শনিবার, ৮ জুন, ২০১৩

রেমিটেন্সের বাহক! পাথরের বালিশে যাদের প্রিয়ার আলিঙ্গন !

রেমিটেন্সের বাহক! পাথরের বালিশে যাদের প্রিয়ার আলিঙ্গন !




১২০ মাইল গতিতে ঘণ্টা দেড়েক গাড়ি চালালেই মরুভূমিটি পাড়ি দেওয়া যায়। এই মরুতে প্রাণের কোন অস্তিত্ব না থাকলেও এটা সেই হিসেবের মধ্যে পড়েনা। সকল মরুভূমিতে মাঝে মধ্যে কাঁটা গাছের ঝোপ-ঝাড় চোখে পড়ে কিন্তু এই মরুভূমিতে গাছের একটি মরা কাঠিও পাওয়া যাবেনা। গরম, শীত এবং বর্ষা কালে এই মরুভূমির আচরণ জলবায়ু ভেদে ভয়ানক আকার ধারণ করে।
বহু মর্মান্তিক পরিণতি এই মরুভূমিকে ঘিরে আছে। গরম কালে সর্বদা ধূলিঝড় বইতে থাকে; গাড়ীর ১০ গজ দুরের সামনের জিনিসও ঠিক মত দেখা যায়না। রাস্তা ও ভূমির উচ্চতা প্রায় এক সমান, মরুভূমির মাঝ বরাবর বালির উপর দিয়ে এই সড়ক তৈরি করা হয়েছে। আবার শীতকালে যেমনি কনকনে হাওয়া, তেমনি ঠাণ্ডা। সন্ধ্যা নামতেই কুয়াসা ঝড়তে থাকে। যেন তেন কুয়াশা নয়! মনে হবে হালকা বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি-কালে এ মরুভূমির পরিস্থিতি আরো ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। মরুভূমির যে যায়গা দিয়ে বৃষ্টির পানি যায়, তার নাম ‘ওয়াদী’ ওয়াদীর গভীরতা বেশী না হওয়ায় বৃষ্টির পরে, প্রচণ্ড গতি নিয়ে হঠাৎ আবির্ভূত হয় বন্যা। পাথর আর কাঁটা গাছের ডাল পালা নিয়ে পানি উপছিয়ে পড়ে ওয়াদীর দুকুল চেপে। ফলে ওয়াদীর পাশ্ববর্তী মরুভূমির বিশাল জায়গা জুড়ে প্রবল গতিতে পানি ধাবিত হয়। যথাসময়ে গাড়ী চালিয়ে ওয়াদী পার হতে না পারলে মৃত্যু নিশ্চিত, গাড়ী সহ যাত্রীরা চিরতরে নিখোঁজ হয়, এই জায়গায় বহু ভয়ানক ও মর্মান্তিক কাহিনী লোকমুখে শুনেছি। 

একবার এই মরুতে ভয়ঙ্কর বালি ঝড়ের কবলে পড়েছিলাম। বালি ঝড়ের মধ্যে ৮০ মাইল যাওয়ার পরে পুলিশের বাধা এসে হাজির। পুলিশ জানায় বালি জমতে জমতে রাস্তার উপর বালির পাহাড় হয়েছে ফলে রাস্তা উদ্ধার করতে পারছেনা। কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে জানায় এভাবে রাস্তায় অপেক্ষা করা বিপদজনক তাই সকল গাড়ীগুলোকে বনী খালিদ নামক গ্রামের দিকে চলে যেতে হবে। বনী আবু খালিদ বিশাল মরুভূমির পাশে অবস্থিত পর্বতরাজির পাদদেশে অবস্থিত ওমানের একটি গ্রামের নাম। সেখানে পৌঁছার পর মনে হল গরমের প্রকোপে প্রতিটি বালি কণা যেন আগুনে ভাজা হচ্ছে। কাঁচা-পাকা রাস্তা আছে, তবে বিদ্যুৎ নাই। পাহাড় থেকে নির্গত পানিই এখানে জীবনের একমাত্র উৎস। উট, গাধা, ছাগলে ভরপুর এই গ্রাম। প্রত্যন্ত এই জনপদেও বিদ্যুৎ না থাকলেও স্কুল আছে। বেশীর ভাগ মানুষ গাধায় চলাচল করে, স্কুলের ছাত্র-শিক্ষকেরাও গাধায় চড়ে স্কুলে আসে। স্কুলের পিছনে বিরাট গাধাখানা আছে। এমন সময় একজন দেশী ভাইয়ের দেখা পেলাম। তিনি জানালেন আবহাওয়া ঠিক হবেনা তাই এখানেই রাত্রি যাপন করতে হবে। আরো বলল এদেশে জুন-জুলাই’য়ের গরমের কারণে স্কুল দুই মাস বন্ধ থাকে। গরমকালে আরবিরা এ এলাকায় থাকেনা, সামুদ্রিক এলাকা কিংবা শহরে চলে যায়। এবার এখনও স্কুল বন্ধ হয়নি, অথচ অগ্রিম গরম পড়া শুরু হয়েছে যা খুবই ভয়ানক ও অসহ্য। 

