রুমানার চোখ যায়নি: জীবন গেছে সাইদের
২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে দেশের গণমাধ্যমে আলোচিত নামটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুমানা মঞ্জুরের। তিনি তার স্বামীর হাতে ‘নির্মমভাবে’ নির্যাতিত হয়েছিলেন। স্বামীর আক্রমনে রুমানার দুই চোখ তখন ‘নষ্ট’ হয়ে যায় এবং নাকেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ ঘটনার জেরে ‘পাষণ্ড’ স্বামী হাসান সাইদকে গ্রেপ্তার হয়ে রিমান্ডে যেতে হয় এবং পুলিশি হেফাজতেই হাসপাতালে তার অস্বাভাবিক ‘রহস্যময়’ মৃত্যু হয়। সেই রহস্যের ধুম্রজাল এখনো কাটেনি।
এরই মধ্যে জানা গেছে, রুমানা কানাডাতেই সুখে দিন কাটাচ্ছেন। তার চোখেরও কিছু হয়নি। এমনটাই দাবি দেশে-বিদেশের বেশ কয়েকটি বাংলাভাষার অনলাইন নিউজ পোর্টালের। এদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই বলছেন, ওই সময় গণমাধ্যমে ফলাও করে রুমানার চোখ ‘নষ্টের’ খবর প্রকাশিত হলেও তার কথিত প্রেম নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য ছিল না। বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী ও সুশীলরা এটাকে একপেশে হিসেবে তখন তুলে ধরেছিলেন। রুমানা এখনো সেই ইরানি যুবকের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। এখন সেই কথিত নারীবাদি ও সুশীলরা কি বলবেন? রুমানারতো চোখ যায়নি, কিন্তু বেচারা ‘পাষণ্ড’ স্বামীর জীবনটাতো ঠিকই গেল। মিডিয়া ও সুশীল-নারীবাদিদের ‘একচোখা’ ভূমিকা নিয়ে এখন প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
জানা যায়, রুমানার বিরুদ্ধে যার সাথে ‘প্রেমের’ অভিযোগ ছিল স্বামী সাইদের সেই ইরানি যুবক নাভেদের সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। তার সাথেই কানাডার ইউনির্ভাসিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে পিএইচডি করছেন রুমানা। কানাডার প্রাথমিক নাগরিকত্বও পেয়েছেন তিনি। ইউনির্ভাসিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে শিক্ষক হিসেবেও নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন তিনি।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রুমানার বাবা সাবেক সেনা কর্মকর্তা মঞ্জুর হোসেন, মা ও রুমানার একমাত্র মেয়ে কানাডায় বসবাস করছেন। এতসব তথ্য জন্ম দিয়েছে নতুন বিতর্কের, তবে কি স্বামী সাইদের অভিযোগই সত্য, কালো চশমায় চোখ ঢেকে আসা রুমানা চোখে দেখতেন! এখন সাইদের ‘রহস্যজনক’ মৃত্যুর ঘটনা আরো রহস্যময় হলো।
বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের জেরে ২০১১ সালের ৫ জুন রাজধানীর ধানমন্ডিতে বাবার বাড়িতে স্বামী হাসান সাইদের হাতে নির্মমভাবে নির্যাতিত হন রুমানা মঞ্জুর। তার বাঁ চোখে মারাত্নক জখম, ডান চোখও প্রায় ক্ষতিগ্রস্ত, নাকে এবং সারা শরীরে কামড়ের ভয়ানক দাগের কথা মিডিয়ায় চলে আসে। পরবর্তিতে রুমানা আর চোখে দেখবেন না বলেও সংবাদ প্রচারিত হয়। তবে ২০০১ সালে সাইদ-রোমানার বিয়ের পর এমন মনোমালিন্যের কাহিনী হিসেবে চলে আসে ‘কথিত প্রেমের’ ব্যাপারটি। স্বামী-স্ত্রীর ১০ বছরের সাংসারিক জীবনে দেয়াল হিসেবে সাইদ দাঁড় করান এই ইরানী যুবক নাভেদকে।
