বৃহস্পতিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৪

সফরের ছালাত অথবা ভীতির সময়ে ছালাতে ‘ক্বছর’ করার অনুমতি ???

সফরের ছালাত অথবা ভীতির সময়ে ছালাতে ‘ক্বছর’ করার অনুমতি ???




সফর অথবা ভীতির সময়ে ছালাতে ‘ক্বছর’ করার অনুমতি রয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন-‘যখন তোমরা সফর কর, তখন তোমাদের ছালাতে ‘ক্বছর’ করায় কোন দোষ নেই। যদি তোমরা আশংকা কর যে, কাফেররা তোমাদেরকে উত্যক্ত করবে। নিশ্চয়ই কাফেররা তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (নিসা ৪/১০১)।

‘ক্বছর’ অর্থ কমানো। পারিভাষিক অর্থে : চার রাক‘আত বিশিষ্ট ছালাত দু’রাক‘আত করে পড়াকে ‘ক্বছর’ বলে। মক্কা বিজয়ের সফরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ক্বছরের সাথে ছালাত আদায় করেন।[মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৩৩৬ ‘সফরের ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৪১।]


শান্তিপূর্ণ সফরে ক্বছর করতে হবে কি-না এ সম্পর্কে ওমর ফারূক (রাঃ)-এর এক প্রশ্নের জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ এটিকে তোমাদের জন্য ছাদাক্বা (উপঢৌকন) হিসাবে প্রদান করেছেন। অতএব তোমরা তা গ্রহণ কর’।[মুসলিম, মিশকাত হা/১৩৩৫ ‘সফরের ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৪১।] সফর অবশ্যই আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্যের সফর হ’তে হবে, গোনাহের সফর নয়’। [মির‘আত ৪/৩৮১।]

সফরের দূরত্ব:----

পবিত্র কুরআনে দূরত্বের কোন ব্যাখ্যা নেই। কেবল সফরের কথা আছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকেও এর কোন সীমা নির্দেশ করা হয়নি। [ইবনুল ক্বাইয়িম, যা-দুল মা‘আদ (বৈরুত: ১৪১৬/১৯৯৬) ১/৪৬৩ পৃঃ।]ইবনুল মুনযির বলেন যে, সফরের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনা শহর ছেড়ে বের হয়ে যাওয়ার পূর্বে ‘ক্বছর’ করেছেন বলে জানা যায় না’-তিনি বলেন, বিদ্বানগণ একমত হয়েছেন যে, সফরের নিয়তে বের হয়ে নিজ গ্রাম (বা মহল্লার) বাড়ীসমূহ অতিক্রম করলেই তিনি ক্বছর করতে পারেন।[নায়লুল আওত্বার ৪/১২৪; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১৩।]

এই সফর পায়ে হেঁটে হোক অথবা উঁটের পিঠে, সাইকেলে হোক বা বাসে-ট্রেনে, পানি-জাহাজে হোক অথবা এরোপেঙ্গনে, কষ্টের হোক অথবা আরামের, বৈধ কোন কাজের জন্য হলে তাতে কসর বিধেয়।(মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ ২০/১৫৭)

দূরবর্তী সফর থেকে যদি একদিনের ভিতরেই ফিরে আসে অথবা নিকটবর্তী সফরে ২/৩ দিন অবস্থান করে তবুও তাতে কসর-জমা চলবে।(আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাই ৪/৪৯৯)

কোত্থেকে কসর শুরু হবে-----

রাসুল (সাঃ) শহর বা জনপদ ছেড়ে বের হয়ে গেলেই কসর শুরু করতেন। আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আমি নবী (সাঃ)-এর সাথে (মক্কা যাওয়ার পথে) মদীনায় যোহরের ৪ রাকআত এবং (মদীনা থেকে ৬ মাইল দূরে) যুল-হুলাইফায় গিয়ে আসরের ২ রাকআত পড়তাম।’(সহীহুল বুখারী ১০৮৯নং, সহীহ মুসলিম, সুনানু আবূদাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, সুনান)

