মঙ্গলবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৫

বাংলাদেশ বেতার- মেজর ডালিম বলছি, “স্বৈরাচার শেখ মুজিবকে হত্যা করা হইয়াছে।”

ফ্লাশ ব্যাক টু ১৯৭৫: 
~~~বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত~~~

গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে এবং দেশবাসীকে শ্বাসরূদ্ধকর পরিবেশ থেকে মুক্তি দেবার জন্য সেনা পরিষদ একটি বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। বাকশাল কায়েমের ফলে দেশ এক চরম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক দলগুলোর সব কয়টাই তখন নিষিদ্ধ এবং রাজনৈতিক তৎপরতাকে বলপূর্বক আন্ডারগ্রাউন্ডে ঠেলে দিয়েছিল বাকশাল সরকার।

আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে দেশের নতুন পরিস্থিতি নিয়ে মত বিনিময় করতে লাগলাম। জাতীয় অবস্থার পর্যালোচনা করে সবাই একমত হলাম, একদলীয় নিষ্পেষনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হবে অবিলম্বে। পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে গণতন্ত্রিক এবং মানবিক অধিকার। বাকশালের শিকড় বাংলার মাটিতে প্রথিত হবার আগেই উপড়ে ফেলতে হবে। একনায়কত্বের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে জনগণকে মুক্ত করার সাথে সাথে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে হবে। কিন্তু এই রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করার ন্যায়সঙ্গত অধিকার যাদের সে সমস্ত দেশপ্রেমিক এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর শক্তি ও সামর্থ্য অত্যন্ত কম। স্বৈরশাসনের ষ্টিমরোলারের পেষণে তাদের আরো দুর্বল করে ফেলা হচ্ছে দিন দিন। এ ক্ষেত্রে তাদের পক্ষে সরকার বদল করার কোন বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব নয়।

কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। শিকড় গেড়ে বসার আগেই একনায়কত্বের অবসান ঘটাতে হবে। রাজনৈতিক মহল থেকে অনেকেই ঈঙ্গিত দিলেন, সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশ জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে অগ্রণীর ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে ইচ্ছুক হলেই সম্ভব হবে এই একনায়কত্ব ও স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে জাতিকে মুক্ত করা। তাদের এ ধরণের ঈঙ্গিতের যৌক্তিকতা অনুধাবন করতে পেরেছিলাম আমরা। যেখানে সাংবিধানিক ও নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একনায়কত্বের অবসান ঘটানো সম্ভব নয় সেখানে স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করার জন্য বৈপ্লবিক পদক্ষেপ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। বৈপ্লবিক পদক্ষেপের মাধ্যমেই উৎখাত করতে হয় স্বৈরাচারী সরকার। এর কোন বিকল্প থাকে না বলেই জনগণ স্বাগত জানায় ঐ ধরণের যে কোন বৈপ্লবিক পদক্ষেপকে। স্বতঃস্ফুর্ত জনসমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে বিপ্লব অর্জন করে তার নৈতিক ও আইনগত বৈধতা। খন্দোকার মোশতাক আওয়ামী লীগের গণতন্ত্রীমনা নেতৃবৃন্দের তরফ থেকে একই প্রকার মনোভাব প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে যে কোন বৈপ্লবিক উদ্যোগকে অভিনন্দন জানিয়ে সর্বোতভাবে সক্রিয় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছেন তিনি এবং আরো অনেকেই। মোশতাক সাহেবের এ ধরণের উক্তির পেছনে আওয়ামী লীগের একটা বড় অংশের সমর্থন ছিল। ইস্তফা দেবার পর জেনারেল ওসমানীর সাথে দেখা করতে গেলে বাকশাল সংক্রান্ত বিষয়ে আলাপের সময় তিনি মন্তব্য করেছিলেন,

 “মুজিব খানকে সরাতে হবে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?”

