বৃহস্পতিবার, ১৩ জুন, ২০১৩

বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুসলমানের করণীয় ???? মাওলানা আবদুল গাফফার !


বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুসলমানের করণীয়

মাওলানা আবদুল গাফফার



বর্তমানে বিশ্বের সর্বত্র মুসলমান জনগণ এক মহাসংকটকাল অতিক্রম করছে। যে সব দেশে মুসলমানগণ সংখ্যালঘু সেসব দেশের কোন কোনটিতে মুসলমান শুধু নিপীড়িত ও নির্যাতিত হচ্ছে শুধু তাই নয় বরং তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, দেশ হতে বিতাড়িত করা হচ্ছে। তথাকথিত অহিংসবাদীদের হিংসাত্মক ও হিংস্র আক্রমণে মানবতা যখন বিপর্যস্ত তখন বিশ্বমানবতাবাদীদের নিরব ভূমিকা শত প্রশ্নের জন্ম দেয় বৈ কি। শান্তিতে নোবেল বিজেতা যখন নিজ দেশের বর্বরতাকে চোখে দেখতে পান না তখন তার নোবেল জয় বিশ্বের সত্যিকারের শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোকে বেদনাহত না করে পারে না।

আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশের মুসলমানরাও যে চরমভাবে বিপন্ন তার কোন দৃষ্টান্ত তুলে ধরার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। নির্যাতিত নিপীড়িত ও গণহত্যার শিকার হওয়ার জন্য শুধু জাতি হিসাবে বা ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান পরিচিতিই যথেষ্ট। আর মুসলমান হিসাবে নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখার প্রচেষ্টা, ইসলামী অনুশাসন অনুযায়ী নিজের জীবনকে পরিচালনা করা এবং ইসলামী অনুশাসনে উদ্বুদ্ধ করণের জন্য দাওয়াত ও সংগ্রামী ভূমিকায় যেসব মুসলমান অবতীর্ণ হয় বা হচ্ছে তারা বিশ্বের তাবৎ তথাকথিত প্রগতিশীলদের দৃষ্টিতে জঙ্গী, মৌলবাদী। সকল সভ্যতা ও সংস্কৃতি উন্নতি লাভ করুক তা বেহায়পনা হোক কিংবা বেলেল্লাপনা হোক তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি উন্নতি লাভ করলেই সমস্যা। সকল জাগরণ পৃথিবীর জন্য কল্যাণকর, তাকে উৎসাহিত কর, এ জাগরণকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দাও, কিন্তু মুসলিম জাগরণের বিষয়টি অসহনীয়। তাকে রূদ্ধ কর, প্রতিরোধ কর। প্রয়োজনে নির্যাতনের স্টীমরোলার চালাও, গণহত্যা কর।

মুসলিম জাতি আজ অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত। তবে এই জাতীয় সংকট মুসলিম জাতির ইতিহাসে বারবার সৃষ্টি হয়েছে। হিজরী সপ্তম ও খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলিম জাতি এই জাতীয় অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত হয়েছিল। যখন তাতারীরা তুর্কিস্তান, ইরাক ও ইরানে ব্যাপক গণহত্যা ও লুটতরাজ চালিয়ে নগরের পর নগর দেশের পর দেশ ধ্বংসস্ত্তপে পরিণত করেছিল। মুসলিম বিশ্বের অস্তিত্বকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছিল। তাতারীদের হিংস্রতা ও বর্বরতা বিশ্বব্যাপী মানুষের অন্তরে এরূপ ভীতির সৃষ্টি করেছিল যে, ঐতিহাসিকগণ লেখেন, তাতারীদের আক্রমণস্থল ইরাক, ইরান ও তুর্কিস্তান হতে হাজার হাজার মাইল দূরের ইংল্যান্ডের সাগরপাড়ের জেলেরা তাতারীদের ভয়ে বহুদিন পর্যন্ত মাছ শিকার করতে বের হয়নি। কিন্তু তাতারীদের এই আক্রমণ ছিল নিছক সেনা আক্রমণ। তাদের আক্রমণ ছিল অস্ত্রকেন্দ্রিক। তাদের লক্ষ্য ছিল হত্যা ও দেশ দখল। কোন আদর্শ বিস্তার তাদের লক্ষ্য ছিল না। তাদের আক্রমণের পিছনে কোন আদর্শিক লক্ষ্য কিংবা কোন আদর্শিক আন্দোলন বা দর্শন নিয়ামক হিসাবে কাজ করেনি।