নামাযের সময় আসার পরেও সফর করলে পথে কসর করা বৈধ। অনুরূপ সফরে নামাযের সময় হওয়ার পরেও বাসায় ফিরে এলে পূর্ণ নামায পড়তে হবে।(লিকাউ বাবিল মাফতূহ, ইবনে উষাইমীন ৭৯পৃঃ, আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাই ৪/৫২৩)

সফরে বের হয়ে শহর ছেড়ে (শহরের বাইরে) বিমান-বন্দর, ষ্টেশন বা বাস-¯ট্যাণ্ডে কসর চলবে। সেখানে কসর করে নামায পড়ার পর যদি কোন কারণবশতঃ পেঙ্গন বা গাড়ি না আসার ফলে বাড়ি ফিরতে হয়, তবুও ঐ কসর করা নামায আর ফিরিয়ে পড়তে হবে না।(আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাই ৪/৫১৪)

কসরের সময়-সীমা—
এত দিন সফরে থাকার নিয়ত করলে কসর চলবে এবং এত দিন করলে চলবে না, তো সে কথার উপযুক্ত দলীল নেই। ৪ কিংবা তার থেকে বেশী দিনের অবস্থান নিয়তে থাকলেও যতদিন তার কাজ শেষ না হয়েছে ততদিন মুসাফির মুসাফিরই; যতক্ষণ না সে স্থায়ীভাবে বসবাসের নিয়ত করেছে।(আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাই ৪/৫৩২-৫৩৯)

সফরে গিয়ে নির্দিষ্ট দিন থাকার সংক্লপ না হলে, বরং কাজ হাসিল হলেই ফিরে আসার নিয়ত হলে অথবা পথে কোন বাধা পড়লে যতদিন ঐ কাজ না হবে অথবা বাধা দূর না হবে ততদিন সফরে কসর করা চলবে।(ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৪০৬-৪০৭)

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ১৯ দিন (মক্কা বিজয় অথবা তাবূক অভিযানে) অবস্থানকালে ‘ক্বছর’ করেছেন। আমরাও তাই করি। তার বেশী হ’লে পুরা করি।[বুখারী ১/১৪৭, হা/৪২৯৮; ঐ, মিশকাত হা/১৩৩৭।]

সিদ্ধান্তহীন অবস্থায় ১৯ দিনের বেশী হ’লেও ‘ক্বছর’ করা যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাবূক অভিযানের সময় সেখানে ২০ দিন যাবৎ ‘ক্বছর’ করেন। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) আযারবাইজান সফরে গেলে পুরা বরফের মৌসুমে সেখানে আটকে যান ও ছ’মাস যাবৎ ক্বছরের সাথে ছালাত আদায় করেন। অনুরূপভাবে হযরত আনাস (রাঃ) শাম বা সিরিয়া সফরে এসে দু’বছর সেখানে থাকেন ও ক্বছর করেন।মিরক্বাত ৩/২২১; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১৩-১৪।]

মোটকথা ভীতি ও সফর অবস্থায় ‘ক্বছর’ করা উত্তম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সফরে সর্বদা ক্বছর করতেন। ওমর, আলী, ইবনু মাসঊদ, ইবনু আববাস (রাঃ) প্রমুখ সফরে ক্বছর করাকেই অগ্রাধিকার দিতেন।[ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৪/৯৮; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১২।] ওছমান (রাঃ) ও আয়েশা (রাঃ) প্রথম দিকে ক্বছর করতেন ও পরে পুরা পড়তেন। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) জামা‘আতে পুরা পড়তেন ও একাকী ক্বছর করতেন।[মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৩৪৭-৪৮ ‘সফরের ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৪১।]

