বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে, এমনকি ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালীন সময়েও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বা ‘সেক্যুলারিজম’ আমাদের স্বাধীনতার পেছনের একটি মূল কারণ বলে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি কিংবা শোনাও যায়নি। তাছাড়া, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ঘোষিত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’-এর পুনর্বিবরণেও ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো উল্লেখ নেই। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়—‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি।’
যদি আরও আগের ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যাবে যে, ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা এবং তত্কালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণের জন্য ‘ছয়দফা কর্মসূচি’ নামক রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করেন। সেই ছয় দফা কর্মসূচি ও ১৯৭০ নির্বাচনের কোনো ইশতেহারেও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র উল্লেখ নেই।
তাহলে কেন এবং কীভাবে ‘ধর্মনিপেক্ষতা’ রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির একটি হিসেবে বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে স্থান পেল তা এক বিস্ময়ের ব্যাপার। হয়তো অনেকের যুক্তি হতে পারে যে, ধর্মীয় বিবেচনায় নাগরিকদের সঙ্গে রাষ্ট্র্র বা সরকার যাতে কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ না করে সেজন্য ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির একটি হিসেবে স্থান দেয়া হয়েছে। কিন্তু নাগরিকদের সঙ্গে রাষ্ট্রের পক্ষপাতহীন আচরণ নিশ্চিত করার জন্য সংবিধানের অন্যান্য ধারায় প্রদত্ত বিধি মোতাবেক প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বর্ণিত ‘জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা’ করাই যথেষ্ট ছিল, এবং এখনো আছে, যদি তা সরকার নিষ্ঠার সঙ্গে করতে চায়। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাকে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত করলে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে আলাদা একটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে কি প্রয়োজন হতো?
বরং ধর্ম-পরিচয়ের কারণে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কিংবা কোনো সংগঠন যাতে নাগরিকদের মাঝে বৈষম্যমূলক আচরণ না করে সেজন্য আইন প্রণয়ন করে বৈষম্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ শাস্তির বিধান করাই হতো উত্তম, যা পাশ্চাত্যের অনেক উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়—‘সেক্যুলারিজম’ বলে কোনো শব্দ যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে নেই, অথচ বৈষম্যহীন নাগরিক অধিকার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাভোগকারী বিশ্বের সব রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নাম সবার আগেই বলতে হয়। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই সেপ্টেম্বর পাসকৃত যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের আর্টিক্যাল ৬-এ বলা হয়েছে, ুঘড় ত্বষরমরড়ঁং ঞবংঃ ংযধষষ বাবত্ নব required as a Qualification to any Office or public Trust under the United States”. তারপর ১৭৯১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পাসকৃত যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১ম সংশোধনীতে বলা হয়েছে, “Congress shall make no law respecting an establishment of religion, or prohibiting the free exercise thereof; or abridging the freedom of speech, or of the press; or the right of the people peaceably to assemble, and to petition the Government for a redress of grievancesÓ এই ক’টি সাংবিধানিক ধারাই যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের জন্য বৈষম্যহীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে আসছে। উপরে উল্লিখিত নাগরিক-অধিকার সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাংবিধানিক ধারার মতো নীতিমালা আমাদের সংবিধানেও আছে, এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ছাড়াই সেগুলো সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু সমস্যাটা হলো যে, আমাদের সংবিধানে নাগরিক অধিকারের বিষয়গুলো শুধু লিখিতই আছে, বাস্তবে এর কোনো প্রয়োগ নেই। অধিকন্তু, সরকার এবং সরকার-গঠনকারী রাজনৈতিক দল নিজেরাই এসব নাগরিক অধিকার হরদম লঙ্ঘন করে যাচ্ছে এবং তা করে পার পেয়ে যাচ্ছে। এখানেই পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে আমাদের প্রধান তফাত্। পাশ্চাত্যে সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিক অধিকার সরকার লঙ্ঘন করলে জনগণ কোর্টেও মাধ্যমে সরকারকে তা মেনে চলতে বাধ্য করে, কিন্তু