আলহামদুলিল্লাহ্!
সকল প্রশংসা একমাত্র মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের, যিনি মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়, যিনি মহাক্ষমাশীল বিচার দিনের মালিক,
একজন মুমিনের ঈমান প্রকাশ পায় আল্লাহ্’র বন্ধুদের সাথে তার বন্ধুত্ব এবং আল্লাহ্’র দুশমনদের সাথে তার দুশমনী পোষণ করার ধরন হতে। কিন্তু বিষয়টি সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহর উদাসীনতা এতটাই প্রকট যে, বর্তমানে তারা আল্লাহ্’র দুশমনদের সাথে এমনভাবে সম্পর্ক রাখছে যার ফলশ্রুতিতে তারা তাদের প্রকৃত ঐতিহ্য, শিক্ষা সংস্কৃতিকে ভুলে বিজাতিদের সাথে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
একজন মুমিনের ঈমান প্রকাশ পায় আল্লাহ্’র বন্ধুদের সাথে তার বন্ধুত্ব এবং আল্লাহ্’র দুশমনদের সাথে তার দুশমনী পোষণ করার ধরন হতে। কিন্তু বিষয়টি সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহর উদাসীনতা এতটাই প্রকট যে, বর্তমানে তারা আল্লাহ্’র দুশমনদের সাথে এমনভাবে সম্পর্ক রাখছে যার ফলশ্রুতিতে তারা তাদের প্রকৃত ঐতিহ্য, শিক্ষা সংস্কৃতিকে ভুলে বিজাতিদের সাথে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
একজন ঈমানদারের উপর ওয়াজিব হলো, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি মহব্বতের সাথে সাথে আল্লাহ্’র বন্ধুদের মহব্বত করা ও তাঁর শত্রুদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা। আল্লাহ্’র বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্ব থাকা এবং আল্লাহ্’র দুশমনদের সাথে দুশমনি থাকা একজন মুমিনের ঈমানের পরিচয় এবং এটি ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ রোকন। যার মধ্যে এ গুণ বিদ্যমান থাকবে না সে সত্যিকার ঈমানদার হতে পারে না। একজন মু’মিনকে অবশ্যই “আল্লাহ্’র সন্তুষ্টির জন্য বন্ধুত্ব এবং আল্লাহ্’র সন্তুষ্টির জন্য শত্রুতা” -এ নীতিতে অটল থাকতে হবে এবং এ মহাসত্য অন্তরে ধারণ করতে হবে।“আল্লাহ্’র সন্তুষ্টির জন্য বন্ধুত্ব এবং আল্লাহ্’র সন্তুষ্টির জন্য শত্রুতা” এটিকে ঈমানের মানদণ্ড বললেও অত্যুক্তি হবে না। সুতরাং যাদের মধ্যে ঈমানের এ মানদণ্ড থাকবে না, তাদেরকে আমরা মু’মিন ভাবা হতে বিরত থাকবো। আল্লাহ্ পাক ফরমান- “তাদের (অর্থাৎ মু’মিনদের) জন্যেই তাদের রব্বের নিকট রয়েছে নিরাপত্তার গৃহ এবং তিনি (আল্লাহ্) তাদের (অর্থাৎ মু’মিনদের) বন্ধু তাদের কর্মের কারণে।” (সূরা আন’আম ৬:১২৭)
মানুষ মাত্রই সঙ্গ প্রিয়। কোন মানুষই একাকী কোথাও থাকতে চায় না যদি সে স্থান জান্নাতও হয়। উদাহরণ স্বরূপ, হযরত আদম আলাইহিস সালাম-এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যায়। আল্লাহ্ পাক তাঁকে সৃষ্টি করে যখন জান্নাতে থাকতে দিলেন তখন জান্নাতের অফুরন্ত নেয়ামতরাজি ভোগ করার পরও তিনি একাকীত্বের যন্ত্রণায় একজন সঙ্গীর জন্য আল্লাহ্ পাকের নিকট দরখাস্ত করলেন। অতঃপর আল্লাহ্ পাক আদম আলাইহিস সালাম-এর সঙ্গীনি হিসেবে হযরত হাওয়া আলাইহিস সালাম’কে সৃষ্টি করলেন এবং হযরত আদম আলাইহিস সালাম’কে একাকীত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিলেন। তাই সমাজবদ্ধ হয়ে মিলেমিশে থাকাটা আদম-সন্তানের স্বভাবজাত ধর্ম। তবে মানুষের সমাজবদ্ধ জীবন সার্থক ও সুন্দর হয়ে ওঠে তখনই যখন তাদের পরস্পরের মাঝে থাকে অকৃত্রিম ও প্রকৃত বন্ধুত্ব এবং সৌহার্দপূর্ণ সর্ম্পক। সুতরাং একজন মানুষের জীবনে অকৃত্রিম ও প্রকৃত বন্ধুর প্রয়োজনীয়তা বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। বিশেষ করে বন্ধুত্ব গ্রহণের পূর্বে মু’মিনের জীবনে প্রকৃত বন্ধু কারা? কী তাদের পরিচয়? প্রভৃতি সম্পর্কে সঠিক ও সুস্পষ্ট ধারণা থাকাটা একান্ত অপরিহার্য। আর এ ব্যপারে জানার উৎস যদি হয় আল-কুরআন তবেতো দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কোন অবকাশই থাকে না। কারণ আল্লাহ্ সুব্’হানাহু ওয়া তায়ালা ইরশাদ করেছেন:
“এ কুরআন মানব জাতির জন্য সুস্পষ্ট জীবন বিধান এবং আল্লাহ্’ভীরু লোকদের জন্য দিক নির্দেশিকা ও উপদেশ স্বরূপ।” (সূরা আল ইমরান ৩:১৩৮)
তাহলে এবার আল কুরআনের পাতায় দৃষ্টি বুলাই, দেখা যাক বন্ধুত্ব সম্পর্কে আল-কুরআনে কী বলা হয়েছে। সূরা আল মায়িদাহ ৫৫ ও ৫৬ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে :
“নিশ্চয়ই তোমাদের সত্যিকার বন্ধু হলেন আল্লাহ্, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মু’মিনগণ (আর এসব মু’মিন হলেন তারা) যারা সালাত কায়েম করে ও যাকাত প্রদান করে। আর কেউ আল্লাহ্, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং মু’মিনদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে (সেই সব লোকের সমন্বয়ে গঠিত) আল্লাহ্’র দলইতো বিজয়ী হবে।“
অর্থাৎ আল-কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী একজন মু’মিনের প্রকৃত বন্ধুর স্তর তিনটি। এক. আল্লাহ্ তায়ালা, দুই. আল্লাহ্’র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তিন. মু’মিনগণ।
প্রথম স্তরের বন্ধু আল্লাহ্ তায়ালা। এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে : “তুমি কি জান না যে, আল্লাহর জন্যই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের আধিপত্য? আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোন বন্ধু ও সাহায্যকারী নেই।” (সূরা আল বাকারা ২:১০৭)
“আল্লাহ্ ছাড়া তোমাদের অন্য কোন বন্ধু বা সাহায্যকারী বলে কেউ নেই।” (সূরা আশ-শূরা ৪২:৩১) আরো ইরশাদ হয়েছে-
“আল্লাহ্ হলেন ঈমানদারগণের বন্ধু ও অভিভাবক। তিনি তাদের অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান। আর অবিশ্বাসীদের বন্ধু হলো তাগুত (অশুভ শক্তি)। যারা ওদের আলো থেকে বের করে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়।“ (সূরা আল বাকারা ২:২৫৭)
যারা প্রকৃতপক্ষেই ঈমান এনেছে এবং ঈমানের দাবী অনুসারে সত্যের পথে অটল-অবিচল থেকে জীবন পরিচালনা করেছে আল্লাহ্ পাক তাদের বন্ধু ও শুভাকাঙ্খী অভিভাবক। তিনি হিদায়াত প্রত্যাশী সত্যকামী বান্দাদেরকে অন্ধকারের অতল গহ্বরে পতিত হওয়া থেকে উদ্ধার করে আলোকময় সীরাতুল মুস্তাকিমের সন্ধান দেন। অপরদিকে যারা আল্লাহ্’র পরিবর্তে তাগুতকে (অপশক্তি) বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছে তারা মূলত নিজের উপর যুলুমকারী, তারা তাদের মন্দ কাজের ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীরে নিঃসীম অন্ধকারের দিকে ছুটে চলেছে। আল্লাহ্ পাক ইচ্ছা করলে তাদেরকে স্বীয় রহমতে দাখিল করতে পারতেন; কিন্তু স্পষ্ট নির্দেশ আসার পরও যারা আল্লাহ্কে ছেড়ে অন্য উপাস্য বেছে নিয়েছে তারা কখনোই হিদায়াত পাবে না, উপরন্তু তাদের উপাস্য বন্ধুরা তাদেরকে জীবনের এমন এক প্রান্তে নিয়ে যাবে যেখান থেকে সত্যের আলোক রশ্মি তাদের দৃষ্টিগোচর হবে না, তারা হারিয়ে যাবে ঘোর অমানিশায়। আল্লাহ্ পাক যাকে হিদায়াত হতে বঞ্চিত করে দেন, তার জন্য আর কোন হিদায়াত নেই বরং আল্লাহ্ পাক তাদেরকে তাদের অনমনীয় বিদ্রোহাত্মক ভূমিকায়ই বিভ্রান্ত হবার জন্য ছেড়ে দেন। সুতরাং না আল্লাহ্ পাক তাদের কোন দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করবেন আর না তারা কোন সাহায্যকারী বন্ধু খুঁজে পাবে সেদিন, যেদিন সবার কৃতকর্মের হিসাব গ্রহণ করা হবে। প্রথম স্তরে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করলে সে হবে পথভ্রষ্ট। আল্লাহ্ ব্যতীত অপর কাউকে সাহায্যকারী বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হচ্ছে-
“আল্লাহ্ ব্যতীত তাদের অন্য কোন সাহায্যকারী বন্ধু (সেদিন হাশরের ময়দানে) থাকবে না, যে তাদেরকে সাহায্য করবে। মূলত আল্লাহ্ যাকে সঠিক পথ দেখান না, তার কোন গতি নেই।“ (সূরা আশ-শূরা ৪২:৪৬)
আল্লাহ্ পাক ইচ্ছা করলে সমস্ত মত-পথের লোককে এক দলে পরিণত করতে পারতেন। কিন্তু যুলুমকারীদের তিনি কোন সাহায্য করবেন না। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হচ্ছে-
“আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে সমস্ত লোককে এক দলে পরিণত করতে পারেন। কিন্তু তিনি যাকে ইচ্ছা স্বীয় রহমতে দাখিল করেন। আর যুলুমকারীদের কোন বন্ধু ও সাহায্যকারী নেই। তারা কি আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কাউকে বন্ধুরূপে বরণ করেছে? কেবল আল্লাহ্ইতো একমাত্র বন্ধু। তিনিই মৃতদের জীবন দানে সক্ষম এবং তিনিই সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান।” (সূরা আশ-শূরা ৪২:৮-৯)
অপর এক আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে-
“ঐসকল লোকের চেয়ে ব্যর্থ ও পথভ্রষ্ট আর কে হতে পারে যারা আল্লাহ্’কে ছেড়ে এমন সব উপাস্যের (দেব-দেবী, ব্যক্তি ও বস্তুর) পেছনে চলছে; যেসব উপাস্য কিয়ামত পর্যন্ত তাদের কোন কাজেই আসবে না এবং ঐ উপাস্যরা তাদের উপাসনার (পূজা-অর্চনার) ব্যাপারে সম্পূর্ণ বে-খবর। কিয়ামত দিবসে শেষ বিচারের জন্য যখন সকল মানুষকে একত্রিত করা হবে সেদিন ঐসব উপাস্য তাদের শত্রুতে পরিণত হবে এবং তারা তাদের সকল উপাসনাই অস্বীকার করে বসবে।“ (সূরা আল আহ্’কাফ ৪৬:৫-৬)
আরও ইরশাদ হচ্ছে-