অতএব স্থায়ী মুসাফির যেমন জাহায, বিমান, ট্রেন, বাস ইত্যাদির চালক ও কর্মচারীগণ সফর অবস্থায় সর্বদা ছালাতে ক্বছর করতে পারেন এবং তারা দু’ওয়াক্তের ছালাত জমা ও ক্বছর করতে পারেন।(মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ ২২/১০৩)

পক্ষান্তরে বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলে; ব্যবসা, চাকুরী, অধ্যয়ন প্রভৃতির জন্য বিদেশে থাকতে হলে তখন আর কসর চলবে না।

সফরে সুন্নত ও নফল নামায-----
সফরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সুন্নাত সমূহ পড়তেন না। [মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৩৩৮ ‘সফরের ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৪১; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১৬।]

অবশ্য বিতর, তাহাজ্জুদ ও ফজরের দু’রাক‘আত সুন্নাত ছাড়তেন না। [ইবনুল ক্বাইয়িম, যা-দুল মা‘আদ ৩/৪৫৭ পৃঃ।]ফরয নামাযের আগে-পরেও নফলের নিয়তে নামায পড়া দূষণীয় নয়।আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) এক সফরে লোকেদেরকে ফরয নামাযের পর সুন্নত পড়তে দেখে বললেন, ‘যদি আমাকে সুন্নতই পড়তে হত, তাহলে ফরয নামায পুরা করেই পড়তাম। আমি নবী (সাঃ)-এর সাথে সফরে থেকেছি। আমি তাঁকে সুন্নত পড়তে দেখিনি।’ তিনি বলতেন, আলালহ বলেছেন,নিশ্চয় তোমাদের জন্য আল্লাহর রসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।(সূরা ৩৩/২১) (সহীহুল বুখারী ১১০১নং, সহীহ মুসলিম)

আমি নবী (সাঃ)-এর সাথে সফরে থেকেছি। তিনি ২ রাকআতের বেশী নামায পড়তেন না। অনুরূপ আবূ বকর, উমার ও উসমান রাঃ-ও করতেন।’(সহীহুল বুখারী ১১০২নং, সহীহ মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ ১৩৩৮নং)

ছালাত জমা ও ক্বছর করা:---

সফরে থাকা অবস্থায় যোহর-আছর (২+২=৪ রাক‘আত) ও মাগরিব-এশা (৩+২=৫ রাক‘আত) পৃথক এক্বামতের মাধ্যমে সুন্নাত ও নফল ছাড়াই জমা ও ক্বছর করে তাক্বদীম ও তাখীর দু’ভাবে পড়ার নিয়ম রয়েছে।[বুখারী, মিশকাত হা/১৩৩৯; আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১৩৪৪।] অর্থাৎ শেষের ওয়াক্তের ছালাত আগের ওয়াক্তের সাথে ‘তাক্বদীম’ করে অথবা আগের ওয়াক্তের ছালাত শেষের ওয়াক্তের সাথে ‘তাখীর’ করে একত্রে পড়বে।[ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১৫।]

হজ্জের সফরে আরাফাতের ময়দানে কোনরূপ সুন্নাত-নফল ছাড়াই যোহর ও আছর একত্রে (২+২) যোহরের আউয়াল ওয়াক্তে পৃথক এক্বামতে ‘জমা তাক্বদীম’ করে এবং মুযদালিফায় মাগরিব ও এশা একত্রে (৩+২) এশার সময় পৃথক এক্বামতে ‘জমা তাখীর’ করে জামা‘আতের সাথে অথবা একাকী পড়তে হয়। [বুখারী, মিশকাত হা/২৬১৭, ২৬০৭ ‘হজ্জ’ অধ্যায়, ‘আরাফা ও মুযদালিফা থেকে প্রত্যাবর্তন’ অনুচ্ছেদ-৫; আহমাদ, মুসলিম, নাসাঈ, নায়ল ৪/১৪০।]




কোন মন্তব্য নেই:

Comment here />

Widget ByBlogger Maruf
Widget ByBlogger Maruf