নিকাব / হিজাব সম্বন্ধে ইসলামিক স্কলারদের অভিমত !!!
গত কয়েকদিন যাবত নিকাব প্রয়োজনীয় নাকি অপ্রয়োজনীয়,নিকাব কি পরতেই হবে নাকি পরা যাবে না?এসব ব্যাপারে ব্লগজগতে ব্যাপক আলোচনা পর্যালোচনা চলছে। আমি ইচ্ছা করেই সেখানে কোন কমেন্ট করিনি।কিন্তু,পরবর্তীতে ব্যাপারটা নিয়ে ইসলামিক স্কলারদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে একটা লেখা লিখতে ইচ্ছে হল।এতে অন্ততঃ আমারও কিছুটা উপকার হবে এবং অনলাইন জগতে বাংলাভাষী ভাইবোনদের জন্য একটা রেফারেন্স হিসেবে অবশিষ্ট্য থাকবে বলে মনে করেই লিখতে শুরু করলাম।
আলোচনার শুরুতেই বলে রাখা ভাল যে,"নিকাব"জিনিসটা ইসলামের কোন মৌলিক বিষয় নয়;এজন্য আল্লাহ তায়ালা কিংবা তার রাসুল (সাঃ)সুস্পষ্টভাবে বলে যাননি যে,নিকাব পরতে হবে নাকি পরা যাবে না? যেহেতু, কুরআন কিংবা হাদীসে স্পষ্টভাবে এ ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি;সুতরাং,আমরা ধরে নেব যে,এটা শাখা প্রশাখাগত একটা বিষয়।মৌলিক কিছু হলে আল্লাহ তায়ালা কিংবা তার রাসুল(সাঃ)এর পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে এ ব্যাপারে কিছু বলা হত।
অতএব,বিষয়টা ইসলামিক স্কলারদের গবেষণার একটা ক্ষেত্র হিসেবেই এখন পরিগণিত হবে।তারা কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন মুলনীতির আলোকে এ বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করবেন।তাদের সে গবেষণা সঠিক কিংবা ভুল যেটিই হোক না কেন তারা তাদের গবেষণার কারণে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সাওয়াব তথা প্রতিদান পাবেন।সঠিক হলে দুইটি সাওয়াব আর ভুল হলে পাবেন একটি।
"চেহারা খোলা যাবে কি যাবে না"এ মাসয়ালা নিয়ে ইসলামী স্কলারগণ অনেক অনেক কথা বলেছেন। চেহারা খোলা নিয়ে যত প্রকার কথাবার্তা হয়েছে তার সবকিছুই পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতকে কেন্দ্র করেই হয়েছে।সবাই মতবিরোধ করেছেন শুধুমাত্র এক জায়গায়।আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, وَلا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلا مَا ظَهَرَ مِنْهَا অর্থাৎ,আর তারা যেন যা আপনা আপনি প্রকাশিত হয়ে যায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্যকে প্রকাশ না করে।(সূরা নূর:৩১)
"যা আপনাআপনি প্রকাশ হয়ে যায়" এ ব্যাপারে পূর্ববর্তী মুফাসসিরদের কাছ থেকে ৩ টা মত পাওয়া যায়।
১. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেন: ওটা হচ্ছে পরিধানের পোশাক। অর্থাৎ, পোশাকের উপরিভাগ;সেটা খোলা থাকতে পারে। সেটা ঢাকার প্রয়োজন পড়বে না। ২.আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও মিসওয়ার বিন মাখরামাহ (রহঃ)এর মতে: ওটা হচ্ছে আংটি ও সুরমা।
