শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

তুমি কি আমাদের সাথে ফাজলেমি করছ? কু’রআনে শেখানো রাগ নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ---

তুমি কি আমাদের সাথে ফাজলেমি করছ? — আল-বাক্বারাহ ৬৭

এই আয়াতে আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে কিছু সাইকোলজি শেখাবেন: ১) কীভাবে মানুষের সবচেয়ে ভয়ংকর মানসিক দুর্বলতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং ২) কীভাবে একটি মোক্ষম মানসিক আক্রমণকে প্রতিহত করে, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ঠিক রেখে, লক্ষ্যে স্থির থাকতে হয়—


মনে করে দেখো, যখন মূসা তার লোকদেরকে বলেছিল, “আল্লাহ তোমাদেরকে একটি গরু জবাই করতে আদেশ করেছেন।” তখন তারা বলল, “তুমি কি আমাদের সাথে ফাজলেমি করছ?” তিনি উত্তর দিলেন, “আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই, যেন আমি নির্বোধ-অবিবেক-লাগামহীন হয়ে না যাই।” [আল-বাক্বারাহ ৬৭]
ধরুন আপনাকে একজন মুসলিম ভাই খুব আগ্রহ নিয়ে ইসলামের কথা বলছে। আপনার কোনো ভুল সংশোধন করার জন্য কিছু উপদেশ শোনাচ্ছে, কু’রআন-হাদিস থেকে কোটেশন দিচ্ছে। কিন্তু আপনার সেটা সহ্য হচ্ছে না। আপনি কোনো যুক্তি দিয়ে তাকে খন্ডন করতে পারছেন না। আর আপনার কাছে কোনো বিকল্প প্রস্তাবও নেই। সেই অবস্থায় আপনি যদি তাকে পুরোপুরি নাস্তানাবুদ করে দিতে চান, তাহলে সোজা তার মুখের উপর কর্কশ ভাষায় জোর গলায় বলুন, “কী সব আবোল তাবোল কথা বলছেন! আপনার কি মাথা খারাপ নাকি? এই সব গাঁজাখুরি কথাবার্তা কোথা থেকে পান আপনারা? ইসলাম মোটেও এটা সমর্থন করে না!”
এর ফলাফল হবে নিচের যেকোনো একটি—
  • ১) সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তার কথার খেই হারিয়ে ফেলবে এবং তার নিজের উপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে। সে তখন মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে গিয়ে আমতা আমতা করে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলা শুরু করবে।
  • ২) সে অপমানে রেগে গিয়ে নিজের আহত ইগোকে বাঁচানোর জন্য: তার ইসলাম নিয়ে কত পড়াশোনা আছে, সে কোথা থেকে কী ডিগ্রি পেয়েছে, সে কোন শাইখের কাছ থেকে কী ফতোয়া শুনেছে — এইসব নিয়ে অনর্থক বক্তৃতা শুরু করে দিবে।
এই পদ্ধতিটি সাইকোলজির ভাষায় ‘গ্যাসলাইটিং’ এর একটি উদাহরণ। কাউকে তার নিজের সম্পর্কে সন্দেহে ফেলে দেওয়া, তার কথা, কাজকে একেবারেই ফালতু-ভুল-পাগলের প্রলাপ ইত্যাদি বলে বোঝানোর চেষ্টা করা, যেন সে নিজের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, রেগে গিয়ে উল্টোপাল্টা আচরণ শুরু করে — এটা হচ্ছে গ্যাসলাইটিং।[১৫২] যারা অহরহ গ্যাসলাইটিং করেন, তারা একধরনের বিকৃত মানসিকতার অধিকারী এবং তাদের জন্য বিশেষ ধরনের মানসিক চিকিৎসা রয়েছে। এধরনের মানুষরা সাধারণত পরিবর্তীতে নানা ধরণের জটিল মানসিক রোগের শিকার হন। যেমন, সাইকোপ্যাথরা অহরহ গ্যাসলাইটিং করেন।[১৫২]
