মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই, ২০১৩

দুই কারণে তালাক বাড়ছে !!!


দুই কারণে তালাক বাড়ছে !!!

স্বামী-স্ত্রীর পরকীয়া অথবা আভিজাত্যের অহঙ্কারে ভেঙে যাচ্ছে রাজধানীর বহু সাজানো ঘর, জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে সুখের সংসার। ইন্টারনেট, ফেসবুক মোবাইল ফোনসহ যাবতীয় তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। উদ্বুদ্ধ করছে প্রতিবেশী দেশের বিভিন্ন হিন্দি সিরিয়াল, নাটক এবং নানা দেশীয় পর্নোগ্রাফি।
এসব কিছুর সহজলভ্যতায় নৈতিক মূল্যবোধ হারাচ্ছে অনেক নারী পুরুষ। ঘটছে নৈতিক স্খলন। জড়িয়ে পড়ছে পরকীয়ার মতো গুরুতর সামাজিক অপরাধে। আর এতেই ভেঙে যাচ্ছে দাম্পত্য জীবন। তছনছ হয়ে যাচ্ছে সুখের সংসার। তবে নগরীর অভিজাত এলাকায় এ ধরনের বিচ্ছেদের ঘটনা বেশি। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে ধনাঢ্য পরিবারের দুলালীরা। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপেরেশনের হিসেবে প্রতিবছর রাজধানীতে বিয়ে বিচ্ছেদের হার বেড়েই চলেছে। সূত্র মতে, ২০১২ সালে এ নগরীতে বিচ্ছেদ ঘটেছে প্রায় ৭ হাজার দম্পতির। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি তালাকের আবেদন করা হয়েছে নারীদের পক্ষ থেকে। ডিসিসি দক্ষিণের এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতিবছর নারীদের পক্ষ থেকে তালাকের আবেদন আসছে শতকরা ৭৫ ভাগ আর পুরুষের পক্ষ থেকে ২৫ ভাগ। এ নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের রয়েছে নানা দৃষ্টিভঙ্গি। তবে সবাই বিষয়টি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। অনেকের মতে, নানা কারণে বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। তবে দু’টি কারণ প্রধান বলে মনে হচ্ছে। প্রথমত, মেয়েরা আগের চেয়ে বেশি শিক্ষিত এবং স্বাবলম্বী হওয়ায় আত্মঅহঙ্কার বেড়েছে। সামাজিক ও পারিবারিক বাঁধন মানতে নারাজ তারা। আছে অনেক ধনীর দুলালীর আত্মঅহমিকাও। বাধাহীন জীবনে অনেক ক্ষেত্রে তারা জড়িয়ে পড়ছে পরকীয়ায়। আসক্ত হচ্ছে নানা মাদকে। দ্বিতীয়ত, মোবাইল অপারেটরগুলোর সহজলভ্যতা, ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট, ফেসবুক ও পর্নোগ্রাফির মতো সহজলভ্য উপাদানে আকৃষ্ট হয়ে তারা মূল্যবোধ ও নৈতিকতা হারাচ্ছে। ডিসিসি দক্ষিণের এক পরিসংখ্যানে থেকে জানা গেছে, ২০০৫ সালে তালাকের সংখ্যা ছিল চার হাজার। ২০১০-এ তা বেড়ে সাড়ে পাঁচ হাজারে পৌঁছেছে। আর ২০১২ সালে তা বেড়ে প্রায় সাত হাজারে উন্নীত হয়। এদিকে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ডিসিসির সালিশ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে নামে মাত্র। শুধু তালাকের সনদ দেয়া ছাড়া আর কোন কার্যক্রম নেই তাদের। তালাকের আবেদন আসার পর উভয়পক্ষকে ডেকে পারস্পরিক সমঝোতার কথা থাকলেও তারা তা করছেন না। আর এ বিষয়ে প্রতি মাসে প্রশাসক বরাবর প্রতিবেদন পাঠানোর কথা থাকলেও তা পাঠানো হয় না। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সামান্য বনিবনা না হওয়ায় স্ত্রী স্বামীকে পাঠাচ্ছেন তালাকের নোটিস। এর মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ডিসিসির যে ভূমিকা থাকার কথা তারা তার কিছুই করছে না বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। কেউ তালাকের আবেদন করলে আইনানুযায়ী ৯০ দিনে তিনটি সালিশ করার পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মিল না হলে তালাক কার্যকর করতে হবে। কিন্তু তালাকের আবেদন জমা পড়ার পর কোন ধরনের সালিশ কার্যক্রম না করেই নির্দিষ্ট সময় পর পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে তালাক সনদ। ফলে সমঝোতার পরিবর্তে দিন দিন রাজধানীতে বাড়ছে তালাকের সংখ্যা। ডিসিসি দক্ষিণের