৩. হাসান বাসরী,সাঈদ বিন জুবাইর ও আ'তা (রাঃ) এর মতে ওটা হল- চেহারা ও উভয় হাতের তালু। (তাফসীরে মাওয়ারদীঃ৪/৯০)
অতএব,তাদের মতপার্থক্যের ভিত্তিতে উপরের অংশটুকু খোলা রাখা যাবে। বাকী অংশটুকু সতর বা ঢেকে রাখতে হবে। প্রসঙ্গতঃ যদি হাতের কব্জি পর্যন্ত ও চেহারা সতর হলে সেগুলো অন্যের সামনে খুলে রাখা যাবে না। আর যদি তা সতর না হয় তাহলে, খুলে রাখা যাবে বা সেদিকে তাকানো যাবে।
এখন আমরা দেখব ইসলামিক স্কলারদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কি বলা হয়েছে? আসুন!!আমরা ইসলামিক স্কলারদের মতামতগুলো কিছুটা বিস্তারিতভাবে জানার চেষ্টা করি।
চেহারা খুলে রাখার ব্যাপারে হানাফী মাযহাবঃ
১ হানাফী মাযহাবের মূল ফাতওয়া হল-স্বাধীনা মহিলার চেহারা, কব্জি পর্যন্ত হাত ও দুই পা ঢেকে রাখা বাধ্যতামুলক নয়।
তাবয়িনুল হাক্বায়েক্ব গ্রন্থে বলা হয়েছে- وَبَدَنُ الْحُرَّةِ عَوْرَةٌ إلَّا وَجْهَهَا وَكَفَّيْهَا وَقَدَمَيْهَا অর্থাৎ,স্বাধীনা মহিলার চেহারা,কব্জি পর্যন্ত দুই হাত ও দুই পা ছাড়া তার দেহটা সতর বা ঢেকে রাখার বস্তু।তাদের দলীল হল- আল্লাহ তায়ালার বাণী- وَلا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلا مَا ظَهَرَ مِنْهَا
অর্থাৎ,আর তারা যেন যা আপনা আপনি প্রকাশিত হয়ে যায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্যকে প্রকাশ না করে।(সূরা নূর:৩১)
সৌন্দর্যের কেন্দ্র বলতে উদ্দেশ্য হল-চেহারা ও কব্জি পর্যন্ত দুই হাত;যেমনটি বলেছেন ইবনে আব্বাস ও ইবনে উমার(রাঃ)।(তাবয়িনুল হাক্বায়েক্ব শরহু কানজুদ দাক্বায়েকঃ ১/৯৬)
তবে,হানাফী মাযহাবের পরবর্তী স্কলারগণ কব্জি পর্যন্ত হাত ও চেহারা প্রকাশ করতে নিষেধ করেছেন। তবে, এ নিষেধাজ্ঞা সতর হিসেবে নয়, বরং সমাজে বিশৃঙ্খলা ও ফিতনা ফাসাদ সৃষ্টির প্রবল ধারণার কারণেই সেগুলো এড়ানোর জন্য তারা এ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।
আল্লামা কাসানি (রহঃ) বলেন: পর পুরুষের জন্য (বিবাহ হারাম নয় এমন) স্বাধীনা মহিলার চেহারা ও দুই হাতের তালু ছাড়া অন্য কোন দিকে তাকানো বৈধ নয়। কেননা, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ অর্থাৎ, হে নবী (সাঃ)! মু'মিনদেরকে বলুন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে। (সূরা নূরঃ৩০) আর হাত ও চেহারার দিকে তাকানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে আল্লাহ তায়ালার বাণী- وَلا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلا مَا ظَهَرَ مِنْهَا
অর্থাৎ,আর তারা যেন যা আপনা আপনি প্রকাশিত হয়ে যায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্যকে প্রকাশ না করে।(সূরা নূর:৩১) শীর্ষক আয়াতের মাধ্যমে।
