সত্য অর্থ খাঁটি, সঠিক, নির্ভুল, বাস্তব, যথার্থ, প্রকৃত, আসল ইত্যাদি। অপরদিকে মিথ্যা অর্থ অসত্য, ভুল, অবাস্তব, অযথার্থ, অমুলক, কল্পিত, নিষ্ফল, অনর্থক ইত্যাদি। অর্থাৎ সত্যের বিপরীত রূপ হ’ল মিথ্যা। সুতরাং সত্য ও মিথ্যার কাজ সম্পূর্ণ ভিন্ন বা পৃথক এবং এ দু’টি বিপরীতধর্মী বিষয়। আবার এ দু’টির সংমিশ্রণ বা সংযোজন বিশুদ্ধ কোন কিছুর উদ্ভব করতে সক্ষম নয়। তাই ইসলামে সত্য ও মিথ্যার সংমিশ্রণ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।
এ নশ্বর জগতে জীবন যাপনে সত্য-মিথ্যার ন্যায় আরও বহু বিপরীতধর্মী বিষয় বিদ্যমান, তন্মধ্যে কয়েকটি হ’ল, ধর্ম-অধর্ম, ভাল-মন্দ, সৎ-অসৎ, ন্যায়-অন্যায়, সুবিচার-অবিচার, কল্যাণ-অকল্যাণ, শান্তি-অশান্তি, জন্ম-মৃত্যু, আকাশ-পাতাল, হাসি-কান্না, আলো-অন্ধকার, উত্তম-অধম, সম্ভব-অসম্ভব, উত্তীর্ণ-অনুত্তীর্ণ, কৃতকার্য-অকৃতকার্য ইত্যাদি। তবে মানব জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য এবং আধ্যাত্মিক বিজয় অর্জনের প্রক্রিয়ায় সত্য ও মিথ্যার ভূমিকা সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি ধর্মীয় জীবন-যাপনে সত্যের কোন বিকল্প নেই। তবুও অলৌকিক উপায়েই সত্যের বিপরীতে মিথ্যা জন্ম লাভ করেছে। মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানব প্রতিনিধিকে সত্য ও মিথ্যা নির্ণয় করার জ্ঞান-বুদ্ধির পক্ষে বিপক্ষে অসংখ্য বাণী অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّ هـذَا لَهُوَ الْقَصَصُ الْحَقُّ وَمَا مِنْ إِلـهٍ إِلاَّ اللهُ وَإِنَّ اللهَ لَهُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ- ‘নিঃসন্দেহে এটাই হ’ল সত্য ভাষণ। এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ (উপাস্য) নেই। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ, তিনিই হ’লেন পরাক্রমশালী মহাপ্রাজ্ঞ’ (আলে ইমরান ৬২)।
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, ذَلِكَ بِأَنَّ اللهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِهِ الْبَاطِلُ وَأَنَّ اللهَ هُوَ الْعَلِيُّ الْكَبِيْرُ- ‘এটাই প্রমাণ যে, আল্লাহই সত্য এবং আল্লাহ ব্যতীত তারা যাদের পূজা করে সব মিথ্যা। আল্লাহ সর্বোচ্চ মহান’ (লোক্বমান ৩০)।
একই ভাবার্থে পুনরায় আল্লাহ প্রত্যাদেশ করেন,
ذَلِكَ بِأَنَّ اللهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِهِ هُوَ الْبَاطِلُ وَأَنَّ اللهَ هُوَ الْعَلِيُّ الْكَبِيْرُ-
‘আল্লাহই সত্য, আর তাঁর পরিবর্তে তারা যাকে ডাকে, তা অসত্য এবং আল্লাহই সবার উচ্চে, মহান’ (হজ্জ ৬২)।
আলোচ্য বিষয়ের প্রমাণে ঈষৎ পরিবর্তিত আকারে মহান আল্লাহ বলেন,
وَالَّذِيْ جَاءَ بِالصِّدْقِ وَصَدَّقَ بِهِ أُوْلَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُوْنَ-
‘যারা সত্য নিয়ে আগমন করেছে এবং সত্যকে সত্য মেনে নিয়েছে তারাই তো আল্লাহভীরু’ (যুমার ৩৩)।
সত্যের অনুকূলে মহান আল্লাহ আরও বলেন,
وَيُحِقُّ اللهُ الْحَقَّ بِكَلِمَاتِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُجْرِمُوْنَ-
‘আল্লাহ সত্যকে সত্যে পরিণত করেন স্বীয় নির্দেশে, যদিও পাপীদের তা মনঃপূত নয়’ (ইউনুস ৮২)।
নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী ও বহির্ভূত দৃশ্য অদৃশ্য সবার উপরে আল্লাহ সত্য, তাঁর উপরে কেউ নেই। এই মহা সত্যের আলোচনায় উপরের আয়াতগুলো উপস্থাপিত হ’ল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, সত্যের মূলে কুঠারাঘাত করার জন্যই মিথ্যার উদ্ভব হয়েছে এবং মিথ্যার কর্ণধার হিসাবে শয়তানের আবেদন নিবেদন অনুমোদিত হয়েছে মহান আল্লাহর দরবারে। শয়তানের এই আবেদন ছিল, মূলতঃ কৃত্রিমভাবে অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন হয়ে মানব জাতিকে সত্যের পথে বাধাগ্রস্ত করা, যা মানব জাতির অজ্ঞাত নয়। বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যতের মালিক মহাপরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহ তা‘আলা উদভূত পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মহাব্যবস্থাকল্পেই তাঁর প্রতি অবিচল থাকার জন্য বিভিন্নভাবে নির্দেশ প্রদান করেন।
এক ও অদ্বিতীয় মহাপবিত্র সত্তা আল্লাহকে অকৃত্রিমভাবে সর্বান্তকরণে সত্যরূপে গ্রহণ করা, পক্ষান্তরে এই সুন্দরতম ধারণাকে শয়তানের প্ররোচনায় সন্দেহ বা মিথ্যায় রূপান্তরিত করার চক্রান্ত হ’তে মুক্তির প্রয়াসেই সত্য-মিথ্যা অভিযানের অবতারণা।
সত্যের মধ্যে মিথ্যার অনুপ্রবেশ, বিশেষ করে আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে মিথ্যা চিন্তা বা মিথ্যা রচনার কথা একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির পক্ষে কল্পনা করাও সম্পূর্ণ অসম্ভব। অথচ শয়তান এরূপ গর্হিত ও অবিশ্বাস্য কাজেও সুযোগমত কোন কোন বান্দার মধ্যে ইন্ধন যুগিয়ে থাকে। মহান আল্লাহ বলেন,
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللهِ كَذِباً أَوْ كَذَّبَ بِآيَاتِهِ إِنَّهُ لاَ يُفْلِحُ الظَّالِمُوْنَ-
‘যে আল্লাহর প্রতি অপবাদ (মিথ্যা) আরোপ করে অথবা তাঁর নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা বলে, তার চাইতে বড় যালেম কে? নিশ্চয়ই যালেমরা সফলকাম হবে না’ (আন‘আম ২১)।
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,
فَمَنِ افْتَرَى عَلَى اللهِ الْكَذِبَ مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الظَّالِمُوْنَ-
‘অতঃপর আল্লাহর প্রতি যারা মিথ্যা আরোপ করেছে, তারাই যালেম, সীমালংঘনকারী’ (আলে ইমরান ৯৪)।
তিনি আরো বলেন,
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللهِ كَذِباً أَوْ كَذَّبَ بِالْحَقِّ لَمَّا جَاءَهُ أَلَيْسَ فِيْ جَهَنَّمَ مَثْوًى لِّلْكَافِرِيْنَ- وَالَّذِيْنَ جَاهَدُوْا فِيْنَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِيْنَ-
‘যে আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলে অথবা তার কাছে সত্য আসার পর তাকে অস্বীকার করে, তার কি স্মরণ করা উচিত নয় যে, জাহান্নামই সে সব কাফেরের আশ্রয়স্থল হবে। যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎ কর্মপরায়ণদের সাথে আছেন’ (আনকাবূত ৬৮-৬৯)।
সত্যকে নিয়ে প্রতারণার প্রেক্ষাপটে, মিথ্যাবাদীদের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ বলেন,
وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللهُ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِيْنَ- أَمْ حَسِبَ الَّذِيْنَ يَعْمَلُوْنَ السَّيِّئَاتِ أَنْ يَسْبِقُوْنَا سَاءَ مَا يَحْكُمُوْنَ-