আমাদের দেশে কোর্ট অধিকাংশ সময়েই সরকারের আইনি-বেইনি সকল কর্মকাণ্ড এবং ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে সমর্থন ও বৈধতা দেয়ার একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সমস্যাটা এখানেই। তাই আমাদের সংবিধানে নাগরিক অধিকার এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সম্পর্কে কি লেখা আছে বা নেই সেটা বড় কথা নয়, সরকার এবং চামচা রাজনীতিবিদ এবং বিচারক ও আমলারা তাদের মনিবের ইচ্ছায় কি করতে চায়, সেটাই মুখ্য। বাংলাদেশে সরকার এবং কোর্ট ইচ্ছা করলে সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে আলাদা একটা রাষ্ট্রীয় স্তম্ভ ছাড়াই ধর্ম-বর্ণ-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য বৈষম্যহীন সম-অধিকার নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র মতো একটা অপ্রয়োজনীয় আলাদা রাষ্ট্রীয় মূলনীতিকে আমাদের রাজনীতিবিদরা আঁকড়ে ধরে আছেন শুধু তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার জন্য। মানুষের নিষ্কলুষ ধর্মীয় অনুভূতি এবং আবেগ-উচ্ছ্বাসকে কুটিল রাজনীতিবিদরা পণ্য হিসেবে এক্সপ্লয়েট করার জন্য ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে অপব্যবহার করছে। সুতরাং, অত্যন্ত উত্কণ্ঠার সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, ‘ধর্মনিপেক্ষতা’কে কেন্দ্র করে আমাদের রাজনীতির অতি দ্রুত মেরুকরণ হয়ে যাচ্ছে ‘ধর্মের পক্ষের ও বিপক্ষের’ শক্তিতে। এই জাতীয় বিভাজনকে অচিরেই রোধ করতে হবে; তা না করলে শুধু যে সামাজিক অস্থিরতা এবং অহেতুক রক্তপাতই বাড়বে তা নয়, বরং গণতন্ত্র ও আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে পড়বে। এর মধ্যে আমাদের রাজনীতিতে ‘স্বাধীনতার পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তি’, ‘দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা এবং দালাল মুক্তিযোদ্ধা’, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’, ইত্যাদি যেসব উপাদানের আবির্ভাব ঘটিয়ে রাজনীতিবিদরা শঠতার সঙ্গে কৃত্রিমভাবে আমাদের অত্যন্ত সুসংহিত জাতিগোষ্ঠীকে বিভাজিত করে ফায়দা লুটার চেষ্টা করছেন, তার সঙ্গে এই ‘ধর্মনিপেক্ষতার পক্ষ/বিপক্ষের’ রাজনীতি একেবারে বারুদের মতো কাজ করবে এতে কোনোই সন্দেহ নেই। তাই এসব বিভাজনকে রোধ করার জন্য নাগরিকদের ঐক্য একান্তই আবশ্যক, কিন্তু সংবিধানে যতদিন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ একটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে থাকবে, ততদিন এর রাজনৈতিক অপব্যবহার থামবে না এবং রাজনীতিতে ‘ধর্মেও পক্ষ/বিপক্ষের’ রাজনৈতিক শক্তির মেরুকরণ এবং সামাজিক বিভাজন তীব্রতর হতে থাকবে। সুতরাং সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আইন ও পক্ষপাতহীন বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিক অধিকারকে যথাযথ বাস্তবায়িত করে সব ধর্ম-বর্ণেও মানুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করা হলে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ আলাদা একটা রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে সংবিধানে থাকার আর কোনো প্রয়োজন হবে না, এই উপলব্ধিবোধ রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ নাগরিকদের মনে যত তাড়াতাড়ি জাগ্রত হবে, ততই জাতির জন্য মঙ্গল।
যদি আরও আগের ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যাবে যে, ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা এবং তত্কালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণের জন্য ‘ছয়দফা কর্মসূচি’ নামক রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করেন। সেই ছয় দফা কর্মসূচি ও ১৯৭০ নির্বাচনের কোনো ইশতেহারেও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র উল্লেখ নেই।
তাহলে কেন এবং কীভাবে ‘ধর্মনিপেক্ষতা’ রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির একটি হিসেবে বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে স্থান পেল তা এক বিস্ময়ের ব্যাপার। হয়তো অনেকের যুক্তি হতে পারে যে, ধর্মীয় বিবেচনায় নাগরিকদের সঙ্গে রাষ্ট্র্র বা সরকার যাতে কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ না করে সেজন্য ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির একটি হিসেবে স্থান দেয়া হয়েছে। কিন্তু নাগরিকদের সঙ্গে রাষ্ট্রের পক্ষপাতহীন আচরণ নিশ্চিত করার জন্য সংবিধানের অন্যান্য ধারায় প্রদত্ত বিধি মোতাবেক প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বর্ণিত ‘জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা’ করাই যথেষ্ট ছিল, এবং এখনো আছে, যদি তা সরকার নিষ্ঠার সঙ্গে করতে চায়। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাকে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত করলে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে আলাদা একটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে কি প্রয়োজন হতো?