কুরআনের আয়াতে "সৌন্দর্য"বলতে সৌন্দর্যের স্থানকে বুঝানো হয়েছে।আর সৌন্দর্যের যে স্থান আপনা আপনি প্রকাশিত হয়ে যায় তাহল-চেহারা ও কব্জি পর্যন্ত হাত।"চোখের সুরমা চেহারার সৌন্দর্য এবং আংটি হাতের সৌন্দর্য।এগুলো কেনাকাটা কিংবা লেনদেনের সময় সাধারণত প্রকাশ করার প্রয়োজন হয়।স্বাভাবিকভাবে চেহারা কিংবা হাতের তালু খোলা ছাড়া এ কাজগুলো করা সম্ভব হয় না।ফলে,এগুলো খোলা রাখাকে বৈধ করা হয়েছে।আর এটাই ইমাম আবু হানিফা(রহঃ)এর মত।
ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)থেকে আরেকটি সুত্রে জানা যায়,মনের মধ্যে জৈবিক কামনার উদ্রেক না হলে কব্জি পর্যন্ত হাত ও চেহারার দিকে তাকানো বৈধ।কামনার উদ্রেক হলে সেটা বৈধ হবে না।
কেননা,রাসুল (সাঃ)বলেছেন: الْعَيْنَانِ تَزْنِيَانِ অর্থাৎ, চক্ষুদ্বয় ব্যভিচার করে। (মুসনাদে আহমাদ,মুসনাদে ইবনে আবী শায়বা)
চোখের ব্যভিচার হল- কামনা সহকারে তাকানো। কেননা, এগুলো ব্যক্তির হারাম কাজে লিপ্ত হওয়ার কারণ হয়। তাই, এগুলো হারাম। তবে, জরুরী অবস্থায় এগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করা বৈধ। যেমন, কাউকে কোর্টে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য ডাকা হয়েছে। সে সাক্ষ্যের প্রয়োজনে কিংবা বিচারক বিচারের প্রয়োজনে তার চেহারার দিকে তাকাতে পারে, যদিও তাতে কামনার উদ্রেক হয়। (দেখুন: বাদায়েউস সানায়ে: ৫/১২২)
ইমাম সারাখসী (রহঃ) চেহারা ও হাতের তালুর দিকে তাকানোর বৈধতা উল্লেখ করে বলেন, وَهَذَا كُلُّهُ إذَا لَمْ يَكُنْ النَّظَرُ عَنْ شَهْوَةٍ فَإِنْ كَانَ يَعْلَمُ أَنَّهُ إنْ نَظَرَ اشْتَهَى لَمْ يَحِلَّ لَهُ النَّظَرُ إلَى شَيْءٍ مِنْهَا
অর্থাৎ,এগুলো সবই কামনামুক্ত হওয়ার শর্তে।যদি পুরুষ মনে করে যে,চেহারা ও হাতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে কামনা জাগ্রত হবে তাহলে,সেদিকে দৃষ্টিপাত করা অবৈধ গণ্য হবে।(আল মাবসুত:১০/১৫৩)
আবু বকর আল জাসসাস (রহঃ) তাফসীরে আহকামুল কুরআনে- يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ অর্থাৎ, মহিলাগণ যেন নিজেদের উপর তাদের জিলবাব (বড় চাদর ইত্যাদি) টেনে নেয়। আয়াতের ব্যাখায় বলেন- فِي هَذِهِ الْآيَةِ دَلَالَةٌ عَلَى أَنَّ الْمَرْأَةَ الشَّابَّةَ مَأْمُورَةٌ بِسَتْرِ وَجْهِهَا عَنْ الْأَجْنَبِيِّينَ
অর্থাৎ, এই আয়াতে যুবতী মহিলাদেরকে বেগানা পুরুষদের সামনে নিজেদের চেহারা ঢেকে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। (আহকামুল কুরআনঃ ৩/৪৮৬)
দুররুল মুখতারে বলা হয়েছে- وَتُمْنَعُ الْمَرْأَةُ الشَّابَّةُ مِنْ كَشْفِ الْوَجْهِ بَيْنَ رِجَالٍ لَا لِأَنَّهُ عَوْرَةٌ بَلْ لِخَوْفِ الْفِتْنَةِ
অর্থাৎ, কামনা থেকে মুক্ত থাকলেও যুবতী মহিলাদেরকে পরপুরুষদের সামনে চেহারা প্রকাশ করতে নিষেধ করতে হবে। তবে, তা সতর হওয়ার কারণে নয় বরং, ফিৎনার আশংকা থাকার কারণে। (দুরুরুল মুখতার: ১/৪০৬)