‘আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যারা সত্যবাদী এবং নিশ্চয়ই জেনে নিবেন মিথ্যুকদেরকে। যারা মন্দ কাজ করে, তারা কি মনে করে যে, তারা আমার হাত থেকে বেঁচে যাবে? তাদের ফায়ছালা খুবই মন্দ’ (আনকাবূত ৩-৪)।
আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য প্রয়োজন অনুপাতে জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেক-বিবেচনা দান করেছেন। এই জ্ঞানের দ্বারা যারা আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করেছে, তারা অবশ্যই আল্লাহর আশ্রয় লাভ করেছে। শয়তান শত চেষ্টা দ্বারাও এদের কোন ক্ষতি করতে পারে না, এটা প্রমাণিত। পক্ষান্তরে যারা এই জ্ঞানের দ্বারা অনধিকার চর্চায় মত্ত হয়েছে, শয়তান সেখানেই একটা সুন্দর আশ্রয় ও সুযোগ লাভ করেছে। অতঃপর চিত্তাকর্ষক ও লোভনীয় বস্ত্ত সামগ্রী দ্বারা তাদের হৃদয় জয় করে, আল্লাহর পথে অগ্রসর হওয়া স্তব্ধ করে দেয়। মানব জীবনে সমস্ত পাপকর্মের জন্মদাতা শয়তান কোন ব্যক্তিকে বিভিন্ন পাপে আচ্ছাদিত করেও পুরোপুরি স্বস্তি পায় না, যতক্ষণ না তাকে আল্লাহর চরম অসন্তুষ্টির পাপ শিরকে লিপ্ত করতে পারে। কারণ শিরকে লিপ্ত হওয়ার অর্থই আল্লাহদ্রোহীতায় লিপ্ত হওয়া। এক পর্যায়ে এরা আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা রটনাও করে এবং আল্লাহর নিদর্শনকেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। মহাজ্ঞানী আল্লাহ এদেরকে সীমালংঘনকারী ও শ্রেষ্ঠ যালেম বলে ঘোষণা দিয়ে উপরোক্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেছেন।
উক্ত কাফের, যালেম ও অপবাদকারীদেরকে সংশোধন করার সুযোগ হিসাবে যুগে যুগে নবী-রাসূলগণের আগমন ঘটেছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশই আল্লাহ ও নবী-রাসূল উভয়কেই প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহদ্রোহীই থেকে যায়। এদের সম্পর্কে সর্বজ্ঞানী আল্লাহ তাঁর মহাসত্য কিতাবে প্রত্যাদেশ করেন যে,
ثُمَّ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا تَتْرَا كُلَّمَا جَاءَ أُمَّةً رَّسُوْلُهَا كَذَّبُوْهُ فَأَتْبَعْنَا بَعْضَهُمْ بَعْضاً وَجَعَلْنَاهُمْ أَحَادِيْثَ فَبُعْداً لِّقَوْمٍ لاَّ يُؤْمِنُوْنَ-
‘এরপর আমি একাদিক্রমে রাসূল প্রেরণ করেছি। যখনই কোন উম্মতের কাছে তাঁর রাসূল আগমন করেছেন, তখনই তারা তাঁকে মিথ্যাবাদী বলেছে। অতঃপর আমি তাদের একের পর এক ধ্বংস করেছি এবং তাদেরকে কাহিনীর বিষয়ে পরিণত করেছি। সুতরাং ধ্বংস হোক অবিশ্বাসীরা’ (মুমিনূন ৪৪)।
একই মর্মার্থে অন্যত্র মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীব (ছাঃ)-কে বলেন,
قُلْ أَطِيْعُوا اللهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْهِ مَا حُمِّلَ وَعَلَيْكُم مَّا حُمِّلْتُمْ وَإِنْ تُطِيْعُوْهُ تَهْتَدُوْا وَمَا عَلَى الرَّسُوْلِ إِلاَّ الْبَلاَغُ الْمُبِيْنُ-
‘বলুন, আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর। অতঃপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তার উপর ন্যস্ত দায়িত্বের জন্য সে দায়ী এবং তোমাদের উপর ন্যস্ত দায়িত্বের জন্য তোমরা দায়ী। তোমরা যদি তাঁর আনুগত্য কর, তবে সৎপথ পাবে। রাসূলের দায়িত্ব তো কেবল সুস্পষ্টরূপে পৌঁছে দেয়া’ (নূর ৫৪)।