“যারা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে, আল্লাহ্ তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখেন। [হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!] তাদের দায়-দায়িত্ব আপনার উপর নয়।” (সূরা আশ-শূরা ৪২:৬)
অন্যত্র আল্লাহ্ পাক আরও ইরশাদ করেন-
“যারা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে বন্ধুরূপে বরণ করে নিয়েছে; তাদের দৃষ্টান্ত সে মাকড়সার মতো যে তার আশ্রয়ের জন্য জাল বুনছে। অথচ অন্য সব গৃহের তুলনায় মাকড়সার (জালের) গৃহই ক্ষণস্থায়ী। হায়! যদি তারা বিষয়টি বুঝতো তাহলে কতই না ভাল হতো।” (সূরা আল আনকাবুত ২৯:৪১)
দ্বিতীয় স্তরের বন্ধু আল্লাহ্’র রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। প্রথম স্তরে আল্লাহ্ পাকের পর দ্বিতীয় স্তরে তাঁর প্রেরিত রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তথা সকল নাবী-রাসূলগণই হচ্ছেন মু’মিনদের প্রকৃত বন্ধু। কারণ তাঁরা বিশ্বমানবতাকে তাগুতের অন্ধকার থেকে বের করে সত্যের আলোর দিকে আল্লাহ্ পাক প্রদর্শিত সিরাতুল মুস্তাকিমের দিকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন-
“নিশ্চয়ই তোমাদের সত্যিকার বন্ধু হলেন আল্লাহ্, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মু’মিনগণ (আর এসব মু’মিন হলেন তারা) যারা সালাত কায়েম করে ও যাকাত প্রদান করে।” (সূরা আল মায়িদাহ্ ৫:৫৫)
আল্লাহ্ পাক আরও ইরশাদ করেন-
“[হে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!] আমি তো আপনাকে বিশ্ববাসীর প্রতি কেবল রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।” (সূরা আম্বিয়া ২১:১০৭)
অর্থাৎ যারা আল্লাহ্’র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলো তারা মূলত আল্লাহ্’র রহমতের তাবুতলে প্রবেশ করলো। আর আল্লাহ্’র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধুমাত্র সু-সংবাদদানকারী বন্ধুই নন, মন্দ কাজে যেন আমরা জড়িয়ে না পড়ি সে জন্য তিনি সতর্ককারীরূপেও প্রেরিত হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে-
“আমি তো আপনাকে সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা এবং সতর্ককারীরূপেই প্রেরণ করেছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।” (সূরা সাবা ৩৪:২৮]
তৃতীয় স্তরের বন্ধু মু’মিনগণ। আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তথা নাবী-রাসূলগণের পর মু’মিন অর্থাৎ ঈমানদারগণই মু’মিনদের প্রকৃত বন্ধু। কেননা মু’মিনগণ পরস্পর পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং তারা একে অপরকে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রদর্শিত পথে চলতে সহায়তা করে। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হচ্ছে-
“ঈমানদার নর ও ঈমানদার নারী একে অপরের বন্ধু; তারা সম্মিলিতভাবে সৎ কাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজের প্রতিরোধ করে; সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহ্ এদেরই ওপর রহমত বর্ষণ করে থাকেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা আত্ তাওবা ৯:৭১)
অর্থাৎ আল্লাহ্ পাকের ফায়সালায় ঈমানদার-মু’মিনগণ স্বাভাবিকভাবেই একে অপরের বন্ধু। আল্লাহ্ পাক তাঁকে এবং তাঁর প্রেরীত নবী-রাসূলগণের পর মু’মিনদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে বলেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- মু’মিন কারা কিংবা কাদেরকে মু’মিন হিসেবে গণ্য করবো কিংবা কী তাদের কর্ম-পরিচয়? অধিকাংশ আ’লিমের মতে অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকারোক্তি এবং আ’মালে সালিহ্ বা সৎকর্ম এই তিনের সমন্বয়ে হয় ঈমান। কুরআন ও সহীহ্ হাদীস যে সমস্ত বিষয়ের প্রতি ঈমান আনয়নের নির্দেশ করেছে উক্ত বিষয় সমূহের প্রতি যে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে তাকেই মু’মিন বা ঈমানদার বলা হয়। যে বিষয়সমূহে বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের অঙ্গ-
১. আল্লাহ্ই হলেন আমাদের একমাত্র রব্ব-সার্বভৌম মালিক, সার্বভৌম আইনদাতা-বিধানদাতা ও নিরংকুশ কর্তা। তিনি ব্যতীত অন্য কোনো দাসত্ব, আইনের আনুগত্য ও উপাসনা পাওয়ার সত্তা নেই।
২. আল্লাহ্’র আদেশ কাজে পরিণত করার জন্য ফিরিশতাগণ নিযুক্ত আছেন।
৩. মানব সৃষ্টির শুরু হতে শেষ নাবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত মানব জাতিকে পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহ্ পাক বিভিন্ন যুগে যেই সকল কিতাব বা ধর্ম গ্রন্থ নাযিল করেছেন তাতে বিশ্বাস স্থাপন করা।
৪. ঐসকল ধর্ম গ্রন্থে আল্লাহ্’র আদেশ ও নির্দেশ অনুসারে সিরাতুল মুস্তাকিম-সরল সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহ্ মানুষের মধ্য হতে যে সকল নাবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন তাঁদের সকলের নবুওয়তে বিশ্বাস করা।
৫. আখিরাত বা মৃত্যু পরবর্তী জীবনের উপর বিশ্বাস রাখা।
৬. তাক্’দীর (ভাল-মন্দ নির্ধারণ) আল্লাহ্’র পক্ষ হতে হয় বলে বিশ্বাস করা।
৭. মৃত্যুর পর কিয়ামত বা শেষ বিচারের দিনে সবাইকে পুনরুত্থিত করা হবে বলে বিশ্বাস রাখা।
এই বিষয়সমূহই ঈমানের ভিত্তি। যে এই বিষয়সমূহের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে তাকেই মু’মিন বা ঈমানদার বলা হয়। এর যে কোন একটিতে অবিশ্বাস করলে আল্লাহ্ পাকের পক্ষ হতে তাকে কাফির বা অবিশ্বাসী গণ্য করা হবে।
মু’মিনের ঈমান হবে ইস্পাতের ন্যায় কঠিন, দৃঢ়, অটল; পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি, ভাই-বোন, আত্মীয়-পরিজন, স্বীয় ধন-সম্পদ কোন কিছুই তাদেরকে সত্যের পথ থেকে, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশ মানা থেকে বিরত রাখতে পারবে না। আর তাই আল কুরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ্ পাক ঈমানদার বান্দাগণকে হুঁশিয়ার করে বলছেন-
“ওহে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের স্বীয় পিতা ও ভাইদেরকেও বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না যদি তারা ঈমানদারীর পরিবর্তে কুফরীকে ভালবাসে। তোমাদের কেউ যদি তাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে, তবে তারাই হবে আত্মঘাতী যালিম।” (সূরা আত্ তাওবা ৯:২৩)
আল্লাহ্ পাক আরও বলেন- “হে মু’মিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহ্’র স্মরণ থেকে বিরত না রাখে। যারা এরূপ করবে, তারাইতো ক্ষতিগ্রস্ত।” (সূরা মুনাফিকুন ৬৩:৯)
আমাদের মুসলিম সমাজ সাধারণত কুরআন-হাদীস শিক্ষাকারী, শিক্ষাদানকারী আলেম সমাজকেও তৃতীয় স্তরের বন্ধুদের মধ্যে অগ্রগামী হিসেবে গণ্য করে থাকে। হাদীস শরীফেও আলেমগণকে নবী-রাসূলগণের আধ্যাত্মিক জ্ঞানের ওয়ারিস-উত্তরাধিকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ নবী-রাসূলগণের ওয়ারিস হিসেবে আলেমগণকে বন্ধু ও শুভাকাঙ্খী হিসেবে মানব সমাজকে সত্যপথের সন্ধান দেয়ার দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। তাদের পরামর্শ মোতাবেক চললে, তাদেরকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করলে সীরাতুল মুস্তাকিমের খোঁজ পাওয়া সহজ হবে বলে আশা করা যায়। তবে সমাজে কতিপয় আলেমের আবির্ভাব ঘটেছে যাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের পূর্বে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরী। এদের অনেকেরই কুরআন-হাদীস সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নেই। কুরআন-হাদীসের সমুদ্র মন্থন না করেই এদের অনেকে সুফী-দরবেশ, মারেফত-তরীকতপন্থী পীর, আধ্যাত্মিক ধর্মগুরু সেজে সরল-সহজ মু’মিন-মুসলমানদেরকে আল্লাহ্’র পরিবর্তে গায়রুল্লাহ্’র সার্বভৌমত্ব, আনুগত্য ও দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ করছে। আল্লাহ্’র জমীনে আল্লাহ্’র দ্বীন প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে তারা মুসলমানদের মধ্যে ফিত্’না-ফাসাদ সৃষ্টির কাজে আত্মনিয়োগ করছে। তারা ইসলামের সাইনবোর্ড লাগিয়ে মানুষকে কুরআন-সুন্নাহ্’র দিকে আহ্বান করার পরিবর্তে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করছে। আল্লাহ্’র দ্বীনের ঝাণ্ডার পরিবর্তে নিজস্ব মত-পথের নিশানকে সমুন্নত রাখতেই তাদের যত চাতুর্যপূর্ণ বয়ান। আল্লাহ্’র মনোনীত দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠায় নিজের জান-মাল কুরবানী করার পরিবর্তে দ্বীন ইসলামকেই আত্ম-প্রতিষ্ঠায় ব্যবহারের মত অভিশপ্ত কাজে এরা লিপ্ত আছে। এদেরকেই বলা হয় উলামায়ে ছু’ বা অসৎ আলেম যারা কখনো মুমিনদের হিতাকাঙ্খী বন্ধু হতে পারে না। ঈমানদার-মু’মিনগণকে সতর্ক করে আল্লাহ্ পাক বলছেন-
”হে ঈমানদারগণ! আলেম ও দরবেশদের অনেকে অন্যায়ভাবে লোকদের ধন-সম্পদ আত্মসাৎ করে চলেছে এবং মানুষকে আল্লাহ্’র পথ থেকে নিবৃত রাখছে। আর যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহ্’র পথে ব্যয় করে না, তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।” (সূরা আত তাওবাহ ৯:৩৪)
এসব আলেমদের অনেকে আবার কুরআন-হাদীসের ভুল বা অপব্যাখ্যা করে বিভিন্ন বই-পুস্তক রচনার মাধ্যমে মানুষের নিকট থেকে দু’পয়সা উপার্জনের ফিকিরে লিপ্ত। এদের পরিণতি ইয়াহুদী-খৃষ্টান ধর্মযাজকদের ন্যায় যাদের সম্পর্কে আল্লাহ্ পাক বলেছেন-