এর ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে আবেদীন (রহঃ) বলেন: تُمْنَعُ مِنْ الْكَشْفِ لِخَوْفِ أَنْ يَرَى الرِّجَالُ وَجْهَهَا فَتَقَعُ الْفِتْنَةُ لِأَنَّهُ مَعَ الْكَشْفِ قَدْ يَقَعُ النَّظَرُ إلَيْهَا بِشَهْوَةٍ
অর্থাৎ,পুরুষেরা তার চেহারা দেখে ফেললে ফিৎনার সৃষ্টি হতে পারে এ আশংকায় তাদেরকে চেহারা খুলতে নিষেধ করতে হবে।কেননা,চেহারা প্রকাশিত হলে পুরুষেরা তার প্রতি কামনাসহ দৃষ্টিপাত করতে পারে।(দুররুল মুখতার ও হাশিয়ায়ে ইবনে আবেদীনঃ১/৪০৬)
বাহরুর রায়েক গ্রন্থে বলা হয়েছে- لَا تَكْشِفُ وَجْهَهَا لِلْأَجَانِبِ مِنْ غَيْرِ ضَرُورَةٍ
অর্থাৎ, জরুরী অবস্থা ব্যতিত পর পুরুষের সামনে মহিলাগণ নিজের চেহারা প্রকাশ করবে না। (বাহরুর রায়েক্বঃ ২/৩৮১)
একই গ্রন্থে অন্যত্র বলা হয়েছে- تُمْنَعُ الْمَرْأَةُ الشَّابَّةُ مِنْ كَشْفِ وَجْهِهَا بَيْنَ الرِّجَالِ فِي زَمَانِنَا لِلْفِتْنَةِ অর্থাৎ, আমাদের বর্তমান যুগে ফিতনার কারণে যুবতী মহিলাদেরকে পুরুষের সামনে তাদের চেহারা প্রকাশে নিষেধ করতে হবে। (প্রাগুক্তঃ ১/২৮৪)
চেহারা খুলে রাখার ব্যাপারে মালেকী মাযহাবঃ
"মানহুল জালীল; শারহু মুখতাসারিল খালীল" গ্রন্থে এসেছে- فَالْوَجْهُ وَالْكَفَّانِ لَيْسَا عَوْرَةً فَيَجُوزُ لَهَا كَشْفُهُمَا لِلْأَجْنَبِيِّ وَلَهُ نَظَرُهُمَا إنْ لَمْ تُخْشَ الْفِتْنَةُ فَإِنْ خِيفَتْ الْفِتْنَةُ بِهِ فَقَالَ ابْنُ مَرْزُوقٍ مَشْهُورُ الْمَذْهَبِ وُجُوبُ سَتْرِهِمَا وَقَالَ عِيَاضٌ لَا يَجِبُ سَتْرُهُمَا وَيَجِبُ عَلَيْهِ غَضُّ بَصَرِهِ وَقَالَ زَرُّوقٌ يَجِبُ السَّتْرُ عَلَى الْجَمِيلَةِ وَيُسْتَحَبُّ لِغَيْرِهَا
অর্থাৎ, চেহারা ও হাতের তালু সতর নয়। অতএব, মহিলা এগুলো পরপুরুষের সামনে প্রকাশ করতে পারবে এবং পুরুষও সেদিকে তাকাতে পারবে; যদি ফিৎনার আশংকা না থাকে। ফিৎনার আশংকা থাকলে ইবনে মারজুক (রহঃ) বলেছেন: মাযহাবের প্রসিদ্ধ মত হল- উভয়টাকে ঢেকে রাখাই ওয়াজিব। আইয়াদ (রহঃ) বলেন, মহিলার জন্য সেগুলো ঢেকে রাখা আবশ্যক নয় বরং, পুরুষের জন্য দৃষ্টি সংযত রাখা ওয়াজিব। জাররুক বলেন, সুন্দরী মহিলার জন্য ঢেকে রাখা ওয়াজিব আর অন্যের জন্য মুস্তাহাব। (মানহুল জালীল শারহু মুখতাসারিল খালীল: ১/২২২)
আহকামুল কুরআনে ইবনুল আরাবী (রহঃ)বলেছেন: وَالْمَرْأَةُ كُلُّهَا عَوْرَةٌ؛ بَدَنُهَا وَصَوْتُهَا، فَلَا يَجُوزُ كَشْفُ ذَلِكَ إلَّا لِضَرُورَةٍ أَوْ لِحَاجَةٍ، كَالشَّهَادَةِ عَلَيْهَا، أَوْ دَاءٍ يَكُونُ بِبَدَنِهَا، أَوْ سُؤَالِهَا عَمَّا يَعِنُّ وَيَعْرِضُ عِنْدَهَا. অর্থাৎ, মহিলার পুরো শরীর ও মুখের স্বর সতরের অন্তর্ভুক্ত। প্রয়োজন ছাড়া এগুলো প্রকাশ করা বৈধ নয়। (যে সব প্রয়োজনে এগুলো প্রকাশ করা বৈধ) সে প্রয়োজনগুলো হল যেমন-তার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়া, তার শরীরের কোন স্থানের চিকিৎসা করা কিংবা নিজের কাছে কোন বিষয় অস্পষ্ট থাকলে জানার জন্য তাকে প্রশ্ন করা ইত্যাদি। (আহকামুল কুরআন-ইবনে আরাবীঃ ৩/৬১৬)
