সোমবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৬

পবিত্র কোরআন খতমের বিনিময়ে হাদিয়া দেওয়া-নেওয়া যাবে ??? মৃত্য ব্যক্তির নামে কোরআন খতম কিংবা চল্লিশা করা যাবে কি?

১) পবিত্র কোরআন খতমের বিনিময়ে হাদিয়া দেওয়া-নেওয়া যাবে ???

পূর্বেকার যুগে মুসলমানগণ সচেষ্ট থাকতেন যাবতীয় ইবাদত যেন যথাযথভাবে আদায় হয়। ইবাদতের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার ত্রুটি বা দুর্বলতা না থাকে।
যেকোনো ইবাদতে ব্যতিক্রমী কিছু মনে হলে তা ফকিহ, মুফতি ও মুহাদ্দিসগণ থেকে জেনে নিয়ে শুধরে নিতেন। এ যুগেও ওই বাস্তবতা ও চিন্তাধারা বিদ্যমান। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিভিন্ন সামাজিক প্রথা ইবাদতে প্রভাব বিস্তার করতে দেখা যায় বর্তমান সমাজে। এ দিকটি বড়ই আফসোসের এবং হতাশার। ইবাদত হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর হুকুম পরিপালনের উদ্দেশ্যে। এতে না কোনো দুনিয়াবি স্বার্থ জড়িত থাকবে, না সামাজিক কোনো প্রথা ইবাদতকে প্রভাবিত করবে। এর ব্যতিক্রম হলে ইবাদত অপরিপূর্ণ হয়, সাওয়াব কমে যায়, অনেক সময় একেবারেই সাওয়াব হয় না, অনেক ক্ষেত্রে ইবাদতটাও সহিহ হয় না।
পবিত্র রমজান মাসের বিশেষ আমলগুলো সিয়াম সাধনার পর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো তারাবির নামাজ। মুসলমানগণ তারাবির নামাজকে যথাযথভাবে আদায় করে তার পরিপূর্ণ ফজিলত অর্জনের জন্য সচেষ্ট থাকেন। অনেক সময় পরিপূর্ণ জ্ঞানের অভাব বা পরিবেশ পরিস্থিতি ও সামাজিকভাবে প্রচলিত প্রথার চাপের মুখে তারাবির মতো আমলে কিছু ত্রুটিবিচ্যুতির অনুপ্রবেশ ঘটে থাকে। যার কারণে তারাবির ফজিলত থেকে পুরোপুরিভাবে বঞ্চিত রয়ে যেতে হয় তাদের। যেমন- তারাবির নামাজ সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পবিত্র কোরআনের খতম। কোরআন খতমের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে একটি হলো যে হাফেজ পবিত্র কোরআন তারাবিতে খতম করবেন, তিনি এর বিনিময় চাইতে পারবেন কি না? হাফেজের কোনো দাবি ছাড়া মুসল্লিগণ তাঁকে বিনিময় প্রদান করতে পারবেন কি না? বিনিময় নয়, হাদিয়া বা উপহারণস্বরূপ কিছু লেনদেন করতে পারা যাবে কি না? ওই হাফেজ যদি কোরআন খতমের পাশাপাশি মসজিদে আজান দেন বা কয়েক ওয়াক্ত নামাজ পড়ান, তখন ওই হাফেজকে বিনিময় দেওয়া যাবে কি না ইত্যাদি।
বিষয়টি ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। যার কারণে শরিয়তের মূল চাওয়াকে পাশ কাটিয়ে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে একে ব্যাখ্যা করে থাকেন। শেষ পর্যন্ত মুসল্লিগণ, যারা আন্তরিকভাবে হাফেজদের খেদমত করতে আগ্রহী, হাফেজ সাহেবদের কিছু আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে মূল্যায়ন করতে চান, রমজান ও তারাবির ফজিলত পরিপূর্ণভাবে পেতে আকাঙ্ক্ষী, তাঁরা স্বয়ং তারাবির নামাজের মতো মহৎ ইবাদতের ফজিলতটুকু অর্জনেও ব্যর্থ হন। এ কারণে তারাবির নামাজে কোরআন খতম করে বিনিময় নেওয়া ও দেওয়ার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় বিধান জানা থাকা আবশ্যক।
তারাবির নামাজের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় শরিয়ার দিক থেকে লক্ষণীয়। প্রথমত, তারাবির নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা। দ্বিতীয়ত, তারাবির নামাজে পুরো এক খতম কোরআন পাঠ করা। শরিয়তের দৃষ্টিতে দুটি বিষয়ের বিধান ভিন্ন ভিন্ন।
তারাবির নামাজ জামাত সহকারে আদায় করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা কিফায়া। কোথাও তারাবির জামাত অনুষ্ঠিত না হলে সবাই গোনাহগার হবে। তারাবির নামাজে পুরো এক খতম কোরআন পাঠ করা সুন্নাতে জায়েদা। যদিও এটি অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ একটি আমল। তবুও বাধ্যতামূলক নয়। তাই খতমে তারাবি সম্ভব না হলে সুরা তারাবি হলেও পড়তে হবে।
ইবাদতের বিনিময়সংক্রান্ত শরিয়তের নীতিমালা : ইবাদতের বিনিময় গ্রহণসংক্রান্ত শরিয়তের নীতিমালা হলো নিরেট ইবাদত তথা ইবাদতে মকসুদা যেমন- নামাজ, রোজা, ইতিকাফ ইত্যাদির ক্ষেত্রে বিনিময় গ্রহণ করা সম্পূর্ণ হারাম। ইসলামের শুরু থেকে যত দিন ইসলামী খেলাফত অবশিষ্ট ছিল, তত দিন এই নীতি বহাল ছিল। ইমামগণ ইমামতি করে বিনিময় গ্রহণ করতেন না। কোরআন শিক্ষা দিয়ে বিনিময় নিতেন না। রাষ্ট্রীয়ভাবে এসবের ব্যবস্থা করা হতো। ইসলামী খেলাফত বিলুপ্তির পর রাষ্ট্রীয়ভাবে শরিয়তের বাধ্যতামূলক ইবাদতগুলোর ব্যবস্থাপনা না থাকায় পরবর্তী ফুকাহাগণ শরিয়তের প্রয়োজনে ইমাম, মুয়াজজিন, কোরআন শিক্ষার মুয়াল্লিমদের বিনিময় গ্রহণে ছাড় দেন। অর্থাৎ এগুলোর ক্ষেত্রে ডক্ট্রিন অব নেসেসিটির ভিত্তিতে বৈধতা প্রদান করেন।
এবার আসা যাক তারাবির বিষয়ে। শরিয়ত মতে, তারাবির নামাজ বাধ্যতামূলক হলেও তারাবিতে খতমে কোরআন বাধ্যতামূলক নয় বিধায় তারাবিতে খতমে কোরআনের বিনিময় এই বৈধতার আওতায় পড়ে না।
তারাবিতে কোরআন খতমের বিনিময়ে হাদিয়া দান ও গ্রহণের হুকুম : ওই নীতিমালার ভিত্তিতে খতম তারাবিতে হাফেজদের বিনিময় বা হাদিয়া দেওয়া-নেওয়া মুসলিম উম্মাহর ফকিহ, মুহাদ্দিসগণ ঐকমত্যের ভিত্তিতে নাজায়েজ বলেছেন। এতে না কোনো মাজহাবের মতবিরোধ আছে, না পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ফকিহগণের মাঝে কোনো মতভেদ আছে। ইমামতির জন্য বেতন ঠিক করা এবং তা আদায় করা যদিও পরবর্তী ফকিহগণের দৃষ্টিতে জায়েজ; কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো ফকিহ খতমে তারাবির বিনিময় বা হাদিয়া নেওয়া-দেওয়ার অনুমতি দেননি।
সুতরাং খতমে তারাবির বিনিময় দেওয়া-নেওয়া উভয়ই নাজায়েজ ও হারাম। হাদিয়া হিসেবে দিলেও জায়েজ হবে না। এক মাসের জন্য নিয়োগ দিয়ে কয়েক ওয়াক্ত নামাজ পড়িয়ে বেতন হিসেবে দিলেও জায়েজ নয়। এটা যেভাবেই দেওয়া হোক, তা কোরআন খতমের বিনিময় হিসেবেই স্বীকৃত হবে। এতে কোনো প্রকার হিলা বা কৌশল করার অবকাশ নেই। (ফতোয়ায়ে শামী ৬/৫৭, আল-বাহরুর রায়েক ৮/২৩, মাজমাউল আনহুর ৩/৫৩৩, ফতওয়ায়ে হামিদিয়া ২/১৩৭-১৩৮, শিফাউল আলীল ওয়া বাল্লুল গালিল ১/১৫৪-১৫৫, আল ইখতিয়ার লিতালীল মুখতার ২/৬২)
পবিত্র কোরআন-সুন্নাহর আলোকে ফকিহদের মতামত : এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট বিধানাবলি এবং এর ভিত্তিতে ফকিহগণ কী মত পোষণ করেন, তার প্রতিও সামান্য আলোকপাত করা হলো-
* আবদুর রহমান ইবনে শিবল (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তোমরা কোরআন পড়ো। তবে তাতে বাড়াবাড়ি করো না। এর প্রতি বিরূপ হয়ো না। কোরআনের বিনিময় ভক্ষণ করো না এবং এর দ্বারা সম্পদ কামনা করো না। (মুসনাদে আহমদ ৩/৪২৮, হাদিস : ১৫৫২৯; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৫/২৪০)
* ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তোমরা কোরআন পড়ো এবং আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করো। তোমাদের পরে এমন জাতি আসবে, যারা কোরআন পড়ে মানুষের কাছে প্রার্থনা করবে। -(মুসনাদে আহমদ ৪/৪৩৭, হাদিস : ১৯৯১৭)
* আবদুল্লাহ ইবনে মা'কাল (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি এক রমজানে লোকদের নিয়ে তারাবি পড়ালেন। এরপর ঈদের দিন উবাইদুল্লাহ ইবনে জিয়াদ (রা.) তাঁর কাছে একজোড়া কাপড় এবং ৫০০ দিরহাম পাঠালেন। তখন তিনি কাপড় জোড়া এবং দিরহামগুলো এই বলে ফেরত দিলেন, আমরা কোরআনের বিনিময় গ্রহণ করি না। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৫/২৩৭, হাদিস : ৭৮২১)
এরূপ আরো বহু হাদিস ও দলিল প্রমাণের আলোকে উম্মতের ফকিহগণ তারাবিতে পবিত্র কোরআন খতমের বিনিময়ে বা হাদিয়া দেওয়া-নেওয়া সম্পূর্ণরূপে হারাম বলেছেন।
প্রখ্যাত ফকিহদের মতামত : ১. হজরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী বলেন, তারাবিতে যে পবিত্র কোরআন পড়ে এবং শোনে তাদের বিনিময় দেওয়া হারাম। (ফতোয়ায়ে রশীদিয়া ৩৯২)
২. হজরত খলিল আহমদ সাহারানপুরী (রহ.) বলেন, বিনিময় দিয়ে পবিত্র কোরআন শোনা জায়েজ নয়। দানকারী এবং গ্রহণকারী উভয় গোনাহগার হবে। (ফতোয়ায়ে খলিলিয়া ১/৪৮)
৩. হজরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) বলেন, বিনিময় লেনদেন হয় এমন খতম তারাবি শরিয়তপরিপন্থী। এরূপ খতমের দ্বারা সাওয়াবের ভাগী হওয়া যাবে না বরং গোনাহের কারণ হবে। (এমদাদুল ফতোয়া ১/৪৮)
৪. মুফতি কেফায়াতুল্লাহ (রহ.) বলেন, তারাবিতে পবিত্র কোরআন শোনানোর বিনিময় গ্রহণ করা জায়েজ নেই। (কেফায়াতুল মুফতি ৩/২৬৫)
৫. হজরত মুফতি আযীযুর রহমান (রহ.) বলেন, বিনিময় গ্রহণ করে কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করা জায়েজ নেই। যাদের নিয়তে দেওয়া-নেওয়া আছে, তাও বিনিময়ের হুকুমে হবে। এমতাবস্থায় শুধু তারাবি আদায় করাই ভালো। বিনিময়ের কোরআন শরিফ না শোনা উত্তম। কিয়ামুল লাইলের সাওয়াব শুধু তারাবি পড়লেই অর্জন হয়ে যাবে। (ফতোওয়া দারুল উলুম ৪/২৪৬)
৬. হজরত মাওলানা মুফতি শফী (রহ.) বলেন, ছোট ছোট সুরা দিয়ে তারাবি পড়ে নিন। বিনিময় দিয়ে কোরআন শুনবেন না। কারণ কোরআন শোনানোর মাধ্যমে বিনিময় গ্রহণ করা জায়েজ নেই। (জাওয়াহেরুল ফিকহ ১/৩৮২)
৭. তারাবিতে কোরআন পড়ার বিনিময় গ্রহণ করা জায়েজ নেই। দানকারী এবং গ্রহণকারী উভয়েই গোনাহগার হবে। যদি বিনিময়বিহীন কোরআন শোনানোর মতো হাফেজ পাওয়া না যায়, তবে ছোট ছোট সুরা দিয়ে তারাবি পড়ে নেওয়াই উত্তম। (ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া ৭/১৭১)
৮. খেদমতের নামে নগদ টাকা বা কাপড়চোপড় ইত্যাদি দেওয়াও বিনিময়ের মধ্যে শামিল। বরং তা বিনিময় ধার্য করা থেকেও জঘন্য। কারণ তাতে দুটি গোনাহ একত্রিত হয়। একটি কোরআনের বিনিময় গ্রহণের গোনাহ। দ্বিতীয়টি হলো, যে বিনিময় হচ্ছে তা না জানার গোনাহ। (আহসানুল ফতোওয়া ৩/৫১৪)
এ বিষয়ে বেরলভি সম্প্রদায়ের মতামত : বিশিষ্ট বেরলভি মুফতি আমজাদ আলী কাদেরী আজমী এক ফতোয়ায় লেখেন, বর্তমানে অধিক প্রচলন দেখা যায়, হাফেজ সাহেবকে বিনিময় দিয়ে তারাবি পড়া হয়। যা জায়েজ নেই। দানকারী ও গ্রহণকারী উভয়ই গোনাহগার হয়। এটুকু নেব বা এটুকু দেবে- এটিই শুধু বিনিময় নয়। বরং যদি জানা থাকে যে এখানে কিছু পাওয়া যায়, যদিও তা নির্দিষ্ট নয়, তা নাজায়েজ। কারণ জানা থাকাও শর্তকৃতের মতো। (বাহারে শরিয়ত ৪/৬৯২)
লা-মাজহাবি সম্প্রদায়ের ফতোয়া : লা-মাজহাবিদের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুর রহমান মোবারকপুরী লেখেন, ইমাম আহদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর কাছে বিনিময় নিয়ে তারাবি নামাজে ইমামতকারী ইমামের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি, সেরূপ ইমামের পেছনে কে বা কারা নামাজ আদায় করবে? আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক বলেন, আমি বিনিময় নিয়ে নামাজ পড়ানোকে মাকরূহ মনে করি এবং আমার ভয় হয়, ওই সব লোকের নামাজ আবার পড়তে হবে কি না, যারা এমন ইমামের পেছনে নামাজ আদায় করে। এরপর তিনি বলেন, আমার মত হলো, বিনিময় গ্রহণ করা যাবে না। (ফতোয়ায়ে নজিরিয়া ১/৬৪২)
* মাওলানা আব্দুল্লাহ আমরতসরী লেখেন, বিনিময়ের মাধ্যমে তারাবিতে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করা বা বিনিময় নির্ধারণ করা সম্পূর্ণ হারাম। বরং এরূপ লোকের পেছনে তারাবিও হয় না। (ফতোয়ায়ে আহলে হাদিস ২/৩০২)
এ আলোচনার পর স্পষ্ট হয়ে গেল, খতম তারাবি পড়িয়ে কোনো প্রকার বিনিময়-হাদিয়া লেনদেনের কোনো অবকাশ দ্বীন ইসলামে নেই। এটি পুরো উম্মতের দল-মত নির্বিশেষে ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত। সুতরাং এ ব্যাপারে অপরিণামদর্শী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন হীলা-বাহানার অবতারণা করে বিষয়টিকে জটিল করার কোনো সুযোগ আর বাকি থাকে না। আল্লাহ আমাদের সত্য বোঝা ও মানার তাওফিক দান করুন আমিন।
হাফেজদের প্রতি ভক্তি-ভালোবাসা ও তাদের খেদমত করার পদ্ধতি : তার পরও একটি বিষয় থেকে যায়, তাহলো মুসলমানগণের আবেগ, হাফেজদের মূল্যায়ন করা তাদের খেদমত করা, তা কিভাবে সম্ভব? মুসলমানদের এরূপ আবেগ, ভক্তি-ভালোবাসা থাকা স্বাভাবিক। কারণ পবিত্র কোরআনের হাফিজের অগণিত ফজিলত হাদিস শরিফে এসেছে। তাই হাফেজদের মূল্যায়ন করা, মুহাব্বত করা, তাদের যথাসম্ভব খেদমত করা সব মুসলমানের জন্য জরুরি বিষয়। শরিয়তে এরও পদ্ধতি ভিন্নভাবে আছে। রমজানসহ সারা বছর তাদের খিদমত করার সুযোগ আছে। যেমন ১. এ ক্ষেত্রে মুসলমানদের সর্বপ্রথম দ্বীনি দায়িত্ব হলো পবিত্র কোরআনের হাফিজকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসা ও ভক্তি করা। এই ভালোবাসা ও ভক্তি সব সময়ের জন্য, সারা বছরের জন্য। শুধু রমজানের জন্য সীমাবদ্ধ নয়। ২. পবিত্র কোরআন ও হাফেজে কোরআনের মুহাব্বত তখনই প্রকাশ পাবে, যদি অন্তরে নিজের সন্তানকে হাফেজে কোরআন বানানোর ইচ্ছা করা হয় এবং চেষ্টা করা হয়। ৩. রমজান মাসে যে হাফেজের পেছনে তারাবি পড়া হবে, তার খানাপিনার ক্ষেত্রে সর্বোন্নত ব্যবস্থা করা যায়। ৪. তাদের যাতায়াতের জন্য সবচেয়ে উন্নত গাড়ি ব্যবহার করা যায়। ৫. সারা বছর যারা পবিত্র কোরআন হিফজ করার কাজে নিয়োজিত, এরূপ ছাত্র-শিক্ষকদের যেকোনো খেদমত যেকোনো সময় আঞ্জাম দেওয়া যায়। নিজের সাধ্যমতো হাফেজদের খোঁজখবর রাখা, তাদের জরুরত পূরণ করা। তাদের খানাপিনার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
এভাবে হাফেজদের যথাযথ খিদমত আঞ্জাম দেওয়া ও আন্তরিক ভালোবাসা দিয়ে তাদের অভিভাবকত্ব করার ফজিলত অপরিসীম। আল্লাহ আমাদের বৈধ পদ্ধতিতে হাফেজদের যথাযথ মূল্যায়ন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
২) মৃত্য ব্যক্তির নামে কোরআন খতম কিংবা চল্লিশা করা যাবে কি? 

