বুধবার, ৫ জুন, ২০১৩

বিগত প্রায় তিনশত বছর ধরে এই মতবাদ গোটা পৃথিবীতে একটি আদর্শ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে আসছে।





বর্তমান পৃথিবীতে অত্যন্ত কৌশলের সাথে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নামক অস্ত্র দিয়ে ইসলামকে ধ্বংস করার চক্রান্ত চলছে। অথচ সাধারণ মানুষকে বুঝানো হচ্ছে এই মতবাদের অর্থ হলো যার যার ধর্ম সে পালন করবে। ইসলামের সাথে এর কোনো বিরোধ নেই। ইংরেজি ‘সেকিউলারিজম’ শব্দের বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। এই সেকিউলারিজম শব্দের প্রকৃত অর্থ হলো ‘ইহজাগতিকতা’. যার ব্যাখ্যা করলে আমরা বুঝতে পারি এই জড় জগতে যা কিছু কেবল সে সবকেই এই মতবাদ স্বীকৃতি দিচ্ছে। এই জড় জগতের বাইরে কোনো কিছুর অস্তিত্বকে স্বীকার না করার নামই ইহজাগতিকতা। অতিন্দ্রীয় কোনো শক্তিকে স্বীকৃতি না দেয়ার নামই হচ্ছে ইহজাগতিকতা। অর্থাৎ সেকিউলারিজম অনুযায়ী যা কিছু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, তাকেই স্বীকৃতি দেয়া যাবে, আর যা কিছু ইন্দ্রিয়ানুভূতির বাইরে তাকে স্বীকৃতি দেয়া যাবে না। এই মতবাদ সরাসরি ধর্মের ওপর আঘাত হানে না, অথচ ধর্মের মূল কেটে দেয়।

বিগত প্রায় তিনশত বছর ধরে এই মতবাদ গোটা পৃথিবীতে একটি আদর্শ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে আসছে। মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে তুরস্কের কামাল পাশাই সর্বপ্রথম এই মতবাদ রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ইতঃপূর্বে কোনো মুসলিম দেশ এইভাবে বিশ্বব্যাপী ঘোষণা দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের পূজারী সেজেছেন বলে কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের ইতিহাসে পাওয়া যায় না।

ধর্মীয় অনুশাসনসমূহ মানুষের ব্যক্তি জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন এবং রাষ্ট্রীয় জীবনকে ধর্মের প্রভাবমুক্ত রাখার প্রক্রিয়াই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মনিরপেক্ষতার স্বরূপ। ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ অনুসারে রাজনীতি, অর্থনীতি, শ্রমনীতি, সভ্যতা ও সংস্কৃতিসহ সব ধরনের নীতিমালা হতে হবে ধর্মের প্রভাবমুক্ত। সঙ্গত কারণে এই মতবাদকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ না বলে ধর্মহীন মতবাদ বলাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত।

ধর্মনিরপেক্ষতা হলো কোনো ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট না হওয়া। অন্যথায় ধর্মহীন জীবন অনুসরণ করা। এরাই অবশেষে ধর্মের বৈরি হয়ে দাঁড়ায়। এই কারণেই দেখা যাচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা ধর্মের উৎকট বিরোধিতায় লিপ্ত। এই মতবাদের জন্মদাতা ও ধারক-বাহকেরা বলে থাকেন, ধর্ম মানুষের একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। কে ধর্ম পালন করলো আর কে পালন করলো নাÑ এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। এই মতবাদ সরাসরি আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করে না বটে, কিন্তু আল্লাহর গুণাবলী সম্পর্কে এই মতবাদ নিজস্ব ধারণা মানুষের সামনে পেশ করে। আল্লাহর অসীম ক্ষমতাকে সসীম করতে চায়। ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ দুনিয়ার জীবনকে মানুষের উন্নতি, শান্তি, প্রগতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীদের মাধ্যমে কোনো বিধান পাঠানোর প্রয়োজন নেই বলে ধারণা দেয়। সমাজ বা রাষ্ট্রে ধর্ম হস্তক্ষেপ করবে এ কথা যারা বলে তারা প্রগতিবিরোধী। তারাই প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক শক্তি। দুই ব্যক্তির সম্পর্কের মধ্যেও ধর্মের প্রভাব থাকা চলবে না। সংক্ষেপে এটাই হলো ধর্মনিরপেক্ষতার স্বরূপ।