তাফসীরে কুরতুবীতে বলা হয়েছে- قَالَ ابْنُ خُوَيْزِ مَنْدَادٍ مِنْ عُلَمَائِنَا: إِنَّ الْمَرْأَةَ إِذَا كَانَتْ جَمِيلَةً وَخِيفَ مِنْ وَجْهِهَا وَكَفَّيْهَا الْفِتْنَةُ فَعَلَيْهَا سَتْرُ ذَلِكَ، وَإِنْ كَانَتْ عَجُوزًا أَوْ مُقَبَّحَةً جَازَ أَنْ تَكْشِفَ وَجْهَهَا وَكَفَّيْهَا
অর্থাৎ, ইবনে খুয়াইজ মানদাদ (রহঃ) আমাদের (মালেকী মাযহাবের) স্কলারদের সুত্রে বলেছেন, মহিলা যদি সুন্দরী হয় এবং তার চেহারা ও হাতের তালুর দিকে তাকানোর কারণে ফিতনার আশংকা থাকে তাহলে, তার উচিত হবে সেগুলোকে ঢেকে ফেলা। আর মহিলা যদি বৃদ্ধা হয় কিংবা সুন্দরী না হয় তার জন্য চেহারা ও হাতের তালু প্রকাশ করা বৈধ। (তাফসীরে কুরতুবী:১২/২২৯)
মাওয়াহেবুল জালীল গ্রন্থে এসেছে- إنْ خُشِيَ مِنْ الْمَرْأَةِ الْفِتْنَةُ يَجِبُ عَلَيْهَا سَتْرُ الْوَجْهِ وَالْكَفَّيْنِ قَالَهُ الْقَاضِي عَبْدُ الْوَهَّابِ وَنَقَلَهُ عَنْهُ الشَّيْخُ أَحْمَدُ زَرُّوق فِي شَرْحِ الرِّسَالَةِ
অর্থাৎ, যদি মহিলার ব্যাপারে ফিৎনার আশংকা থাকে তাহলে, তার চেহারা ও হাতের তালু ঢেকে ফেলা ওয়াজিব। এটাই কাজী আবুল ওয়াহহাব (রহঃ) এর মত এবং এ মতটাকে শায়খ আহমাদ জারুক "শারহুর রিসালাহ" গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। (মাওয়াহেবুল জালীল ফি শারহী মুখতাসারি খালীল: ১/৪৯৯)
হাশিয়াতুদ দাসুক্বীতে বলা হয়েছে- إذَا عَلِمَتْ، أَوْ ظَنَّتْ الْفِتْنَةَ بِهَا كَانَ سَتْرُهَا وَاجِبًا
অর্থাৎ, যখন মহিলা জানবে কিংবা ফিৎনার ব্যাপারে আশংকা করবে তখন তা ঢেকে রাখা ওয়াজিব বা আবশ্যক হবে। (হাশিয়াতুদ দাসুকীঃ২/৫৫)
চেহারা খুলে রাখার ব্যাপারে শাফেয়ী মাযহাবঃ
শাফেয়ী মাযহাবের স্কলারগণ মহিলার চেহারা খুলে রাখা কিংবা সেদিকে তাকানোর ব্যাপারটাকে তিনটি অবস্থায় ভাগ করেছেন।
১. মহিলার সঙ্গে কুকর্মে লিপ্ত হওয়ার আশংকা থাকা। এমতাবস্থায়, সেদিকে তাকানো সকল ইসলামিক স্কলারের মতে হারাম।
২. মনে জৈবিক কামনা নিয়ে তার দিকে তাকানো। শুধুমাত্র তাকে দেখে দেখে নিজের কামনা চরিতার্থ করা ও ফিৎনার আশংকা থাকা। এটাও হারাম। তখন মহিলার কর্তব্য হবে নিজের চেহারা ও দুই হাতের তালু ঢেকে রাখা।
৩. মনে কামনাও জাগ্রত হয় না, ফিৎনার ও আশংকা থাকে না এমতাবস্থায় শাফেয়ী স্কলারদের মধ্যে দুটি মত পাওয়া যায়।
ক. সেগুলো খুলে রাখা কিংবা সেদিকে তাকানো বৈধ নয়। আর এ মতের পক্ষে মত দিয়েছেন- ইমাম নববী, আবু আলী তাবারী, আবু ইসহাক শিরাজী, রাওইয়ানী, শায়েখ আবু মুহাম্মদ প্রমুখ শাফেয়ী স্কলার।