সূত্রে জানা যায়, বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা বেশি ঘটছে উচ্চবিত্ত পরিবারের মধ্যে। মূলত পরকীয়া, পরনারী বা পরপুরুষে আসক্তি, যৌতুক ও শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগে তাদের মধ্যে বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। ডিসিসি উত্তরের অঞ্চল ১-এর এক কর্মকর্তা জানান, সামাজিক অস্থিরতা, মাদকাসক্তের প্রভাব, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, পরস্পরকে ছাড় না দেয়ার কারণেই বিয়ে ভাঙছে। কিন্তু নারীদের পক্ষ থেকেই তালাকের আবেদন বেশি আসছে। এর কারণ তারা চাহিদামতো বিচার পাওয়ার অনিশ্চয়তায় তালাকের রাস্তা বেছে নিচ্ছেন। এক সময় আগে ডিসিসির আইন বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত সালিশ পরিচালিত হতো। কিন্তু এখন এর সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে যাওয়ায় পুরো নগরীতে ১০টি অঞ্চলে ভাগ করে অঞ্চলভিত্তিক সালিশ বোর্ড গঠন করে ডিসিসি উত্তর ও দক্ষিণ। এসব অঞ্চলভিত্তিক অফিসে ১০ আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা সালিশ পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। এ সংখ্যা শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। মূলত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবহেলায় তালাকের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন। তবে ডিসিসি দক্ষিণের অঞ্চল ৩-এর এক কর্মকর্তা এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এমনিতেই আমাদের জনবল কম। তারপরও তালাকের আবেদন এলে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি এর সমাধানের। কিন্তু এ বিষয়ে স্ত্রীপক্ষ আমাদের কথা শুনতে চায় না। পরে বাধ্য হয়ে আমরা তালাকের সনদ দিয়ে দিই। তবে পর্যালোচনায় দেখা গেছে আভিজাত্যের অহঙ্কারই বেশির ভাগ দাম্পত্য জীবনের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংসারে ছিল না তাদের অভাব অনটন। ছিল না যৌতুকের জন্য টানাপড়েন। ভরপুর আভিজাত্য ছিল তাদের চারপাশে। কিন্তু এ আভিজাত্যের কারণেই ভেঙে গেছে রাজধানীর গুলশান, বনানী, উত্তরা ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকার বহু সুখের সংসার। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন নগরীর সবচেয়ে অভিজাত ওইসব এলাকায় গত এক বছরে প্রায় দেড় হাজার বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় একটি বিচ্ছেদের ঘটনাও যৌতুকের কারণে ঘটেনি। সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন। তারা আরও জানান, বিচ্ছেদ ঘটানোর ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে ধনীর ঘরের দুলালীরা। বৃদ্ধ শ্বশুর ভুল করে পুত্রবধূর তোয়ালে ব্যবহারের ঘটনায় স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করেন এক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর কন্যা। এর শেষ পরিণতি হয় বিচ্ছেদ। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের গুলশান-বনানী এলাকার এক কর্মকর্তা জানান, এ সংস্থার মাধ্যমে বিচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলো সত্যি আজব ধরনের। স্বামীর ঘরে বৃদ্ধ পিতা-মাতা থাকার কারণেও অনেক স্ত্রী বিচ্ছেদের নোটিস দেন। তবে সব নোটিসেই লেখা থাকে আমাদের মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় আমরা পরস্পর আলাদা হতে চাই, কিংবা আমি এ স্বামীর সংসার করতে অপারগ। গুলশান এলাকায় বসবাসকারী এক ধনাঢ্য পরিবারের কন্যা চিকিৎসায় বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে ফিরে আসেন দেশে। বিয়ে করেন সেনাবাহিনীর মেজর পদমর্যাদার এক কর্মকর্তাকে। দু’বছর সংসার জীবন কাটার পর ডাক্তার স্ত্রী মেজরের মাসিক আয়ের সঙ্গে পরিবারের ব্যয়ের