যারা ইসলামের জন্য কাজ করেন, তাদেরকে এই ধরনের আক্রমণ অনেক সহ্য করতে হয়। যেমন: আপনি একদিন ইসলামের উপর একটি চমৎকার আর্টিকেল লিখে ছাপালেন। দেখবেন কিছু পাঠক এমন সব চরম অবান্তর, অপ্রীতিকর, ফালতু মন্তব্য করছে, যেগুলো পড়ে শুধু আপনি না, আপনার নিকটজনরাও বিভ্রান্ত হয়ে ভয় পেয়ে যায়। আপনি ভবিষ্যতে আর্টিকেল লেখার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। কিছু লিখতে গেলেই তখন আপনার সেই কথাগুলো মনে পড়ে, হাত কাঁপে, গলা শুকিয়ে আসে। আপনার কাছের লোকজন এরপর থেকে আপনাকে সাহস জোগানো তো দূরের কথা, উল্টো বার বার আপনাকে সাবধান করে ভয় দেখায়। নানা ভাবে তারা আপনাকে আর্টিকেল লেখা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে। চারিদিকে এত বাঁধা-বিপত্তি দেখে আপনার হাত-পা জমে যায়, কলম আর চলে না। আপনি আর্টিকেল লেখা কমিয়ে দিতে দিতে একসময় ছেড়ে দেন। শয়তান জিতে যায়।
অনেক সময় একজন মুসলিম ভাই/বোন অনেক আগ্রহ নিয়ে অনলাইনে ইসলামের ব্যাপারে কিছু লেখেন। কিন্তু দেখা যায় কোনো এক পাঠক এমন এক ফালতু কমেন্ট করে সবার সামনে তাকে ধুয়ে দেয় যে, সেই কমেন্ট পড়ার পর লেখক/লেখিকা রেগে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন নিজের বিদ্যা এবং জ্ঞানের গভীরতা প্রমাণ করার জন্য। তখন তার অপ্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মতো কথাবার্তা পড়ে অন্যান্য পাঠকরা, যারা তাকে আগে শ্রদ্ধা করত, তার উপর ভরসা হারিয়ে ফেলেন। এভাবে শয়তান জিতে যায়, লেখক হেরে যান। ইসলামের পথে একজন উদীয়মান দা’য়ী ঝরে যায়।
কু’রআনে আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে নবীদের জীবনী থেকে শিখিয়েছেন: কী ধরনের আক্রমণ আসবে এবং মানুষ কীভাবে আমাদের আত্মবিশ্বাস ভেঙ্গে দিয়ে আমাদেরকে রাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। একবার রেগে গেলেই সর্বনাশ। আমরা হেরে যাবো, শয়তান জিতে যাবে। আমরা যেন হেরে না যাই, সেজন্য তিনি এই আয়াতে একটি শক্তিশালী দু’আ শিখিয়ে দিয়েছেন—
أَعُوذُ بِٱللَّهِ أَنْ أَكُونَ مِنَ ٱلْجَٰهِلِينَ
আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই, যেন আমি নির্বোধ-অবিবেক-লাগামহীন হয়ে না যাই।
নবী মূসার ﷺ এই দু’আর মাধ্যমে আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে শেখাচ্ছেন: এধরনের আক্রমণ পেলে আমরা যেন সাথে সাথে তাঁর ﷻ কাছে আকুল ভাবে সাহায্য চাই, যেন তিনি আমাদেরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি দেন। أَعُوذُ (আউ’যু) হচ্ছে আকুল আবেদন। একটি ছোট শিশু ভয় পেলে যেমন দৌড়িয়ে মার কাছে গিয়ে আশ্রয় নেয়, তেমনি আমরা আমাদের চারপাশে এত মানুষ এবং জ্বিন শয়তান থেকে আল্লাহর ﷻ কাছে আকুল ভাবে আশ্রয় চাই, যেন তিনি আমাদেরকে জাহিল হওয়া থেকে রক্ষা করেন। جَٰهِل হচ্ছে এমন একজন, যার বুদ্ধি-শুদ্ধি কম, যার কথা-বার্তা, আচার-আচরণে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, যে বিবেকহীনদের মতো আচরণ করে। এটি আ’কল বা বিচারবুদ্ধির বিপরীত। যে বিচারবুদ্ধি ব্যবহার করে কাজ করে না, বিবেক হারিয়ে ফেলে — সে জাহিল।[১][১৫৩]