অতঃপর মিথ্যাবাদী বান্দাদের সন্বোধন করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
بَلَى قَدْ جَاءَتْكَ آيَاتِيْ فَكَذَّبْتَ بِهَا وَاسْتَكْبَرْتَ وَكُنْتَ مِنَ الْكَافِرِيْنَ- وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ تَرَى الَّذِيْنَ كَذَبُواْ عَلَى اللهِ وُجُوْهُهُم مُّسْوَدَّةٌ أَلَيْسَ فِيْ جَهَنَّمَ مَثْوًى لِّلْمُتَكَبِّرِيْنَ-
‘হ্যাঁ, তোমার কাছে আমার নির্দেশ এসেছিল। অতঃপর তুমি তাকে মিথ্যা বলেছিলে, অহংকার করেছিলে এবং কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিলে। যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে, ক্বিয়ামতের দিন আপনি তাদের মুখ কালো দেখবেন। অহংকারীদের আবাসস্থল জাহান্নাম নয় কি?’ (যুমার ৫৯-৬০)।
একই বিষয়ে পুনরায় বর্ণিত হয়েছে,
إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا بِالذِّكْرِ لَمَّا جَاءَهُمْ وَإِنَّهُ لَكِتَابٌ عَزِيْزٌ- لاَ يَأْتِيْهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلاَ مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيْلٌ مِّنْ حَكِيْمٍ حَمِيْدٍ- مَا يُقَالُ لَكَ إِلاَّ مَا قَدْ قِيْلَ لِلرُّسُلِ مِنْ قَبْلِكَ إِنَّ رَبَّكَ لَذُوْ مَغْفِرَةٍ وَذُوْ عِقَابٍ أَلِيْمٍ-
‘নিশ্চয়ই যারা কুরআন আসার পর তা অস্বীকার করে, তাদের মধ্যে চিন্তা-ভাবনার অভাব রয়েছে। এটা অবশ্যই এক সম্মানিত গ্রন্থ। এতে মিথ্যার প্রভাব নেই, সামনের দিক থেকেও নেই এবং পিছন দিক থেকেও নেই। এটা প্রজ্ঞাময়, প্রশংসিত আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। আপনাকে তো তাই বলা হয়, যা বলা হ’ত পূর্ববর্তী রাসূলগণকে। নিশ্চয়ই আপনার পালনকর্তার কাছে রয়েছে ক্ষমা এবং রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (হা-মীম-সাজদাহ ৪১-৪৩)।
মিথ্যাবাদীদের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ আরও বলেন,
وَالَّذِيْنَ كَذَّبُواْ بِآيَاتِنَا يَمَسُّهُمُ الْعَذَابُ بِمَا كَانُواْ يَفْسُقُوْنَ-
‘যারা আমার নিদর্শনাবলীকে (আয়াত সমূহকে) মিথ্যা বলে, তাদেরকে তাদের নাফারমানীর কারণে আযাব স্পর্শ করবে’ (আন‘আম ৪৯)।
মানব সৃষ্টির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে অনায়াসেই দৃষ্টিগোচর হবে যে, সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্ব নিয়েই মানুষ প্রথম হ’তেই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। অতঃপর জন্ম-মৃত্যুর ন্যায় প্রতিটি মানুষের মধ্যে সত্য ও মিথ্যার জন্ম-মৃত্যু ঘটছে আবহমানকাল ধরে। জন্ম-মৃত্যু মহাক্ষমতার মালিক আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্ট প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত সত্য। মিথ্যা কখনও এই মহাসত্যের অবমাননা করতে পারবে না। তবে সন্দেহের ধূম্রজাল এঁকে আচ্ছন্ন করে রাখার ব্যাপক কৌশল অবলম্বন করতে পারে মাত্র। যেমন মিথ্যাবাদীদের ধারণা, মৃত্যুর পর তাদের কোন অস্তিত্ব থাকবে না বা পুনরুত্থিত হবে না এবং ক্বিয়ামতও হবে না। এ ধারণার বশবর্তী হয়েই মিথ্যাবাদীরা আল্লাহ ও রাসূলদের অবিশ্বাস ও অস্বীকার করেছে। কিন্তু মিথ্যাবাদীরা যদি তাদের গোড়ার ইতিহাসে ফিরে তাকায় তবে মৃত্যুর পরের চাইতেও তা কঠিন দেখবে। অর্থাৎ মৃত্যুর পরেও কিছু উপাদান থাকে, কিন্তু জন্মের পূর্বে তার কিছুই থাকে না, সামান্য ঘৃণিত পদার্থের সূত্র ধরে কত সুন্দর মানুষের আবির্ভাব হয়। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অসীম সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জ্ঞানের দ্বারা মানব সৃষ্টি করেন, অতঃপর তুচ্ছ মানবের কাছেই অস্বীকৃতি ও অবিশ্বাসের প্রত্যুত্তর লাভ করেন। মহা ধৈর্যশীল আল্লাহ তা‘আলা সীমালংঘনকারী এই সব সম্প্রদায়কে কখনও রেহাই দিবেন না। এদের কাউকে হইজগতেই পাকড়াও করেছেন এবং পরজগতেও পাকড়াও করবেন। আর কিছু সংখ্যককে ইহজগতে সুখভোগের সুযোগ দিয়েছেন, কিন্তু মৃত্যুর মুহূর্ত হ’তেই সাংঘাতিকভাবে পাকড়াও করবেন, এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
পৃথিবীর শেষ অধ্যায়ে মানব জাতির নৈতিক পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার জন্যই পবিত্র কুরআনের ধারক ও বাহক মহানবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আবির্ভাব হয়েছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় জ্ঞান-বিজ্ঞানে ভরপুর মানব সমাজের অনেকেই তাঁকে মিথ্যাবাদী হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। তাদের ভ্রম সংশোধনের জন্যে আল্লাহ তা‘আলা পুনঃপুনঃ প্রত্যাদেশ বাণী প্রেরণ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,
وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقاً وَعَدْلاً لاَّ مُبَدِّلِ لِكَلِمَاتِهِ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ- وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الأَرْضِ يُضِلُّوْكَ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ إِنْ يَتَّبِعُوْنَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَخْرُصُوْنَ-
‘আপনার প্রতিপালকের বাক্য পূর্ণ সত্য ও সুষম। তাঁর বাক্যের কোন পরিবর্তনকারী নেই। তিনিই শ্রবণকারী, মহাজ্ঞানী। আর যদি আপনি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথা মেনে নেন, তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী করে দিবে। তারা শুধু অলীক কল্পনার অনুসরণ করে এবং সম্পূর্ণ অনুমান ভিত্তিক কথাবার্তা বলে থাকে’ (আন‘আম ১১৫-১১৬)।
রাসূল (ছাঃ)-এর সম্পর্কে বাণী হ’ল,
إِذَا جَاءَكَ الْمُنَافِقُوْنَ قَالُوْا نَشْهَدُ إِنَّكَ لَرَسُوْلُ اللهِِ وَاللهُ يَعْلَمُ إِنَّكَ لَرَسُوْلُهُ وَاللهُ يَشْهَدُ إِنَّ الْمُنَافِقِيْنَ لَكَاذِبُوْنَ-
‘মুনাফিকরা আপনার কাছে এসে বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ জানেন যে, আপনি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী’ (মুনাফিকূন ১)।
সূরা ইউনুস-এর ১০৮ নং আয়াতে সর্বজ্ঞ আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীব (ছাঃ)-কে প্রত্যাদেশ করেন,
قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَكُمُ الْحَقُّ مِن رَّبِّكُمْ فَمَنِ اهْتَدَى فَإِنَّمَا يَهْتَدِيْ لِنَفْسِهِ وَمَنْ ضَلَّ فَإِنَّمَا يَضِلُّ عَلَيْهَا وَمَا أَنَاْ عَلَيْكُمْ بِوَكِيْلٍ-