ইমাম তাকিউদ্দিন আস সুবুকী (রহঃ) বলেন: মহিলার চেহারা ও হাতের তালু তাকানোর দিক থেকে সতর;তবে নামাজের জন্য সেগুলো সতর নয়।
খ. মনে কামনা কিংবা ফিৎনার আশংকা না থাকলে সেদিকে তাকানো কিংবা সেগুলো প্রকাশ করা হারাম নয়। কেননা, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا অর্থাৎ,আর তারা যেন যা আপনা আপনি প্রকাশিত হয়ে যায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্যকে প্রকাশ না করে।(সূরা নূর:৩১)
আর সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা করা হয়েছে- চেহারা ও হাতের কব্জি। তাই,সেদিকে তাকানোতে কিংবা সেগুলো প্রকাশে কোন বাধা নেই।
তবে, শাফেয়ী মাজহাবের অধিকাংশ স্কলার প্রথমোক্ত মতের পক্ষেই গেছেন এবং এটাই তাদের মাজহাবের অগ্রগণ্য মত। (আওদাতুল হিজাব দ্রষ্টব্য)
চেহারা খুলে রাখার ব্যাপারে হাম্বলী মাজহাব
আল ফুরু' গ্রন্থে বলা হয়েছে- ظُفُرُ الْمَرْأَةِ عَوْرَةٌ، فَإِذَا خَرَجَتْ فَلَا يَبِينُ مِنْهَا شَيْءٌ وَلَا خُفُّهَا، فَإِنَّ الْخُفَّ يَصِفُ الْقَدَمَ، وَأَحَبُّ إلَيَّ أَنْ تَجْعَلَ لِكُمِّهَا زِرًّا عِنْدَ يَدِهَا لَا يَبِينُ مِنْهَا شَيْءٌ
অর্থাৎ, মহিলার নখও সতর। অতএব, যখন সে বের হবে তার কোন কিছুই প্রকাশ করবে না। এমনকি মোজাও নয়। কেননা, সেটাও পায়ের গঠন প্রকাশ করে দেয়। আমার কাছে সবচেয়ে পছন্দনীয় বলে মনে হয় যে, মহিলা তার হাতায় বোতাম লাগিয়ে নেবে, যেন কিছুই প্রকাশিত না হয়। (আল ফুরু': ৮/১৮৬)
আল্লামা আব্দুল কাদের আশ শায়বানী (রহঃ) বলেন: والحرة البالغة كلها عورة في الصلاة حتى ظفرها وشعرها "إلا وجهها" والوجه والكفان من الحرة البالغة عورة خارج الصلاة باعتبار النظر كبقية بدنها
অর্থাৎ, প্রাপ্তবয়স্কা মহিলার জন্য চেহারা ছাড়া নখও চুলসহ সবকিছুই সতর। আর নামাজের বাইরে তাকানোর ব্যাপারে চেহারা ও দুই হাত কব্জি পর্যন্ত শরীরের অন্যান্য স্থানের মতই সতর বা ঢেকে রাখার বস্তু। (নায়লুল মা'আরেব বি শারহি দালিলিত তালিবঃ ১/৩৯)
আমরা ইসলামিক স্কলারদের উপরোক্ত মতগুলোকে সংক্ষেপে এভাবে উল্লেখ করতে পারি---
১. ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) ও শাফেয়ী মাজহাবের সঠিক মত হচ্ছে- বেগানা পুরুষের সামনে চেহারা ও হাতের তালু ঢেকে রাখা ওয়াজিব।
২. হানাফী ও মালেকী মাযহাবের স্কলারদের ফতোয়া ছিল- এটা ওয়াজিব নয় বরং, মুস্তাহাব বা উত্তম। তবে,হানাফী ও মালেকী স্কলারগণ মতামত দিয়ে থাকেন যে,কোন মহিলার দ্বারা কিংবা কোন মহিলার উপর ফিতনার আশংকা হলে চেহারা ঢেকে রাখা ওয়াজিব হবে।
৩. এগুলো সতরের কারণে তারা ওয়াজিব বলেননি। বরং, ফিতনার আশংকা থাকলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা এ অঙ্গগুলো ঢেকে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
মুফাসসিরদের অভিমতঃ