প্রাচীন আরবদের জাহিল বলা হতো কারণ তারা অনেক বিবেকহীন কাজ করত, যা কোনো সুস্থ চিন্তার মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। যেমন: আল্লাহকে ﷻ ‘খুশি’ করার জন্য ‘প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে’ নগ্ন হয়ে কা’বার চারপাশে নাচা। এক সর্বোচ্চ সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে ﷻ মানার পরেও নানা ধরণের নগ্ন মূর্তির পূজা করা। স্ত্রীকে আর পছন্দ না হলে তাকে ‘মা’ বানিয়ে ফেলা। বংশ মর্যাদা বজায় রাখার জন্য মেয়ে শিশু জন্মালে তাকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে দেওয়ার মতো ভয়ংকর বিবেকহীন কাজ করত। একারণেই রাসুল মুহাম্মাদ-এর ﷺ নবুওয়াতের আগের আরবদের যুগকে জাহিলিয়াতের যুগ বলা হতো।
এই আয়াতে দেখুন: নবী মূসা ﷺ  কিন্তু বনী ইসরাইলিদের এইরকম পিত্তি জ্বলানো কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলেননি, “কি! তোমাদের এত বড় সাহস! আমি তোমাদের সাথে ফাজলেমি করছি? তোমরা জানো না আমি কে? আমি তোমাদেরকে ফিরাউন থেকে মুক্তি দেইনি? আমি তোমাদেরকে মরুভূমিতে পাথর ভেঙ্গে পানি বের করে দেখাইনি? আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর কাছ থেকে আকাশ থেকে মান্না এবং সালওয়া এনে দেখাইনি? আমার মুখের উপর এত বড় কথা!” — এসব কিছুই তিনি বলেননি। তিনি সাথে সাথে নিজের রাগ সংবরণ করার জন্য আল্লাহর ﷻ আছে দু’আ করেছেন, কারণ তিনি জানতেন: রেগে গেলেই তিনি ভুল সিদ্ধান্ত নেবেন। একারণেই বিভিন্ন ধরণের মেডিটেশন পদ্ধতি, আত্মউন্নয়ন, নফসের পরিশুদ্ধি (তাজকিয়াতুন নাফস) ইত্যাদি কোর্সে বিশেষ ভাবে শেখানো হয়: কীভাবে রাগ দমন করতে হয়।
রাগের ফলাফল
রাগ একটি ভয়ংকর ব্যাপার। পৃথিবীতে আজকে প্রায় ৫০% স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে যায়, যার একটি বড় কারণ রাগ।[১৪৮] গবেষণায় দেখা গেছে আমেরিকাতে প্রতি তিনজন উঠতি বয়সীর মধ্যে দুইজনের প্রচন্ড রাগ থেকে অন্যকে আক্রমণ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। সেখানে প্রায় ৬০ লক্ষ উঠতি বয়সীরা অনিয়ন্ত্রিত রাগের কারণে বিভিন্ন ধরণের অপ্রীতিকর, অসামাজিক কাজ করে। এমনকি স্কুলে বন্দুক নিয়ে গিয়ে সহপাঠীকে গুলি করে মারার ঘটনাও অহরহ ঘটে।[১৫১]ইংল্যান্ড, যেখানকার মানুষরা নিজেদেরকে উচ্চ শিক্ষিত, ভদ্র-মার্জিত মনে করে, সেখানে[১৪৯]—
  • ৪৫% মানুষ কাজে থাকার সময় নিয়মিত রেগে গিয়ে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন।
  • ৬৪% মানুষ অফিসে কাজ করার সময় কলিগের উপর রেগে গেছেন।
  • ২৭% নার্সের উপর আক্রমণ হয়েছে রাগের কারণে।
  • প্রতি বিশ জনে এক জন তাদের প্রতিবেশীর সাথে ঝগড়া করেন।
  • ৮০% এর বেশি যানবাহন চালক অন্য চালকের ক্রোধের স্বীকার হয়েছেন।
  • ৫০% কম্পিউটার ব্যবহারকারী রেগে গিয়ে কম্পিউটারে আঘাত করেছেন বা জিনিসপত্র ছুঁড়ে মেরেছেন।
  • ৬৫% মানুষ ফোনে অন্যের সাথে রাগরাগী করেন।
অথচ সেই দেশে এক বাস ড্রাইভার অন্য বাস ড্রাইভারকে দেখলে হাত উচিয়ে সম্ভাষণ জানায়, যেখানে বাংলাদেশে এক বাস ড্রাইভার অন্য ড্রাইভারকে দেখে বিশুদ্ধ বাংলায় গালি দেয়। সেই দেশে গাড়ি ধুয়ে দেওয়ার পর গাড়ির মালিক হাঁসি মুখে থ্যাঙ্কইউ বলে বাড়তি বখশিশ দেয়, যেখানে বাংলাদেশের গরিব ছেলেটা গাড়ি ধুয়ে দেওয়ার পর কিছু বখশিশ চাইলে, মানুষ হাত তুলে চড় মারার চেষ্টা করে। সেই দেশেই রাগের কারণে যদি এত সমস্যা হয়, তাহলে বাংলাদেশে কী ভয়াবহ অবস্থা তা বোঝার জন্য পরিসংখ্যানের দরকার নেই। সরকারি অফিস, স্কুল, কলেজ, বাজারে গেলেই দেখা যায় রাগ আমাদেরকে কত নীচে নামিয়ে দিয়েছে।
রাগ কী?