ইদানিং ফেসবুক, ব্লগ এবং সোস্যাল মিডিয়ায় রুমানা মঞ্জুর এবং নাভেদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের বেশ কিছু ছবিও প্রকাশিত হয়েছে। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, তবে কি রুমানার সাথে নাভেদের সত্যি কোন অবৈধ সম্পর্ক ছিল। এমন ছবি দেখার পর রুমানার দিকে ঘৃণার আঙ্গুল তুলে একজন বলেছেন, [বিচার চাই রুমানার, তার বাবার। সাঈদের মা-বোনের কাছে ক্ষমা চাই আমাদের অসহায়ত্বের জন্য। একজন নারী ইচ্ছে করলে একজন পুরুষের জীবনকে কিভাবে বিভীষিকাময় করে তুলতে পারে তার অনবদ্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে রুমানা। ঘৃনা জানাই রুমানার মত নারীদের। ততোধিক ঘৃনা তথাকথিত সুশীলদের জন্য-যারা পেছনের ঘটনা না জেনেই নারী নির্যাতনের দোহাই দিয়ে-সাইদের মত অসহায় স্বামীদেরকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হতে বাধ্য করে। তাদের উপর সাইদের মা-বোনের কান্না অভিশাপ হয়ে ঝরে পড়ুক।]
সাইদ কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার পরদিন রুমানার বাবা অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মনজুর হোসেন ধানমণ্ডি থানায় হাসান সাইদকে আসামি করে একটি মামলা করেন। মামলা এবং তৎকালিন সময়ে প্রতিবাদের ঝড়ের মুখে রুমানাকে নির্যাতনের ঘটনায় ২০১১সালের ১৫ জুন রাজধানীর উত্তর মুগদার একটি বাসা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। হাসান সাইদ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একজন প্রকৌশলী ছিলেন। গ্রেপ্তারের পর কয়েক দফায় রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়। ৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে পুলিশি হেফাজতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ‘রহস্যজনক’ মৃত্যুবরণ করেন।
যেদিন ভালবাসা ছিল : রুমানা-সাইদ ও তার একমাত্র মেয়ে (ফাইল ছবি)
তবে সাইদের অভিযোগ ছিল “রুমানা শুধু পরকীয়াই করেনি। নাভেদের সাথে পানশালায় গিয়েছে রুমানা। মদ পান করে ফুর্তি করেছে। একসাথে আইস স্কেটিং ও ইয়োগা ক্লাস করেছে। এসব কীর্তিকলাপ জেনেও আমি ওকে ক্ষমা করেছিলাম। ভালবেসেছিলাম পাগলের মতো। কিন্তু বিনিময়ে ও শুধু প্রতারণাই করেছে।”
সাইদের লাশ উদ্ধারের সময় তাঁর শরীরে কম্বল মোড়ানো ছিল। তাঁকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলেও সাইদের পরিবারের অভিযোগ। মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হতে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের জন্য তাঁরা অপেক্ষা করবেন। ঢামেক হাসপাতালের ফরনেসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডা. আখম শফিউজ্জামান লাশের ময়নাতদন্ত করেন। ময়নাতদন্ত শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, ‘কী কারণে তার মৃত্যু হয়েছে, তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। নিশ্চিত হওয়ার জন্য রাসায়নিক পরীক্ষা করতে ভিসেরা মহাখালীতে পাঠানো হয়েছে। আর হার্ট পরীক্ষা করা হবে হিস্টোপ্যাথলজি বিভাগে।’ সেই প্রতিবেদনের কি হলো কেউ জানে না।