আমাদের সমাজে একটা রীতি প্রচলিত রয়েছে সেটা হলো- কোন ব্যক্তি যদি মারা যায়, তাহরের মারা যাওয়ার সাত দিনের পর অথবা মারা যাওয়ার পর প্রথম শুক্রবার আল কোরআনের হাফেজদের ডেকে কোরআন খতম করানো। এছাড়া মৃত্যুর চল্লিশ দিনের মাথায় বিশাল মজলিশের মাধ্যমে মেজবানের আয়োজন করা হয়। ইসলামে মূলত এগুলো জায়েজ আছে কিনা জানতে হলে নিচের বর্ণনাটি পড়ুন। মেজবান বলতে বোঝায় মানুষকে খাওয়ানো। লোকদের খাওয়ানো একটি ভালো কাজ। বুখারি শরিফের মধ্যে রাসুল (সা.) বলেছেন, এটি একটি আফতারুল ইসলাম, ইসলামের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কাজ। সুতরাং আপনি লোকদের খাওয়াইতে পারেন; কিন্তু সেখানে আনুষ্ঠানিকতা চার দিনে, ১০ দিনে, চল্লিশা ইত্যাদি করেন তাহলে আপনি সুন্নাহ পরিপন্থী কাজ করলেন। সে ক্ষেত্রে সওয়াব তো দূরের কথা, বেদাত হওয়ার কারণে আপনি বড় ধরনের কবিরা গুনাহর মধ্যে লিপ্ত হয়ে গেলেন। সুতরাং এ ধরনের কাজ করবেন না, তাহলে আমলও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একাধিক হাদিস দ্বারা এই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাই মেজবান বা চল্লিশা এ জাতীয় নাম না দিয়ে আপনি যেকোনো দিন আপনার সুবিধামতো আত্মীয়স্বজন বা গরিবদের খাওয়াতে পারেন, মৃত ব্যক্তিদের জন্য দোয়া করতে পারেন।
এরপর কোরআন খতম আপনি নিজে করবেন। কোরআন খতম করে মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করবেন। মৃত ব্যক্তির জন্য কোরআন খতম করার বিষয়টি রাসুলুল্লাহ (সা.) অথবা সাহাবিদের আমল দ্বারা সাব্যস্ত হয়নি। এটাও আমরা নিজেরাই আবিষ্কার করে নিয়েছি।
মৃত ব্যক্তির জন্য কোরআন খতম না করে কোরআন খতম আমরা নিজেরাই করব, তারপর আমরা লোকদের মেজবান খাওয়াব। আমরা মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে দান-খয়রাত করব, ছদকায়ে জারিয়া করব। আর বেশি বেশি করে মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করব। এটা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।

                               ----------------------------------------------------------------------------------

                              '' শুধু নিজে শিক্ষিত হলে হবেনা, প্রথমে বিবেকটাকে শিক্ষিত করুন। ''

ইসলামে মিলাদ পালন করা কি জায়েজ ?ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম দিবস,মৃত্যু দিবস পালন করা ?

১) ইসলামে মিলাদ পালন করা কি জায়েজ ?
আমাদের দেশে কিছু কিছু লোক আছে তারা মনে করে মিলাদ যদি পড়া না হয় তবে সুন্নাতের বড় একটা খেলাপ করে ফেলল।মনে রাখবেন, মূলত মিলাদ বর্তমানের কিছু মানুষের সৃষ্টি।রাসূল, সাহাবা,তাবেয়ী তাবে তাবেয়ী হতে কোন আমলে মিলাদ ছিলনা সেজন্য অনেকে মিলাদকে বিদআদ বলে থাকেন।আর মিলাদ আমাদের - বিশেষ করে উপমহাদেশে পালিত বা উদযাপিত হয় মূল আরবের কোথাও মিলাদের প্রচলন  নাই।
বাংলাদেশে মিলাদের সাথে পরিচিত নয় এমন লোকজন নেই বললেই চলে। এবং এই নিয়ে আমাদের মধ্যে চরম বিভ্রান্তি রয়েছে। কেউ এটাকে জাতিজ বলে আবার কেউ এটাকে নাজায়িজ বলে। আজ আমি এ সম্পর্কে সামান্য কিছু আলোচনা করব। 

মিলাদ এর শাব্দিক অর্থ হল জন্ম। মিলাদুন্নবী মাহফিল এর উদ্দেশ্য হল হুজুর সাঃ এর জীবন বৃত্তান্ত আলোচনা করা। মিলাদের উদ্দেশ্য এটাই হলে তবে হুজুর সাঃ এর জীবনী আলোচনা করে এবং এর শেষে দরুদ (আর সবচেয়ে বড় দুরুদ হচ্ছে দরুদে ইব্রাহীম) ও দোয়া করে নিলে তবে মিলাদ করা জায়িজ আছে।
নিশ্চয়ই আমি আপনাকে(হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে) সাক্ষী,সুসংবাদদাতা এবং সতর্ককারী হিসেবে পাঠিয়েছি যেন তোমরা আল্লাহ তায়ালার উপর এবং উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর ঈমান আনো এবং তোমরা উনার খিদমত করো ও উনার তাযীম-তাকরীম করো এবং উনার ছানা-ছিফত করো সকাল-সন্ধ্যা। (সূরা ফাতহ্: আয়াত ৮-৯) 