আমরা যখন রেগে যাই, তখন আমাদের রক্তে অ্যাড্রেনালিন এবং কর্টিসল হরমোন দুটি ছড়িয়ে পড়ে, যা আমাদেরকে কঠিন পরিস্থিতি দ্রুত মোকাবেলার জন্য তৈরি করে। আমরা সাথে সাথে উত্তেজিত হয়ে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু একটা করে ফেলি। এই সময় মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা অনেক সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। পরিস্থিতি সঠিকভাবে বিবেচনা করে, কী কী সম্ভাব্য পদক্ষেপ নেওয়া যেত, এই সব বিস্তারিত চিন্তা মানুষ তখন করতে পারে না। তখন মুহূর্তের মধ্যে যেটাই মাথায় আসে, সেটাই মানুষ করে ফেলে।[১৫০]
বিপদের সময় এটা কাজে লাগে, কারণ তখন সময় নিয়ে চিন্তা করে কিছু করতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে। তাই এই সময় রাগ বা উত্তেজনা মানুষের জন্য উপকারি। কিন্তু অন্য সময় এটা মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, কারণ মানুষ তখন পরিস্থিতি সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করে না। ঘটনা কীভাবে ঘটল সেটা বিস্তারিত বিবেচনা করে না। কী করলে সবচেয়ে ভাল ফলাফল আসবে সেটা ভেবে দেখে না। যার ফলে রেগে গেলে মানুষ বেশিরভাগ সময় অযৌক্তিক, অপ্রীতিকর, ভুল কাজ করে ফেলে। [১৫০]
আমরা কেন রেগে যাই?
রেগে যাওয়ার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এক কথায় বললে বলা যায়: যখন আমরা উপলব্ধি করি: আমাদের সাথে বা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এমন কারো বা কিছুর সাথে অন্যায় করা হয়েছে, তখন আমরা রেগে যাই।[১৫০] যেমন—

“আমার সাথে ও এভাবে কথা বলল কেন?”
“আমার দিকে ও এভাবে তাকাল কেন?”
“আমাকে দেখে ও এটা করল না কেন?”
“আমার কথার উত্তর দিতে ও এত দেরি করল কেন?”
“আমি এতবার ওর কাছে এটা চাই, তাও আমাকে দেয় না কেন?”
“আমার জীবনটা এরকম হলো কেন? আমি কি অমুকের মতো সুন্দর জীবন পেতে পারতাম না?”
“আমি ওর জন্য এত করি, কিন্তু ও আমার জন্য কিছুই করে না কেন?”
“আমি এত চেষ্টা করেও ওটা পেলাম না, কিন্তু ও ওটা পেল কীভাবে?”
“আমার সন্তানকে এটা না দিয়ে, ওর সন্তানকে দিলো কেন?”
“ও আমাকে এই ব্যাপারে উপদেশ দেবার কে?”