এদিকে বাকশালী একনায়কত্ব স্থাপন করেও শেখ মুজিব তার ক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। সিদ্ধান্ত হল- তাকে আজীবন রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘোষণা দেবে বাকশাল। ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এক সমাবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘোষণা দেয়ার কথা প্রচার করা হয়। উল্লেখ্য, ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে তাকে পাঁচ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করা হয়েছিল। সেটাতে শেখ মুজিব সন্তুষ্ট হতে পারেননি বলেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল তাকে আজীবন রাষ্ট্রপতি বানাবার। আরো খবর পাওয়া গেল সমস্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত এবং বিভিন্ন শ্রেণীর জনগণের মাঝ থেকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় সরকার বিরোধী মনোভাবাপন্ন দুই লক্ষ লোকের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। জেলা গভর্ণর ও তাদের অধিনস্থ রক্ষীবাহিনীর সাহায্যে ঐ তালিকাভুক্ত লোকদের মেরে ফেলা হবে। এই নীলনকশা বাস্তবায়িত করে শেখ মুজিব চেয়েছিলেন বাংলাদেশের জনগণের প্রতিবাদী কন্ঠকে আগামী কয়েক দশকের জন্য স্তব্ধ করে দিতে। এভাবে রাজনৈতিক বিপক্ষ শক্তিকে সমূলে উৎপাটন করার এক হীন চক্রান্ত করা হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশেই।

~~বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা~~ সেনা পরিষদকে অনেক জটিল বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হয়েছিল। বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে যে সমস্ত সমস্যা দেখা দিতে পারে সে সমস্ত সমস্যাবলীর সমাধান সম্পর্কেও ভেবে দেখতে হয়েছিল নেতৃবৃন্দকে। বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগৃহিত তথ্যাবলী ও খবরা-খবরের ভিত্তিতেই সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সর্বপ্রথম ঠিক করতে হয়েছিল- কবে বিপ্লব ঘটানো হবে, কি পরিসরে সংগঠিত করা হবে বিপ্লব? খবর ছিল, ১৫ই আগষ্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ এবং কেন্দ্রিয় নেতারা ছাড়াও জাতীয় পর্যায়ের প্রায় সব বাকশালী নেতারাই উপস্থিত থাকবেন। নব্যনিযুক্ত জেলা গভর্ণররা এবং জেলা পর্যায়ের নেতারা ইতিমধ্যেই ঢাকা শহরে এবং শেরে বাংলা নগরের এমপি হোস্টেলে ভীড় জমিয়েছেন। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে পুলিশ এবং স্পেশাল স্কোয়ার্ড। নেতাদের ব্যক্তিগত বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য ছাড়াও শেখ মনি ও শেখ কামালের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অস্ত্রধারীরাও থাকবে অনুষ্ঠানে। জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে ভার্সিটি এলাকায় টহল দেবার জন্য মোতায়েন করা হবে। জাতীয় রক্ষীবাহিনীর ডাইরেক্টর ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান এবং ডেপুটি ডাইরেক্টর কর্নেল সাব্বিউদ্দিন দু’জনেই ঘটনাক্রমে সেদিন দেশের বাইরে অবস্থান করবেন। ঐ দিনটি ভারতের স্বাধীনতা দিবস বিধায় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আনন্দ উৎসব নিয়ে ব্যস্ত থাকবে ভারত সরকার। ১৪-১৫ তারিখ এর রাত ঢাকা ব্রিগেডের নাইট ট্রেনিং এর জন্য নির্ধারিত।

১২ই আগষ্ট এক বৈঠকে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিপ্লব সংগঠিত হবে ১৫ই আগষ্ট সুবেহ্‌ সাদেকে। যেহেতু বাকশালী নেতাদের প্রায় সবাই সেদিন ঢাকায় অবস্থান করবেন সেই পরিপ্রেক্ষিতে শুধুমাত্র ঢাকাতে অপারেশন চালিয়ে বিপ্লবকে সফল করে তোলা সম্ভব হবে। সীমিত পরিসরে বিপ্লব ঘটালে বিপ্লবের সফলতার জন্য অতি প্রয়োজনীয় তিনটি উপকরণ যথা:-
(ক) নূন্যতম শক্তির প্রয়োগ
(খ) গতিশীলতা
(গ) গোপনীয়তা