সাইদের মৃত্যু আত্মহত্যা কি না এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের অতিরিক্ত পরিচালক জামালউদ্দিন খলিফা গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘আত্মহত্যার মতো হতাশাগ্রস্ত তিনি ছিলেন না। এটি রহস্যজনক। তাঁর মুখে পলিথিন বাঁধা ছিল বলে কারারক্ষীরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানান।’
লাশ গ্রহণকালে সাইদের স্বজনরা এ মৃত্যুকে ‘রহস্যজনক’ দাবি করেন এবং রুমানার চরিত্র ও মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে নানা কথা বলেন। সে সময় কারা হেফাজতে সাইদের রহস্যজনক মৃত্যুর রাতে কয়েকজন ব্যক্তি প্রিজন সেলে প্রবেশ করেছিল। কারাগারে সব সময় লুঙ্গি পরে থাকা সাইদের লাশ মিলেছে প্যান্ট পরা অবস্থায়। হাতে রশির বাঁধনের দাগ কিভাবে এল, সে প্রশ্নও তুলেছেন তাঁর স্বজনরা।
সাইদের বাবা সাইদ আহমেদ কবির সাংবাদিকদের ওই সময় বলেছিলেন, ‘রুমানা মঞ্জুর আত্মস্বীকৃত ব্যাভিচারিণী। রুমানা মনজুরের সব কিছু ঠিক আছে। এখনো সে সব দেখতে পায়। কিন্তু মিডিয়ার সামনে এলে সে চোখে কালো চশমা দিয়ে আসে।
মৃত্যুর আগে সাইদ আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে রুমানাকে ‘মারধরের’ কথা স্বীকার করলেও নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। ঘটনার সময় তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন কিন্তু তিনি রুমানার চোখ নষ্ট হওয়ার জন্য তিনি দায়ী নন বলেও দাবী করেন। উল্টো রুমানা তাকে ‘কানা’(চোখে কম দেখার কারণে) বলে কটাক্ষ করতো।
ছবিটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। দাবি করা হচ্ছে রুমানার সাথে এই যুবকই নাভেদ
সমাজের প্রগতিশীল নারীদের প্রতিনিধিত্ব করেন এমন একজন নারী হলেন বিশিষ্ট অভিনেত্রী, নারী নেত্রী রোকেয়া প্রাচী। রোমানার ব্যাপারটি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার মনে হয় বাংলাদেশের নারীদের সবচেয়ে বেশি একটা কথা বলে কাবু করা হয়, সেটা হলো চরিত্রের গল্প। এটার সত্যতা যাচাই করতে হবে। তখন তার স্বামী একটা অভিযোগ এনেছিল, তারপর তাকে নির্যাতন করেছে। আমি এটা বিশ্বাস করি না। শুধু শুধু ভদ্রমহিলাকে অপবাদ দেয়া হচ্ছে। তবে কোন মেয়ে যদি নিজে কাউকে পছন্দ না করে সে বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আছে। স্বামীর সাথে তার যদি বনিবনা না হয় সেটা এবং অন্য কাউকে পছন্দ করার অধিকারও আছে।”
বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের ব্যাপারে প্রাচী বলেন, পরকীয়া থাকতেই পারে, তার মানে এই নয় যে তার স্বামী তার চোখ কান উপরায় ফেলবে। অনেক স্বামীও পরকীয়া করে, তাই বলে কি মেয়েরা তার স্বামীর চোখ উপরায় ফেলবে? আজকের প্রেক্ষাপটে প্রত্যেকেরই ব্যক্তি স্বাধীনতার যুগ। এক্ষেত্রে আমরা যদি মেয়েদের চারিত্রিক ব্যাপারটা সামনে নিয়ে আসি তাহলে তারা বাইরে আসবে না। তাহলে হেফাজতের মতো ধর্মান্ধ সংগঠনগুলো আরো বেশি সুযোগ পেয়ে যাবে।
সাইদের মৃত্যুর বিষয়ে রোকেয়া প্রাচী বলেন, “আসলে তার স্বামী আত্নহত্যা করেছিল নাকি অন্য কোনভাবে মারা গিয়েছিল এটা তদন্তের ব্যাপার। তবে আমি বলবো, মানসিক টানাপেড়নের জায়গাটাকে শ্রদ্ধা করতে হবে। স্বামীরা মেয়েদের মানসিকভাবে অত্যাচার করে। এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।‘’
কোন মন্তব্য নেই:
/>