বরং ধর্ম-পরিচয়ের কারণে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কিংবা কোনো সংগঠন যাতে নাগরিকদের মাঝে বৈষম্যমূলক আচরণ না করে সেজন্য আইন প্রণয়ন করে বৈষম্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ শাস্তির বিধান করাই হতো উত্তম, যা পাশ্চাত্যের অনেক উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়—‘সেক্যুলারিজম’ বলে কোনো শব্দ যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে নেই, অথচ বৈষম্যহীন নাগরিক অধিকার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাভোগকারী বিশ্বের সব রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নাম সবার আগেই বলতে হয়। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই সেপ্টেম্বর পাসকৃত যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের আর্টিক্যাল ৬-এ বলা হয়েছে, ুঘড় ত্বষরমরড়ঁং ঞবংঃ ংযধষষ বাবত্ নব required as a Qualification to any Office or public Trust under the United States”. তারপর ১৭৯১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পাসকৃত যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১ম সংশোধনীতে বলা হয়েছে, “Congress shall make no law respecting an establishment of religion, or prohibiting the free exercise thereof; or abridging the freedom of speech, or of the press; or the right of the people peaceably to assemble, and to petition the Government for a redress of grievancesÓ এই ক’টি সাংবিধানিক ধারাই যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের জন্য বৈষম্যহীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে আসছে। উপরে উল্লিখিত নাগরিক-অধিকার সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাংবিধানিক ধারার মতো নীতিমালা আমাদের সংবিধানেও আছে, এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ছাড়াই সেগুলো সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু সমস্যাটা হলো যে, আমাদের সংবিধানে নাগরিক অধিকারের বিষয়গুলো শুধু লিখিতই আছে, বাস্তবে এর কোনো প্রয়োগ নেই। অধিকন্তু, সরকার এবং সরকার-গঠনকারী রাজনৈতিক দল নিজেরাই এসব নাগরিক অধিকার হরদম লঙ্ঘন করে যাচ্ছে এবং তা করে পার পেয়ে যাচ্ছে। এখানেই পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে আমাদের প্রধান তফাত্। পাশ্চাত্যে সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিক অধিকার সরকার লঙ্ঘন করলে জনগণ কোর্টেও মাধ্যমে সরকারকে তা মেনে চলতে বাধ্য করে, কিন্তু আমাদের দেশে কোর্ট অধিকাংশ সময়েই সরকারের আইনি-বেইনি সকল কর্মকাণ্ড এবং ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে সমর্থন ও বৈধতা দেয়ার একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সমস্যাটা এখানেই। তাই আমাদের সংবিধানে নাগরিক অধিকার এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সম্পর্কে কি লেখা আছে বা নেই সেটা বড় কথা নয়, সরকার এবং চামচা রাজনীতিবিদ এবং বিচারক ও আমলারা তাদের মনিবের ইচ্ছায় কি করতে চায়, সেটাই মুখ্য। বাংলাদেশে সরকার এবং কোর্ট ইচ্ছা করলে সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে আলাদা একটা রাষ্ট্রীয় স্তম্ভ ছাড়াই ধর্ম-বর্ণ-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য বৈষম্যহীন সম-অধিকার নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র মতো একটা অপ্রয়োজনীয় আলাদা রাষ্ট্রীয় মূলনীতিকে আমাদের রাজনীতিবিদরা আঁকড়ে ধরে আছেন শুধু তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার জন্য। মানুষের নিষ্কলুষ ধর্মীয় অনুভূতি এবং আবেগ-উচ্ছ্বাসকে কুটিল রাজনীতিবিদরা পণ্য হিসেবে এক্সপ্লয়েট করার জন্য ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে অপব্যবহার করছে। সুতরাং, অত্যন্ত উত্কণ্ঠার সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, ‘ধর্মনিপেক্ষতা’কে কেন্দ্র করে আমাদের রাজনীতির অতি দ্রুত মেরুকরণ হয়ে যাচ্ছে ‘ধর্মের পক্ষের ও বিপক্ষের’ শক্তিতে। এই জাতীয় বিভাজনকে অচিরেই রোধ করতে হবে; তা না করলে শুধু যে সামাজিক অস্থিরতা এবং অহেতুক রক্তপাতই বাড়বে তা নয়, বরং গণতন্ত্র ও আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে পড়বে। এর মধ্যে আমাদের রাজনীতিতে ‘স্বাধীনতার পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তি’, ‘দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা এবং দালাল মুক্তিযোদ্ধা’, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’, ইত্যাদি যেসব উপাদানের আবির্ভাব ঘটিয়ে রাজনীতিবিদরা শঠতার সঙ্গে কৃত্রিমভাবে আমাদের অত্যন্ত সুসংহিত জাতিগোষ্ঠীকে বিভাজিত করে ফায়দা লুটার চেষ্টা করছেন, তার সঙ্গে এই ‘ধর্মনিপেক্ষতার পক্ষ/বিপক্ষের’ রাজনীতি একেবারে বারুদের মতো কাজ করবে এতে কোনোই সন্দেহ নেই। তাই এসব বিভাজনকে রোধ করার জন্য নাগরিকদের ঐক্য একান্তই আবশ্যক, কিন্তু সংবিধানে যতদিন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ একটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে থাকবে, ততদিন এর রাজনৈতিক অপব্যবহার থামবে না এবং রাজনীতিতে ‘ধর্মেও পক্ষ/বিপক্ষের’ রাজনৈতিক শক্তির মেরুকরণ এবং সামাজিক বিভাজন তীব্রতর হতে থাকবে। সুতরাং সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আইন ও পক্ষপাতহীন বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিক অধিকারকে যথাযথ বাস্তবায়িত করে সব ধর্ম-বর্ণেও মানুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করা হলে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ আলাদা একটা রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে সংবিধানে থাকার আর কোনো প্রয়োজন হবে না, এই উপলব্ধিবোধ রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ নাগরিকদের মনে যত তাড়াতাড়ি জাগ্রত হবে, ততই জাতির জন্য মঙ্গল।
কোন মন্তব্য নেই:
/>