তাদের একজন বলা শুরু করল, আমরা বাংলাদেশ থেকে বাপের টাকা খরচ করে আগত চরম হতভাগা যুবক। আমরা এসি কক্ষের ঠাণ্ডার কথা শুনেছি, কোনদিন চোখে দেখিনি। এই গ্রামের বেশীর ভাগ মানুষ, বিভিন্ন কোম্পানি ও আরবির বাসা থেকে পালিয়ে আসা। যারা দুটি বেশী টাকা কামাতে চায় তাদের সকলের আজ একই দশা। পাহাড়ের নীচে খেজুর গাছ ও কাঁটা গাছের জঙ্গল আছে, সেখানেই আমরা ঝুপড়ি ঘরে থাকি। পুলিশ আসা যাওয়া করে, তবে আমাদের কখনও দৌড়ায় না। আমরা অনেকে পুলিশের ক্ষেতে-খামারেও কাজ করি। পুলিশ জানে আমাদের অনেকেরই বৈধ ওয়ার্ক পারমিট নাই। তাছাড়া বৈধ মানুষ এ এলাকায় কাজ করতে কিংবা থাকতে চায়না। আরবিরা ভাল বেতন দিলেও কর্মঠ ও বিশ্বস্ত শ্রমিক পায়না। যার কারণে অবৈধ শ্রমিকেরা এই এলাকার কাজকে কিছুটা নিরাপদ ভাবে এবং কিছুটা দুঃচিন্তামুক্ত ভাবে ক্ষেতে খামারে কাজ করতে পারে। আমাদের এখানকার জীবন বড় কঠিন ও দূর্বিসহ। কাজ করলেই নগদ টাকা পাওয়া যায়; তাই এখানে থাকি। এখানকার আরবিরা বড় দয়ালু, নিজেরাই আমাদের ফল, সবজি, গোশত দিয়ে যায়। অনেকে ছাগল-উট জবাই করে আমাদের কাছে গোশত বণ্টন করে। কারো মানত থাকলে জীবিত ছাগল-উঠ আমাদের দিয়ে যায়, আমরা জবাই করে খাই। রোজার সময় ফিৎরা যাকাত পাই। 

বনী খালিদে আমার রাত্রি যাপনের ইচ্ছার কথা জানতে পেরে, যুবক যে সমস্যার কথা বলল তা শুনে আমি ‘থ’ হয়ে গেলাম। যুবকটি বলতে রইল, আমরা এক ঝুপড়িতে ১২ জন থাকি, পালা করে প্রতি রাত্রে ১১ জন ঘুমাই, একজন জেগে থাকি। যিনি জেগে থাকেন তিনি ঘুমন্ত মানুষদের শরীরের উপর পানি ছিটিয়ে দেয়। পানির কারণে ঘুমন্ত মানুষের কাপড়, গেঞ্জি ভিজে গেলে পর কিছুটা আরাম বোধ হয়। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে তা আবার শুকিয়ে যায়। আবারো পানি ছিটানো হয় এবং যথারীতি শুকিয়ে যায়; এভাবেই হতভাগাদের প্রতিটি রাত কাটে, আবার সকালের সূর্য উঠে। আমরাই যেখানে ভালভাবে থাকতে পারিনা, সেখানে আপনাকে আমরা কিভাবে রাখবো? তাই আমাদের শরম দিবেন না ভাই! 