“ধ্বংস তাদের জন্য যারা স্বহস্তে কিতাব (তাওরাত) (পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে) লিখে বলে যে, এটা আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। উদ্দেশ্য এর বিনিময়ে সামান্য কিছু অর্থ উপার্জন করা। সুতরাং আক্ষেপ তাদের প্রতি, যা তারা স্বহস্তে লিখেছে তজ্জন্য এবং আক্ষেপ তাদের প্রতি, তাদের উপার্জনের জন্য।” (সূরা আল বাকারা ২:৭৯]
সুতরাং কোন আল্লাহ্ওয়ালা আলেম কিংবা আধ্যাত্মিক ধর্মীয় গুরুকে শুভাকাঙ্খী বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার পূর্বে তার মধ্যে অবশ্যই নিম্নের আলামতসমূহ বিদ্যমান আছে কি-না তা যাচাই করে নেয়াটা ঈমানের দাবী-
১. তিনি কুরআন কিংবা হাদীস হিফ্যকারী হওয়াটা শর্ত নয় তবে অবশ্যই কুরআন ও সুন্নাহ্’র গভীর ও সূক্ষ্ম জ্ঞান তার মাঝে থাকতে হবে।
২. তিনি আ’মল ও আক্বীদাহ’য় আল্লাহ্’র নির্দেশের ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাতের শতভাগ অনুসরণ করতে সক্ষম না হলেও বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রমকারী হবেন না। সর্বোপরি শিরক, কুফর ও তাগুতের সমর্থক না হয়ে চরম বিদ্রোহী হবেন।
৩. দ্বীনের দাওয়াতকে তিনি একমাত্র আল্লাহ্ পাকের সন্তুষ্টির জন্যই খালেছ করবেন। তিনি যেমন দুনিয়ার মানুষের নিকট হতে নাম, যশ, খ্যাতি, সম্মান ও পরিচিতির আশায় এ কাজ করবেন না ঠিক তেমনি প্রভাব-প্রতিপত্তি, অধিক ধন-সম্পদ প্রভৃতির আকাঙ্খাও করবেন না।
৪. পরিমিত আহার, পরিমিত ঘুম, স্বল্পভাষী, অধিক সালাত আদায়কারী, তাওবাকারী, সামর্থানুযায়ী দান-খয়রাতকারী, অল্পে তুষ্ট, লজ্জাশীলতা, স্থিরতা, সহিষ্ণুতা প্রভৃতি গুণাবলী তার মাঝে বিদ্যমান থাকবে।
৫. তিনি অবশ্যই পরিহার করে চলবেন: অহংকার, বখিলতা, ঈর্ষাপরায়ণতা ও বিদআ’ত।
মূলত আল্লাহ্ পাক চাহেন তাঁর মুমিন বান্দাগণ সত্যপন্থীদের সাথে থাকুক। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাকের ঘোষণা কতইনা চমৎকার-
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর আর সত্যবাদীদের সাথে থাক।” (সূরা আত তাওবাহ ৯:১১৯)
কিয়ামত দিবসে যাদের বন্ধুত্ব টিকে থাকবে এবং উপকারে আসবে তারাই প্রকৃত বন্ধু। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক বলেন-
“বন্ধুরা সেদিন (কিয়ামত দিবসে) একে অপরের শত্রুতে পরিণত হবে, শুধুমাত্র মুত্তাকীরা (আল্লাহ্’ভীরুগণ) ব্যতীত।” (সূরা যুখরুফ ৪৩:৬৭)
অর্থাৎ তাক্বওয়া অবলম্বনকারী মু’মিনগণের পারস্পরিক বন্ধুত্ব কিয়ামত দিবসেও টিকে থাকবে। এক কথায়, যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল আদেশ-নিষেধ নিঃশঙ্কোচে নির্দ্বিধায় মেনে চলেছে তাদের তাদের মাঝে যদি কোন বন্ধুত্ব থেকে থাকে তবে সেই বন্ধুত্বের বন্ধন কিয়ামতের দিনও টুট্’বে না অথচ অপরাপর সকলের বন্ধুত্ব সেদিন পারস্পরিক শত্রুতায় রূপ নিবে।
উল্লিখিত আয়াতসমূহ থেকে স্পষ্টভাবে মু’মিনদের বন্ধুদের ও ভালোবাসার পাত্র সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেল। এখন এটা জানাও জরুরী যে, আল্লাহ্ পাক প্রদত্ত বন্ধুত্বের শ্রেণীসমূহের বাইরে অপর কোন শ্রেণী বা দল, ব্যক্তি বা সম্প্রদায় মু’মিনদের বন্ধু হওয়ার বা ভালোবাসা পাবার যোগ্য কি-না? কুরআনুল কারীমের বেশ কিছু আয়াতে আল্লাহ্ সুব্’হানাহু ওয়া তায়ালা মু’মিনদেরকে কতিপয় চিহ্নিত ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও স¤প্রদায়ের সাথে বন্ধুত্ব করা হতে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। যারা এ নির্দেশের ব্যতিক্রম করবে আল্লাহ্ পাক তাদের সাথে কোন সম্পর্ক রাখবেন না এবং তারা যালিম (যুলুমকারী) হিসেবে চিহ্নিত হবেন। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হচ্ছে- “হে ঈমানদারগণ! তোমরা সর্বাত্ত্বকভাবে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” (সূরা আল বাকারা ২:২০৮)
আরও ইরশাদ হচ্ছে-
“আল্লাহ্ কেবল তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের (মু’মিনদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে স্বদেশ থেকে বহিষ্কার করেছে এবং তোমাদের বহিষ্কারে সাহায্য করেছে। তাদের সাথে যারা বন্ধুত্ব করে তারাতো যালিম (যুলুমকারী)।” (সূরা আল মুম্’তাহানা ৬০:৯)
অপর এক আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে-
“মু’মিনগণ যেন মু’মিনগণ ব্যতীত (অবিশ্বাসী) কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যে এরূপ করবে তার সাথে আল্লাহ্’র কোন সম্পর্ক থাকবে না। তবে যদি তোমরা তাদের পক্ষ থেকে কোন অনিষ্টের আশঙ্কা কর, তবে তাদের সাথে সাবধানতার সাথে থাকবে। আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর সম্পর্কে তোমাদের সতর্ক করেছেন। এবং সবাইকে তাঁরই নিকট ফিরে যেতে হবে।” (সূরা আল ইমরান ৩:২৮)
যারা বাহ্যিক পরিচয়ে মু’মিন-মুসলিম এবং মুসলিম সমাজে বসবাস করেন, মু’মিন স্বজন-পরিজনের সাথে বাহ্যিক সুসম্পর্ক এবং সদ্ভাব বজায় রেখে চলেন অথচ গোপনে অমুসলিম কাফির-মুশরিকদের সাথে সখ্য (বন্ধুত্ব) গড়ে তোলেন তাদের সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
“সেসব মুনাফিককে সুসংবাদ শুনিয়ে দিন যে, তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। যারা মু’মিনদের পরিবর্তে কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে এবং তাদেরই কাছে সম্মান প্রত্যাশা করে, অথচ সমস্ত সম্মান শুধুমাত্র আল্লাহ্ পাকেরই জন্য।” (সূরা আন নিসা ৪:১৩৮-১৩৯)
আরও ইরশাদ হচ্ছে-
“আপনি তাদের অনেককে কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবেন। কত নিকৃষ্ট তাদের কৃতকর্ম, যে কারণে আল্লাহ্ তাদের উপর ক্রোধান্বিত হয়েছেন। তাদের শাস্তিভোগ চিরস্থায়ী হবে।” (সূরা আল মায়িদাহ্ ৫:৮০)
অর্থাৎ আল্লাহ্ পাকের নির্দেশের বিরোধীতা করে কাফির-মুশরিকদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করলে তাদেরকে আল্লাহ্ পাকের কাহ্’হার (মহা-শাস্তিদাতা) নামের রূপটি অবলোকন করতে হবে কিয়ামত দিবসে। আল্লাহ্ পাক অমুসলিমদের বন্ধুত্ব গ্রহণ সম্পর্কে আরও স্পষ্টভাবে সতর্ক বার্তা পাঠিয়েছেন তাঁর হিদায়াতকামী বান্দাদের উদ্দেশ্যে। আল্লাহ্ পাক বলেন-
“হে মুমিনগণ, ইয়াহূদী ও নাসারাদেরকে তোমরা বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে নিশ্চয় তাদেরই একজন। নিশ্চয় আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে হিদায়াত দেন না।” [সূরা মায়িদাহ ৫:৫১]
আয়াতে আল্লাহ্ মু’মিনদেরকে জানিয়ে দিলেন, আমি যাদের কিতাব দিয়েছি, অর্থাৎ ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদেরকে কখনোই তোমাদের বন্ধু বানাবে না। কারণ, তারা কখনোই তোমাদেরকে তাদের নিজেদের আপন মনে করে না, তারা সব সময় তোমাদেরকে তাদের শত্রু হিসেবে গণ্য করে। আর তারা সব সময় মু’মিনদের ক্ষতির অনুসন্ধান করে। তারপরও যারা কিতাবিদের সাথে বন্ধুত্ব করবে আল্লাহ তাদের বিষয়ে বলেন, তারা সে সব জাতিরই অন্তর্ভুক্ত হবে, তারা মু’মিনদের অন্তর্ভুক্ত হবে না। আয়াতে আল্লাহ্ মু’মিনদের কাফেরদের নির্যাতনের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। অর্থাৎ, তোমরা তাদের কিভাবে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে? তারা তোমাদের নিকট আল্লাহ্’র পক্ষ হতে যে হিদায়াতের মিশন এসেছে, তা অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করছে এবং তোমাদেরকে কোন প্রকার অপরাধ ছাড়া তোমাদের বাড়ি-ঘর হতে বের করে দিয়েছে, তোমাদের ভিটা-বাড়ি ছাড়া করেছে। সুতরাং, তোমরা তাদেরকে কখনোই বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না।এ বিষয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন, কাফিররা যদি মু’মিনদের আত্মীয়-স্বজন বা রক্ত সম্পর্কীয় ও গোত্রীয় লোকও হয়, তাদের সাথে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব এবং তাদের খালেস মহব্বত করতে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মু’মিনদের জন্য হারাম করে দিয়েছেন। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন কিতাবিদের সাথে বন্ধুত্ব করতে এবং তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করেন। অপর এক আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কাফিরদেরও বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করেন। কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব করা হারাম হওয়া বিষয়ে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন বলেন, “হে মুমিনগণ, তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা তো তাদের প্রতি বন্ধুত্বের বার্তা পাঠাও, অথচ তারা যে সত্য তোমাদের কাছে আগমন করেছে, তা অস্বীকার করছে। তারা রাসূলকে ও তোমাদেরকে (জন্মভূমি থেকে) বহিস্কার করে এই অপরাধে যে, তোমরা তোমাদের রব্ব আল্লাহ্’র প্রতি ঈমান এনেছো। যদি তোমরা আমার সন্তুষ্টিলাভের জন্যে এবং আমার পথে জিহাদ করার জন্যে (ঘরবাড়ি থেকে) বের হয়ে থাক, তবে কেন তাদের প্রতি গোপনে বন্ধুত্বের পয়গাম প্রেরণ করছ? তোমরা যা গোপন কর এবং যা প্রকাশ কর, তা সবই আমি খুব ভাল করে জানি। তোমাদের মধ্যে যে এটা করে, সে নিশ্চিতভাবেই সত্যপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। তোমাদেরকে করতলগত করতে পারলে তারা তোমাদের শত্রু হয়ে যাবে এবং মন্দ উদ্দেশ্যে তোমাদের প্রতি হাত ও জিহ্বা প্রসারিত করবে এবং চাইবে যে, কোনরূপে তোমরাও কাফির হয়ে যাও।” (সূরা মুমতাহানা ৬০:১-২)