‘বলুন, হে মানবকূল! সত্য তোমাদের কাছে পৌঁছে গেছে তোমাদের পরওয়ারদেগারের তরফ থেকে। এখন যে কেউ পথে আসে সে পথপ্রাপ্ত হয় স্বীয় মঙ্গলের জন্য। আর যে বিভ্রান্ত ঘুরতে থাকে, সে স্বীয় অমঙ্গলের জন্য বিভ্রান্ত অবস্থায় ঘুরতে থাকবে। অনন্তর আমি তোমাদের উপর অধিকারী নই’ (ইউনুস ১০৮)।
একইভাবে অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُواْ اتَّقُوْا اللهَ وَكُوْنُوْا مَعَ الصَّادِقِيْنَ-
‘হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক’ (তওবাহ ১১৯)। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
وَبِالْحَقِّ أَنْزَلْنَاهُ وَبِالْحَقِّ نَزَلَ وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلاَّ مُبَشِّراً وَنَذِيْراً-
‘আমি সত্যসহ এ কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং সত্যসহ এটা অবতীর্ণ হয়েছে। আমি তো আপনাকে শুধু সুসংবাদদাতা ও ভয়প্রদর্শক করেই প্রেরণ করেছি’ (বনী ইসরাঈল ১০৫)।
মানুষ হ’ল প্রেমময় আল্লাহর ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ শ্রেষ্ঠ জ্ঞান সম্পন্ন প্রাণী। তাই মানুষ বার বার ভুল করলে বা অন্যায় করলেও আল্লাহ তাকে সংশোধন করতে চান, ভাল করতে চান। এজন্যে উত্তম ব্যবহারের প্রতীক হিসাবে মহানবী (ছাঃ)-কে নবুওয়াত দিয়ে তাদের কাছে প্রেরণ করেন। মহানবী (ছাঃ) তাঁর অসাধারণ মানবত্ব দ্বারা আল্লাহর অমীয় বাণী নিয়ে লোকদের মাঝে আল্লাহর প্রেমের বাণী, হেদায়াতের বাণী, ভীতির বাণীসহ পবিত্র সত্যময় ইসলামের বাণী প্রচার করতে থাকেন। উপরের আয়াতগুলোতে আল্লাহর প্রসংশিত বাণী সম্বলিত পবিত্র কুরআনের সত্যতা এবং মহানবী (ছাঃ)-এর সত্যতার কথাও পুনঃ পুনঃ ঘোষিত হয়েছে। মিথ্যাকে দুর্বল হ’তে দুর্বলতর করে সত্যের জয়ধ্বনিকে মহাউন্নত করাই এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
এখানে সত্য ও অসত্যের প্রতিযোগিতায় সত্যের জয়যাত্রা তুলে ধরা হয়েছে এবং আল্লাহ ঘোষিত যে কোন বাক্যকে সকল সত্যের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর বাণী অমর ও অপরিবর্তনীয় এবং তাঁর প্রিয় রাসূলের রাণীও তদ্রূপ বলে স্বীকৃত হয়েছে। মহাজ্ঞানী আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় রাসূলকে পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের মিথ্যা বাণী মেনে নিতে নিষেধ করেছেন। এতদ্ব্যতীত প্রতারক ও মিথ্যুক মুনাফেকদের মিথ্যাচারিতার কথাও অদৃশ্যের জ্ঞাতা আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন। অতঃপর বিশ্ববাসীর প্রতি সত্যের আহবান জানাবার জন্য বিশ্বনবীর উপর পুনঃ পুনঃ প্রত্যাদেশ আসতে থাকে। এক পর্যায়ে সমগ্র বিশ্ববাসীর প্রতি ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যে মহাপ্রজ্ঞাময় আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যাদেশ করেন,
وَلَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيْرًا مِّنَ الْجِنِّ وَالإِنْسِ لَهُمْ قُلُوْبٌ لاَّ يَفْقَهُوْنَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لاَّ يُبْصِرُوْنَ بِهَا وَلَهُمْ آذَانٌ لاَّ يَسْمَعُوْنَ بِهَا أُوْلَـئِكَ كَالأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُوْلَـئِكَ هُمُ الْغَافِلُوْنَ-