এরকম “আমি, আমার, আমাকে” ধরনের আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর চিন্তা যারা বেশি করেন, তারা ঘন ঘন রেগে যান এবং ছোটোখাটো ঘটনাতেও রেগে যান।[১৪৮] যে যত বেশি নিজেকে নিয়ে চিন্তা করেন, নিজের চাওয়া পাওয়া নিয়ে স্পর্শকাতর থাকেন, তার রাগ হয় তত দ্রুত।[১৪৮]
এধরনের মানুষদের চিন্তাভাবনা এবং অন্যের সাথে তাদের আলোচনা ঘুরে ফিরে শুধু তাদের চাওয়া-পাওয়া নিয়েই হয় এবং তারা কী পাচ্ছে না, তাদের সাথে কী অন্যায় হচ্ছে, কী হলে ভালো হতো — এগুলোই চলতে থাকে। তারা মনে করেন: এই ব্যাপারগুলো নিয়ে দিনের পর দিন চিন্তা করে, মানুষের সাথে বার বার কথা বলে তাদের লাভ হচ্ছে, বুকটা হালকা হচ্ছে। কিন্তু আসলে হয় তার উল্টোটা। তাদের মনের বিষ বাড়তেই থাকে এবং সেই বিষ অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে থাকে।[১৪৮]
এধরনের মানুষরা সপ্তাহের বেশিরভাগ দিন মুখ গোমড়া করে অসুখী, বিতৃষ্ণাময় জীবন পার করেন, এবং একইসাথে তাদের আশে পাশের নিকটজনদের জীবনকেও অসহ্য করে তোলেন। দুঃখজনকভাবে আমাদের বেশিরভাগেরই পরিবারে এক বা একাধিক মানুষ থাকেন, যারা তাদের আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর মানসিকতার জন্য নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, এবং তাদের কারণে পুরো পরিবারকে বার বার কষ্টকর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
রাগ প্রতিরোধ এবং দমন করার উপায়
রাগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণা এবং বইয়ের কোনো অভাব নেই। রাগ নিয়ন্ত্রনের কোর্স এবং প্রোগ্রামগুলো পাশ্চাত্যের দেশে একটি বিরাট ব্যবসা। বড় কোম্পানিগুলো তাদের সেলস এবং কাস্টমার সাপোর্ট কর্মচারীদের রাগ নিয়ন্ত্রণের উপর কোর্স করতে বাধ্য করেন, কারণ কোম্পানির কাস্টোমার হারানো এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির একটি বড় কারণ কর্মচারীদের রাগ। ডঃ ক্লেয়টন-এর লেখা ‘সাইকোলজি সেলফহেল্প’ বইটি একটি খুবই কাজের বই, যা বিনামূল্যে পাওয়া যায়।[১৪৮] সেখানে তিনি বেশ কিছু পদ্ধতি শিখিয়েছেন রাগ দমন করার জন্য—
১) আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা ভাবনা কমানো। অন্যের অবস্থার প্রতি আরও সংবেদনশীল হওয়া। আমরা যত বেশি মেনে নেব: “সবাই একরকম হয় না, সবাই আমার মতো করে ভাবে না” — আমরা তত বেশি সহনশীল হবো, তত কম রেগে যাব এবং তত বেশি নিজে শান্তিতে থাকব। রেগে যাওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটলে প্রথমে নিজেকে জিজ্ঞেস করব: “ও কি অসুস্থ?” “ও কি কোনো কারণে মানসিক চাপের মধ্যে আছে?” “ওর সাথে কেউ কি সম্প্রতি খারাপ ব্যবহার করেছে, যার ঝাল ও এখন আমার উপর ঝাড়ছে?” “ও আমার সাথে যা করছে, আমি হলে কি ওর সাথে একই কাজ করতাম?” “আমি ওর কাছ থেকে যা পাওয়ার আশা করি, সেটা আমি নিজে কি ওকে দেই, যেভাবে ও চায়?” “আমি ওকে আমার জন্য যা করতে বলি, আমি নিজে কি সেটা সেভাবেই করি, যেভাবে ও চায়?”