চেহারা ঢেকে রাখার পক্ষে কিছু মুফাসসির মত প্রকাশ করেছেন। তাদের মতগুলো সংক্ষেপে এখানে তুলে ধরতে চেষ্টা করব ইনশাল্লাহ।
উল্লেখ্য যে, সবাই يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِن جلابيبهن আয়াতের ব্যাখ্যায় নিম্নোক্ত মতামতগুলো প্রকাশ করেছেন।
১. ইমাম ইবনুল যাওজী (রহঃ)বলেন: أي يغطين رؤوسهنّ ووجوههنّ ليعلم أنهن حرائر
অর্থাৎ, তারা তাদের মাথা ও চেহারা ঢেকে রাখবে। তাদেরকে দেখে যেন চেনা যায় যে তারা স্বাধীনা নারী। (সাফওয়াতুত তাফসীর ও তাফসীরে রাওয়ায়েউল বায়ানঃ ২/৩৮২)
২. আল্লামা ইবনে হাইয়্যান তার তাফসীর "আল বাহরুল মুহীত"-এ বলেন: شامل لجميع أجسادهن، অর্থাৎ, এর মধ্যে সমস্ত শরীরই অন্তর্ভুক্ত। আর আয়াতে عَلَيْهِنَّ বা "তাদের উপর" বলতে উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে- তাদের চেহারার উপর। (তাফসীরে বাহরুল মুহীতঃ ৮/৫০৪)
৩. আল্লামা আবুস সাউদ বলেন, ومعنى الآية: أي يغطين بها وجوههنّ وأبدانهنّ
অর্থাৎ, আয়াতের অর্থ হচ্ছে, মহিলাগণ জিলবাব (বড় চাদর ইত্যাদি) দিয়ে তাদের চেহারা ও নিজ শরীর ঢেকে ফেলবে। (তাফসীরে আবু সাউদ: ৭/১১৫)
৪. আল্লামা আবু বকর আল জাসসাস (রহঃ) বলেন- فِي هَذِهِ الْآيَةِ دَلَالَةٌ عَلَى أَنَّ الْمَرْأَةَ الشَّابَّةَ مَأْمُورَةٌ بِسَتْرِ وَجْهِهَا عَنْ الْأَجْنَبِيِّينَ অর্থাৎ, এই আয়াতে যুবতী মহিলাদেরকে বেগানা পুরুষদের সামনে নিজেদের চেহারা ঢেকে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। (আহকামুল কুরআনঃ ৩/৪৮৬)
৫. তাফসীরে দুররুল মানসুরে ইমাম সুয়ুতী (রহঃ) ইবনে সিরিন (রহঃ) সুত্রে উল্লেখ করেছেন যে, عَن مُحَمَّد بن سِيرِين رَضِي الله عَنهُ قَالَ: سَأَلت عُبَيْدَة رَضِي الله عَنهُ عَن هَذِه الْآيَة {يدنين عَلَيْهِنَّ من جلابيبهن} فَرفع ملحفة كَانَت عَلَيْهِ فقنع بهَا وغطى رَأسه كُله حَتَّى بلغ الحاجبين وغطى وَجهه وَأخرج عينه الْيُسْرَى من شقّ وَجهه الْأَيْسَر مِمَّا يَلِي الْعين অর্থাৎ, ইবনে সিরিন (রহঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি উবায়দাহ আস সালামী (রহঃ) কে يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِن جلابيبهن আয়াত সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে তিনি তার কাছে থাকা একটা চাদর জাতীয় জিনিস দিয়ে দুই চোখের ভ্রুসহ পুরা মাথা ঢেকে ফেলে বাম চোখটাকে চোখের কাছাকাছি একটা ফাকা জায়গা দিয়ে বের করে রাখলেন। (দুররুল মানসুরঃ ৬/৬৬০)
৬. তাফসীরে ইবনে কাসীরে এসেছে- قَالَ عَلِيُّ بْنُ أَبِي طَلْحَةَ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ: أَمَرَ اللَّهُ نِسَاءَ الْمُؤْمِنِينَ إذا خرجن من بيوتهن في حَاجَةٍ أَنْ يُغَطِّينَ وُجُوهَهُنَّ مِنْ فَوْقِ رُؤُوسِهِنَّ بِالْجَلَابِيبِ، وَيُبْدِينَ عَيْنًا وَاحِدَةً.
