্ত্রীকে মিলন-শয্যা থেকে সরিয়ে রাখা –তার সাথে যৌন সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা। অন্য কথায় তাকে না শয্যা-সঙ্গী বানাবে, না তার সাথে যৌন সম্পর্ক বজায় রাখবে। আর তৃতীয়ত বলা হয়েছে তাকে মারধোর করতে। কিন্তু এ মারধোর সম্পর্কে একথা স্পষ্ট যে, তা অবশ্যই শিক্ষামূলক হতে হবে মাত্র। ক্রীতদাস ও জন্তু-জানোয়ারকে যেমন মারা হয়, সে রকম মার দেয়ার অধিকার কারো নেই।–[‘ফতোয়ায়ে কাজীখান’-এ বলা হয়েছেঃ (আরবী**************************************************)
স্বামী স্ত্রীকে চারটি অবস্থায় বা চারটি কারণে মারতে পারে। এক, স্বামীর ইচ্ছা ও নির্দেশ সত্ত্বেও স্ত্রী যদি সাজ-সজ্জা পরিত্যাগ করে। দুই, স্বামী যৌন সঙ্গমের ইচ্ছা প্রকাশ করলেও সেজন্যে প্রস্তুত না হওয়া তার পবিত্র ও হায়যমুক্ত থাকা সত্ত্বেও। তৃতীয়, স্ত্রী যদি নামায তরক করে এবং চতুর্থ, স্ত্রী যদি স্বামীর বিনানুমতিতে ঘর থেকে বাইরে চলে যায়।]
কিন্তু এ সব কয়টি কাজ স্বামী এক সঙ্গে করবে, কিংবা একটার পর একটা প্রয়োজনানুপাতে করবে। ….আয়াতের ধরন ও বাচনভঙ্গী দেখে বাহ্যত সব কয়টি কাজ এক সঙ্গে করারই অনুমতি রয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু বিবেক ও সুস্থ বুদ্ধির নির্দেশ এই যে, এই কয়টি কাজ এক সঙ্গে একই সময় করবে না, ক্রমিক নীতিতে ও প্রয়োজনানুপাতে একটির পর একটি করবে। কিন্তু এ কাজ করার অনুমতিই দেয়া হয়েছে স্ত্রীকে অনুগতা বানাবার উদ্দেশ্যে। নিছক কষ্ট বা শাস্তি দেয়াই এর লক্ষ্য নয়। কাজেই একটি একটি করে তার সফলতা যাচাই করবে। তা ব্যর্থ হলে পরেরটা করবে। আয়াতের শেষাংশে আল্লাহর পরিচয় দিয়ে যা বলা হয়েছে, তার মানে আল্লামা শাওকানীর ভাষায় নিম্নরূপঃ
(আরবী************************************************************)
আয়াতে স্বামীদের বলা হয়েছে স্ত্রীদের জন্যে ভালোবাসার বাহু বিছিয়ে দিতে, পার্শ্ববিনম্র করতে অর্থাৎ তোমরা স্বামীর যদি স্ত্রীদের প্রতি যা ইচ্ছা তা-ই করার ক্ষমতা রাখ, তাহলেও তোমাদের উচিত তোমাদের ওপর স্থাপিত আল্লাহর অসীম ও অতুলনীয় ক্ষমতার কথা স্মরণ করা। কেননা তা হচ্চে সর্বক্ষমতার ঊর্ধ্বে –অধিক। মনে রেখ, আল্লাহ তোমাদের প্রতি উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছেন।–[আয়াত থেকে আল্লাহর ইচ্ছা এই মনে হয় যে, স্ত্রীকে মারবার ব্যাপারে যতদূর সম্ভব হালকা ভাব অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। এজন্যে আল্লাহ তা’আলা ওয়ায-নসীহত, বোঝানো –সমঝানোর আদেশ দিয়েছেন সর্ব প্রথম। তারপরে ক্রমশ অগ্রসর হয়ে মিলন-শয্যা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা ও শেষ পর্যায়ে মারবার কথা বলেছেন। ইমাম ফখরুদ্দীন রাযীর মতে এর তাৎপর্য হচ্ছেঃ
(আরবী*******************************************************************)
একথা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া যে, অপেক্ষাকৃত হালকা শাসনে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলে পরে তাতেই ক্ষান্ত করা উচিত এবং তার পরও অধিকতর কঠোর নীতি অবলম্বনে অগ্রসর হওয়া কিছুতেই জায়েয নয়।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) এ আয়াতের ভিত্তিতে বলেছেনঃ
(আরবী*********************************************************)
প্রথমে তাকে মিলন-শয্যা থেকে সরিয়ে দেবে, এতে যদি সে মেনে যায় ভালো, অন্যথায় আল্লাহ তা’আলা তোমাকে অনুমতি দিয়েছেন তাকে মারবার; কিন্তু সে মার নির্দয় অমানুষিক হবে না। মারের চোটে তার হাড় ভেঙ্গে দিতে পারবে না। এতে যদি সে ফিরে আসে ভালো কথা; অন্যথায় তুমি তার কাছ থেকে বিনিময় গ্রহণ করে তাকে তালাক দিয়ে দিতে পারো।]