২) ক্ষমা করে ব্যাপারটা ছেড়ে দেওয়া। যার কারণে আমরা রেগে যাই, তাকে যদি আমরা ক্ষমা করে ছেড়ে দিতে পারি, তাহলে আমাদের রেগে থাকার কোনো কারণ থাকবে না। তবে রেগে থাকা অবস্থায় কাউকে ক্ষমা করা খুবই কঠিন কাজ।
তবে এই ক্ষমার অর্থ এই নয় যে—
  • ব্যাপারটা ভুলে যাওয়ার জন্য কথা দেওয়া। মানুষ রেগে যাওয়ার মতো ঘটনা সহজে ভুলে যেতে পারে না।
  • ক্ষমা মানে বিশ্বাস করা নয় যে, আমার রেগে যাওয়ার পেছনে তার কোনো দোষ নেই। দোষ না থাকলে ক্ষমার প্রশ্ন আসতো না।
  • ক্ষমা মানে এই নয় যে, তার এই কাজটাকে সমর্থন করা।
  • ক্ষমার মানে এই নয় যে, সেই খারাপ কাজ ভবিষ্যতে হওয়াকে অনুমোদন দেওয়া। ধর্মীয় বা সামাজিক অনুশাসন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে না। যেটা খারাপ কাজ, সেটা খারাপই।
এই ক্ষমার অর্থ হলো: নিজের ভেতরে সিদ্ধান্ত নেওয়া যে, “আমি ওকে আর ঘৃণা করব না। আমি আমার মনের ভেতরের বিষটাকে উপরে ফেলব এবং নিজের মনের ভিতরে শান্তি আনার চেষ্টা করব।”
৩) টিভি দেখা বন্ধ করা। বিংশ শতাব্দীর পর থেকে নিয়মিত টিভি দেখে এমন ছেলে বা মেয়ে ১৫ বছর বয়স্ক হওয়ার আগেই নানা ধরনের কার্টুন, মুভি, সিরিয়ালের মাধ্যমে গড়ে প্রায় ১৫,০০০ মানুষকে হিংস্রভাবে খুন, হত্যা, ধ্বংস করা দেখে।[১৪৮] টিভিতে শেখানো হয়: “যে কোনো সমস্যার দ্রুত সমাধান হচ্ছে ভায়লেন্স।” টিভি তাদেরকে শেখায়—
“দেশে আইন-শৃঙ্খলা বাস্তবায়ন করতে চাও? একটি কম্পিউটারাইজড লোহার বর্ম পড়ে, অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আইন নিজের হাতে তুলে নাও। গরিব-অসহায় মানুষদের সাহায্য করতে চাও? প্যান্টের বাইরে আন্ডারওয়্যার পড়ে, পিঠে একটা কাপড় ঝুলিয়ে, অর্ধেক মুখোশ পড়ে, নানা ধরনের রকমারি সরঞ্জাম ব্যবহার করে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে ব্যাপক মারামারি, ধ্বংসযজ্ঞ করে বেড়াও। অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে চাও? একটা মাকড়সার কামড় খেয়ে, তারপর মাকড়সার মতো দেওয়ালে ঝুলে শত্রুর সাথে মারামারি করে বেড়াও।”
টিভি আমাদের সন্তানদেরকে শেখায়: “যাবতীয় সমস্যার সবচেয়ে দ্রুত সমাধান হচ্ছে: কোনোভাবে দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর থেকে বেশি শারীরিক শক্তি এবং মারণাস্ত্র প্রযুক্তি অর্জন করে ভায়লেন্সের ব্যবহার এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া।”
কু’রআনে শেখানো রাগ নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি
রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণা করে বের করা এই পদ্ধতিগুলো ১৪০০ বছর আগে থেকেই আমরা জানতাম, কারণ আল্লাহ ﷻ নিজে আমাদেরকে শিখিয়েছেন কীভাবে রাগ দমন করতে হয়—
وَإِذَا مَا غَضِبُوا۟ هُمْ يَغْفِرُونَ
যখন তারা রেগে যায়, তখন (সাথে সাথে) তারা ক্ষমা করে ব্যপারটা ছেড়ে দেয়। [আশ-শুরা ৪২:৩৭, আংশিক]
আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে غفر (গা’ফারা) অর্থাৎ ক্ষমা করে ছেড়ে দিতে বলছেন। غفر এর অর্থ ক্ষমা করা, ঢেকে দেওয়া, গোপন করা।[১৫৫] ক্ষমা করে কয়েকদিন পর পর সেটার কথা নিজে মনে করা এবং নানা কথা এবং কাজের মধ্যে দিয়ে যাকে ক্ষমা করা হয়েছে, তাকে কৌশলে মনে করিয়ে দেওয়া নয়।