কিন্তু আমাদের দেশে মিলাদ ও কিয়াম সাধারনত যে নিয়মে করা হয় এবং আজগুবি কবিতা ''ইয়ানবী সালামু আলাইকা'' ধরনের শাব্দিক ও অর্থ গত ভুল দরুদ পড়া হয় তা আপত্তিকর ও কুরান হাদিসের নীতি বহির্ভুত। 

৬০৪ হিজরীতে ফাসিক বাদশাহ আবু সাঈদ মুযাফফরুদ্দীন , আবুল খাত্তাব ইবনে দিহইয়া নামক জৈনক দরবারী আলেম দ্বারা মিলাদ মাহফিলের ব্যাবস্থা করেন। 
আল্লামা আব্দুর রহমান রহঃ প্রচলিত মিলাদ কে বিদয়াত বলেন। খোলাফায়ে রাশেদিন , সাহাবাগন রাঃ আইম্মায়ে মুজতাহিদগন তা করেন নি।(প্রমান আশশিরাতুল ইলাহিয়া ২৫৩ পৃ) 
আল্লামা আহমদ বিন মুহাম্মদ মিসরী রহঃ লিখেন মাযহাব চারের ইমামগন মিলাদ মাহফিলের জঘন্যতার উপরে একমত পোষন করেন। (প্রমানঃ রাহে সুন্নাত ২৫৩ পৃ) 
''
যদি কেউ আমার এই দ্বিনের মধ্যে এমন কিছু আবিষ্কার করতঃ অনুপ্রবেশ করায় তাহলে সে কাজ হবে প্রত্যাখ্যাত। কিছুতেই তা গ্রাহ্য হবেনা'' (বুখারী ও মুসলিমঃ মিশকাত শরীফ ২৭ পৃ) 
উল্লেখ্য মিলাদে কিয়াম করা শিরক ও নাজায়িজ। 
তবে প্রচলিত পন্থা ছাড়া কেউ মিলাদ পড়াতে চাইলে নিয়ম এই যে, কোন একজন হক্কানী আলেম রসুল সাঃ এর জীবনী নিয়ে আলোচনা করবেন এবং দরুদ পড়ার ফযীলত বলবেন এবং সবাই মহব্বতের সহিত দরুদ পড়বে। পরিশেষে আলেম সাহেব সবাই কে নিয়ে দোয়া করবেন। 
(
প্রমানঃ মিশকাত ২৭, ৪০৩, ওয়াফ্যাতুল আয়ান ৪ঃ১১৭ইতেসাম ১;১১৪, মজলিসে আবরার ২১৩ ফাতয়াওয়ায়ে রাহিমীয়া ২;২৮৩মুসলিম শরীফ ২;৭৭, আবু দাউদ শরীফ ২;৭১০) 

আমার এবং হক্কানী আলেমদের মতঃ 
ইয়া নবী সালামু আলাইকা- এখানে যে "ইয়া" শব্দটা বলা হয় সেটা তখনি বলা হয় যখন কেউ উপস্থিত থাকে কিন্তু নবী করিম (সাঃ) এর সাথে এই ইয়া বলে বেদাতিরা বেয়াদবি করে। কারন নবী (সাঃ) কে তারা হাজির নাজির বলে। হতচ আল্লাহ ছাড়া কেউই হাজির নাজির নয়। রাসূল (সাঃ) এর কি এত সম্মান কম (নাউযুবিল্লাহ্‌) যে ওনি সৌদি থেকে মিলাদ শোনার জন্য বাংলাদেশে আসবেন? 

আর যারা কিয়াম করে, তারা তাদের কিয়ামের অল্প সময় শুধু দাঁড়িয়ে থাকে আর বাকি সময় বসে থাকে। রাসূল কে সম্মান জানাতে হলে তো সারাক্ষন দাঁড়িয়ে থাকত। তাইনা? 

যাদের সামান্য জ্ঞান বুদ্ধি আছে তারা এইসব পাগলামী করবে না। 

২) ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম দিবস,মৃত্যু দিবস পালন করা ?
কেউ মারাগেলে ৭দিনে বা ৪০ দিনে মিলাদ মাহফিল ও দোয়া খায়ের করা হয় এবং পোলাও ও রুটির ব্যবস্থা করা হয় তাবারক হিসাবে। ইসলামে এর গুরুত্ব কতটুকু?