তারা নিজেদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি

বিস্তারের লক্ষ্যে তাদের গণহত্যামূলক আক্রমণ পরিচালনা করেনি। ফলে তৎকালীন যুগের কিছু স্বচ্ছ হৃদয় ও আধ্যাত্মিকতার অধিকারী দ্বীনের একনিষ্ঠ ও প্রভাববিস্তারী মুবাল্লিগ ও দাঈগণের প্রচেষ্টায় তাদের প্রভাবে ও সংস্পর্শে গোটা তাতারী জাতি ইসলাম কবুল করে নিয়েছিল। শুধু ইসলাম গ্রহণ নয়; বরং এই হিংস্র তাতারী জাতিই পরবর্তীতে ইসলামের বড় সংরক্ষক ও ইসলামী সভ্যতার পতাকাবাহীরূপে আবির্ভূত হয়েছিল এবং বিশালাকারের একাধিক ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল।

প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক টি ডব্লিউ আরনল্ড (T.W) তাঁর Preaching of Islam (ইসলামের প্রচার) গ্রন্থে লেখেন, ‘কিন্তু ইসলাম ঐ ধ্বংসস্ত্তপ থেকে পুনরায় সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়াল এবং যে হিংস্র মোগলরা মুসলমানদেরকে গণহারে হত্যা করেছিল ইসলাম প্রচারকগণ সেই বর্বর ও হিংস্র মোগলদেরকে মুসলমান বানিয়ে ফেলল।’

ইসলাম প্রচারকগণের মাধ্যমে তাতারীরা লাভ করেছিল এক নতুন দ্বীন ও বিশ্বাস। মুসলমানেরা তাদেরকে উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতি, সুসংহত ও পরিপূর্ণ সামাজিক ও নাগরিক নিয়মকানুন এবং নতুন নতুন জ্ঞান ও জীবনাচারে পরিপুষ্ট করে এক নতুন জীবনের সন্ধান দান করেছিল। ফলে এদের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এশিয়া মাইনর ও ইউরোপে এক বিশাল ইসলামী সাম্রাজ্য, যাকে বলা হত উসমানী খেলাফত বা উসমানী সাম্রাজ্য। এই উসমানী খেলাফতই হারামাইন শরীফাইনসহ ইসলামী পবিত্র স্থানসমূহের সংরক্ষণে আবির্ভূত হয়েছিল এবং ইসলামের মান মর্যাদা ও শান-শওকতের প্রতিভূরূপে বিশ্বের দরবারে স্থান করে নিয়েছিল।

তবে বর্তমান বিশ্বের মুসলিম জাতির সংকট পূর্বের যে কোন সংকটের তুলনায় কিছুটা অধিক ভয়াবহ। অজুহাত পেলে তো কথাই নেই নতুবা অজুহাত সৃষ্টি করে হলেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে এবং মুসলমানদেরকে বিশেষত দ্বীনদার শ্রেণীকে গণহারে হত্যা করা হচ্ছে। তদপেক্ষা ভয়াবহ হল, সংবাদপত্রসহ বিশ্বের সকল গণপ্রচারমাধ্যম দ্বারা মুসলমানদের বর্তমান ও নতুন প্রজন্মকে সভ্যতা ও সংস্কৃতিগতভাবে বিপথগামী করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের মন মস্তিষ্কে ইসলাম বিরোধী ধ্যান ধারণা ও ইসলাম বিরোধী আকিদা বিশ্বাসের বীজ বপন করা হচ্ছে। শুধু তাই নয় নতুন প্রজন্মকে ইসলাম বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ করা হচ্ছে এবং তাদেরই মাধ্যমে দেশে দেশে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ও আক্রোশ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিপরীত ধর্মের সকল জাতি গোষ্ঠির কুৎসিত ঐক্য ও ঐক্যবদ্ধ চক্রান্ত মুসলিম জাতিকে আরও বেশী বিপন্ন করে তুলেছে।