যুবকদের কথা শুনে আমার খু্বই খারাপ লাগল এবং আমি দৃঢ়তার সাথে তাদের বললাম; আপনাদের সাথে আপনাদের মত করেই আজ আমি রাত কাটাব। সমস্যার সাথে লড়াই করার অভ্যাস আমার আছে! যুবকটি আমার কথায় আরো লজ্জিত হয়ে বলল, ভাই অন্যদের কাছে পানি ছিটানোর একটি যন্ত্র আছে, আমাদের কাছে সে যন্ত্রটি নাই, আমরা এখানে নতুন তা যন্ত্রটি এখনও কিনতে পারি নাই। (এটি সেই যন্ত্র যা আমাদের দেশে হাত দিয়ে পাম্প করে জমিতে কীটনাশক ও মশা মারার ঔষধ ছিটানো হয়)। তাই আমরা বালতিতে পানি ভরে হাত দিয়ে সেই পানি ছিটিয়ে দেই। আপনার গায়ে যদি জোড়ে পানির ছিটা পড়ে তাহলে বার বার ঘুম ভেঙ্গে যাবে। কেননা আপনার সেই অভ্যাস গড়ে উঠেনি। আজকে যেহেতু আপনি আমাদের মেহমান! তাই আপনাকে মেশিন ওয়ালা কারো ঝুপড়ীতে থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। 

আমি অনুনয় করে বললাম আপনারা এভাবে মাসের পর মাস কাটিয়ে দিচ্ছেন, আমি না হয় এক রাত ঘুমালাম? তারপরও আপনাদের কঠিন রাত্রির সাথী হতে চাই, আশা করি আমাকে আজকে রাত্রে আপনাদের সাথেই মেহমান বানাবেন! যাক, আমার দৃঢ় প্রত্যয়ে তারা খুশী হল এবং মেহমান বানাতে রাজি হল। লুঙ্গি-গামছা সহ এক সেট কাপড় সর্বদা গাড়িতেই থাকে, ফলে সমস্যা হয়নি। জেনারেটর যুক্ত দোকানের ফ্রিজ থেকে কিছু ফল নিয়ে তাদের মেহমান হবরা উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। 

জঙ্গলা কৃতির স্থানে তাদের বাসস্থানে পা রাখা মাত্রই বুঝতে পারলাম গরম কাকে বলে এবং গরমের পরিমাণ কেমন হতে পারে! আবহাওয়া এমনিতেই গরম। আরো মনে হল খেজুর গাছের প্রতিটি পাতা যেন রাতের আঁধারে গরম আমদানি করে ডাল নেড়ে তাপমাত্রা বায়ুতে মিশিয়ে দিচ্ছে। বুঝতেই পারছি বাহিরের চেয়ে জঙ্গলের ভিতরে এবং খেজুর বাগানের উষ্ণতা অতিমাত্রায় বেশী। 

এসব যুবকেরা বাগানেই থাকতে বাধ্য, কেননা দিনের সূর্যতাপে খোলা যায়গার ঘরে থাকার অর্থ চুলায় উপরে থাকার সমান! কিছুক্ষণ পরই আমার মনে হল, এইমাত্র নিভে যাওয়া পোড়া বাড়ীর প্রজ্বলিত কয়লার স্তূপের উপর বসেছি। শুইতে যাবার অনেক আগেই নিজের গায়ে কয়েকবার পানি ছিটালাম, কিছুক্ষণ পরে আর মনে করতে পারছিনা না জীবনে ঠাণ্ডার অনুভূতি কেমন ছিল? মনে হচ্ছিল সাধারণ উষ্ণতার এক লোটা পানি যদি পেতাম, তাহলে সারা শরীরে রাজ্যের শান্তি বয়ে যেত! 

বনী আবু খালিদের হতভাগ্য দুর্ভাগাদের হাতের অর্জিত টাকা দিয়েই আমাদের দেশের রেমিটেন্সের সমৃদ্ধি বাড়ছে। আমরা সংসদে বসে যথাযথ দায়িত্ব পালন করছি না। দেশে জিডিপির হার বেড়েছে বলে অহংবোধ করছি! এই রেমিটেন্সের টাকায় ভর করে দেশ আজ সম্মুখের দিকে তাকিয়ে আছে! অথচ রেমিট্যান্স প্রেরক এই যুবকদের দিনগুলো কত নির্মম, রাতগুলো কত কঠিন তা কতজন পিতা-মাতা জানে! দীর্ঘ পথের পানে অসহায় স্ত্রী যখন চাদরের নীচে শুয়ে, একাকীত্বের বেদনায় তুলোর বালিশে মুখ চেপে ধরে। তখন তাঁদের হতভাগা প্রিয়তমেরা রূঢ় মরুর তপ্ত উষ্ণতায় অসহায়ত্বের বন্ধনে পাথরের বালিশকে আলিঙ্গন করে উত্তাল যৌবনের রাতগুলো কাটায়..........

(সংগ্রহ -ক্লিক করুন >Moshfe qul Alam ) 



কোন মন্তব্য নেই:

Comment here />

Widget ByBlogger Maruf
Widget ByBlogger Maruf