স্ত্রীদের প্রতি ব্যবহার সম্পর্কে একথা বলে দুনিয়ার স্বামীদের বিশেষভাবে সাবধান করে দেয়া হয়েছে, যেন তারা নারী অবলার প্রতি কোনোরূপ দুর্ব্যবহার ও অন্যায়-অত্যাচার করতে সাহসী না হয়।
অতঃপর বলা হয়েছে, স্ত্রী যদি স্বামীকে মেনে নেয়, স্বামীর সাথে মিলমিশ রক্ষা করে বসবাস করতে রাজি হয় এবং তা-ই করে, তাহলে স্বামীর কোনো অধিকার নেই তার ওপর কোনোরূপ অত্যাচার করার, তাকে একবিন্দু কষ্ট ও জ্বালাতন দেয়ার! আয়াতের শেষাংশে কোনো উপযুক্ত কারণ ব্যতীত স্ত্রীকে কষ্ট দেয়ার যে কতদূর অন্যায় তার দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, তারা যদিও অবলা, দুর্বল, স্ত্রীকে কষ্ট দেয়ার যে কতদূর অন্যায় তার দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, তারা যদিও অবলা, দুর্বল, তোমাদের জুলুম-পীড়ন থেকে আত্মরক্ষা করার সাধ্য যদিও তাদের নেই; তোমাদের অত্যাচারের প্রতিশোদ গ্রহণ করতে তারা যদিও অক্ষম; কিন্তু তোমাদের ভুললে চলবে না যে, আল্লাহ হচ্ছেন প্রবল পরাক্রান্ত, শ্রেষ্ঠ, শক্তিমান; তিনি অবশ্যই প্রত্যেক জালিমের জুলুমের প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন এবং সেজন্যে কঠোর শাস্তিদান করবেন। অতএব তোমরা শক্তিমান বলে স্ত্রীদের ওপর অকারণ জুলুম করতে উদ্যত হবে, তা কিছুতেই হতে দেয়া যায় না।
স্ত্রীদের প্রতি ভালো ব্যবহার ঈমানের লক্ষণ
স্ত্রীদের ওপর অন্যায়ভাবে, অকারণে ও উঠতে-বসতে আর কথায়-কথায় কোনোরূপ দুর্ব্যবহার বা মারধোর করতে শুধু নিষেধ করেই ক্ষান্ত করা হয়নি, ইসলাম আরো অগ্রসর হয়ে স্ত্রীদের প্রতি সক্রিয়ভাবে ভালো ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন স্বামীদেরকে।
এ পর্যায়ে কুরআনের আয়াতঃ
(আরবী**************************************)
স্ত্রীদের সাথে যথাযথভাবে কুব ভালো ব্যবহার করবে।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা কাসেমী লিখেছেনঃ
(আরবী******************************************************)
স্ত্রীদের সাথে কার্যত ইনসাফ করে আর ভালো সম্মানজনক কথা বলে একত্র বসবাস করো যেন তোমরা স্ত্রীদের বিদ্রোহ বা চরিত্র খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণ হয়ে না বসো। এ ধরনের কোনো কিছু করা তোমাদের জন্যে আদৌ হালাল নয়।
আল্লামা আ-লুসী লিখেছেনঃ
(আরবী*********************************************************)
তাঁদের সাথে ভালোভাবে ব্যবহার করো। আর ‘ভালোভাবে’ মানে এমনভাবে যা শরীয়ত ও মানবিকতার দৃষ্টিতে অন্যায় নয় –খারাপ নয়।
এ ‘ভালোভাবে’ কথার মধ্যে এ কথাও শামিলঃ
(আরবী***********************************************)
স্ত্রীকে মারধোর করবে না, তার সাথে খারপ কথাবার্তা বলবে না এবং তাদের সাথে সদা হাসিমুখে ও সন্তুষ্টচিত্তে সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে।
তাফসীরকারদের মতে এ আয়াত থেকে এ কথাও প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রী যদি ঘরের কাজ-কর্ম করতে অক্ষম হয় বা তাতে অভ্যস্ত না হয়, তাহলে স্বামী তার যাবতীয় কাজ করিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে বাধ্য। (আরবী*******)
স্ত্রীদের সাথে ভালো ব্যবহার করা পূর্ণ ঈমান ও চরিত্রের লক্ষণ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ
(আরবী****************************************************)