মুসলিম জাতির বর্তমান কালের সংকটময় এই পরিস্থিতি ঈমানী ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অধিকারী, দৃঢ় ঈমানী চেতনার অধিকারী ব্যক্তিবর্গের জন্যই শুধু নয় বরং সামান্য ঈমানী চেতনার অধিকারী সাধারণ মুসলিম জনগণের জন্যও উদ্বেগ সৃষ্টিকারী। এহেন পরিস্থিতি অবলোকন করে সাধারণ মুসলমান তো বটেই বহু দ্বীনদার ও দ্বীনী জ্ঞানের অধিকারী শ্রেণীও হতাশার শিকার হচ্ছে।

কিন্তু মুসলমানমাত্রই যে বিশ্বাস অন্তরে লালন করে থাকে সেই বিশ্বাসকে সদাসর্বদা অন্তরে জাগরুক রাখা উচিৎ, সর্বদা স্মরণে রাখা উচিৎ। আর তা হল, আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। মহাবিশ্বের পরিচালনার লাগাম তাঁর হাতে, তিনি তাঁর দ্বীনের সংরক্ষক, সত্য সমুন্নতকারী, নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের সাহায্যকারী, বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত মানুষের ত্রাতা, স্বৈরাচারী ও দাম্ভিকের আস্ফালন ও দম্ভ চূর্ণকারী। তাঁর বৈশিষ্ট্য হল-ألا له الخلق(জেনে রেখো, সকল মাখলুকই তাঁর কর্তৃত্বাধীন এবং তাঁর নির্দেশই কার্যকর। আরাফ ৭ : ৫৪)

তিনি তাঁর নিজের সম্পর্কে বলেছেন

قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَنْ تَشَاءُ وَتَنْزِعُ الْمُلْكَ مِمَّنْ تَشَاءُ وَتُعِزُّ مَنْ تَشَاءُ وَتُذِلُّ مَنْ تَشَاءُ بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

বল হে সার্বভৌম শক্তির মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা দান কর এবং যার নিকট হতে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নাও। যাকে ইচ্ছা তুমি পরাক্রমশালী কর আর যাকে ইচ্ছা তুমি হীন কর। কল্যান তোমার হাতেই। নিশ্চয়ই তুমি সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান। (আলে ইমরান, আয়াত ২৬)

এই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মহামহিম আল্লাহ রাববুল আলামীনের উপর বিশ্বাস স্থাপনকারী মুসলমানদের বর্তমান পরিস্থিতির পরিবর্তন অসম্ভব কিছু নয়। অতীত ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত নবী ও

সাহাবাযুগে তো বটেই তৎপরবর্তী যুগেও আমরা দেখতে পাই।

পরিস্থিতির অবিশ্বাস্য পরিবর্তনের হাজারো দৃষ্টান্তের মধ্য থেকে একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে।

যে পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটে একটি পরাজিত ও বিপর্যস্ত জাতির পুনরায় বিজয়ী হওয়ার ও মাথা তুলে দাঁড়ানোর এবং বিজয়ী জাতির পরাজিত হওয়ার ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করার সাহস কেউ করতে পারে না এবং বিন্দুমাত্র ধারণা ও আশাও পোষণ করতে পারে না সেই রকম এক পরিস্থিতিতেই কুরআন মজীদ ঘোষণা করল-

الم l غُلِبَتِ الرُّومُ l فِي أَدْنَى الْأَرْضِ وَهُمْ مِنْ بَعْدِ غَلَبِهِمْ سَيَغْلِبُونَ l فِي بِضْعِ سِنِينَ لِلَّهِ الْأَمْرُ مِنْ قَبْلُ وَمِنْ بَعْدُ وَيَوْمَئِذٍ يَفْرَحُ الْمُؤْمِنُونَ l بِنَصْرِ اللَّهِ يَنْصُرُ مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ الْعَزِيزُ الرَّحِيمُ

‘আলিফ-লাম-মীম। রোমকগণ পরাজিত হয়েছে নিকটবর্তী অঞ্চলে; কিন্তু তারা তাদের পরাজয়ের পর শীঘ্রই বিজয়লাভ করবে, কয়েক বৎসরের মধ্যেই। পূর্বের ও পরের ফয়সালা আল্লাহরই। আর সেই দিন মুমিনরা হর্ষোৎফুল্ল হবে, আল্লাহর সাহায্যে। তিনি যাকে ইচ্ছা সাহায্য করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু। রূম ৩০ : ১-৫