অর্থাৎ যতই সততা, সভ্যতা আর মানবতার সুর তাদের কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ুক না কেন ইয়াহুদী ও খৃষ্টানরা কখনোই মুসলমানদের প্রকৃত বন্ধু হবে না। যদিও আপাত দৃষ্টিতে কদাচিৎ তাদেরকে বন্ধুর ভূমিকায় দেখা যায়, তাও অনুসন্ধান চালালে দেখা যাবে, ভবিষ্যতের কোন বিষবৃক্ষের আশায় তারা বর্তমান চারা গাছ দান করেছেন। আমাদের এ ধারণাকে আরো দৃঢ় করেছে আল্লাহ্ পাকের এই বাণী-
“অবশ্য মুসলমানদের প্রতি শত্র“তায় মানুষের মধ্যে ইয়াহুদী ও মুশরিকদেরকেই তুমি সর্বাধিক উগ্র দেখবে …।” (সূরা আল মায়িদাহ্ ৫:৮২)
আরও ইরশাদ হচ্ছে-
“হে মুসলমানগণ! আহলে কিতাবদের মধ্যে থেকে যারা তোমাদের দ্বীনকে (ধর্মকে) উপহাস ও খেলা মনে করে, তাদেরকে এবং অন্যান্য কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। এবং যদি তোমরা মু’মিন হও তবে আল্লাহ্’কে ভয় কর।” (সূরা আল মায়িদাহ্ ৫:৫৭)
অর্থাৎ প্রকৃত হিতাকাঙ্খীতো নয়ই বরং ইয়াহুদী ও খৃষ্টানরা মুসলমানদের বিরোধীতায় সবচেয়ে বেশী অগ্রগামী। তারা আমাদের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে আমাদেরকে উপহাস ও বিদ্রুপ করতেও ছাড়েনা। সুতরাং সর্বাবস্থায় মুসলমানদেরকে ইয়াহুদী, খৃষ্টান ও মুশরিকদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করা হতে বিরত থাকতে হবে।
তবে মু’মিনদের ভালোবাসা ও ঘৃণা সম্পর্কে সবচেয়ে কঠোর এবং স্পষ্ট যে আয়াতটি কুরআনে বর্ণিত হয়েছে তা এবার পেশ করছি:
“তোমরা কখনো এমন দেখতে পাবে না যে, যারা আল্লাহ্ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান পোষণ করে তারা এমন লোকদের ভালোবাসছে যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করেছে। তারা তাদের পিতা, অথবা পুত্র অথবা ভাই অথবা জ্ঞাতি-গোষ্ঠীভুক্ত হলেও তাতে কিছু এসে যায় না। আল্লাহ্ এসব লোকদের হৃদয়-মনে ঈমান বদ্ধমুল করে দিয়েছেন এবং নিজের পক্ষ থেকে একটি রূহ দান করে তাদের শক্তি যুগিয়েছেন। তিনি তাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত হতে থাকবে। তারা সেখানে চিরদিন অবস্থান করবে। আল্লাহ্ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহ্’র প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। তারা আল্লাহ্’র দলের লোক। জেনে রেখো আল্লাহ্’র দলের লোকেরাই সফলকাম।” (সূরা মুজাদালাহ ৫৮:২২)
এ আয়াতে দু’টি কথা বলা হয়েছে। একটি নীতি কথা। অন্যটি প্রকৃত ঘটনার বর্ণনা। নীতি কথায় বলা হয়েছে যে, সত্য দ্বীনের প্রতি ঈমান এবং দ্বীনের শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব ও ভালবাসা দু’টি সম্পুর্ণ পরস্পর বিরোধী বিষয়। এ দু’টি বিষয়ের একত্র সমাবেশ বা অবস্থান কোনভাবে কল্পনাও করা যায় না। মু’মিন এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের শত্রুদের সাথে ভালবাসা ও বন্ধুত্ব একই হৃদয়ে একত্রিত হওয়া একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। কোন মানুষের হৃদয়ে যেমন একই সাথে নিজের প্রতি ভালবাসা এবং শত্রুর প্রতি ভালবাসা একত্রিত হতে পারে না তখন এটাও ঠিক অনুরূপ ব্যপার। অতএব আমরা যদি কাউকে দেখি, কেউ ঈমানের দাবীও করে এবং সাথে সাথে ইসলাম বিরোধী লোকদের সাথে ভালবাসা ও বন্ধুত্বের সম্পর্কও রাখে তাহলে আমাদর মনে কখনো যেন এ ভুল ধারণা না জন্মে যে, এ আচরণ সত্ত্বেও সে তার ঈমানের দাবীতে সত্যবাদী। অনুরূপ যেসব লোক একই সাথে ইসলাম ও ইসলাম বিরোধীদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে সে নিজেও যেন তার এ অবস্থান ভালভাবে চিন্তা ভাবনা করে দেখে যে, প্রকৃতপক্ষে সে কি, মুমিন, না মুনাফিক। সে প্রকৃতপক্ষে কোন অবস্থানে থাকতে চায়, মু’মিন নাকি মুনাফিক হয়ে। তার মধ্যে যদি সততার লেশমাত্রও থেকে থাকে এবং মুনাফিকীর আচরণ যে নৈতিক দিক দিয়ে মানুষের জন্য নিকৃষ্টতম আচরণ এ বিষয় তার মধ্যে সামান্যতম অনূভূতিও থাকে তা হলে তার উচিত একই সাথে দুই নৌকায় আরোহণের চেষ্টা পরিত্যাগ করা। ঈমান এ ব্যাপারে তার কাছে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত দাবী করে। সে যদি মু’মিন থাকতে চায় তাহলে যেসব সম্পর্ক বন্ধন ইসলামের সংগে তার সম্পর্ক ও বন্ধনের সাথে সাংঘর্ষিক তার সবই তাকে বর্জন করতে হবে। ইসলামের সাথে সম্পর্কের চাইতে অন্য কোন সম্পর্ক প্রিয়তর হয়ে থাকলে ঈমানের মিথ্যা দাবী ছেড়ে দেয়াই উত্তম।
এতো গেল নীতিগত কথা। কিন্তু এখানে আল্লাহ্ তা’আলা শুধু নীতির কথা বর্ণনা করাই যথেষ্ট মনে করেননি। বরং ঈমানের দাবীদারদের সামনে নমুনা স্বরূপ এ বাস্তব ঘটনাও পেশ করেছেন যে, সত্যিকার ঈমানদারগণ বাস্তবে সবার চোখের সামনে সে সম্পর্ক ও বন্ধন ছিন্ন করেছিল যা আল্লাহ্’র দ্বীনের সাথে সম্পর্কের পথে প্রতিবন্ধক ছিল এটা ছিল এমন একটা ঘটনা যা বদর ও উহুদ যুদ্ধের সময় সমগ্র আরব জাতি প্রত্যক্ষ করেছিল। যেসব সাবাহায়ে কিরাম মক্কা থেকে হিজরত করে এসেছিলেন তারা শুধু আল্লাহ্ এবং দীনের খাতিরে নিজেদের গোত্র এবং ঘনষ্টতর নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। হযরত আবু উবাদাহ তাঁর নিজের পিতা আবদুল্লাহ্ ইবনে জাররাহকে হত্যা করেছিলেন। হযরত মুসআ’ব ইবনে উমায়ের আপন ভাই উবাদাহ ইবনে উমায়েরকে হত্যা করেছিলেন। হযরত উমার (রাযিআল্লাহু আনহু) তাঁর মামা আস ইবনে হিশাম ইবনে মুগীরাহকে হত্যা করেন। হযরত আবু বকর (রাযিআল্লাহু আনহু) তার পুত্র আবদুর রহমানের বিরুদ্ধে লড়তে প্রস্তুত হয়েছিলেন। হযরত আলী, হযরত হামযা এবং হযরত উবাইদা ইবনুল হারেস তাদের নিকটাত্মীয় উতবা, শায়বা, এবং ওয়ালীদ ইবনে উতবাকে হত্যা করেছিলেন। বদর যুদ্ধের বন্দীদের ব্যাপারে হযরত উমার (রাযিআল্লাহু আনহু) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তাদের সবাইকে হত্যা করার আবেদন করে বলেছিলেন, আমাদের মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিকটাত্মীয়কে হত্যা করবে। এ বদর যুদ্ধেই এক আনসারী হযরত মুসআ’ব ইবনে উমায়েরের আপন ভাই আবু আযীয ইবনে উমায়েরকে পাকড়াও করে বাঁধছিলেন। তা দেখে হযরত মুসআ’ব চিৎকার করে বললেন: বেশ শক্ত করে বাঁধো। এর মা অনেক সম্পদশালিনী। এর মুক্তির জন্য সে তোমাদেরকে অনেক মুক্তিপণ দিবে। একথা শুনে আবু আযীয বললো: তুমি ভাই হয়ে একথা বলছো। জবাবে হযরত মুসআ’ব ইবনে উমায়ের বললেন: এ মুহুর্তে তুমি আমার ভাই নও, বরং যে আনসারী তোমাকে পাকড়াও করছে সে আমার ভাই। বদর যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জামাতা আবুল আস বন্দি হয়ে আসলে তাঁর জামাতা হওয়ার কারণে আবুল আসের সাথে অন্য সব কয়েদী থেকে ভিন্ন বিশেষ কোন সৌজন্যমূলক আচরণ করা হয়নি। খাঁটি ও নিষ্ঠাবান মু’মিন কাকে বলে এবং আল্লাহ্ ও তাঁর দীনের সাথে তাদের সম্পর্ক কি এভাবে বাস্তবে তা দুনিয়াকে দেখানো হয়েছে। দায়লামী হযরত মু’য়ায (রাযিআল্লাহু আনহু) থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ দোয়টি উদ্ধৃত করেছেন:
“হে আল্লাহ আমাকে কোন পাপী (অপর একটি বর্ণনায় আছে ফাসেক) লোকের দ্বারা উপকৃত হতে দিও না। তাহলে আমার মনে তার প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হবে। কারণ, তোমার নাযিলকৃত অহীর মধ্যে আমি একথাও পেয়েছি যে, আল্লাহ্ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান পোষণকারী লোকদেরকে তোমার আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের বিরোধীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবে না। “
এ বিষয়ে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন, কাফিররা যদি মু’মিনদের আত্মীয়-স্বজন বা রক্ত সম্পর্কীয় ও গোত্রীয় লোকও হয়, তাদের সাথে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব এবং তাদের খালেস মহব্বত করতে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মুমিনদের জন্য হারাম করে দিয়েছেন। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন বলেন,
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজদের পিতা ও ভাইদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরিকে প্রিয় মনে করে। তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদেরকে বন্ধরূপে গ্রহণ করে তারাই যালিম”। [সূরা তাওবাহ ৯:২৩]
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল, বর্তমানে অধিকাংশ মানুষ দ্বীনের এ গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতিকে একেবারেই ভুলে গেছে। তারা অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব করাকে তাদের উদারতা, উগ্রবাদ বিরোধিতা ও অসাম্প্রদায়িকতা বলে চালিয়ে যাচ্ছে। তারা মনে করে অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব করা ও তাদের সাথে সু-সম্পর্ক রাখা উদারপন্থী ও অসাম্প্রদায়িক হওয়ার প্রমাণ। মনে রাখতে হবে, যে সব মুসলিম এ ধরনের মন-মানসিকতা পোষণ করে তারা কখনোই ঈমানদার হতে পারে না। তারা ইয়াহুদী খৃষ্টানদের দোসর এবং আল্লাহ ও আল্লাহ্’র রাসূলের দুশমন। আমাদের সমাজে এ ধরনের ঘাতকের অভাব নাই।