خُذِ ٱلْعَفْوَ وَأْمُرْ بِٱلْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ ٱلْجَٰهِلِينَ
দাবি না রেখে ক্ষমা করা শেখো, ভালো কাজের আদেশ দাও এবং নির্বোধ-লাগামহীনদের পাত্তা দিবে না।[আল-আরাফ ৭:১৯৯]
এই আয়াতে আল্লাহ আমাদেরকে عفو (আ’ফউ) করার অভ্যাস করতে বলছেন। عفو হচ্ছে কোনো ধরনের রাগ চেপে না রেখে, ভালবেসে ক্ষমা করে দেওয়া। যেমন, আপনার বাচ্চা আপনার শখের ল্যাপটপে পানি ঢেলে নষ্ট করে দিল। আপনি অনেক কষ্টে রাগ চেপে একটা শুকনো হাসি দিয়ে তাকে মাফ করে দিলেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আপনি ঠিকই গজ গজ করছেন—এটা আ’ফউ নয়। আ’ফউ হচ্ছে: আপনি তাকে মাফ করে দিলেন, তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন, সুন্দর করে বোঝালেন—একদম স্বতঃস্ফূর্ত, নির্ভেজাল, কোনো ধরনের দাবি না রেখে মাফ করা।[১]
وَإِذَا مَرُّوا۟ بِٱللَّغْوِ مَرُّوا۟ كِرَامًا
তারা যখন ফালতু কথা-কাজ [আপত্তিকর আচরণ, অন্যকে উপেক্ষা করে কথা] দেখে/শোনে, তখন তারা সন্মান বজায় রেখে সেখান থেকে সরে পড়ে। [আল-ফুরকান ২৫:৭২, আংশিক]
এখানে আল্লাহ আমাদেরকে لغو (লাগু’) থেকে নিজের সন্মান বজায় রেখে সরে পড়তে বলেছেন। لغو হচ্ছে: ফালতু, নন্সেন্স কথাবার্তা; ফাজলেমি, ছ্যাবলামি, ফচকেমি; অন্যকে অপদস্থ করে কথাবার্তা, কাউকে খোঁচানো ইত্যাদি।[১৫৪] আজকালকার রেডিওতে ডিজেদের ছ্যাবলামি কথাবার্তা, টিভিতে একে অন্যকে পচানো টক-শো, নাটকের ফালতু ঘটনা এবং কুটনামী আইডিয়া, গানের সুড়সুড়ি দেওয়া লিরিক্স, অশ্লীল মিউজিক ভিডিও, হিন্দি সিরিয়ালে ভাবী-ননদ-শাশুড়ির একে অন্যকে অপদস্থ করার নানা পরিকল্পনা — এগুলো সব لغو -এর মধ্যে পড়ে। এগুলো থেকে দূরে রাখার কঠিন নির্দেশ কু’রআনে রয়েছে।
কু’রআন – আমাদের জন্য সাইকোলজি গাইডবুক
কু’রআনে বহু জায়গায় মূসা ﷺ এর উপর আক্রমণের ঘটনা এবং দক্ষতার সাথে তার পরিস্থিতি মোকাবেলার উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ ﷻ মুসা ﷺ এর ঘটনাগুলো বর্ণনা করেছেন এক বিশেষ উদ্দেশ্যে: এগুলো ছিল রাসুল মুহাম্মাদের ﷺ জন্য কেস স্টাডি, যা থেকে তিনি শিক্ষা পেয়েছেন: কীভাবে জাহিল আরবদের সাথে মোকাবেলা করতে হবে, কীভাবে রাগ দমন করতে হবে এবং অপমান হজম করে মূল লক্ষ্যে স্থির থাকতে হবে। একইভাবে এই আয়াতগুলো আজকের যুগে যারা ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছেন এবং যারা ইসলামের প্রচারে বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের জন্য চমৎকার গাইডলাইন।
কু’রআনে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর উপর এই ধরণের আয়াতগুলো আমাদেরকে শুধুই ইতিহাস শেখায় না, এগুলোর মধ্যে আমাদের জন্য নানা ধরণের শিক্ষা রয়েছে। কু’রআন কোনো ঐতিহাসিক গ্রন্থ নয় যে, এখানে আমাদের মনোরঞ্জনের জন্য কিছু মজার ঘটনা লেখা থাকবে। এটি আমাদের জন্য একটি পথ নির্দেশ। এর প্রতিটি আয়াতে আমাদেরকে সংশোধন করার জন্য কিছু না কিছু বাণী দেওয়া হয়েছে। একারণে প্রতিটি আয়াত পড়ার পর আমাদের নিজেকেদেরকে প্রশ্ন করতে হবে, “এই আয়াতে আল্লাহ ﷻ আমাকে কী শেখাচ্ছেন? আমার ভেতরে এখন কী পরিবর্তন আনতে হবে?”

কোন মন্তব্য নেই:

Comment here />

Widget ByBlogger Maruf
Widget ByBlogger Maruf