উত্তরঃ- এটি সম্পুর্ন একটি বিদআতী কাজ। ইসলামে এই রকম কোন কাজের প্রমাণ নেই। সুত্রঃ-(সুরা বাকারা ৪১ নং আয়াত,তাফসিরুল মারেফুল কুরআন)মৃত ব্যক্তির স্বরণে যে দিবস পালন করা হয় তাকেই শোক দিবস বলা হয়। শোক দিবস পালন করা ইসলামের দৃষ্টিতে নাযায়েজ ও হারাম।
আসুন মিলাদ এবং ঈদে মিলাদুন্নবীর ইতিহাস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। অতঃপর সিদ্ধান্ত নেই কোনটা সঠিক এবং বেঠিক। ইতিহাস না জানলে এই সিদ্ধান্তে আসা বড়ই কষ্টকর।আমাদের সমাজে বিদআত এমন ভাবে ঢুকে গেছে যে তার বিরূদ্ধে কথা বললে আলিম সমাজ অমুসলিমবলে গালি দিতে এবং ইসলাম থেকে খারিজকরতে ডানে বায়ে তাকায় না। এসব বিদআত শরীরে টিউমারের মতো জেগে উঠেছে আর আমাদের আলিম সমাজ এসকল টিউমার অপারেশনের পরিবর্তে স্বাস্থ্যের অংশ বলে প্রচার প্রসার করে বেড়াচ্ছেন, আর সাধারন মুসলমানগণ ভাবছেন আরে তাইতো, নিশ্চই টিউমার সুস্বাস্থের অংশ!!
আল কুরআনের কোন আয়াত বা কোন হাদীস দ্বারা কারো জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালনের কোনই প্রমাণ পাওয়া যায় না।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে যাঁর সবচেয়ে বেশী ভালোবাসতেন সে সব সাহাবাগণ বিশ্বনবী (সাঃ) এর জীবিতকালে অথবা তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর জন্ম বা মৃত্যু বার্ষিকী পালন করেননি। এমনকি রাসূল (সাঃ) এর একমাত্র পূত্র ইবরাহীম ছাড়া বাকী পুত্রগণ তাদের জন্মের এক বছরের মধ্যেই মারা যায়। শুধু মাত্র ইবরাহীম ষোল মাস বয়সে মারা যায়। এজন্য নাবী (সাঃ) এতই দুঃখিত হন যে, তাঁর চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত) কিন্তু এই আদরের ছেলেটির জন্মের দ্বিতীয় বছরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার মৃত্যুঅথবা জন্মোৎসব পালন করেননি।
ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম দিবস,মৃত্যু দিবস পালন করা এবং এ উপলক্ষে যে সমস্ত আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করা হয় তা হারাম এবং বিদআত। জন্ম দিবস এবং মৃত্যু দিবস পালনের কোন প্রমাণ কিংবা চর্চা রাসুল সা. কিংবা তাঁর সাহাবী (রাঃ) দের মাধ্যমে হয়েছিল বলে কোন প্রমাণ নাই।
ইসলামে সকল হুকুম আহকাম, আচার-অনুষ্ঠান সুনির্ধারিত ও কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস দ্বারা প্রমাণিত।কিন্তু নবী কারীম সা.এর জন্ম দিবস,মৃত্যু দিবস পালনের কথা কোথাও নেই। এমনকি নবী প্রেমের নজীরবিহীর দৃষ্টান স্থাপনকারি সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমদের কেহ এ ধরনের কাজ করেছেন বলে কোন প্রমাণ নেই।
ইসলামে কম হলেও একলাখ চব্বিশ হাজার নবী, তারপরে খুলাফায়ে রাশেদীন ও অসংখ্য সাহাবা, মনীষি আওলিয়ায়ে কেরাম জন্ম গ্রহণ করেছেন ও ইন্তেকাল করেছেন। যদি তাদের জন্ম বা মৃত্যু দিবস পালন ইসলাম সমর্থিত হত বা সওয়াবের কাজ হত তাহলে বছরব্যাপী জন্ম-মৃত্যু দিবস পালনে ঘূর্ণাবর্তে আবদ্ধ হয়ে যেতে হত আমাদের সকল মুলমানদের।
রাসূলুল্লাহ সা. এর সাহাবাগন ছিলেন সত্যিকারার্থে নবীপ্রেমিক ও সর্বোত্তম অনুসারী। নবী প্রেমের নজীর ও দৃষ্টান্ত তারাই স্থাপন করেছেন। তারা কখনো নবী কারীম সা. এর জন্মদিনে অনুষ্ঠান পালন করেননি। যদি এটা করা ভাল হত ও মহব্বতের পরিচায়ক হত তবে তারা তা অবশ্যই করতেন। আর জন্মোৎসব পালন করার কালচার সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা ছিল না তা বলা যায় না। কেননা তাদের সামনেই তো খৃষ্টানরা ঈসা আলাইহিস সালাম-এর জন্মদিন ( বড়দিন) উদযাপন করত।
তাছাড়া নবী কারীম সা. এর জন্মদিন পালনের প্রস্তাব সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। যেমন হিজরী ক্যালেন্ডার প্রবর্তিত হওয়া সময় উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে বৈঠকে বসলেন। কোন এক স্মরনীয় ঘটনার দিন থেকে একটি নতুন বর্ষগণনা পদ্ধতি প্রবর্তন করা হবে বলে সিদ্ধান- নেয়া হয়। কেউ কেউ প্রস্তাব করলেন রাসূলুল্লাহ সা. এর জন্ম তারিখ থেকে সন গণনা শুরু করা যেতে পারে। উমর রাঃ এ প্রস্তাব বাতিল করে দিয়ে বললেন যে এ পদ্ধতি খৃষ্টানদের। উমার রাঃ এর এ সিদ্ধানে-র সাথে সকল সাহাবায়ে কেরাম একমত পোষণ করলেন। এবং রাসূলে কারীম সা. এর হিজরত থেকে ইসলামী সন গণনা আরম্ভ করলেন।
যেহেতু রাসুল সা. এর জন্ম দিবস এবং মৃত্যু দিবস পালন করা জায়েয নয় সেহেতু অন্য কারো জন্মদিসবস,মৃত্যু দিবস পালন করা শরিয়ত সম্মত নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এগুলো ধর্মের নামে চালু করা হয়েছে কিন্তু এসব আনুস্থানিকতা পালনে ইসলামের কোন সমর্থন নেই।আমাদের সমাজে সমাজে পিতা-মাতা, দাদা-দাদী সন্তান-সন্ততি,নেতা নেত্রীর জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী নানা আনুস্থানিকতা এবং অত্যন্ত জমজমাট ভাবে পালন করা হয়ে থাকে।সেখানে অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে বিশাল খাবার-দাবারের আয়োজন ও অন্যান্য আনুস্থানিকতা করা হয়ে থাকে,কিন্তু আমরা কজনে জানি বা জানার চেষ্টা করি যে,জন্ম বার্ষিকী এবং মৃত্যুবার্ষিকী আনন্দ উৎসব বা শোক পালন করা ইসলামি চেতনার পরিপন্থি।
জন্ম দিবস বা মৃত্যু দিবস কেন্দ্রিক আচার অনুষ্ঠান খৃষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য অমুসলিমদের ধর্মীয়রীতি।তাই এটা মুসলিমদের জন্য পরিত্যাজ্য। বিধর্মীদের ধর্মীয় রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান যতই ভাল দেখা যাক না কখনো তা মুসলিমদের জন্য গ্রহণ করা জায়েয নয়।