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন যেভাবে ইসলামী আকীদায় অবিশ্বাসী কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করাকে হারাম করেছেন এবং তাদের ঘৃণা করার নির্দেশ দিয়েছেন, সেভাবে যারা মু’মিন-এক আল্লাহ্’র সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও নিরংকুশ কর্তৃত্বকে মেনে ঈমান এনেছে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা ও তাদের মহব্বত করাকেও ওয়াজিব করেছেন। একজন মু’মিনের প্রতি অপর মু’মিনের ভালোবাসা ও মহব্বত থাকতে হবে এবং তাদের বিপদ-আপদে এগিয়ে আসতে হবে। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন বলেন,
“তোমাদের বন্ধু কেবল আল্লাহ্, তাঁর রাসূল ও মুমিনগণ, যারা সালাত কায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে বিনীত হয়ে। আর যে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব করে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ্’র দলই বিজয়ী”। [সূরা মায়িদাহ ৫:৫৫]
তো আসুন এবার আপনার-আমার আনুগত্য, বন্ধুত্ব যে অবিশ্বাসী কাফির-মুশরিকদের কাছে বাঁধা পড়ে আছে তা বোঝার জন্যশাইখ ড. সালেহ ইবন ফাউযান আল-ফাউযান লিখিত বই আল-ওয়ালা ওয়া আল-বারা ফিল ইসলাম (ইসলামের দৃষ্টিতে বন্ধুত্ব ও শত্রুতা) থেকে কিছু “আলামত” (sign) আমরা একটু বিবেচনা করে দেখি।
উক্ত রেফারেন্স-এর নিম্নলিখিত “আলামত”গুলোর ব্যাখ্যা উপস্থাপন করবো ইনশা-আল্লাহ :
১.বেশ-ভূষায় এবং কথা-বার্তায় অবিশ্বাসী বা কাফিরদের অনুকরণ করা।
২.অমুসলিম কাফিরদের দেশে বসবাস করা, দ্বীনের হেফাজতের জন্য অমুসলিম দেশ থেকে মুসলিম দেশে হিজরত করা হতে বিরত থাকা।
৩.বিনোদন ও পর্যটনের উদ্দেশ্যে অবিশ্বাসী বা কাফিরদের দেশে ভ্রমণ করা।
৪.কাফিরদের পক্ষে মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়াই করা, মুসলিমদের বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করে তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করা, তাদের প্রশংসা করা।
৫.অমুসলিমদের থেকে সাহায্য কামনা করা, তাদের কথার উপর ভরসা করা, তাদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু নির্বাচন করা, তাদেরকে উপদেষ্টা হিসাবে গ্রহণ করা বা নিয়োগ দেয়া, তাদেরকে এমন উচ্চ পদে তাদের নিয়োগ দেয়া যাতে মুসলিমদের গোপন বিষয়সমূহ তাদের কাছে প্রকাশিত হয়ে যায়।
৬.অমুসলিম তথা কাফির-মুশরিকদের উৎসব ইত্যাদিতে যোগ দেয়া এবং সেগুলোর সময় তাদের শুভেচ্ছা জানানো।
৭.অমুসলিমদের ভ্রান্ত বিশ্বাস ও অপকর্ম সম্বন্ধে না জেনেই, তাদের সভ্যতার বা নৈতিকতার প্রশংসা করা।
৮.শিরককারী-মুশরিকদের জন্য আল্লাহ্’র দরবারে মাগফিরাত-ক্ষমা ও করুণা প্রার্থণা করা।
এক. বেশ-ভূষায় এবং কথা-বার্তায় অবিশ্বাসী বা কাফির-অমুসলিমদের সাদৃশ্য অবলম্বন করা:
লিবাস-পোশাক, চাল-চলন ও কথা-বার্তা ইত্যাদিতে অমুসলিম-কাফির-মুশরিকদের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করা, তাদের সাথে বন্ধুত্বকেই প্রমাণ করে। মুমিনরা কখনোই অমুসলিমদের অনুকরণ করতে পারে না। তারা সব সময় তাদের নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখবে। নিজেরা মানব জাতির জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবে। তাদের আদর্শের প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হবে। তারা কেন বিজাতিদের আদর্শের অনুকরণ করবে? তারা সব সময় বিজাতিদের কৃষ্টি-কালচার ও সংস্কৃতির বিরোধিতা করবে এবং তাদের অন্ধানুকরণ হতে দূরে থাকবে। সে কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য রাখে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকবে।” (আবু দাউদ কিতাবুল লিবাস পরিচ্ছদ)
যে সব আচার-আচরণ, কথা-বার্তা, আখলাক-চরিত্র ইত্যাদি কাফেরদের বৈশিষ্ট্য, সে সব বিষয়ে তাদের অনুকরণ করা সম্পূর্ণ হারাম। যেমন- দাড়ি মুণ্ডন, গোফ বড় করা, প্রয়োজন ছাড়া তাদের সংস্কৃতিতে কথা বলা, তারা যে সব পোশাক পরিধান করে, তা পরিধান করা, তারা যে সব খাদ্য গ্রহণ করে, তা গ্রহণ করা, ইত্যাদি।
দুই. অমুসলিম কাফিরদের দেশে বসবাস করা, দ্বীনের হেফাজতের জন্য অমুসলিম দেশ থেকে মুসলিম দেশে হিজরত করা হতে বিরত থাকা:
যখন একজন মুসলিম ব্যক্তি কোন অমুসলিম দেশে তার দ্বীনের বিষয়ে আশঙ্কা করবে, তাকে অবশ্যই দ্বীনের হেফাজতের জন্য কাফেরদের দেশ ত্যাগ করে কোন মুসলিম দেশে হিজরত করতে হবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রতিটি মুসলিমের উপর তার দ্বীনের হেফাজতের জন্য হিজরত করা ওয়াজিব। কারণ, দ্বীনের বিষয়ে আশঙ্কা করার পরও কাফের দেশে অবস্থান করা, কাফেরদের সাথে সু-সম্পর্ক রাখা ও তাদের সাথে বন্ধুত্ব করার প্রমাণ বহন করে। এ কারণেই হিজরত করতে সক্ষম, এমন ব্যক্তির জন্য কোন কাফেরদের মাঝে অবস্থান করা আল্লাহ্ হারাম ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন বলেন,
“নিশ্চয় যারা নিজদের প্রতি যুলমকারী, ফেরেশতারা তাদের জান কবজ করার সময় বলে, তোমরা কি অবস্থায় ছিলে? তারা বলে, আমরা জমিনে দুর্বল ছিলাম। ফেরেশতারা বলে, আল্লাহর জমিন কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তাতে হিজরত করতে? সুতরাং ওরাই তারা যাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম। আর তা মন্দ প্রত্যাবর্তন-স্থল। তবে দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশু যারা কোন উপায় অবলম্বন করতে পারে না এবং কোন রাস্তা খুঁজে পায় না। অতঃপর আশা করা যায় যে, আল্লাহ্ তাদেরকে ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ্ মার্জনাকারী, ক্ষমাশীল।” [সূরা আন-নিসা ৪:৯৭-৯৯]
আয়াতে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মু’মিনদের জন্য হিজরত করাকে ফরয করে দিয়েছেন। একমাত্র দুর্বল যারা হিজরত করতে অক্ষম তাদেরকে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন অমুসলিম দেশে অবস্থান করার অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু হিজরত করতে সক্ষম ব্যক্তিদের জন্য অমুসলিম দেশে বসবাস করার অনুমতি আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন কোন মুসলিমকে দেননি। কারণ হিজরতের বিধান অদ্যবধি চালু আছে। তা বন্ধ হয়নি।
অনুরূপভাবে যাদের কাফেরদের দেশে থাকার দ্বারা ইসলাম ও মুসলিমের কোন উপকার ও কল্যাণ রয়েছে, তাদের জন্য কাফেরদের দেশে থাকার অনুমতি ইসলাম দিয়েছে। যেমন- কাফেরদের দেশে কাফেরদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিতে পারে, তাদের মধ্যে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরতে পারে এবং ইসলামের প্রচার করতে পারে। এ ধরনের লোকের জন্য কাফের দেশে অবস্থান করাতে কোন অসুবিধা বা গুনাহ নাই। তারা সেখানে অবস্থান করে মুসলিমদের পক্ষে কাজ করবে। তবে এর বিপরীত উদ্দেশ্যে দুনিয়াবী ভোগ-বিলাস, আরাম-আয়েশের জন্য কুফ্’ফারের দেশে অবস্থান করা জায়িয নয়। যেমন হাদীস শরীফে এসেছে:
হযরত সামুরা বিন জুনদুব (রাযিআল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: “যে কেউ কোন মুশরিকের সাথে দেখা করে, সমাবেশে মিলিত হয়, একত্রে বাস করে অথবা তার পাশাপাশি স্থায়ীভাবে বসবাস করে এবং তার সাথে তার পন্থাসমূহের ব্যাপারে একমত হয় এবং তার সাথে নিজের বসবাসকে উপভোগ করে, তবে সে তারই মত একজন।” (আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ)
হাদীসটির সহজ-সরল ব্যাখ্যা হচ্ছে- মুসলিমদের মধ্য থেকে যদি কেউ কোন মুশরিক অর্থাৎ একাধিক ঈশ্বরে বিশ্বাসী অথবা এক আল্লাহ্’র রুবুবিয়্যাতে বিশ্বাস করে না এমন কারো সাথে দেখা করে, তাদের সমাবেশে মিলিত হয়, একত্রে বাস করে অথবা কাফির/মুশরিকের পাশাপাশি স্থায়ীভাবে বসবাস করে এবং কাফির/মুশরিকের সাথে তার পন্থাসমূহের ব্যাপারে একমত হয় এবং কাফির/মুশরিকের সাথে নিজের বসবাসকে উপভোগ করে, তবে ঐ মুসলিম ঐ কাফির/মুশরিকের মত একজন।
তাহলে হাদিসটি এই শিক্ষাই দেয় যে, একজন মু’মিন মুসলমানের উচিত নয় অ-মুসলিম কুফ্ফারের দেশে বাস করা, তার অবশ্যই কোন মুসলিম দেশে হিজরত করা উচিত, যেখানে প্রকৃত ইসলাম চর্চা করা হয়।
তিন. বিনোদন ও পর্যটনের উদ্দেশ্যে তাদের দেশে ভ্রমণ করা:
প্রয়োজন ব্যতীত কাফেরদের দেশে ভ্রমণ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে প্রয়োজনীয় কাজে ভ্রমণ করাতে কোন অসুবিধা নাই। যেমন, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য, উচ্চ শিক্ষা লাভ, বিশেষতঃ এমন কোন ডিগ্রি হাসিল, যা তাদের দেশে যাওয়া ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়, এ ধরনের কোন প্রয়োজনীয় কাজের জন্য ভ্রমণ করা বৈধ। তখন এ সব প্রয়োজনের খাতিরে তাদের দেশে সফর করা ও সেখানে সাময়িক অবস্থান করাতে কোন গুনাহ হবে না। আর একটি কথা মনে রাখতে হবে, যে সব প্রয়োজনের তাগিদে তাদের দেশে ভ্রমণ করা যেতে পারে, প্রয়োজন শেষ হওয়ার সাথে সাথে তার জন্য মু’মিনদের দেশে ফিরে আসা ওয়াজিব। সেখানে কাল ক্ষেপণ করা বা বিনোদনের উদ্দেশ্যে ঘুরা-ফেরা করা কোন ক্রমেই উচিত না।