ঘটনাটি খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর সূচনা লগ্নের। পৃথিবীতে তখন দুটি বিশাল পরাশক্তি বিদ্যমান। একটি রোমান অপরটি পারসিক। পশ্চিমাঞ্চল তথা ইউরোপের একটা বড় এলাকা আর এদিকে সিরিয়া, জেরুজালেম, মিশর, মরক্কো, আবিসিনিয়া ইত্যাদি নিয়ে এক বিরাট পূর্বাঞ্চল ছিল রোমান সাম্রাজ্যের শাসনাধীন। অপরদিকে ইরাক, ইয়েমেন এবং আরো অনেক এলাকা এমনকি উত্তরে রাশিয়ার কিছু অংশ ও আফগানিস্তান অতিক্রম করে সিন্ধুনদের পশ্চিম প্রান্তবর্তী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল পারস্য সাম্রাজ্য। তৎকালীন পৃথিবীতে আর কোন তৃতীয় শক্তি ছিল না যার দ্বারা এই সাম্রাজ্য দুটি আক্রান্ত হতে পারে। আধিপত্য বিস্তার ও সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এই দুই শক্তির মাঝে প্রায়ই ছোট বড় যুদ্ধ সংঘটিত হত। এরূপ একটি বড় যুদ্ধে পারসিকরা রোমানদেরকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। শুধু পরাজিত নয় রোমানরা এই যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। তারা এত বড় বিপর্যয়ের শিকার হয় যে, তারা পুনরায় কখনও শক্তিশালী হবে এবং পারসিকদেরকে পরাজিত করবে এইরূপ কোন কল্পনা কারও পক্ষে সম্ভব তো ছিলই না বরং ছিল হাস্যকর। যেরূপ হাস্যকর তৃতীয় বিশ্বের কোন ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নিকট আমেরিকার পরাজিত হওয়ার কল্পনা করা।

পারসিকরা যেহেতু ছিল অগ্নি উপাসক তাই মক্কার কাফেরদের দুর্বলতা ছিল পারসিকদের প্রতি। তাদের কামনা ছিল পারসিকরা জয়লাভ করুক।

পক্ষান্তরে রোমানরা যেহেতু আহলে কিতাব ছিল তাই আসমানী কিতাব কুরআনের অধিকারী মুসলমানদের দুর্বলতা ছিল রোমানদের প্রতি। রোমানরা পরাজিত হলে কাফেররা উল্লসিত হল এবং মুসলমানদের উদ্দেশে বলল, আমরাও তোমাদেরকে অচিরেই পরাজিত করব যেভাবে আমাদের সমর্থিত পারসিকরা তোমাদের সমর্থিত রোমানদেরকে পরাজিত করেছে।

কিন্তু বিস্ময়করভাবে ৬১৬ খৃষ্টাব্দে কুরআনুল কারীম উপরিউক্ত আয়াত নাযিল করে ভবিষ্যদ্বাণী করল যে, অনধিক নয় বৎসরের মধ্যে রোমকরা পারসিকদের উপর বিজয় লাভ করবে। ৬২৩/৬২৪ খৃষ্টাব্দে এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হয়। আর সেই বৎসরই বদর যুদ্ধে ৩১৩ জন সৈনিকের প্রায় নিরস্ত্র এক মুসলিম বাহিনীর নিকট সহস্রাধিক বিপুল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত কাফের বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়।

ইউরোপীয়ান ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গীবন লেখেন, ‘মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরানী বিজয়ের পূর্ণযৌবনকালে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন যে, কয়েক বৎসরের মধ্যেই রোম সাম্রাজ্যের বিজয় পতাকা পুনরায় সগৌরবে উড্ডীন হবে। তিনি যখন এই ভবিষ্যদ্বাণী করলেন তখনকার পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী এই ভবিষ্যদ্বাণী ছিল সর্বাপেক্ষা অযৌক্তিক ও অবিবেচনাপ্রসূত। কেননা, সম্রাট হিরাক্লিয়াসের শাসনামলের প্রথম বারো বৎসর রোম সাম্রাজ্যের পতন ও বিলুপ্তির অত্যাসন্নতাই ঘোষণা করেছিল। (Decline and fall of the Roman Empire)

অতএব পরিস্থিতি যতই সংকট ও শংকাপূর্ণ হোক হতাশ হওয়ার কিছু নেই। পরিস্থিতির পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ

মানুষের মধ্যে আমি পালাক্রমে এই দিনগুলোর আবর্তন ঘটাই।-সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৪০