হিসাব মেলাতে শুরু করেন। এতে দেখা যায় পরিবারের ব্যয়ের বেশির ভাগই আসছে স্ত্রীর তরফে। এক পর্যায়ে স্বামীর পরিবারের সামাজিক মর্যাদা আর্থিক অবস্থা নিয়ে দু’জনের মধ্যে শুরু হয় টানাপড়েন। যা ব্যবসায়ী পিতার পিএইচডি ডিগ্রিধারী ডাক্তার কন্যাকে বেশ ক্ষুব্ধ করে তোলে। অমনি বিচ্ছেদের নোটিস ঠুকে দেন তিনি। সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আপসরফার চেষ্টা করেছেন। তবে ডাক্তার স্ত্রী নাছোড়বান্দা। তিনি কিছুতেই ঘর করবেন না কম বেতনভোগী ওই সরকারি কর্মকর্তার। এতে স্বাভাবিক কারণেই ইতি ঘটে ওই দম্পত্তির দু’বছরের দাম্পত্য জীবনের। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে পরিচয় থেকে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয় বনানী এলাকার এক দম্পতি। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই চাকরি করার কারণে ব্যস্ত সময কাটে তাদের। একে অপরকে তেমন সময় দিতে পারেন না। এ নিয়ে শুরু হয় মন কষাকষি। এক পর্যায়ে স্বামী স্ত্রীকে চাকরি ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব করেন। এতেই ঘটে বিপত্তি। বড়লোক পিতার কন্যা স্ত্রী আচমকা তালাকের নোটিস দেন। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা অনেক চেষ্টা করেও ফেরাতে পারেননি ওই স্ত্রীকে। এমনি ধরনের শ’ শ’ ঘটনা চাপা পড়ে আছে সংস্থার সালিশি পরিষদের ফাইলে। অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সন্দেহ অবিশ্বাসের কারণেও কিছু বিচ্ছেদের নজির আছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। রাজধানীর উত্তরা এলাকার বাসিন্দা প্রায় ৭০ বছর বয়সী এক স্বামী অফিসের অধস্তন কর্মচারী মহিলার সঙ্গে কথা বলতে দেখে সন্দেহ করেন তার স্ত্রী। এ নিয়ে শুরু হয় দু’জনের ঝগড়া। ওই দম্পতির পুত্র, পুত্রবধূ মেয়ে মেয়ের জামাইরা মিলে চেষ্টা করেও ঠেকাতে পারেনি প্রায় ৪০ বছরের সংসার জীবন। সিটি করপোরেশনের এক  আঞ্চলিক কর্মকর্তা জানান, এ এলাকার আলোচিত বিচ্ছেদগুলোর মধ্যে এটি আমার কাছে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম বলে মনে হয়েছে। তিনি বলেন, গরিব পরিবারগুলোর সমস্যা ভরণপোষণ কিংবা যৌতুক ও অভাব অনটন। কিন্তু অভিজাত শ্রেণীর সংসারের সমস্যা হয় এ ধরনের ঠুনকো সন্দেহবশত আবেগতাড়িত বিষয়। বিয়ে সালিশি পরিষদের এক কর্মকর্তা জানান, পরকীয়ার কারণেও বেশ কিছু বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। যেমন গুলশান নিকেতন এলাকার এক বাসিন্দা দীর্ঘদিন বিদেশে কর্মরত ছিলেন। ১৭ বছর বয়সের এক মেয়ে ১৪ বছর বয়সের কন্যাকে নিয়ে স্ত্রী থাকতেন দেশে। এক পর্যায়ে ছেলের শিক্ষকের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে যান স্ত্রী। গোপনে খবর পেয়ে স্বামী ছুটে আসেন ঢাকায়। কিন্তু তার আগে স্ত্রী ঠুকেছেন তালাকের নোটিস। জীবনের উপার্জিত সব কিছু নিয়ে ওই স্ত্রী চলে যান আলাদা ঘরে। এখানেই ইতি ঘটে তাদের ২০ বছরের সংসার জীবনের। স্ত্রীর দেয়া তালাকের নোটিস ঠেকানোর জন্য ওই স্বামী বহু কান্নাকাটি করেছেন হাতে পায়ে ধরেছেন অনেকের। কিন্তু তাতে ডিসিসির অনেকের মনে দাগ কাটলেও ২০ বছর আগে পিতা-মাতার অবাধ্য হয়ে বিয়ে করা স্ত্রীর মন গলেনি। বাংলাদেশ কাজী সমিতির সভাপতি আবদুল জলিল মিয়াজী বলেন, সমাজের নেতৃত্ব দেন এসব অভিজাত এলাকার অধিবাসীরা। তাদের দাম্পত্য জীবন বিশেষ করে বিয়ে বিচ্ছেদের বিষয়টি একান্তই ব্যক্তিগত। এটা নিয়ে বলার তেমন কিছু নেই। বলতে গেলে অনেক ক্ষতির কারণও হতে পারে। সুতরাং, এসব ঘটনা তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকুক এটাই আমি চাই। নগরীর ধানমন্ডি এলাকায়ও একই ধরনের ভুরিভুরি ঘটনা আছে বলে এক কাজী জানান।

কোন মন্তব্য নেই:

Comment here />

Widget ByBlogger Maruf
Widget ByBlogger Maruf