এ ধরনের সফর বৈধ হওয়ার জন্য শর্ত হল, সে সেখানে নিজের দ্বীন প্রকাশ করার ক্ষমতা থাকতে হবে, মুসলিম হওয়ার কারণে তার মধ্যে কোন প্রকার সংকোচ ও হীনমন্যতা থাকতে পারবে না। মুসলিম হওয়ার কারণে তার সম্মানবোধ থাকতে হবে। অমুসলিমের দেশে যে সব অন্যায়, অনাচার ও কু-সংস্কার সংঘটিত হয়, তার থেকে দূরে থাকতে হবে। শত্র“দের ষড়যন্ত্রের শিকার হওয়া থেকে সাবধান থাকতে হবে। অনুরূপভাবে যদি কারো জন্য অমুসলিম দেশে ইসলামের দাওয়াত দেয়া ও ইসলাম প্রচারের কাজ করার সুযোগ হয়, তখন তার জন্য অমুসলিম দেশে অবস্থান করা বৈধ, আবার কখনও কখনও ওয়াজিব।
চার. কাফিরদের পক্ষে মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়াই করা, মুসলিমদের বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করে তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করা, তাদের প্রশংসা করা:
মুসলিমদের বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করে তাদের সহযোগিতা করা মারাÍক অপরাধ ও বড় গুনাহ। যারা এ ধরনের কাজ করে, তারা কোন ক্রমেই মুসলিম হতে পারে না। এ কাজটি হল, ইসলাম বিনষ্টকারী ও ঈমান হারা হওয়ার অন্যতম উপকরণ। এ ধরনের কাজ করলে সে মুরতাদ বা বেঈমান বলে গণ্য হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের এ ধরনের কাজ করা হতে নাজাত দান করুন। আমরা একটা মুসলিম প্রধান দেশে থাকি বলে অনেক সময়ই হয়তো “মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সাহায্য করা” বলতে কি বোঝায় তা হয়তো বুঝি না।
পাঁচ. অমুসলিমদের থেকে সাহায্য কামনা করা, তাদের কথার উপর ভরসা করা, তাদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু নির্বাচন করা,তাদেরকে উপদেষ্টা হিসাবে গ্রহণ করা বা নিয়োগ দেয়া, তাদেরকে এমন উচ্চ পদে তাদের নিয়োগ দেয়া যাতে মুসলিমদের গোপন বিষয়সমূহ তাদের কাছে প্রকাশিত হয়ে যায়।
এই ব্যাপারটা যে সরাসরি কুরআন থেকে এসেছে তাও হয়তো আমরা অনেকেই জানিনা। দেখুন আল্লাহ্ কি বলছেন:
“হে মুমিনগণ, তোমরা তোমাদের ছাড়া অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধরূপে গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের সর্বনাশ করতে ত্রুটি করবে না। তারা তোমাদের মারাÍক ক্ষতি কামনা করে। তাদের মুখ থেকে তো শত্রুতা প্রকাশ পেয়ে গিয়েছে। আর তাদের অন্তরসমূহ যা গোপন করে তা মারাÍক। অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য আয়াতসমূহ স্পষ্ট বর্ণনা করেছি। যদি তোমরা উপলব্ধি করতে। শোন, তোমরাই তো তাদেরকে ভালবাসা এবং তারা তোমাদেরকে ভালবাসে না। অথচ তোমরা সব কিতাবের প্রতি ঈমান রাখ। আর যখন তারা তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ করে, তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি। আর যখন তারা একান্তে মিলিত হয়, তোমাদের উপর রাগে আঙ্গুল কামড়ায়। বল, তোমরা তোমাদের রাগ নিয়ে মর! নিশ্চয় আল্লাহ্ তারা যা করে, তা পরিবেষ্টনকারী। যদি তোমাদেরকে কোন ভালো কিছু স্পর্শ করে তখন তাদেরকে কষ্ট দেয়, আর যদি তোমাদের উপর কোন বিপদ-কষ্ট আপতিত হয়, তখন তারা তাতে খুশি হয়।” (সূরা আলে ইমরান ৩:১১৮-১২০)
সাধারণভাবে প্রায় সকল মুসলিম দেশ, আর বিশেষভাবে আমাদের দেশের সাদা-চামড়ার কাফির-মুশরিক বিশেষজ্ঞ তথা উপদেষ্টা প্রীতি যে কি ভয়াবহ তা সচেতন পাঠক মাত্রই জানেন। দাতা ও সেবা সংস্থা, এনজিও, জ্বালানী খাত, এমন কি শিক্ষাক্ষেত্রেও বিভিন্ন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে “বিশেষজ্ঞ” শিক্ষক নিয়োগের বদৌলতে দেশের জন-সাধারণের নৈতিকতার বারোটা যেমন বাজতে বসেছে তেমনি বিদেশীদের পরিকল্পিত কাফিরায়ণ প্রকল্পের আওতায়, “সেকেলে ইসলামে” প্রতিদিন বিশ্বাস হারাচ্ছে শত শত “ডি-জুস” উত্তর “ফেসবুক” প্রজন্মের মুসলিম সন্তানেরা। অথচ আল্লাহ আপনাকে দেড় হাজার বছর আগেই বলে দিয়েছেন: অবিশ্বাসীদের উপদেষ্টা, কনসাল্টেন্ট, সাহায্যকারী হিসাবে গ্রহণ না করতে কারণ মুসলিমদের ক্ষতি করার কোন সুযোগ তারা হাতছাড়া করবে না। অথচ, আমাদের দেশ সহ প্রায় সকল মুসলিম দেশের স্পর্শকাতর ও গোপন বিষয়গুলোতে অবিশ্বাসীদের “প্রবেশাধিকার” অবারিত বললেও ভুল হবে না বোধহয়। যারা নিজেদের মু’মিন-মুসলিম দাবী করেন এবং মুসলিম সমাজে বসবাস করেন, মু’মিন স্বজন-পরিজনের সাথে বাহ্যিক সুসম্পর্ক এবং সদ্ভাব বজায় রেখে চলেন অথচ অমুসলিম কাফির-মুশরিকদের সাথে সখ্য-বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলেন তাদের সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
“সেসব মুনাফিককে সুসংবাদ শুনিয়ে দিন যে, তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। যারা মু’মিনদের পরিবর্তে কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে এবং তাদেরই কাছে সম্মান প্রত্যাশা করে, অথচ সমস্ত সম্মান শুধুমাত্র আল্লাহ্ পাকেরই জন্য।” (সূরা আন নিসা ৪:১৩৮-১৩৯)
“আপনি তাদের অনেককে দেখবেন, কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করে। তারা নিজেদের জন্য যা পাঠিয়েছে তা অবশ্যই মন্দ। তা এই যে, তাদের প্রতি আল্লাহ ক্রোধান্বিত হয়েছেন এবং তারা চিরকাল আযাবে থাকবে।” (সূরা আল মায়িদাহ্ ৫:৫৭)
ছয়. অমুসলিম তথা কাফির-মুশরিকদের উৎসব ইত্যাদিতে যোগ দেয়া এবং সেগুলোর সময় তাদের শুভেচ্ছা জানানো।
খুব সম্ভবত অজ্ঞতাবশতই, আমাদের দেশের বহু মানুষ বিধর্মীদের উৎসবসমূহে তাদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন, কেউ কেউ তাদের দাওয়াতে যান তাদের পার্টি বা ভোজ ইত্যাদিতে অংশগ্রগণ করেন। এটা হচ্ছে তাদের প্রতি আপনার ভালবাসার পরিচায়ক এবং অনেক ক্ষেত্রই তাদের মত হবার সুপ্ত বাসনার প্রকাশ! এ সম্বন্ধে সূরা আল ফুরকানের ৭২ নং আয়াতের তাফসীরে ইবনে কাসীর (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, “আল্লাহ্’র ম’মিন বান্দারা মিথ্যা বলেনা, পাপাচারে লিপ্ত হয়না, কুফরী করে না, অশ্লিল ও মন্দ কাজ হতে বিরত থাকে, কাফির-মুশরিকদের অনুষ্ঠান, আনন্দ উৎসবে যোগদান করা হতে বিরত থাকে।”
সুতরাং পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, বিধর্মীদের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া, তাদের শুভেচ্ছো জানানো ইত্যাদি ইসলামের দৃষ্টিতে কত গর্হিত ও অপছন্দনীয় হারাম কাজ।
সাত. অমুসলিমদের ভ্রান্ত বিশ্বাস ও অপকর্ম সম্বন্ধে না জেনেই, তাদের সভ্যতার বা নৈতিকতার প্রশংসা করা।
এটাও হচ্ছে বিধর্মীদের প্রতি আপনার ভালোবাসা তথা তাদের কৃষ্টি-কালচারের প্রতি আপনার দুর্বলতার আলামত! আমরা অনেককেই বলতে শুনি যে, “(পশ্চিমা কাফির দেশগুলো) ওসব দেশের নিয়ম কানুন কতই না ইসলামিক, কেবল তারা মুসলিম নয় এই যা” অথবা “ওসব দেশে সব কিছু নিয়ম মেনে চলে এবং ওখানে আরো ভালোভাবে ইসলাম পালন করা যায়” ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ আমরা ভুলে যাই যে, পশ্চিমা দেশগুলোতে “কুফর” হচ্ছে আদর্শ, আর আমাদের দেশের মত মুসলিম দেশ গুলোতে এখনো, এত কিছুর পরেও, ইসলামই হচ্ছে আদর্শ। আরো একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতিও আমরা ভুলে যাই: ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে, “কুফর/শিরক” হচ্ছে এমন দোষ যা অন্য সকল গুণ বা অর্জন নষ্ট করে দেয় -আর- ঈমান হচ্ছে এমন একটা গুণ, যা অন্য অনেক দোষকে মুছে দেয় বা হালকা করে দেয়! অনেকে আবার তাদের বস্তুবাদী অর্জনকে তাদের “শুদ্ধতার” প্রতিফল মনে করে থাকেন অথচ দেখুন আল্লাহ্ কুরআনে কি বলেছেন:
“আর তুমি কখনো তোমার দু’চোখ সে সবের প্রতি প্রসারিত করো না, যা আমি তাদের বিভিন্ন শ্রেণীকে দুনিয়ার জীবনের জাঁক-জমকস্বরূপ উপভোগের উপকরণ হিসেবে দিয়েছি। যাতে আমি সে বিষয়ে তাদেরকে পরীক্ষা করে নিতে পারি। আর তোমার রবের প্রদত্ত রিযিক সর্বোৎকৃষ্ট ও অধিকতর স্থায়ী।” (সূরা ত্ব-হা ২০:১৩১)
আট. শিরককারী-মুশরিকদের জন্য আল্লাহ্’র দরবারে মাগফিরাত-ক্ষমা ও করুণা প্রার্থণা করা:
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মুশরিকদের জন্য দো’আ ও ক্ষমা প্রার্থনা করাকে হারাম করেছেন। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন বলেন-
“নাবী ও মুমিনদের উচিত নয় যে, তারা মুশরিকদের মাগফিরাত কামনা করবে, এমনকি যদি তারা ঘানষ্ট আত্মীয়ও হয়, যখন তাদের নিকট এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তারা নিশ্চিতভাবে জাহান্নামের অধিবাসী।” [সূরা তাওবা ৯:১১৩]
আয়াতে কারীমা দ্বারা এ কথা স্পষ্ট হয় যে, কাফির, মুশরিক ও বেঈমানরা অবশ্যই চির জাহান্নামী। তারা কখনোই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। যখন কোন মানুষের নিকট এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়, লোকটি কাফির বা মুশরিক (শিরককারী) তখন তার জন্য আল্লাহ্’র নিকট ক্ষমা প্রার্থণা করা এবং তার মাগফিরাত কামনা করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যদিও সে তার নিকটাত্মীয় বা মাতা-পিতা হোক। কারণ, তাদের জন্য দো’আ করা বা ক্ষমা প্রার্থনা দ্বারা প্রমাণিত হয়, মুসলিমরা তাদের মহব্বত করে এবং তারা যে ভ্রান্ত ও বাতিল দ্বীনের উপর আছে তা সঠিক। অন্যথায় তাদের জন্য কেন ক্ষমা প্রার্থণা করবে এবং দো’আ করবে?