অতি সহজেই হাসিল করা যাবে। টার্গেট হিসাবে নির্ধারন করা হয় রাষ্ট্রপতি, শেখ ফজলুল হক মনি, মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, সেরনিয়াবাত, সৈয়দ হোসেন, তাজুদ্দিন আহমদ, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক। এদের বন্দী করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। রেডিও বাংলাদেশ, বাংলাদেশ টিভি, ওয়্যারলেস সেন্টার, টিএন্ডটি, জাতীয় রক্ষীবাহিনীর সদর দফতর, রক্ষীবাহিনীর সাভারের মূল ক্যাম্প, সংসদ সদস্যদের হোষ্টেল, এয়ারপোর্ট, সাভার ট্রান্সমিশন-রিলে সেন্টার প্রভৃতি স্থানগুলো নিয়ন্ত্রণে নেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। সীমিত পরিসরে নূন্যতম শক্তি প্রয়োগ করে ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করা হবে নির্ধারিত টার্গেটগুলোর উপর। একই সাথে দেশের অন্যান্য সেনা নিবাসের ইউনিটগুলোর সেনা পরিষদগুলোকে সর্তক অবস্থায় রাখা হবে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মাধ্যমে; যাতে করে প্রয়োজনে যে কোন প্রতিবন্ধকতা কিংবা সীমান্তের ওপার থেকে কোনপ্রকার সামরিক হুমকির যথাযথভাবে মোকাবেলা করা যায় জনগণের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।

কেন্দ্রিয় কমিটি ’৭১ থেকে ’৭৫ সাল অব্দি দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন এবং বিপ্লব সর্ম্পকে একটি দলিল তৈরি করে সেনা পরিষদের সব ইউনিটে বিতরণ করে। দলিলের সারবস্তু ছিল নিম্নরূপ: -
রুশ সামাজিক সম্প্রসারণবাদ এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ১৯৭১এর স্বাধীনতা সংগ্রামের সুযোগে প্রতিক্রিয়াশীল আপোষকামী শ্রেণীর প্রতিভূ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের যোগসাজসে বাংলাদেশকে তাদের একটি তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। শেখ মুজিবর রহমান এবং আওয়ামী লীগের প্রতারণা ও ঘৃণ্য বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা হয়ে উঠেছে অর্থহীন। স্বাধীকার ও আত্ম নিয়ন্ত্রণের চেতনায় উদ্বুদ্ধ জাতীয় সংগ্রাম নিক্ষিপ্ত হয়েছে ব্যর্থতার অন্ধ গলিতে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ভৌগলিক স্বাধীনতা লাভ করে বটে কিন্তু জাতীয় মুক্তির পথ সুকৌশলে বন্ধ করে দেয় আওয়ামী লীগ সরকার ও তার বিদেশী প্রভুরা। স্বাধীনতা উত্তরকালে স্বৈরাচারী মুজিব সরকারের শাসনামলের চার বছর বাংলাদেশের ইতিহাসের এক চরম বিভীষিকাময় কাল। সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, সম্প্রসারণবাদী নীলনকশা এবং ক্ষমতাসীন শাসক গোষ্ঠির ফ্যাসিবাদী স্বৈরতন্ত্র, অবিচার, অত্যাচার এবং অবাধ দুর্নীতি জাতীয় জীবনকে করে তুলেছে র্দুবিষহ। জাতীয় সম্পদের অবাধ লুন্ঠনের ফলে দেশের অর্থনীতি হয়ে পড়েছে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত এবং দেশ আজ পৌঁছে গেছে চুড়ান্ত ধ্বংসের শেষপ্রান্তে। জাতীয় রাজনীতিতে দেখা দিয়েছে চরম নৈরাজ্য ও স্থিতিহীনতা। এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে জাতিকে মুক্ত করার দায়িত্ব স্বভাবতঃই বর্তায় প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর উপর। কিন্তু আওয়ামী-বাকশালী শ্বেত সন্ত্রাস এবং সুপরিকল্পিত চক্রান্তের মুখে সাংবিধানিকভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মুজিব সরকারকে উৎখাত করা তাদের পক্ষে আজ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সরকারি নির্যাতন ছাড়াও রাজনৈতিক দলগুলোর অপারগতার মূল কারণ হল- তাদের অনৈক্য, তাত্ত্বিক জ্ঞানের দেউলিয়াপনা, সাংগঠনিক দুর্বলতা, নেতৃত্বের কোন্দল এবং নেতাদের স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিকতা। দেশ ও জাতি আজ এক চরম সংকটে নিমজ্জিত। স্বৈরশাসনের নাগপাশ থেকে হতাশাগ্রস্থ জাতিকে মুক্ত করা আজ প্রতিটি দেশপ্রেমিকের নৈতিক দায়িত্ব। বর্তমান অবস্থার পটভূমিতে সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়া অন্য কোন উপায়ে স্বৈরাচারী একনায়কত্বের অবসান ঘটানো সম্ভব নয় বলেই এ গুরুদায়িত্ব সম্পন্ন করার অভিপ্রায়ে একটি জনপ্রিয় বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ঘটাবার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে সেনা পরিষদ। বিপ্লবের