যার চরিত্র সবচেয়ে উত্তম, নিষ্কলুষ সে সবচেয়ে বেশি পূর্ণ ঈমানদার। আর তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ব্যক্তি হচ্ছে সে, যে তার স্ত্রীর নিকট সবচেয়ে ভালো।
অপর এক হাদীসে স্ত্রীদের ব্যাপারে রাসূলে করীম (স)-এর নিজের ভূমিকা উল্লেখ করে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*************************************************)
তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো লোক সে, যে তার পরিবার ও স্ত্রী-পরিজনের পক্ষে ভালো। আর আমি আমার নিজের পরিবারবর্গের পক্ষে তোমাদের তুলনায় অনেক ভালো। তোমাদের সঙ্গী-স্ত্রী বা স্বামী –যদি মরে যায়, তাহলে তার কল্যাণের জন্যে তোমরা অবশ্যই দো’আ করবে।
হযরত আবূ যুবার (রা) বলেন, একদা নবী করীম (স) সাহাবীদের লক্ষ্য করে বললেনঃ
(আরবী*******************) –তোমরা আল্লাহর দাসীদের মারধোর করো না।
তখন হযরত উমর ফারূক (রা) রাসূলের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেনঃ
(আরবী************************************************)
আপনার এ কথাটি শুনে স্ত্রীরা তাদের স্বামীদের ওপর খুবই বাড়াবাড়ি শুরু করে দিয়েছে।
তখন নবী করীম (স) তাদেরও মারবার অনুমতি দিলেন। একথা জানতে পেরে বহু সংখ্যক মহিলা রাসূলের ঘরে এসে উপস্থিত হলো এবং তারা তাদের স্বামীদের বিরুদ্ধে নানা প্রকারের অভিযোগ পেশ করলো। সব কথা শুনে নবী করীম (স) বললেনঃ
(আরবী***************************************************************)
বহু সংখ্যক মহিলা মুহাম্মদের পরিবারবর্গের নিকট এসে তাদের স্বামীদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করে গেছে। মনে হচ্ছে, এসব স্বামী তোমাদের মধ্যে ভালো লোক নয়।
অন্য কথায়ঃ
(আরবী******************************************************)
বরং তোমাদের মধ্যে উত্তম লোক হচ্ছে তারা, যারা তাদের স্ত্রীদের মারপিট করে না; বরং তাদের অনেক কিছুই তারা সহ্য করে নেয়। (অথবা বলেছেন) তাদের প্রতি প্রেম-ভালোবাসা পোষণ করে, তাদের কঠিন মার মারে না এবং তাদের অভাব-অভিযোগগুলো যথাযথভাবে দূর করে।
স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক উপহার বিনিময়
স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রেম-ভালোবাসার স্থায়িত্ব ও গভীরতা বিধানের উদ্দেশ্যে প্রয়োজন হচ্ছে পারস্পরিক উপহার-উপঢৌকন বিনিময়। স্বামীর কর্তব্য স্ত্রীকে মাঝে-মধ্যে নানা ধরনের চিত্তাকর্ষক দ্রব্যাদি দেয়া। স্ত্রীরও যথাসাধ্য তাই করা উচিত। যার যে রকস সম্বল ও সামর্থ্য, সেই অনুপাতে যদি পরস্পরে উপহার-দ্রব্যের আদান-প্রদান হয়, তাহলে তার ফলে পারস্পরিক আকর্ষণ, কৌতুহল ও হৃদয়াবেগ বৃদ্ধি পাবে। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের প্রতি থাকবে সদা সন্তুষ্ট। এজন্যে রাসূলে করীম (স)-এর একটি সাধঅরণ ও সংক্ষিপ্ত উপদেশ সব সময় স্মরণে রাখা কর্তব্য। তা হলোঃ (আরবী************) অর্থাৎ তোমরা পরস্পর উপহার-উপঢৌকনের আদান-প্রদান করো। দেখবে, এর ফলে তোমাদের পারস্পরিক ভালোবাসার সৃষ্টি হয়েছে –পারস্পরিক প্রেম-ভালোবাসার মাত্রা বৃদ্ধি পাবে।
অপর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*************************************************)
তোমরা পরস্পরে হাদিয়া-তোহফার আদান-প্রদান করবে, কেননা হাদিয়া-তোহফা দিলের ক্লেদ ও হিংসা-দ্বেষ দূর করে দেয়।
এর কারণ সুস্পষ্ট। মানুষের দিলে ধন-মালের মায়া খুবই তীব্র ও গভীর। তা যদি কেউ অন্য কারো নিকট থেকে লাভ করে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তার মন তার দিকে ঝুঁকে পড়ে, আকৃষ্ট হয় এবং মাল-সম্পদ দানকারীর মনও ঝুকে পড়ে তার প্রতি, যাকে সে তা দান করল।