অর্থাৎ সুদিন ও দুর্দিন, জয় ও পরাজয় ইত্যাদি আল্লাহ তাআলা পালাক্রমে কখনও এই জাতিকে কখনও ঐ জাতিকে দান করেন।

তবে পরিস্থিতি হতে উত্তরণ এবং সংকট ও শঙ্কা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য মুসলিম জাতির জন্য আল্লাহ তাআলা কর্তৃক আরোপিত বহু শর্তাদি রয়েছে। কুরআন ও হাদীস, নববী জীবন চরিত্র ও সাহাবায়ে কেরামের কর্ম ও আদর্শের আলোকে কিছু শর্ত পূরণ করা আমাদের জন্য এই মুহূর্তেই জরুরী।

এক. এই মুহূর্তে বিশ্বের সকল মুসলমান বিশেষত অপেক্ষাকৃত অধিক সংকটে নিপতিত মুসলমানদের জন্য সর্বপ্রথম ও সর্বাপেক্ষা জরুরী ও কর্তব্য বিষয় হল, আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ, রুজু ইলাল্লাহ তথা একান্তভাবে আল্লাহ অভিমুখী হওয়া, তাওবা ও ইস্তিগফার করা, দুআ করা ও কাকুতি মিনতি সহকারে কান্নাকাটি করা।

কুরআন মজীদ বিষয়টাকে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছে এবং বলছে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ

হে মুমিনগণ ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।-সূরা বাকারা, আয়াত ১৫৩

অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে-

أَمَّنْ يُجِيبُ الْمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ السُّوءَ وَيَجْعَلُكُمْ خُلَفَاءَ الْأَرْضِ

বরং তিনি যিনি আর্তের আহবানে সাড়া দেন যখন সে তাঁকে ডাকে এবং তিনিই বিপদ আপদ দূরীভূত করেন এবং তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেন।-সূরা নামল, আয়াত ৬২

অন্যত্র বলা হয়েছে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحًا عَسَى رَبُّكُمْ أَنْ يُكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ

মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবা কর-বিশুদ্ধ তাওবা; তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কর্মগুলো মোচন করে দেবেন।-সূরা তাহরীম, আয়াত ৮

স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রীতি ছিল এই যে, যখনই তাঁর সামনে সামান্যতম উদ্বেগের কোন কিছুর আবির্ভাব ঘটত তখন তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং দুআয় মশগুল হতেন।

হযরত হুযাইফা রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত-

كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا حزبه أمر صلى

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে যখন কোন উদ্বেগ সৃষ্টিকারী বিষয় উপস্থিত হত তখন তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন।-আবু দাউদ, হাদীস নং ১৩২১

হযরত আবুদ্দারদা রা. কর্তৃক বর্ণিত-

كان النبي صلى الله عليه وسلم إذا كانت ليلة ريح شديدة كان مفزعه إلى المسجد حتى تسكن الريح وإذا حدث في السماء حدث من خسوف شمس أو قمر كان مفزعه إلى المصلى حتى ينجلي.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অভ্যাস ছিল প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়ার রাত হলে তাঁর আশ্রয়স্থল হত মসজিদ যতক্ষণ না ঝড়ো হাওয়া শান্ত হত। আর যখন আকাশে সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের ঘটনা ঘটত তখন তাঁর আশ্রয়স্থল হল নামাযস্থল (অর্থাৎ তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং নামায অব্যাহত রাখতেন) যতক্ষণ না সূর্য বা চন্দ্র গ্রহণমুক্ত হয়ে যেত।

অতএব এ মুহূর্তে আমাদের সকলের জন্য জরুরী তাওবা ইস্তিগফার, আল্লাহ-অভিমুখিতা, দুআ ও মুনাজাত। সেই সঙ্গে কুরআন তিলাওয়াতের আমল অব্যাহত রাখা এবং আপদকালীন পঠিতব্য কুরআনের সূরা ও আয়াত বেশী বেশী পাঠ করা। যেমন সূরা ফীল, সূরা কুরাইশ, لا اله الا انت سبحانك انى كنت من الظلمين، نصر من الله وفتح قريب قريب ইত্যাদি।

দুই. দ্বিতীয় শর্ত এবং জরুরী ও ত্বরিৎ পদক্ষেপের বিষয় হল তাকওয়া অবলম্বন, গুনাহ পরিহার, গুনাহ হতে আত্মরক্ষা করে চলা। কোন গুনাহকেই সাধারণ ও তুচ্ছ গণ্য না করা।