উদ্দেশ্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে জনগণের উপর সামরিক শাসনের বোঝা চাপিয়ে দেয়া নয়। তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অক্ষমতা ও অযোগ্যতার সুযোগ গ্রহণ করে সামরিক শাসন কায়েম করা হয়েছে কিন্তু এভাবে সামরিক বাহিনীকে সরাসরিভাবে জাতীয় রাজনীতিতে জড়ানোর পরিণামে সে সমস্ত দেশে উচ্চভিলাসী সামরিক শাসকবৃন্দের গোষ্ঠিস্বার্থই চরিতার্থ হয়েছে; জাতি ও দেশের কোন কল্যাণ হয়নি। কোন বিশেষ গোষ্ঠির স্বার্থ হাসিল করা আমাদের বিপ্লবের উদ্দেশ্য নয়। এই বিপ্লবের চরিত্র হবে অন্যান্য দেশে সাধারণভাবে সংগঠিত যে কোন ক্যু’দ্যাতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। সেনা পরিষদ দেশবাসী এবং সারাবিশ্বে প্রমাণ করবে- বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর বৃহৎ অংশ দেশপ্রেমিক; ক্ষমতালিপ্সু, সুযোগ সন্ধানী নয়। অবস্থার সুযোগ নিয়ে জনগণের রক্ষক হয়ে ভক্ষক বনে যাবার অভিপ্রায় তাদের নেই। দেশ ও জনগণের স্বার্থরক্ষায় নির্ভীক, নিবেদিত প্রাণ সৈনিক তারা। জনগণের মৌলিক অধিকার এবং গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্যই বিপ্লব। স্বৈরশাসনের অবসান ঘটানো হবে যাতে করে সুষ্ঠ জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিকাশ ঘটাবার জন্য দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা সংগঠিত হতে পারেন গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাবাহিকতায়। জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে এগিয়ে নেবার দায়িত্ব হবে দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলসমূহের। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব হবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের। সেনাবাহিনী দেশ ও জাতীয় স্বার্থের অতন্ত্র প্রহরী হয়ে র্নিবাচিত সরকারের অধিনে সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করে যাবে আন্তরিক নিষ্ঠার সাথে। প্রমাণ করা হবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক। জাতীয় স্বার্থই তাদের কাছে মুখ্য, ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠি স্বার্থ নয়। অনন্য এই বিপ্লব নিখাদ দেশপ্রেমের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্তমূলক মাইলফলক হিসাবে স্থাপিত হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে।

আসন্ন বিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যাবলীঃ -১। রুশ-ভারতের নাগপাশ থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করা।
২। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
৩। ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ নামে বাকশাল ও মুজিব সরকারের প্রতারণামূলক কার্যক্রমের প্রকৃত উদ্দেশ্য জনগণের সামনে তুলে ধরা।
৪। কৌশলগত কারণে স্বল্প সময়ের জন্য সংসদকে বলবৎ রেখে সাংবিধানিকভাবে একটি দেশপ্রেমিক সর্বদলীয় অস্থায়ী / র্নিদলীয় সরকার গঠন করা।

সর্বদলীয় অস্থায়ী / র্নিদলীয় সরকারের দায়িত্বঃ
১। বাকশাল প্রণোদিত শাসনতন্ত্রের ৪র্থ সংশোধনী, সংবাদপত্র ও প্রকাশনা আইন, রক্ষীবাহিনী আইন, আর্ন্তজাতিক শ্রমিক আইনের পরিপন্থী শ্রমিক আইন ও অন্যান্য কালা-কানুন বাতিল করা।
২। রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে দিয়ে দেশে অবিলম্বে প্রকাশ্য রাজনীতি ও গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
৩। সকল রাজবন্দীদের বিনাশর্তে মুক্তি দেয়া।
৪। সাধারণ নির্বাচনের দিন ধার্য করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
৫। জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি যে কোন হুমকির মোকাবেলা করার জন্য জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করা এবং জরুরী ভিত্তিতে প্রাপ্তবয়স্ক সক্ষম ছেলে-মেয়েদের সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অবকাঠামো গড়ে তোলা।