ব্যক্তি জীবনে ধর্মকে গ্রহণ ও পার্থিব জীবনের সকল ক্ষেত্রে ধর্মকে নির্বাসন দেয়ার মতবাদ তথা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ অত্যন্ত কুটিল ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ এবং দূরভিসন্ধিমূলক। যারা এ মতবাদের পক্ষে, তারা ব্যক্তি জীবনেও ধর্মের বন্ধন স্বীকার করতে রাজি নয়। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে,ধর্ম যদি ব্যক্তিগত ব্যাপারই হয়, তাহলে ধর্মকে মেনে চলেন না কেন? তখন এ মতবাদের অনুসারীরা বলবে, ধর্ম মানা না মানা একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ প্রশ্ন করাও অপরাধ। কেননা কারো ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মাথা ঘামানোর অধিকার কারো নেই এর অর্থ হলো, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা যে ধর্মকেই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য এ ধরনের বিভ্রান্তিমূলক মতবাদ প্রচার করে থাকেন তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা এ কথা ভালো করেই জানে যে, ধর্মকে মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপারে পরিণত করলে এবং ধর্ম পালন করা না করার ব্যাপারে শাসন করার কেউ না থাকলে ধর্ম এমনিতেই বিদায় নিয়ে যাবে পৃথিবী থেকে।

তারা এ উদ্ভট মতবাদকে ধর্মহীন মতবাদ না বলে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বলে। আর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদই মূলত ধর্মহীনতাবাদ। অতএব, বোঝা গেল যে, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা মূলত নাস্তিক। ধর্মের প্রতি এদের কোনো বিশ্বাস বা সহানুভূতি নেই। ধর্মের প্রভাব বিস্তার ঘটুক অথবা মানুষ ধর্মভীরু হোক, ধর্মীয় বিধিমালা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক, ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে মানুষেরা চরিত্র গঠন করুক এ ধরনের কোনো কর্মসূচি ধর্মনিরপেক্ষ শাসক এবং ধর্মনিরপেক্ষ দলসমূহ দিতে মোটেই কার্পণ্য করে না। এদের প্রতিটি কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করে দেখলেই অনুধাবন করা যায়, ধর্মকে বরখাস্ত করতে এরা কত সিদ্ধহস্ত। জীবন সম্পর্কে যারা অবাধ ভোগবাদে বিশ্বাসী তারাই এই ধর্মনিরপেক্ষতার ধারক-বাহক। জীবনকে নীতিবোধের ঝামেলামুক্ত করে স্বাধীনভাবে যা খুশি তাই করা যায়, এ সস্তা সুবিধা আদায় করার জন্যই একশ্রেণীর নৈতিক চরিত্রহীন ব্যক্তিরা ধর্মকে চিরতরে বিদায় করে দিয়ে সর্বস্তরে চরিত্রহীনতার প্লাবন বহায়ে দেয়ার জন্যই ধর্মনিরপেক্ষতার আমদানি করে তা প্রতিষ্ঠার জন্যই এরা দল গঠন করে দলের অন্যতম নীতিনির্ধারণ করে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। কারণ অবাধে ভোগ করতে হলে ধর্মকে ব্যক্তিগত ব্যাপারে পরিণত করা ছাড়া উপায় নেই। ধর্ম সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে পরিণত হলে ভোগ করার চোরাগলি পথ বন্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং এ মতবাদের প্রবক্তাদের যে উদ্দেশ্য খারাপ তা দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার।

এ জন্য ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা প্রকৃত ধর্ম তথা ইসলামকে উৎখাতের জন্য সরাসরি ‘ইসলামকে উৎখাত করবো বা ইসলামপন্থীদের নির্মূল করবো, এ কথা তারা বলবে না। কারণ তারা জানে সরাসরি একথা বললে এ দেশের জনগণ তাদের কবর রচিত করবে। তাই তারা মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা উৎখাতের নামে ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের উৎখাত করতে চায়। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা মৌলবাদ শব্দটা ব্যবহার করে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে ইসলামকে উৎখাত করার জন্য। মৌলবাদী বলতে বা ফান্ডামেন্টালিস্ট বলতে তাদেরকে বুঝায়, যারা মূল জিনিসে বিশ্বাসী তারাই মৌলবাদী (ফান্ডামেন্টালিস্ট)।