রাসূলে কারীম সা. বলেছেন – “যে ব্যক্তি কোন জাতির সাদৃশ্যতা গ্রহণ করবে সে তাদের অনর্ভূক্ত বলে গণ্য হবে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জীবিতকালে ওয়াহী দিবস, কুরআন নাযিল দিবস, পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম (আঃ) এর জন্ম বা মৃত্যু দিবস, মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম (আঃ) এর জন্ম বা মৃত্যু দিবস এসেছে কিন্তু রাসূল (সাঃ) এভাবে কোন নবীর স্মরণে বা কোন সাহাবার শাহাদাত দিবস অথবা কোন জিহাদের দিবস পালন করেন নাই এবং নির্দেশও দেন নাই। বরং তিনি বলে গেছেন , আমার পরে আমার শরীআতের মধ্যে যে সকল নতুন কাজকর্ম আবিষ্কার হবে, আমি তা হতে সম্পর্কহীন এবং ঐ সকল কাজকর্ম মারদূদ পরিত্যাজ্য ও ভ্রষ্ট। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত) তাই মীলাদুন্নবী ও মৃত্যুবার্ষিকী কিংবা কোন জীবিত ও মৃত ব্যক্তির জন্মবার্ষিকী বা মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা কুরআন ও হাদীসের দৃষ্টিতে বিদআত তথা মনগড়া কাজ। আর ইতিহাসের দৃষ্টিতে ইয়াহুদী, খৃষ্টান ও অগ্নিপুজকদের অন্ধ অনুসরণ তথা ইসলাম বিরোধী কাজ। আর এসব জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকী পালন কার তো বৈধ নয়ই বরং এগুলো থেকে অবশ্যই বিরত থাকা জরুরী।
মীলাদঃ পাক ভারত ও বাংলার মুসলিম সমাজে প্রচলিত ও সবচেয়ে আকর্ষনীয় এবং ব্যাপকভাবে পালনীয় অনুষ্ঠানটি হচ্ছে মীলাদ মাহফিল ও মীলাদুন্নবী দিবস। কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজের সূচনায় মীলাদ যেন অপরিহার্য এবং মহা ধুমধামে ঈদে মীলাদুন্নবী উৎসব পালন করা যেন বিরাট সাওয়াবের কাজ। অথচ এই মীলাদ এর কথা মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ও রাসুলূল্লা (সাঃ) এর হাদীস কোনটিতেই নেই। অথবা মীলাদ কোন সাহাবী, তাবিঈ, তাবি তাবিঈ, কোন ইমাম করেছেন বা করতে বলেছেন তার কোন দলীল প্রমান ও নাই। এটা কোন নির্ভরযোগ্য আলিমের দ্বারাও চালু হয়নি। এমনকি যারা এর ধারক বাহক হয়ে সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত নবী প্রেমের নামে এই মীলদ বা ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করে আসছেন তারাও স্বীকার করে থাকেন যে, এটার কোন দলীল নাই। মীলাদ চালু হয়েছে রাজা বাদশাহ বা স্বল্প শিক্ষিত সুফীদের দ্বারা। তাই সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত নবী প্রেমের নামে এই মীলাদ বা ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করা ইসলামরে কোন অংশ নয়। বরং এটা ধর্মের নামে নবআবিষ্কৃত বিদআত। তাই এখানে মীলাদুন্নবী ও মীলাদের সূচনা, তার ইতিহাস, মীলাদ ও কিয়ামের নামে যে সব শিরকী ও বিদআতী কাজ হচ্ছে এবং এ সম্পর্কে হানাফী আলিমদের সহ বিখ্যাত জ্ঞাণী-গুণীদের মন্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। যেন সমাজে প্রচলিত এসব বিদআত থেকে জাতি মুক্ত হতে পারে।
মীলাদ ও ঈদে মীলাদুন্নবীর অর্থঃ আরবী মীলাদশব্দের অর্থ জন্মের সময়- (আল-কামূস ১ম খন্ড, ২১৫ পৃঃ, নওলকিশোর ছাপা, মিসবা-হুল লুগা-ত ৯৫৪ পৃঃ, ৫ম খন্ড সংস্করণ, দিল্লী ছাপা)।
এবং ঈদে মীলাদুন্নবীর অর্থ হচ্ছে নাবীর জন্মদিনের আনন্দোৎসব। বর্তমানে ১২ই রবিউল আউয়ালকে ঈদে মীলাদুন্নবী অর্থাৎ নাবী (সাঃ) এর জন্মের আনন্দ উৎসব দিবস বলে জোর প্রচার করা হচ্ছে। যদিও রাসূল (সাঃ) এর জন্ম দিবস নিয়ে বিভিন্ন রকম মত আছে তার মধ্যে ১২ই রবিউল আউয়ালের মত হচ্ছে অন্যান্য মতের তুলনায় দুর্বল। এ সম্পর্কে সামনে আলোচনা করা হয়েছে।
মীলাদ ও মীলাদুন্নবীর ইতিহাসঃ নাবী (সাঃ) এর সময়, খুলাফায়ে রাশেদীনদের সময় বা উমাইয়া খলিফাদের যুগে এগুলো ছিল না। এর বীজ বপন করে আব্বাসীয় খলিফাদের যুগে জনৈক মহিলা। মাদীনাহ শরীফে প্রিয় নাবী (সাঃ) এর রওযা মোবারক যিয়ারত করার ও সেখানে দুআ করার যে ব্যবস্থা রয়েছে ঠিক সেভাবে আল্লাহর নাবী (সাঃ) মক্কায় যে ঘরে ভূমিষ্ট হয়েছিলেন সেই ঘরটির যিয়ারত ও সেখানে দুআ করার প্রথা সর্বপ্রথম চালু করেন বাদশাহ হারুনুর রশিদের মা খায়যুরান বিবি (মৃত্যু ১৭৩ হিজরী ৭৮৯ ঈসায়ী) পরবর্তীকালে ১২ই রবিউল আউয়ালকে আল্লাহর নাবী (সাঃ) এর জন্ম ও মৃত্যু দিবস ধরে নিয়ে তীর্থ যাত্রীগন ঐ ঘরে এসে দুআ করা ছাড়াও বারকাতের আশায় ভূমিষ্ট হওয়ার স্থানটি স্পর্শ ও চুম্বন করতো। (ইবনু জুবায়ের ১১৪, ৬৩ পৃঃ ও আল-বাতালুনী ৩৪ পৃঃ) এখানে ব্যক্তিগত যিয়ারত ছাড়াও একটি উৎসব অনুষ্ঠিত হতো। তা ইবনু জুবাইরের (মৃত্যু ৬১৪ হিঃ) গ্রন্থের ১১৪ ও ১১৫ পৃষ্ঠায় প্রথম জানা যায়।
অতঃপর হিজরীয় চতুর্থ শতকে উবাইদ নামে এক ইয়াহুদী ইসলাম গ্রহণ করে। তার নাম রাখা হয় উবাইদুল্লাহ। তিনি নিজেকে ফা-তিমাহ (রাঃ) এর সম্ভ্রান্ত বংশধর বলে দাবী করেন এবং মাহদী উপাধি ধারণ করেন। এঁরই প্রপৌত্র (পৌত্রের ছেলে) মুয়িব লিদীনিল্লাহ ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের জন্মবার্ষিকীর অনুকরণে ছয় রকম জন্মবার্ষিকী ইসলামে আমদানী করেন এবং মিশরের ফাতিমী শিয়া শাসকরা মুসলিমদের মধ্যে জন্মবার্ষিকী পালনের রীতি চালু করেন। এই ফাতিমী শিয়া খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা আবূ মুহাম্মাদ ইবাইদুল্লাহ ইবনু মায়মূন প্রথমে ইয়হূদী ছিলেন- (আল বিদা-য়াহ আননিহাইয়া একাদশ ১৭২ পৃঃ) কারো মতে তিনি ছিলেন অগ্নিপূজারী- (মাকরিজীর আল খুতাত আল আ-সার ১ম খন্ড ৪৮ পৃঃ) ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, মিশরের ফিরআউন জন্মোৎসব পালন করতেন- (ফাতা-ওয়া নাযীরিয়্যাহ ১ম খন্ড, ১৯৯ পৃঃ) ফিরআউন ছিল ইয়াহুদী। তারপর ঐ ইয়হুদী রীতি খৃষ্টানদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়। ফলে তারা তাদের নাবী ঈসা (আঃ)- এর পন্মবার্ষিকী ক্রিসমাস ডেপালন করতে থাকে।
মুসলিমদের মাঝে এই জন্মবার্ষিকী রীতি চালু হওযার একশ তিন বছর পর অর্থাৎ ৪৬৫ হিজরীতে আফজাল ইবনু আমীরুল জাইশ মিশরের ক্ষমতা দখল করে রাসূল (সাঃ), আলী (রাঃ), ফাতিমাহ (রাঃ), হাসান (রাঃ), হোসেন (রাঃ)- এর নাম সহ প্রচলিত ছয়টি জন্মবার্ষিকী পালনের রীতি বাতিল করে দেন। (মিশরের মুফতী শায়খ মুহাম্মাদ রচিত আহসানউল কালা-ম ফী মাইয়্যাতা আল্লাকু বিস সুন্নাতি অল বিদআতী মিনাল আহকাম, ৪৪-৪৫ পৃঃ বরাতে তাম্মিহু উলিল আবসা-রা ইলা কামা লিদ্দিন আমা ফিল বিদআয়ী মিনাল আখতা-র ২৩০পৃঃ) এর পর ত্রিশ বছর বন্ধ থাকার পর ফাতিমী শিয়া খলিফা আমির বি-আহকা-মিল্লা-হ পুনরায় এই প্রথা চালু করেন। তখন থেকেই জন্মবার্ষিকী পালনের রীতি চালূ হয়ে এখনও চলছে। (ঐ ২৩০-২৩১ পৃঃ)