৬। সমাজতন্ত্রের নামে বিদেশী নিয়ন্ত্রণ, স্বেচ্ছাচারী একনায়কত্ব ও সরকারি সহযোগিতায় জাতীয় সম্পদ লুন্ঠন, কালোবাজারী, মুনাফাখোরী, চোরাচালান ও অবাধ দুর্নীতির ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে যে অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে তার সমাপ্তি ঘটিয়ে বিপর্যস্ত দেউলিয়া অর্থনীতির পূর্ণবিন্যাসের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৭। জাতীয় জীবনে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য বিচার বিভাগের পুর্ণ স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে দেশে আইনের শাসন প্রবর্তন করা।
৮। প্রশাসন কাঠামোকে দুর্নীতিমুক্ত করা।
৯। রাষ্ট্রীয় নীতিসমূহে বাংলাদেশী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের জীবনাদর্শের প্রতিফলন নিশ্চিত করার সাথে সাথে সংখ্যালঘু নাগরিকদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা।
১০। পঁচিশ বছরের মৈত্রী চুক্তি বাতিল করা।

উল্লেখিত কর্মসূচী বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যেই সংগঠিত করা হবে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান।ঐতিহাসিক বিপ্লবের চুড়ান্ত পরিকল্পনা ও নির্দেশাবলী যথাসময়ে নির্ধারিত পদ্ধতিতে কেন্দ্রিয় কমিটির তরফ থেকে জানানো হবে। [আগষ্ট বিপ্লবের এক মহানায়ক রাষ্ট্রদূত লেঃ কর্ণেল (অবঃ) শরিফুল হক ডালিম বীর উত্তম লিখিত “যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি” থেকে ]




"... বঙ্গবন্ধু ইজ ডেড। ফুল আর্মি হ্যাজ রেভোল্টেড এন্ড এন্টায়ার আর্মি হ্যাজ সেলিব্রেটেড" - সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ।

 “বাংলাদেশে ফেরাউনের পতন ঘটেছে।” - শেখ মুজিবের ঘনিষ্টজন বাকশালের শীর্ষ নেতা আবদুল মালেক উকিল।

 দৈনিক ইত্তেফাক ১৬ আগস্ট ১৯৭৫:

”ঐতিহাসিক নবযাত্রা”

দেশ ও জাতির এক ঐতিহাসিক প্রয়োজন পুরণে গতকাল প্রত্যুষে প্রবীণ জননায়ক খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী সরকারের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করিয়াছেন। পুর্ববর্তী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হইয়াছেন এবং এক ভাবগম্ভীর অথচ অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করিয়াছেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও তাহার নুতন সরকারের প্রতি স্হল, নৌ ও বিমানবাহিনীর অধিনায়কগণ তাহাদের স্ব স্ব বাহিনীর পক্ষ হইতে অবিচল আস্হা ও আনুগত্য ঘোষণা করিয়াছেন। দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্হাসমুহ যথা বাংলাদেশ রাইফেল, পুলিশ এবং রক্ষীবাহিনীর প্রধানগণও নুতন সরকারের প্রতি তাহাদের অকুণ্ঠ আনুগত্য জ্ঞাপন করিয়াছেন এবং সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার পবিত্র দায়িত্বে আত্মনিয়োগ করিয়াছেন।

“জনসাধারনের স্বস্তির নিঃশ্বাস” 
দ্বিপ্রহর সাড়ে ১২টায় সান্ধ্য আইন শিথিল হওয়ার সাথে সাথে রাজধানীর রাজপথে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। মূছুল্লিগণ কাতারে কাতারে মসজিদে মসজিদে জুম’আর নামাজ আদায়ে শামিল হন। পরিবর্তনে “পবিত্র ঈদের খুশির মত” একে অপরকে আলিঙ্গন করিয়া কুশল বার্তা বিনিময় করেন।”

 ”রাস্তায় মিছিল বের হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, সেই মিছিল আনন্দ-মিছিল। ” “দেয়াল” - জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।

The Bangladesh Observer, August 16, 1975

Armed Forces Take over: Martial Law Proclaimed: Curfew Imposed
--------------------------------------------------------------------------------------
Mushtaq Becomes President 
---------------------------------
Mujib Killed: Situation Remains Calm.



                        ----------------------------------------------------------------------------------

                             '' শুধু নিজে শিক্ষিত হলে হবেনা, প্রথমে বিবেকটাকে শিক্ষিত করুন। ''

কোন মন্তব্য নেই:

Comment here />

Widget ByBlogger Maruf
Widget ByBlogger Maruf