এক্ষেত্রে হযরত উমার ইবনে আবদুল আজীজ (রাহ.) এর একটি চিঠি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চিঠিটি তিনি লিখেছিলেন তাঁর এক সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধানের উদ্দেশ্যে। তিনি লিখেছিলেন,

আল্লাহর বান্দাহ উমর ইবনে আবদুল আজীজ এর পক্ষ হতে মানসূর ইবনে গালেবের নামে

তোমরা সর্বদা তাকওয়ার উপর অবিচল থাকবে। কেননা তাকওয়া ও আল্লাহভীতিই সর্বোত্তম পাথেয় ও উপকরণ, অধিক কার্যকর কৌশল এবং প্রকৃত শক্তি। সেনাপ্রধান নিজে এবং তার অধীনস্থ সৈনিকেরা যেন শত্রু অপেক্ষা গুনাহকে অধিক ভয় করে। কেননা, শত্রুদের কৌশল, তাদের শক্তি ও আক্রমণ অপেক্ষা গুনাহ অধিক ভয়াবহ। আমরা শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়লাভ করি তাদের গুনাহর কারণে। তাদের গুনাহ না থাকলে আমরা তাদের সঙ্গে শক্তিতে পেরে উঠতাম না। কারণ আমাদের সৈন্য সংখ্যা ও অস্ত্রশক্তি তাদের তুলনায় কম। গুনাহকর্মে যদি আমরা তাদের সমপর্যায়ের হয়ে যাই তাহলে অস্ত্রশক্তি ও সৈন্যসংখ্যায় তারা আমাদের তুলনায় অগ্রগামী থাকবে। দুশমন অপেক্ষা নিজের গুনাহর ব্যাপারে অধিক সচেতন হওয়া প্রয়োজন। যতদূর সম্ভব অন্য সবকিছু অপেক্ষা নিজের গুনাহর ব্যাপারে অধিক চিন্তিত থাকা উচিৎ।-সীরাতে উমার বিন আবদুল আজীজ, আবদুল্লাহ বিন আবদুল হাকাম (সংক্ষেপিত)

তদ্রূপ সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. সৈন্যসহ যখন দজলা নদীতে ঘোড়া নামিয়ে দিলেন এবং দজলা নদীর পানির উপর দিয়ে ঘোড়া চলতে থাকল আর তাঁরা নদী পার হতে থাকলেন এমনভাবে যেন তাঁরা মাটির উপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছেন তখন তাঁর পাশে ছিলেন সালমান ফারসী রা.। সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. বললেন,

حسبنا الله ونعم الوكيل، والله لينصرن الله وليه وليظهرن دينه وليهزمن الله عدوه إن لم يكن في الجيش بغي أو ذنوب تغلب الحسنات

আল্লাহ তাআলাই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই সর্বোত্তম তত্ত্বাবধায়ক। আল্লাহর শপথ, আল্লাহ তাআলা তাঁর বন্ধুদের সাহায্য করবেন এবং তাঁর দীনকে সমুন্নত করবেন এবং তাঁর শত্রুদেরকে পরাস্ত করবেন যদি না সেনাবাহিনীর মধ্যে নাফরমানী এবং পুণ্যকর্ম বিনাশকারী গুনাহকর্ম বিদ্যমান থাকে।-দালাইলুন নুবুওয়াহ, আবূ নুআইম আলআসফাহানী

এরূপ বহু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায়। যার সবগুলোর মর্মার্থ একটিই। আর তা হল, গুনাহকর্ম হতে বিরত থাকা মুসলমানের বিজয়, উৎকর্ষলাভ ও উন্নতশির হওয়ার জন্য পূর্বশর্ত এবং প্রধান শর্ত।

তিন. আরেকটি জরুরী বিষয় হল, মুসলিম জনসাধারণকে ঈমান বিধ্বংসী ফিতনা সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করা। তাওহীদ ও ঈমানের সঙ্গে তাদেরকে যথার্থরূপে পরিচিত করে তোলা। কুফর কী, কুফরের ভয়াবহ পরিণাম কী সে সম্পর্কে তাদেরকে সম্যক ধারণা দেওয়া। মসজিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে গভীর করে তোলা। আলেম উলামার- সংসর্গ অবলম্বনে উদ্বুদ্ধ করা। এর জন্য দাওয়াত ও তাবলীগী কার্যক্রমের সঙ্গে তাদেরকে যুক্ত করাসহ নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা। এ ক্ষেত্রে সাধারণ দ্বীনদার শ্রেণী ও আমাদের যে দায়িত্ব ছিল তিক্ত হলেও সত্য যে, সেই দায়িত্ব পালনে সীমাহীন অবহেলা ও ত্রুটি হয়েছে। পরিণামে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