তবে এখানে দু’টি জিনিসের প্রতি লক্ষ্য রাখা দরকার:
প্রথমত, কারো ঈমানের ব্যাপারে আমরা যদি গুরুতর সন্দেহে থাকি, তাহলে তার জন্য তার মৃত্যুর পরে, দোয়া করার আগে আমরা সাবধান হবো এবং জেনে নিতে চেষ্টা করবো যে, “গুরুতর সন্দেহের” কারণ ঘটার পর, অন্তত তিনি নিজে কখনো নিজেকে মুসলিম বলে দাবী করেছেন কি না। আর যদি আমরা নিশ্চিত হই যে, তিনি আমৃত্যু ইসলামের বাইরেই ছিলেন, তবে তার জন্য কিছুতেই দোয়া করা জায়েয না, সে যত বড় ব্যক্তিত্বই হোন না কেন!
তাই কারো ঈমানের ব্যাপারে “গুরুতর সন্দেহ” থাকলে আমরা তার মৃত্যুর পর নিরাপদ অবস্থানে থেকে চুপ থাকতে পারি। আবারও বলছি এটা কেবল যাদের ব্যাপারে “গুরুতর সন্দেহ” রয়েছে, তাদের বেলায় প্রযোজ্য। তবে একজন বে-আমলী সাধারণ মুসলিম, যিনি মৃত্যুর পূর্ব মূহূর্ত পর্যন্ত নিজেকে মুসলিম বলে দাবী করতেন, আমরা অবশ্যই তার জন্য মাগফিরাত কামনা করবো।
দ্বিতীয়ত, যারা পাপকর্মের জন্য বা দ্বীন ইসলামের নিয়মনীতি বিরুদ্ধ (সিনেমা, নাচ, গান, অশ্লীল সাহিত্য ইত্যাদি ইত্যাদি) কাজের জন্য বিখ্যাত, যারা প্রকাশ্য তাগুত তাদের মৃত্যুর পরে (এবং এমন কি তাদের জীবদ্দশায়ও) তাদের ঐ সমস্ত কাজ তা দেশের জন্য বা তাদের জন্য যত বড় সম্মানই বয়ে আনুক না কেন আমরা সেগুলোকে সমর্থন করে তাদের, আমাদের জন্য আদর্শ করে তুলবো না ইসলামের দৃষ্টিতে যে খলনায়ক, তাকে মহানায়ক বানাবো না। তাদের পক্ষে এমন কোন প্রচার-প্রচারণা বা স্তব-স্তুতি করবো না, যার মাধ্যমে খলনায়কও মহানায়ক হয়ে যায় এবং না জেনেই মানুষ তাদের অনুসরণ করতে শুরু করে। বরং ধর্মীয় পরিচয়ে তাদেরকে মুসলিম জানলেও মৃত্যুর পর তাদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করবো না।
যা হোক ঈমানের চূড়ান্ত দাবী এই যে, কাফির-মুশরিকরা কখনোই মু’মিনের ভালোবাসা বা বন্ধুত্ব পাবার যোগ্য নয়, মু’মিনের ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের দাবীদার হচ্ছেন অপর মু’মিন ভাই-বোনেরা। ইসলামিক স্কলারদের মতসমূহ পর্যালোচনা করলে “আল-ওয়ালা ওয়া আল-বারা”-র ভিত্তিতে পৃথিবীর মানুষকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়:
১. যাদেরকে আমরা সব সময় ভালোবাসবো কখনোই ঘৃণা করবো না। যেমন: নাবীগণ, সিদ্দিকগণ, শহীদগণ ও আমালে সালেহকারীগণ।
২. যাদেরকে পরিপূর্ণরূপে ঘৃণা করবো কোন ভালোবাসা ছাড়া। যেমন: কাফির-মুশরিকগণ। এখানে একটু ছোট্ট ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে ভালোবাসা আর দয়া/করুণা কিন্তু এক ব্যাপার নয়। ধরুন আপনার গাড়ীর ধাক্কায় একটা লোক আহত হলো আপনি তাকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার আগে নাম জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়ার প্রয়োজন নেই যে সে মুসলিম না কাফির এটা দয়া বা করুণা থেকেই আপনি যে কারো জন্য করবেন। “ওয়ালা” শব্দটিতে একটা “নিজেদের একজন মনে করার” একটা ধারণা আছে। মু’মিনের জন্য একজন কাফির/মুশরিককে নিজেদের একজন বা বন্ধু মনে করার কোন অবকাশ নেই।
৩. যাদের ভালোবাসার কারণ যেমন রয়েছে, তেমনি ঘৃণা করার কারণও রয়েছে। এরা হচ্ছেন মূলত ঈমানদার মুসলিম কিন্তু তারা কবীরা গুনাহে লিপ্ত রয়েছেন। তাদের ঈমানের জন্য বা আমালে সালেহ’র জন্য তাদের আমরা তাদের ভালোবাসবো এবং তাদের পাপাচারের জন্য আমরা তাদের ঘৃণা করবো।
পরিশিষ্ট : ইবলিশ (শয়তান) হযরত আদম আলাইহিস সালাম-এর একান্ত আপন হয়ে, নিজেকে একমাত্র বন্ধু হিসেবে উপস্থাপন করে তাঁর ভবিষ্যৎ মঙ্গলের (!) চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। অতঃপর বন্ধুর মন গলাতে শুরু করেছিলেন প্রাণঢালা কান্না। হযরত আদম আলাইহিস সালামও প্রথম পর্যায়ে সরল বিশ্বাসে ইবলিশকে প্রকৃত বন্ধু বলে বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু অবশেষে নকল বন্ধু ইবলিশের শঠতা ও প্রতারণা বুঝতে পেরে প্রকৃত বন্ধু আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের দরবারে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন। তিনি নিজের অনিচ্ছাকৃত ভুল স্বীকার করে তাঁর মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্’র সাথে পূর্বের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেছিলেন।
সুতরাং আদি পিতার আদর্শ অনুসরণ করে আমাদেরও আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মসমালোচনার মাধ্যমে বন্ধুত্বতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা শঠ-প্রতারক শত্রুতাকারীদের চিনে নেয়া একান্ত কর্তব্য। আমাদের উচিত নকল বন্ধুদের পরিচয় চিহ্নিত করে তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং প্রকৃত বন্ধুদের পরিচয় জেনে তাদের সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করা। কারণ সঠিক বন্ধু নির্বাচন করতে না পারলে কিয়ামত দিবসে শুধু অনুশোচনাই করতে হবে। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হচ্ছে-
‘যালিম ব্যক্তি সেদিন (কিয়ামত দিবসে) নিজ হস্তদ্বয় কামড়াতে কামড়াতে বলবে, হায় আফসোস! আমি যদি রাসূলের প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করতাম; হায় দুর্ভাগ্য আমার; আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম!’ (সূরা আল ফুরকান ২৫:২৭-২৮)
সুতরাং আমাদের উচিত হবে বিগত দিনগুলোর যাবতীয় ভুলত্রুটি শুধরে নিয়ে প্রকৃত বন্ধুর সাথে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রদর্শিত সিরাতুল মুস্তাকিমের (সরল-সহজ পথ) দিকে এগিয়ে যাওয়া। এতে যেমন নিজ নিজ জীবন হয়ে উঠবে সুন্দর ও সার্থক, পাশাপাশি সংসার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা বিশ্ব সমাজেও বয়ে যাবে অনুপম সুখ-সমৃদ্ধি আর শান্তি-শৃঙ্খলার অফুরন্ত বারিধারা।
পরিশেষে মহান রব্ব আল্লাহ্ সুব্’হানাহু ওয়া তায়ালার দরবারে দোয়ার মাধ্যমে মাধ্যমে লেখার ইতি টানছি : “হে আমাদের রব্ব, দয়া করে আপনার মু’মিন বান্দাদের ‘আল-ওয়ালা ওয়া আল-বারা’ (ইসলামের দৃষ্টিতে শত্রু-মিত্র)-এর ব্যাপারগুলো বোঝার তাওফিক্ব দিন এবং আমরা যেন আপনার সন্তুষ্টি নিয়ে শোকর গুজার বান্দাহ হিসেবে দুনিয়া হতে বিদায় হতে পারি সে তাওফিক্ব দিন! আমীন!”