ঐতিহাসিক অন্যান্য বর্ণনা থেকে জানা জায়, জন্মবার্ষিকী পালনের এই রীতি ঐ মীলাদ প্রথা খালিফা মুস্তালি বিল্লাহর প্রধান মন্ত্রী বদল আল জামালী বাতিল করে দেয়। এবং তার মৃত্যুর পর পুনরায় চালূ হলে পরবর্তীতে কুরআন-হাদীসের অনুসারী সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ূবী এই সব জন্মবার্ষিকী ও মীলাদ প্রথা বাতিল করে দেন। কিন্তু সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ূবীর ভগ্নিপতি আরবিলের শাসনকর্তা মুজাফফরউদ্দিন ছাড়া কেউ এর বিরোধিতা করেন নাই। ঐতিহাসিকরা বলেন যে, বাদশাহ মোজাফফারউদ্দিনের মীলাদ মাহফিল গুলোতে নামধারী সুফীরা উপস্থিত হন এবং এই মাহফিল ফজর থেকে যোহর পর্যন্ত চলত। বাদশাহ এই মীলাদের জন্য তিনলক্ষ স্বর্ণমুদ্রারও অধিক বেশী খরচ করতেন। (মাকরিজীর আল খুতাত ১ম খন্ড ৪৯০ পৃঃ, মিরআতুয জামা-ন ফী তা-রিখীল আইয়্যান ৮ম খন্ড ৩১০ পৃঃ, পূর্বোক্ত তানবিহু উলিল আবসা-র ৩২ পৃঃ)
সুন্নীদের মাঝেও মীলাদুন্নবী ঢুকে প্রড়। তাই শাইখ ওমার ইবনু মুহাম্মাদ মোল্লা নামে এক প্রসিদ্ধ সৎব্যক্তি মুসিলে মীলাদুন্নবী করে ফেলেন এরই অনুসরণ করেন ইরবিলের শাসনকর্তা মুজাফফরউদ্দিন- (কিতাবুল বা-য়িস আলা ইনকা-রিল-বিদায়ী আল হাওয়া-দিস ৯৬ পৃঃ) মোল্লা ওমার ইবনু মুহাম্মাদ মুসিলের বাসিন্দা ছিলেন। আর ইরবিল মুসিলেরই নিকটবর্তী এলাকা ছিল। তাই আনুমানিক ৬০৪ হিজরীতে সুন্নীদের মধ্যে মীলাদুন্নবীর সূত্রপাত হয়। অতঃপর ইরবিলের শাসনকর্তা মুজাফফর উদ্দিন তা ধূমধামের সাথে মানতে থাকে। এমন সময় স্পেনের এক ইসলামী বিদ্বান আবুল খাত্তা-ব ওমার ইবনুল হাসান ইবনু দিহইয়াহ মরক্কো ও আফ্রিকা, শিসর ও সিরিয়া, ইরাক ও খোরাসান প্রভৃতি দেশ ঘুরতে ঘুরতে ৬০৪ হিজরীতে ইরবিলে প্রবেশ করেন এবং বাদশাহ মুজাফফার উদ্দিনকে মীলাদুন্নবী পালনের ভক্ত হিসাবে দেখতে পান। তাই তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মীলাদ সম্পর্কে একটি বই লেখেন- কিতাবুত তানভীল ফি মাওলিদিস সিরাজিল মুনীরনামে। অতঃপর তিনি এটাকে ৬২৬ হিজরীতে ছটি মাসলিসে বাদশাহ মুজাফফর উদ্দিীনের নিকট পড়ে শোনান। বাদশাহ তাতে সন্তুষ্ট হতে তাঁকে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা দান করেন- (আফাইয়া-তুল আয়া-ন ৩য় খন্ড, ১২২ পৃঃ) ফলে মুসীম জাহানের বিভিন্ন দেশে জন্মবার্ষিকী পালনের রীতি ছড়িয়ে পড়ে। তাই মরক্কোবাসীরা এই মীলাদের নাম দিয়েছেন মাওসমআলজেরিয়াবাসিীরা এর নাম দিয়েছে যারদাহমিশর ও মধ্যপ্রাচ্য বাসীরা এর নাম দেয় মাওলিদ(আলইনসা-ফ ফীমা কীলা ফিল মাওলিদ মিনাল গুলুয়ে আলইজহা-ফ ২৭ পৃঃ)
আর ভারতীয় উপমহাদেশে মীলাদুন্নবী আমদানীকারীরা ছিল শিয়া। যেমন ইসলামের মধ্যে প্রথম মীলাদ আমদানীকারক ছিল শিয়া খলীফা মুয়ীয লিদীনিল্লাহ। ভারতের মোঘল সম্রাটদের কিছু মন্ত্রী ও পরামর্শদাতা ছিল শিয়া।যেমন মোঘল সম্রাট হুমায়ূন ও সম্রাট আকবরের মা শিয়া ছিল। আকবরের অভিভাবক বৈরাম খাঁ কট্টর শিয়া ছিরেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাষ্ট্রদূত শিয়া ছিলেন। বাদশাহ বাহদুর শাহ শিয়া ছিলেন। তাঁরাই এই উপমহাদেশে সুন্নীদের মধ্যে মীলাদুন্নবীর চলন করে দেন। ফলে ফিয়া- মীলাদুন্নবীর আনুষঙ্গিক ব্যাপারগুলো সুন্নীদের মধ্যে প্রচলিত হয়ে পড়ে। যেমন- আলোকসজ্জা ও মিছিল প্রভৃতি। (শায়খ আইনুল বারী আলিয়াবীর কর্তৃক রচিত মীলাদুন্নবী ও বিভিন্ন বার্ষিকীপুস্তকের ৩৩ পৃঃ)
অন্য র্বনা থেকে জানা যায় যে, মীলদ পাঠের নিয়ম ৫৯০ হিজরী সনে বরকুক সুলতান ফরাহ ইবনু নসরের যুগে প্রচলিত হয়। তিনি খুব আরামপ্রিয় সুলতান ছিলেন। শরীআতের কড়াকড়ি নির্দেশ তিনি মেনে চলতেন না। সামান্য কাজে কিভাবে বেশী সাওয়াব পাওয়া যায় তিনি এরূপ কাজের অনুসন্ধান করতেন। অবশেষে শাফিঈ মাযহাবের এক বিদআতী পীর প্রচলিত মীলাদ পাঠের পদ্ধতি আবিস্কার করে সুলতানকে উপহার দেন। সুলতান বড় সাওয়াবের কাজ মনে করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ধর্ম পালনের নামে মীলাদ পাঠের ব্যবস্থা চালূ করেন। সেখান থেকেই প্রচলিত মীলাদের উদ্ভব ঘটে।
এই মীলাদের পূর্ণ বিবরণ পরবর্তীকালে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনু খাল্লিকান (৬৮১ হিজরী) তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তারপর জালালুদ্দীন আস-সয়ূতী (মৃত্যু ৯১১ হিজরী) তাঁর হুসনুল মুহাযরা ফী আমালিল মাওয়ালীদ গ্রন্থে ইবনু খাল্লিকানের লেখার উপর নির্ভর করে মীলাদের বিবরণ পেশ করেছেন। সুলতান মুজাফফরউদ্দীন যে মীলাদ চালু করেছিলেন তাতে যথেষ্ট খৃস্টীয় প্রভাব বিদ্যমান ছিল। কারণ সে সময় ক্রুসেড যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ সৈন্য সিরিয়া, জেরুজালেম প্রভৃতি এলাকায় আগমণ করেছিল। তারা যীশুখৃষ্টের জন্মদিন পালন করতো। এসব দেখে শুনে সুলতান মুজাফফরউদ্দীনের মনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্ম দিবস তথা মীলাদের অনুষ্ঠান করার প্রেরণা পেগে উঠে। সুফীদের সাথে যোযোগ রেখে তিনি ৪টি খানকাহ নির্মাণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ইনতে কালের প্রায় ৪০০ বছর পর খৃস্টানদের মধ্যস্থতায় প্লাটিনাসের নূরের মতবাদ ইসলামের হিকামাতুল ইরাব বা ফালাসাফাতুল ইসলাহ নামে ইসলামী লেবাসে প্রথমে সুফিদের মধ্যে ও পরে মীলাদের মাধ্যমে ইসলামে প্রবেশ লাভ করে।