(আরবী*************************************)
ইবরাহীম ইবনে ইয়াজীদ নখয়ী বলেছেনঃ
(আরবী*********************************************************************)
পুরুষের পক্ষে তার স্ত্রীকে এবং স্ত্রীর পক্ষে তার স্বামীকে উপহার দান খুবই বৈধ কাজ। তিনি আরো বলেছেনঃ
(আরবী***********************************************************************************)
স্ত্রী যদি স্বামীকে কিংবা স্বামী যদি স্ত্রীকে কোনো উপহার দেয়, তবে তা তাদের প্রত্যেকের জন্যে হতে তার পাওয়া দান।
কিন্তু এ ব্যাপারে শরীয়তের নির্দেশ হলো, কেউই অপরের দেয়া উপহার ফেরত নিতে বা দিতে পারবে না। ইবরাহীম নখয়ী বলেছেনঃ
(আরবী********************************************************************)
এ দুয়ের কারোর পক্ষেই তার নিজের দেয়া উপহার ফিরিয়ে নেয়া জায়েয নয়।
হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয বলেছেণ, ‘এভাবে উপহার আদান-প্রদান করলে কেউই কারোরটা ফিরিয়ে দেবে না, ফিরেয়ে নেবে না।
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ
(আরবী*******************************************************)
স্বামী স্ত্রীকে এবং স্ত্রী স্বামীকে যা কিছু একবার দিয়ে দিয়েছে, তা ফেরত নেয়া কারো পক্ষেই জায়েয নয়।
ইবনে বাত্তাল বলেছেনঃ কারো কারো মতে স্ত্রী তার দেয়া জিনিস ফিরিয়ে নিলেও নিতে পারে; কিন্তু স্বামী তার দেয়া উপহার কিছুতেই ফিরিয়ে নিতে পারবে না।
স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক মান-অভিমান অনেক সময় জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব করে। অনেক সময় তা সীমাতিক্রম করে যায়। অনেক সময় কথার কাটাকাটি ও তর্ক-বিতর্কেও পরিণত হয়ে পড়ে। রাসূলে করীম (স)-এর দাম্পত্য জীবনেও তা লক্ষ্য করা গিয়েছে। হযরত উমরের বেগম একদিন হযরত উমরকেই বললেনঃ
(আরবী**********************************************)
আল্লাহর কসম, নবীর বেগমরা পর্যন্ত তাঁর কথার প্রত্যুত্তর করে থাকেন। এমন কি তাঁদের এক-একজন রাসূলকে দিনের বেলা ত্যাগ করে রাত পর্যন্ত অভিমান করে থাকেন।
তখন হযরত উমর (রা) চিন্তায়ি ভারাক্রান্ত হয়ে তাঁর কন্যা উম্মুল মু’মিনীন হযরত হাফসার নিকট উপস্থিত হয়ে বিষয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন ও সত্যাসত্য জানতে চাইলেন। জবাবে হাফসা হ্যাঁ-সূচক উক্তি করলেন। হযরত উমর এর পরিণাম ভয়াবহ মনে করে কন্যাকে সাবধান করে দিলেন ও বললেনঃ
(আরবী******************************************************)
সাবধান! তুমি রাসূলের নিকট বেশি বেশি জিনিস পেতে চাইবে না। তাঁর কথায় মুখের ওপর জবাব দেবে না, রাগ করে কখনো তাঁকে ত্যাগ করবে না। আর তোমার কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে তা আমার নিকট চাইবে।
(আরবী***************************************************************)
নিজের কন্যার দাম্পত্য জীবন সুখের হওয়ার জন্যে অর্থ ব্যয় করার একটা নির্দেশ এতে নিহিত রয়েছে। আর এ হচ্ছে স্বামী ও স্ত্রী উভয়েরই মর্যাদা রক্ষার ব্যাপার এবং এ উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যয় করা কর্তব্য। জামাতার নিকট মেয়ে বেশি বেশি জিনিস চাইলে তার কষ্ট হতে পারে মনে করে কন্যার জন্যে অর্থ ব্যয় করতে প্রস্তুত হওয়ারও নিদর্শন এতে রয়েছে।
----------------------------------------------------------------------------------
'' শুধু নিজে শিক্ষিত হলে হবেনা, প্রথমে বিবেকটাকে শিক্ষিত করুন। ''