চার. আরও অনেক জরুরী বিষয়ের মধ্য হতে এই ছোট্ট লেখায় উল্লেখ করার মত সর্বশেষ জরুরী বিষয় হল, আমাদের নতুন প্রজন্মকে দ্বীনের জরুরী বিষয় সম্পর্কে অবহিত করা। দ্বীনী ফরযসমূহ ও ইসলামী নীতি, চরিত্র ও আদর্শ সম্পর্কে অবহিত করা। দ্বীনের মৌলিক শিক্ষা সম্পর্কে অবহিত করা। তাদের মন ও মস্তিষ্কে এ কথা বদ্ধমূল করে দেওয়া যে, মানবজীবনের জন্য কল্যাণকর আদর্শ একমাত্র ইসলামী আদর্শ, ইসলাম ব্যতীত অন্য যে কোন আদর্শের শ্লোগান-তা যতই চিত্তাকর্ষক হোক, ফাঁকা বুলিসর্বস্ব বৈ কিছু নয়। আর এই দায়িত্ব প্রথমত প্রতিটি পরিবারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও সন্তান-সন্ততির পিতামাতাকেই গ্রহণ করতে হবে। এবং এটাকে চিকিৎসা ও বাসস্থানের ব্যবস্থাকরণের ন্যায় অপরিহার্য দায়িত্ব বলে মনে করতে হবে। বরং প্রকৃত সত্য হল, পার্থিব এই বিষয়গুলোর ব্যবস্থাপনা অপেক্ষা অধিক জরুরী সন্তান সন্ততিকে আকীদা বিশ্বাসের তালীম দান, তাদের আকীদা বিশ্বাসকে বিশুদ্ধকরণ রক্ষাকরণ ও শক্তিশালী করণ। এ ব্যাপারে শৈথিল্য কি অবহেলা সন্তান-সন্ততির পার্থিব প্রয়োজনের বিষয়গুলোর ব্যাপারে অবহেলা অপেক্ষা অধিক কুফলবাহী, অধিক ভয়াবহ।

কারণ পার্থিব প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর সম্পর্ক ক্ষণস্থায়ী জীবনের সঙ্গে আর দ্বীনী শিক্ষা ও দীক্ষা এবং আকীদা বিশ্বাসের সম্পর্ক মৃত্যু পরবর্তী চিরস্থায়ী জীবনের সঙ্গে। ঐ জীবনের ভালোমন্দ পরিণামের সঙ্গে।

আল্লাহ তাআলা বলেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ

মুমিনগণ, তোমরা রক্ষা কর নিজেরদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে ঐ আগুন হতে যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর।

হাদীসে এসেছে-

كلكم راع وكلكم مسئول عن رعيته

তোমাদের প্রত্যেকেই অধীনস্থদের তত্ত্বাবধায়ক, দায়িত্বশীল ও শাসকের মর্যাদা রাখ। অতএব তোমাদের প্রত্যেককেই তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জবাবদিহী করতে হবে।

এ ক্ষেত্রে উলামায়ে কেরামকেও এগিয়ে আসতে হবে। জনগণকে সচেতন করণ, পাড়া-মহল্লায় মক্তব প্রতিষ্ঠা করণসহ স্থান ও কাল উপযোগী যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণে উলামায়ে কেরাম যদি তাদের কর্মপরিধিকে বিস্তৃত করেন তাহলে তাঁরা নিজেরাও নিরাপদ হবেন, দেশও নিরাপদ হবে।

আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, মাত্রাতিরিক্ত আবেগতাড়িত হয়ে খন্ডকালীন ও তৎক্ষণাৎ কর্মসূচীর অপেক্ষা সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত দীর্ঘস্থায়ী কর্মসূচী গ্রহণের মধ্যেই কল্যাণ নিহিত।

(হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভীর একটি ভাষণ অবলম্বনে)




কোন মন্তব্য নেই:

Comment here />

Widget ByBlogger Maruf
Widget ByBlogger Maruf