ছয়. অমুসলিম তথা কাফির-মুশরিকদের উৎসব ইত্যাদিতে যোগ দেয়া এবং সেগুলোর সময় তাদের শুভেচ্ছা জানানো।
খুব সম্ভবত অজ্ঞতাবশতই, আমাদের দেশের বহু মানুষ বিধর্মীদের উৎসবসমূহে তাদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন, কেউ কেউ তাদের দাওয়াতে যান তাদের পার্টি বা ভোজ ইত্যাদিতে অংশগ্রগণ করেন। এটা হচ্ছে তাদের প্রতি আপনার ভালবাসার পরিচায়ক এবং অনেক ক্ষেত্রই তাদের মত হবার সুপ্ত বাসনার প্রকাশ! এ সম্বন্ধে সূরা আল ফুরকানের ৭২ নং আয়াতের তাফসীরে ইবনে কাসীর (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, “আল্লাহ্’র ম’মিন বান্দারা মিথ্যা বলেনা, পাপাচারে লিপ্ত হয়না, কুফরী করে না, অশ্লিল ও মন্দ কাজ হতে বিরত থাকে, কাফির-মুশরিকদের অনুষ্ঠান, আনন্দ উৎসবে যোগদান করা হতে বিরত থাকে।”
সুতরাং পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, বিধর্মীদের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া, তাদের শুভেচ্ছো জানানো ইত্যাদি ইসলামের দৃষ্টিতে কত গর্হিত ও অপছন্দনীয় হারাম কাজ।
সাত. অমুসলিমদের ভ্রান্ত বিশ্বাস ও অপকর্ম সম্বন্ধে না জেনেই, তাদের সভ্যতার বা নৈতিকতার প্রশংসা করা।
এটাও হচ্ছে বিধর্মীদের প্রতি আপনার ভালোবাসা তথা তাদের কৃষ্টি-কালচারের প্রতি আপনার দুর্বলতার আলামত! আমরা অনেককেই বলতে শুনি যে, “(পশ্চিমা কাফির দেশগুলো) ওসব দেশের নিয়ম কানুন কতই না ইসলামিক, কেবল তারা মুসলিম নয় এই যা” অথবা “ওসব দেশে সব কিছু নিয়ম মেনে চলে এবং ওখানে আরো ভালোভাবে ইসলাম পালন করা যায়” ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ আমরা ভুলে যাই যে, পশ্চিমা দেশগুলোতে “কুফর” হচ্ছে আদর্শ, আর আমাদের দেশের মত মুসলিম দেশ গুলোতে এখনো, এত কিছুর পরেও, ইসলামই হচ্ছে আদর্শ। আরো একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতিও আমরা ভুলে যাই: ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে, “কুফর/শিরক” হচ্ছে এমন দোষ যা অন্য সকল গুণ বা অর্জন নষ্ট করে দেয় -আর- ঈমান হচ্ছে এমন একটা গুণ, যা অন্য অনেক দোষকে মুছে দেয় বা হালকা করে দেয়! অনেকে আবার তাদের বস্তুবাদী অর্জনকে তাদের “শুদ্ধতার” প্রতিফল মনে করে থাকেন অথচ দেখুন আল্লাহ্ কুরআনে কি বলেছেন:
“আর তুমি কখনো তোমার দু’চোখ সে সবের প্রতি প্রসারিত করো না, যা আমি তাদের বিভিন্ন শ্রেণীকে দুনিয়ার জীবনের জাঁক-জমকস্বরূপ উপভোগের উপকরণ হিসেবে দিয়েছি। যাতে আমি সে বিষয়ে তাদেরকে পরীক্ষা করে নিতে পারি। আর তোমার রবের প্রদত্ত রিযিক সর্বোৎকৃষ্ট ও অধিকতর স্থায়ী।” (সূরা ত্ব-হা ২০:১৩১)
আট. শিরককারী-মুশরিকদের জন্য আল্লাহ্’র দরবারে মাগফিরাত-ক্ষমা ও করুণা প্রার্থণা করা:
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মুশরিকদের জন্য দো’আ ও ক্ষমা প্রার্থনা করাকে হারাম করেছেন। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন বলেন-
“নাবী ও মুমিনদের উচিত নয় যে, তারা মুশরিকদের মাগফিরাত কামনা করবে, এমনকি যদি তারা ঘানষ্ট আত্মীয়ও হয়, যখন তাদের নিকট এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তারা নিশ্চিতভাবে জাহান্নামের অধিবাসী।” [সূরা তাওবা ৯:১১৩]
আয়াতে কারীমা দ্বারা এ কথা স্পষ্ট হয় যে, কাফির, মুশরিক ও বেঈমানরা অবশ্যই চির জাহান্নামী। তারা কখনোই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। যখন কোন মানুষের নিকট এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়, লোকটি কাফির বা মুশরিক (শিরককারী) তখন তার জন্য আল্লাহ্’র নিকট ক্ষমা প্রার্থণা করা এবং তার মাগফিরাত কামনা করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যদিও সে তার নিকটাত্মীয় বা মাতা-পিতা হোক। কারণ, তাদের জন্য দো’আ করা বা ক্ষমা প্রার্থনা দ্বারা প্রমাণিত হয়, মুসলিমরা তাদের মহব্বত করে এবং তারা যে ভ্রান্ত ও বাতিল দ্বীনের উপর আছে তা সঠিক। অন্যথায় তাদের জন্য কেন ক্ষমা প্রার্থণা করবে এবং দো’আ করবে?
তবে এখানে দু’টি জিনিসের প্রতি লক্ষ্য রাখা দরকার:
প্রথমত, কারো ঈমানের ব্যাপারে আমরা যদি গুরুতর সন্দেহে থাকি, তাহলে তার জন্য তার মৃত্যুর পরে, দোয়া করার আগে আমরা সাবধান হবো এবং জেনে নিতে চেষ্টা করবো যে, “গুরুতর সন্দেহের” কারণ ঘটার পর, অন্তত তিনি নিজে কখনো নিজেকে মুসলিম বলে দাবী করেছেন কি না। আর যদি আমরা নিশ্চিত হই যে, তিনি আমৃত্যু ইসলামের বাইরেই ছিলেন, তবে তার জন্য কিছুতেই দোয়া করা জায়েয না, সে যত বড় ব্যক্তিত্বই হোন না কেন!
তাই কারো ঈমানের ব্যাপারে “গুরুতর সন্দেহ” থাকলে আমরা তার মৃত্যুর পর নিরাপদ অবস্থানে থেকে চুপ থাকতে পারি। আবারও বলছি এটা কেবল যাদের ব্যাপারে “গুরুতর সন্দেহ” রয়েছে, তাদের বেলায় প্রযোজ্য। তবে একজন বে-আমলী সাধারণ মুসলিম, যিনি মৃত্যুর পূর্ব মূহূর্ত পর্যন্ত নিজেকে মুসলিম বলে দাবী করতেন, আমরা অবশ্যই তার জন্য মাগফিরাত কামনা করবো।
দ্বিতীয়ত, যারা পাপকর্মের জন্য বা দ্বীন ইসলামের নিয়মনীতি বিরুদ্ধ (সিনেমা, নাচ, গান, অশ্লীল সাহিত্য ইত্যাদি ইত্যাদি) কাজের জন্য বিখ্যাত, যারা প্রকাশ্য তাগুত তাদের মৃত্যুর পরে (এবং এমন কি তাদের জীবদ্দশায়ও) তাদের ঐ সমস্ত কাজ তা দেশের জন্য বা তাদের জন্য যত বড় সম্মানই বয়ে আনুক না কেন আমরা সেগুলোকে সমর্থন করে তাদের, আমাদের জন্য আদর্শ করে তুলবো না ইসলামের দৃষ্টিতে যে খলনায়ক, তাকে মহানায়ক বানাবো না। তাদের পক্ষে এমন কোন প্রচার-প্রচারণা বা স্তব-স্তুতি করবো না, যার মাধ্যমে খলনায়কও মহানায়ক হয়ে যায় এবং না জেনেই মানুষ তাদের অনুসরণ করতে শুরু করে। বরং ধর্মীয় পরিচয়ে তাদেরকে মুসলিম জানলেও মৃত্যুর পর তাদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করবো না।
যা হোক ঈমানের চূড়ান্ত দাবী এই যে, কাফির-মুশরিকরা কখনোই মু’মিনের ভালোবাসা বা বন্ধুত্ব পাবার যোগ্য নয়, মু’মিনের ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের দাবীদার হচ্ছেন অপর মু’মিন ভাই-বোনেরা। ইসলামিক স্কলারদের মতসমূহ পর্যালোচনা করলে “আল-ওয়ালা ওয়া আল-বারা”-র ভিত্তিতে পৃথিবীর মানুষকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়:
১. যাদেরকে আমরা সব সময় ভালোবাসবো কখনোই ঘৃণা করবো না। যেমন: নাবীগণ, সিদ্দিকগণ, শহীদগণ ও আমালে সালেহকারীগণ।
২. যাদেরকে পরিপূর্ণরূপে ঘৃণা করবো কোন ভালোবাসা ছাড়া। যেমন: কাফির-মুশরিকগণ। এখানে একটু ছোট্ট ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে ভালোবাসা আর দয়া/করুণা কিন্তু এক ব্যাপার নয়। ধরুন আপনার গাড়ীর ধাক্কায় একটা লোক আহত হলো আপনি তাকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার আগে নাম জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়ার প্রয়োজন নেই যে সে মুসলিম না কাফির এটা দয়া বা করুণা থেকেই আপনি যে কারো জন্য করবেন। “ওয়ালা” শব্দটিতে একটা “নিজেদের একজন মনে করার” একটা ধারণা আছে। মু’মিনের জন্য একজন কাফির/মুশরিককে নিজেদের একজন বা বন্ধু মনে করার কোন অবকাশ নেই।
৩. যাদের ভালোবাসার কারণ যেমন রয়েছে, তেমনি ঘৃণা করার কারণও রয়েছে। এরা হচ্ছেন মূলত ঈমানদার মুসলিম কিন্তু তারা কবীরা গুনাহে লিপ্ত রয়েছেন। তাদের ঈমানের জন্য বা আমালে সালেহ’র জন্য তাদের আমরা তাদের ভালোবাসবো এবং তাদের পাপাচারের জন্য আমরা তাদের ঘৃণা করবো।
পরিশিষ্ট : ইবলিশ (শয়তান) হযরত আদম আলাইহিস সালাম-এর একান্ত আপন হয়ে, নিজেকে একমাত্র বন্ধু হিসেবে উপস্থাপন করে তাঁর ভবিষ্যৎ মঙ্গলের (!) চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। অতঃপর বন্ধুর মন গলাতে শুরু করেছিলেন প্রাণঢালা কান্না। হযরত আদম আলাইহিস সালামও প্রথম পর্যায়ে সরল বিশ্বাসে ইবলিশকে প্রকৃত বন্ধু বলে বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু অবশেষে নকল বন্ধু ইবলিশের শঠতা ও প্রতারণা বুঝতে পেরে প্রকৃত বন্ধু আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের দরবারে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন। তিনি নিজের অনিচ্ছাকৃত ভুল স্বীকার করে তাঁর মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্’র সাথে পূর্বের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেছিলেন।
সুতরাং আদি পিতার আদর্শ অনুসরণ করে আমাদেরও আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মসমালোচনার মাধ্যমে বন্ধুত্বতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা শঠ-প্রতারক শত্রুতাকারীদের চিনে নেয়া একান্ত কর্তব্য। আমাদের উচিত নকল বন্ধুদের পরিচয় চিহ্নিত করে তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং প্রকৃত বন্ধুদের পরিচয় জেনে তাদের সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করা। কারণ সঠিক বন্ধু নির্বাচন করতে না পারলে কিয়ামত দিবসে শুধু অনুশোচনাই করতে হবে। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হচ্ছে-
‘যালিম ব্যক্তি সেদিন (কিয়ামত দিবসে) নিজ হস্তদ্বয় কামড়াতে কামড়াতে বলবে, হায় আফসোস! আমি যদি রাসূলের প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করতাম; হায় দুর্ভাগ্য আমার; আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম!’ (সূরা আল ফুরকান ২৫:২৭-২৮)
সুতরাং আমাদের উচিত হবে বিগত দিনগুলোর যাবতীয় ভুলত্রুটি শুধরে নিয়ে প্রকৃত বন্ধুর সাথে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রদর্শিত সিরাতুল মুস্তাকিমের (সরল-সহজ পথ) দিকে এগিয়ে যাওয়া। এতে যেমন নিজ নিজ জীবন হয়ে উঠবে সুন্দর ও সার্থক, পাশাপাশি সংসার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা বিশ্ব সমাজেও বয়ে যাবে অনুপম সুখ-সমৃদ্ধি আর শান্তি-শৃঙ্খলার অফুরন্ত বারিধারা।
পরিশেষে মহান রব্ব আল্লাহ্ সুব্’হানাহু ওয়া তায়ালার দরবারে দোয়ার মাধ্যমে মাধ্যমে লেখার ইতি টানছি : “হে আমাদের রব্ব, দয়া করে আপনার মু’মিন বান্দাদের ‘আল-ওয়ালা ওয়া আল-বারা’ (ইসলামের দৃষ্টিতে শত্রু-মিত্র)-এর ব্যাপারগুলো বোঝার তাওফিক্ব দিন এবং আমরা যেন আপনার সন্তুষ্টি নিয়ে শোকর গুজার বান্দাহ হিসেবে দুনিয়া হতে বিদায় হতে পারি সে তাওফিক্ব দিন! আমীন!”
----------------------------------------------------------------------------------
'' শুধু নিজে শিক্ষিত হলে হবেনা, প্রথমে বিবেকটাকে শিক্ষিত করুন। ''
কোন মন্তব্য নেই:
/>