অর্থাৎ, আলী ইবনে আবি তালহা (রাঃ) ইবনে আব্বাস (রাঃ) সুত্রে বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মু'মিন নারীদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যখন তারা বাড়ী থেকে কোন প্রয়োজনে বের হবে তখন তারা যেন মাথার উপর থেকে জিলবাব দিয়ে নিজেদের চেহারা ঢেকে ফেলে এবং একটা চোখকে প্রকাশ করে। (ইবনে কাসীরঃ ৬/৪৮২)
এতক্ষণে আমরা ইসলামিক স্কলারদের বিভিন্ন মতামত নিয়ে আলোচনা করলাম। এখন আমাদের যার যে মতটাকে দালীলিক দিক থেকে যুক্তিযুক্ত মনে হয় তিনি বিনা দ্বিধায় সেটাকে মানতে পারেন।
আর যেহেতু, এটা কুরআন কিংবা হাদীস দিয়ে ফরজ করা হয়নি সেহেতু, এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা কারও জন্য উচিত হবে না বলে মনে করি। কেননা, যে মাসয়ালাতে ইসলামিক স্কলারদের গবেষণার সুযোগ থাকে সেখানে সবাই স্কলারদের যেকোন মতামতকে গ্রহণ করার পূর্ণ স্বাধীনতা রাখেন।
আর যেসব ইসলামিক স্কলারগণ চেহারা ঢেকে রাখাকে ওয়াজিব বলেছেন তাদের অধিকাংশই মত দিয়েছেন সামাজিক ফিৎনাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য। এ ব্যাপারে ইসলামিক স্কলারদের সুত্র ছিল এ রকম যে,
"কোন একটি কাজ অন্য কোন হারামের দিকে ধাবিত করলে সেটাও হারাম।" এ সুত্রের সাথেই ইসলামিক স্কলারগণ একমত।
আর সে কারণেই তারা ফিতনার আশংকা থাকলে চেহারা প্রকাশিত রাখাকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে চেহারা ঢাকাকে আবশ্যক করে দিয়েছেন।কেননা,মানুষেরা কোন প্রকার ফিৎনায় পড়ুক সেটা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন চান না।
এ ছাড়া বিবাহের আগে কনে দেখার সময় যেভাবে ছেলে মেয়েকে দেখে থাকেন ওটাকেও বলা হয়েছে জরুরী অবস্থা।কেননা,এর মাধ্যমে ছেলে ও মেয়ে পরস্পরের প্রতি বিবাহে আকৃষ্ট হয়।রাসুল (সাঃ) বলেছেন:
«انْظُرْ إِلَيْهَا، فَإِنَّهُ أَحْرَى أَنْ يُؤْدَمَ بَيْنَكُمَا» অর্থাৎ, তার দিকে দৃষ্টিপাত কর (তাকে দেখে নাও) কেননা, সেটা তোমাদের পরস্পরের প্রতি হৃদ্যতা সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। (তিরমিজী)
তবে,আমাদের যেসব বোনেরা অন্যান্য গুণাবলীর পাশাপাশি নিকাব ব্যবহার করছেন তাদেরকে আমি অন্যদের উপরে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসাব।কেননা,পবিত্র কুরআন নিকাবে উৎসাহ দেয়ার কারণে তারা নিকাব ব্যবহার করে আল্লাহ তায়ালার বিধান আরও বেশী করে মেনে চলছেন।আর কুরআনে নিকাবের প্রতি উৎসাহ দেয়ার কারণে এটাকে আমরা অবশ্যই তাকওয়ার পরিচায়ক বলে ধরে নেব।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।
কোন মন্তব্য নেই:
/>