মঙ্গলবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০১৫

ইসলামী শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা ???

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড ও মানবসভ্যতার প্রাণ। মানবাত্মার সুষম বিকাশ, লালন ও কর্ষণের একমাত্র বাহন হলো শিক্ষা। শিক্ষা জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধির এক নিয়ামক শক্তি, তাই সুশিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির অগ্রগতি ও ক্রমোন্নতি সম্ভব নয়। প্রকৃত শিক্ষাই মানুষের দেহ ও আত্মাকে সুন্দর সুসামঞ্জস করে গড়ে তোলে এবং মানুষকে সচ্চরিত্রবান, সুরুচিসম্পন্ন, কর্মদক্ষ, ন্যায়-নিষ্ঠাবান, পরিশীলিত ও পরিমার্জিত করে তাকে উন্নত ও সমৃদ্ধ মানবে পরিণত করে। ফলে সে অজ্ঞেয় বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে। যে জ্ঞানের মাধ্যমে তার সুকুমার বৃত্তি বিকশিত হয় এবং মানবিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। পৃথিবীতে কেবল ইসলাম ছাড়া সব মতবাদ ও মতাদর্শে শিক্ষার এই মূলতত্ত্ব অনুপস্থিত। ইসলাম নিছক গতানুগতিক কোনো ধর্মের নাম নয়, বরং এটি হলো মানবতার মুক্তির মহা সনদ এবং উন্নত জীবন ধারার ব্যবস্থাপক। এখানে নৈতিকতার প্রাণশক্তি স্পন্দিত এবং প্রকৃত শিক্ষার আলো বিচ্ছুরিত। মানুষের জীবন ধারা, কর্মপদ্ধতি, আদর্শ, কর্মচাঞ্চল্য, ত্যাগ, সাধনা ও সফলতার সমন্বয় ও অভিব্যক্তির পরস্ফুিটন ঘটেছে এই ইসলামের মাঝে। পৃথিবীর প্রথম ও পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলামই সর্বপ্রথম শিক্ষার প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে। আহ্বান করেছে অজ্ঞতার অমানিশার বুকচিরে সুশিক্ষার আলোর দিকে।
ইসলামী জীবন দর্শনে শিক্ষা মানবতার সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ নিশ্চিতকারী এক ঐশী শক্তি। এ শিক্ষা মানুষের দেহ ও আত্মার পূর্ণতা বিকাশে নিরন্তর প্রয়াসী। এটি সব সময় বিশ্ব নিয়ন্তার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে মানবতাকে এক, অদ্বিতীয়, অমুখাপেক্ষী সত্তার প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রত্যয়ী। এ ছাড়া সত্যের আবিষ্কার, মিথ্যার অপনোদন, মানবতাবিধ্বংসী সব ধরনের কার্যকে পরিহার এবং পাশবিকতাকে নির্মূল করে মানুষের মধ্যে কাগ্ধিক্ষত গুণাবলীর বিকাশ ঘটায় এ শিক্ষা। এ জন্যই ইসলামী শিক্ষা কালোত্তীর্ণ শক্তি হিসেবে জাতির রকমারি সমস্যার একমাত্র সমাধানকারী মাধ্যম। ফলে বিশ্ব মুসলিমের জন্য এ শিক্ষাকে অত্যাবশ্যক করা হয়েছে। ইসলামী শিক্ষা মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার মাপকাঠি। এ শিক্ষার মাধ্যমে সব সৃষ্টি জগতের ওপরে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মানুষ যখন এ শিক্ষাকে হৃদয়ের মর্মস্থলে দৃঢ়প্রত্যয় ও বিশ্বাসরূপে গ্রহণ করে তখন তার মধ্যে সৃষ্টি হয় ঈমান এবং জীবন ও জগত সম্পর্কে এক সুস্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন ধারণা। 
আর এ ঈমান আল্লাহর ইচ্ছার সঙ্গে মানুষের ইচ্ছাকে একাকার করে দেয়; মানুষ স্বতঃসম্ফূর্তভাবে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করে। এখান থেকেই শুরু হয় মানব জীবনের এক ইতিবাচক অভিযাত্রা। আল্লাহর প্রতি পরম নির্ভরতার কারণে মানুষ চিরতরে মুক্ত হয় জীবন সম্পর্কে সব ধরনের ভয়ভীতি ও অনিশ্চয়তা থেকে। এমনকি সে অবলীলাক্রমে মৃত্যুর ভয়কেও জয় করে। এর ফলে মানুষের প্রতিটি কাজ হয় গঠনমূলক ও সৃজনধর্মী। সে প্রতিটি পদক্ষেপই গ্রহণ করে আল্লাহর নির্দেশিত কল্যাণের পথে। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, নীতি-দুর্নীতি, পাপ-পুণ্যে বিশ্বাস ইত্যাদি ধারণা কেবল ইসলামী শিক্ষা থেকেই লাভ করা সম্ভব। এ জন্য আল কোরআন ও হাদিসে এ শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নানা কৌণিকে সাবলীল ভাষায় পরিব্যক্ত হয়েছে। আ কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যাকে হিকমত তথা দীনের জ্ঞান দেয়া হয়েছে, তাকে দেয়া হয়েছে বিপুল কল্যাণ ও সমৃদ্ধি’ (আল-বাকারাহ : ২৬)।
আ কোরআনে আরও বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞানদান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের উচ্চমর্যাদা দেবেন। আর যা কিছু তোমরা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে পূর্ণ অবহিত’ (মুজাদালাহ : ১১)।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত ও প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বিদ্যার্জনে ব্যাপৃত থাকে এবং সে অবস্থায় তার মৃত্যু সমাগত হয়, জান্নাতে তার এবং নবীদের মধ্যে কেবল একটি ধাপই ব্যবধান থাকবে’ (দারিমি)।


সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এরূপ অসংখ্য আয়াত ও হাদিস বিদ্যমান, যা নিরন্তর ইসলামী শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার প্রতি নির্দেশ করে।
বস্তুবাদী ও ভোগবাদী দর্শনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা পৃথিবীর শুধু চাকচিক্য ও বৈষয়িক বাণিজ্যিক উন্নতির প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। এতে নৈতিক শিক্ষাদানের বিষয় অনুপস্থিত। এজন্যই আজ অসত্ প্রতিযোগিতার সংঘাত, শোষণ, প্রতারণা ও নিপীড়নের কালো থাবা বিস্তার লাভ করেছে। উত্সর্গিত হয়েছে নৈতিক মূল্যবোধ ও মানবতা। সুতরাং ধর্ম ও নৈতিকতাহীন শিক্ষা জ্ঞান-বিজ্ঞানের এ চরম উন্নতির যুগেও সভ্যতা বিবর্জিত এক মানববিধ্বংসী কুশিক্ষা বলে বিবেচিত। কারণ এতে চরিত্র গঠন এবং মন ও মস্তিষ্কের উত্কর্ষ সাধনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই। জাগতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কেবল ইসলামী শিক্ষা মানুষকে সত্ চরিত্র, ন্যায়বাদী ও সত্যাশ্রয়ী হিসেবে গড়ে তোলার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। এ শিক্ষা মানুষকে দীক্ষা দেয় তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাতের।
 এ তিনটি বিষয় ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে রাসুল (সা.) তাঁর সাহাবিদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলেছিলেন এবং তাদের একেকটি হীরকখণ্ডে পরিণত করেছিলেন, যা সর্বকালের এক বিস্ময়। যারা ছিলেন যে কোনো মানদণ্ডে চূড়ান্ত শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী; শৌর্যে, সাহসে, সততা, পবিত্রতায়, সর্বমানবিক প্রেম-মততায় ও জীবনাচারে পূর্ণ দয়িত্বসম্পন্ন। নির্লোভ ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধ, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও মনুষ্যত্ব নিষ্ঠায় এমন একদল স্বর্ণপ্রভা মানুষ তৈরি হয়েছিল—যাদের সততা, ইনসাফ ও হিম্মতের সামনে বিশ্ব সবিনয়ে মাথা অবনত করেছিল। এটি ছিল কেবল ইসলামী শিক্ষারই ফসল। এটি কোনো আবেগতাড়িত বক্তব্য নয়, বরং বাস্তবতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন।
তাই আজ সময়ের দাবি—ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতার কুহক পরিত্যাগ করে জীবনঘনিষ্ঠ নৈতিকতানির্ভর ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার ঘটাতে হবে। কোরআন ও হাদিসের আলোকে নৈতিকতা ও শিষ্টাচারসহ ইসলামী সংস্কৃতি ও সভ্যতা সংবলিত বিষয় নির্ধারণ করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। আমরা আশা করব সুধীজনের আগ্রহ, তরুণ ও যুবসমাজের সচেতনতা; সর্বোপরি সরকারি উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার অপরিহার্যতায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা হবে বিজ্ঞানভিত্তিক নৈতিকতানির্ভর এক সুন্দর, সুষম, গ্রহণযোগ্য সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা।

কোন মন্তব্য নেই:

Comment here />

Widget ByBlogger Maruf
Widget ByBlogger Maruf