কুরআন-হাদিস তথা আল্লাহ ও নবীদের দেখানো পথ ছাড়া অন্য কোনো পথ, মত মেনে নেয় না যারা তারাই মৌলবাদী। কুরআন-হাদিসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন-কানুন মেনে নিতে চায় না, যারা কুরআন-হাদিসের আদর্শের কোনো পরিবর্তন চায় না,যারা কুরআন-হাদিস অনুযায়ী নিজেদের ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন তথা আন্তর্জাতিক জীবন পর্যন্ত গড়তে চায়। কুরআন-হাদিসকেই অনুসরণ করতে চায়। ইসলামকে যারা অকৃত্রিমভাবে বুকে চেপে ধরে রাখতে চায় তারাই মৌলবাদী। প্রতিটি ইসলামী চিন্তাবিদকেই যে মূল ইসলামের জন্য নির্যাতনের স্টিম রোলার সহ্য করতে হয়েছে। সেই মূল ইসলামেই যারা বিশ্বাস করে তারাই মৌলবাদী মুসলমান। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা এই মৌলবাদকেই উৎখাত করতে চায়। তারা এই মৌলবাদী মুসলমানদেরকেই নির্মূল করে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীন অবস্থা কায়েম করতে চায়।

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ইতিবৃত্ত পর্যালোচনা করলে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, এ মতবাদ কোনো কল্যাণকর মতবাদ নয়। এ মতবাদ মানব জাতির জন্য চরম অকল্যাণকর। এ মতবাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো ধর্মকে মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপারে সীমাবদ্ধ করার নামে মানুষের জীবনের সর্বস্তর থেকে আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর প্রভাবমুক্ত করে মানুষকে ধর্মের প্রভাবমুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বের বন্ধন ছিন্ন করার পর কোনো আদর্শের ওপর ভিত্তি করে মানুষ তার জীবন পরিচালনা করবে এ ধরনের কোনো আদর্শের সন্ধান ও মতবাদ পাওয়া যাবে না। জীবনের সকল বিভাগকে ধর্মীয় আদর্শমুক্ত করে মানুষকে তার জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যস্থল পশুর ন্যায় জীবন গ্রহণে বাধ্য করে এ মতবাদ। এ মতবাদ মানুষকে কোনো আদর্শের সন্ধান দেয় না বলে মানুষ চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ মানুষকে আদর্শহীন অবস্থায় ছেড়ে দেয়। তখন মানুষের জীবনে নেমে আসে সীমাহীন শূন্যতা।

ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ যখন মানুষকে আদর্শহীন অবস্থায় ছেড়ে দেয় তখন মানুষের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, শিক্ষার ক্ষেত্রে তার জীবনের সকল ক্ষেত্রে বিরাজ করতে থাকে এক চরম অরাজকতা। ঠিক এমন এক মুহূর্তে মানুষের চরম বিপদের সময় ভোগবাদে বিশ্বাসী ধূর্ত ব্যক্তিরা বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর মতবাদ মতাদর্শ তৈরি করে মানুষের সামনে পেশ করে মানব জাতির সীমাহীন সমস্যা সমাধানের জন্য পরামর্শ দেয়। আদর্শশূন্য হতাশাগ্রস্ত এ সমস্ত ভ্রান্ত মতবাদ গ্রহণ করার ফলে সমস্যা আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এসব কিছুই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নামক বিষবৃক্ষের ফল।

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মানুষকে স্বেচ্ছাচারিতার শেষ স্তরে নিক্ষেপ করে। এ মতবাদ মানবদেহের সুপ্ত পশুত্বকে বল্গাহীন করে নৈতিকতার শেষ বন্ধনটুকু ছিন্ন করারই জঘন্য আদর্শ মাত্র। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ যে ধরনের সভ্যতার জন্ম দিয়েছে তা নৈতিকতার দৃষ্টিতে মানব সমাজের উপযোগী নয়। এ মতবাদ মানুষকে প্রবৃত্তির দাসে পরিণত করে। এ মতবাদের প্রভাবে মানুষের মধ্যে ব্যক্তিগত স্বার্থ, দলীয় সুবিধাবাদ, সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদসহ নানা ধরনের ক্ষতিকর প্রবণতা জন্ম দেয়। ধর্মহীনতার ফলে জনগণ ব্যাপকভাবে নৈতিকতা বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়ে। পরিচিত ভালো কাজসমূহ লোপ পায়। আর পরিচিত-অপরিচিত খারাপ কাজসমূহ ব্যাপকভাবে সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আল্লাহ আমাদের এই স্থূলবুদ্ধি সম্পন্ন এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের খপ্পর থেকে হেফাজত করে সঠিক ধর্মপথের অনুসারী হওয়ার তৌফিক এনায়েত করুন। লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট ও গ্রন্থকার।


কোন মন্তব্য নেই:

Comment here />

Widget ByBlogger Maruf
Widget ByBlogger Maruf