এছাড়াও মীলদের ইতিহাস সম্পর্কে প্রখ্যাত হানাফী আলিম ও বহু গ্রন্থের প্রণেতা মরহুম মাওলানা আঃ রহীম তার সুন্নত ও বিদআত বইয়ের ২২৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ মীলাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস হলোঃ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর মৃত্যুর ২০০ বছর পর এমন এক বাদশাহ প্রচলন করেন যাকে ইতিহাসে ফাসিক ব্যক্তি কলে উল্লেখ করা হয়েছে। জামে আজহারের শিক্ষক ডঃ আহমদ শারবাকী লিখেছেনঃ ৪০০ হিজরীতে ফাতিমী শাসকরা মিশরে এর প্রচলন করেন। একথাও বলা হয় যে শাইখ ইবনু মুহাম্মদ নামক এক ব্যক্তি ইরাকের মুসিল শহরে এর প্রচলন করেছেন। পরে আল মুজাফফর আবূ সাঈদ বাদশা ইরাকের ইরবিল শহরে মীলাদ চালু করেন। ইবনু দাহইয়া এ বিষয়ে একখানা কিতাব লিখে তাকে দেন। বাদশাহ তাকে এক হাজার দীনার পুরস্কার দেন- ( ইয়াসআলুনাকা আনিদ-দীনি ওয়াল হায়া-হ ১ম খন্ড ৪৭১ পৃঃ)
এই মীলাদুন্নবী ও মীলাদ-এর ইতিহাস থেকে জানা যাচ্ছে যে এগুলো কুরআন ও হাদীস সমর্থিত নয় বরং ইয়াহুদী, খৃষ্টা ও অগ্নিপূজকদের রীতি অনুকরণ ও অনুসরণ। আর অন্য জাতীর সাদৃশ্য গ্রহণ সম্পর্কে বিশ্বনাবী (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য গ্রহণ করে সে তার দলভূক্ত হয়ে থাকে। (আবূ দাউদ ২ং খন্ড ২৩০ পৃঃ, মুসনাদে আহমাদ ২য় খন্ড ৫০ ও ৯২ পৃঃ, মিশকাত ৩৭৫ পৃঃ)
অন্যান্য বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, সে আমাদের দলের নয় যে ব্যক্তি আমাদের ছাড়া অণ্যের সাদৃশ্য গ্রহণ করে।তোমরা ইয়াহুদীদের সাদৃশ্য গ্রহণ কর না এবং খৃষ্টানদেরও না। (তিরমিযী ২য় খন্ড ৫৪ পৃঃ, মিশকাত ৩৯৯ পৃঃ) অতএব মহানবী (সাঃ) এর প্রতি যদি সত্যই কারো ভালোবাসা থেকে থাকে তাহলে তাঁর উক্ত হাদীস দুটি জানার পর ইহুদী-খৃষ্টান ও অগ্নিপূজারীদের সাদৃশ্য গ্রহণ করে কোন মুমিন মুসলিম মীলাদুন্নবী, জন্মবাষিকী ও আলোকসজ্জা প্রভৃতি অনৈসলামিক কাজ করতে পারে না। এবং এই ধরনের বিদআতি কাজ কারার জন্য যারা উৎসাহ ও প্ররচনা দিয়ে থাকে তারা কেউই সহীহ হাদীস পেশ করতে পারেন না। কেহ বা বলে থাকেন কোরআনে অনেক ঈদকরার কথা বলা আছে যা ঈদে মীলাদুন্নবীর ইঙ্গিত। এগুলো হচ্ছে সরল মুসলিমদের ধোকা দিয়ে তাদের ঘোর অন্ধকারে রাখা এবং জনমত সৃষ্টি করা এক কথায় দল ভারী করা এবং ভারী দল দেখিয়ে বলা যে আমরা এতোগুলো মানুষ কি ভুল করছি?” সর্বদা মনে রাখতে হবে যে সত্য যদি একজনও বলে সেটা সব সময়ের জন্যই সত্য।
ঐতিহাসিকভাবে রাসুলূল্লাহ (সাঃ) এর জন্ম তারিখ কোনটি?
ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলোর ভিত্তিতে অধিকাংশের মতে মহানবী (সাঃ) এর জন্ম মাস রবিউল আউয়াল মাস। আল্লামা ইবনুল জওযী বলেন, অধিকাংশ বিদ্বানের ঐক্যমতে রাসূল (সাঃ) এর জন্ম রবিউল আউয়াল মাসে- (সীরাতুল মুস্তফা ১ খন্ড, ৫১ পৃঃ ২নং টীকা) তবে জন্ম তারিখের ব্যাপারে মতভেদ আছে যেমন এ ব্যাপারে আটটি উক্তি আছে। যথা-
(
১) ২, ,১০, ১২ ও ১৩ ই রবিউল আউয়াল। (সিফাতুস সফঅহ ১ম খন্ড, ১৪ পৃঃ, আলঅফা বি-আহওয়া-লিল মুস্তফার উর্দু তর্জমা সীরাতে সাইয়িদুল আম্বিয়া ১১৭ পৃঃ)
(
২) মুসান্নাফ ইবনু শাইবায় জাবির ও ইবনু আব্বাস থেকে বর্ণিত ১৮ই রবিউল আউয়াল। (আল বিদা-য়াহ আননিহা-য়াহ ২য় খন্ড ২৪২ পৃঃ)
(
৩) ১ লা রবিউল আউয়াল। (আলইস্তীআ-ব ১৩ পৃঃ)
(
৪) ইবনু হিশাম বলেন, আল্লামা তাবারী ও ইবনু খালদূনও বলেন ১২ই রবিউল আউয়াল। (তাহযীবু সীরাতে ইবনু হিশাম ৩৬ পৃঃ) (তারিখুল উমাম অলমুলক ১ম খন্ড, ৫৭১ পৃঃ,)
(
৫) আল্লামা ইবনু আব্দিল বার ২রা রবিউল আউয়াল বলা সত্বেও বলেন যে, ঐতিহাসিকগণ ৮ই রবিউল আউয়ালের সোমবারকেই সঠিক বলেছেন। (আলইস্তীআ-ব ১৪ পৃঃ)
(
৬) ইবনু সাদ বলেন, আবূ জাফর মুহাম্মাদ ইবনু আলীর মতে ১০ই রবিউল আউয়াল এবং আবূ মাশার নাজীহ মাদানীর মতে ২রা রবিউল আউয়াল সোমবার। (তাবাকাতে ইবনু সাদ ১ম খন্ড ৮০, ৮১ পৃঃ)
(
৭) কনষ্টান্টিনোপলের বিখ্যাত জোতির্বিদ মাহমূদ পাশা তাঁর যুগ থেকে মুহাম্মাদ (সাঃ) পর্যন্ত ক্যালেন্ডার ঘেটে প্রমাণ করেছেন সোমবারদিনটি ১২ই রবিউল আউয়ালে কোন মতেই পড়ে না। বরং তা ৯ই রবিউল আউয়ালেই সঠিক হয়। এজন্য সঠিক বর্ণনা ও জ্যোতির্বিদদের গণনা হতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্ম দিনের নির্ভর যোগ্য তারিখ ৯ই রবিউল আউয়াল। (কাসাসুল কুরআন ৪র্থ খন্ড, ২৫৩-২৫৪ পৃঃ)
(
৮) হাদীস ও ইতিহাসের বহু মহাবিদ্বান- যেমন আল্লামা হুমাইদী, ইমাম ইবনু হাযম, ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ, ইবনুল কাইয়িম, ইবনু কাসীর, ইবনু হাজার আসকালানী ও বাদরুদ্দীন আইনি প্রমুখের মতে ৯ই রবিউল আউয়াল সোমবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্ম দিন। (কাসাসুল কুরআন ৪র্থ খন্ড, ২৫৩ পৃষ্ঠা) সমস্ত বর্ণনা প্রমান করে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্ম ক্ষন, জন্ম তারিখ, জন্মসন এসবেই মতভেদ আছে। কেবল একটা ব্যপারে সবাই একমত যে, তাঁর জন্মদিনটি ছিল সোমবার। (মুসলিম ১ম খন্ড, ৩৬৮পৃঃ)
এবং প্রায় সবাই একমত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মৃত্যু হয়েছিল রবিউল আউয়াল মাসে। এ সম্পর্কে যদি তর্কের খাতিরে মেনে নেয়া হয় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্ম ও মৃত্যু হয়েছিল ১২ই রবিউল আউয়ালে তাহলে ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের অনুকরণে ১২ই রবিউল আউয়ালে ঈদে মীলাদুন্নবী তথা নাবী (সাঃ) এর জন্মবার্ষিকী খুশী মানানো হয় অথচ ঐ দিনেই নাবীজীর ইন্তেকালের শোক পালন করা হয় না কেন? এ কথায় সবাই একমত যে, একই আনন্দ ও দুঃখ একত্রিত হলে দুঃখের মধ্যে আনন্দ ম্লান হয়ে যায়। তাই ১২ই রবিউল আউয়াল মীলাদুন্নবীর উৎসব পালন না করে নাবীর মৃত্যু শোক পালনক করাই যুক্তিযুক্ত হতো।
আল্লাহকে খুশী করার জন্য আল্লাহর নাবী (সাঃ) আমাদের যে সকল বিধান দিয়েছেন তা পালন করাই যথেষ্ট, নতুন করে কিছু আবিষ্কার করার অবকাশ কোথায়? আল্লাহ পাক আমাদের সহীহ হাদীস অনুসারে চলার তৌফিক দান করুন। আমীন…..

                          ----------------------------------------------------------------------------------

                          '' শুধু নিজে শিক্ষিত হলে হবেনা, প্রথমে বিবেকটাকে শিক্ষিত করুন। ''
Widget ByBlogger Maruf
Widget ByBlogger Maruf