‘আর আমি সৃষ্টি করেছি জাহান্নামের জন্য বহু জিন ও মানুষ। তাদের অন্তর রয়েছে, কিন্তু তার দ্বারা বিবেচনা করে না, তাদের চোখ রয়েছে, তার দ্বারা দেখে না, তাদের কান রয়েছে, তার দ্বারা শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত, বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারাই হ’ল গাফেল, শৈথিল্যপরায়ণ’ (আ‘রাফ ১৭৯)।
একই বিষয় অন্য জায়গায় আল্লাহ বলেন,
وَلَوْ شِئْنَا لَآتَيْنَا كُلَّ نَفْسٍ هُدَاهَا وَلَكِنْ حَقَّ الْقَوْلُ مِنِّيْ لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِيْنَ-
‘আমার এ উক্তি অবধারিত সত্য যে, আমি জিন ও মানব সকলকে দিয়ে অবশ্যই জাহান্নাম পূর্ণ করব’ (সিজদাহ ১৩)।
মানব সম্প্রদায়ের উপর ভীতি প্রদর্শন মূলক সর্বশেষ বাণী দ্বারা মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মহাক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে মানব ও জিন জাতিকে সত্যের অবমাননার জন্য জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়ার সংবাদ পরিবেশন করেন। উপরের আয়াত দু’টির প্রথমটিতে অভিযোগের সুরে বলেন, মানুষের মনুষ্য উপযোগী অন্তর আছে, বিবেক আছে, চোখ আছে, কান আছে, কিন্তু এগুলো তারা কাজে না লাগিয়ে চতুষ্পদ জন্তুর মত আচরণ করে। শেষোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাঁর বাণীকে অবধারিত সত্য বলে ঘোষণা দিয়ে মানুষ ও জিন জাতির দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
পূর্বে উল্লেখ করেছি, আল্লাহর মহাসত্য বাণী ‘অমর ও অপরিবর্তিত। নিম্নোক্ত আয়াতেও সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘আমার উক্তি অবধারিত সত্য’ (সাজদা ১৩)। সুতরাং সত্যকে অস্বীকার, অবিশ্বাস ও অবমাননার জন্যই মানব জাতিকে তাদের শেষ পরিণতির কথা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। বস্ত্ততঃ সমগ্র কুরআনে আল্লাহর আদেশ, নির্দেশ, ঘোষণা ইত্যাদির শতভাগই মহাসত্যের অন্তর্ভুক্ত। আর সকল সত্যের অধিকাংশই আল্লাহর ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতির মধ্যে গণ্য। এ ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতিকেও আল্লাহ অব্যর্থ সত্য বলে আয়াত অবতীর্ণ করেন। মহান আল্লাহ বলেন,
فَاصْبِرْ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ وَلَا يَسْتَخِفَّنَّكَ الَّذِيْنَ لاَ يُوْقِنُوْنَ-
‘আপনি ছবর করুন! আল্লাহর ওয়াদা সত্য। যারা বিশ্বাসী নয়, তারা যেন আপনাকে বিচলিত করতে না পারে’ (রূম ৬০)।
পরবর্তী সূরা লোক্বমানে আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمْ وَاخْشَوْا يَوْماً لاَّ يَجْزِيْ وَالِدٌ عَنْ وَلَدِهِ وَلَا مَوْلُوْدٌ هُوَ جَازٍ عَنْ وَالِدِهِ شَيْئاً إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ فَلاَ تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَلَا يَغُرَّنَّكُم بِاللَّهِ الْغَرُوْرُ-
‘হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর এবং ভয় কর এমন এক দিবসকে, যখন পিতা পুত্রের কোন কাজে আসবে না এবং পুত্রও তার পিতার কোন উপকার করতে পারবে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহর ওয়াদা সত্য। অতএব পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে ধোঁকা না দেয় এবং আল্লাহ সম্পর্কে প্রতারক শয়তান যেন তোমাদেরকে প্রতারিত না করে’ (লোক্বমান ৩৩)।
উপরের আলোচনার ধারাবাহিকতায় সত্য ও মিথ্যার যে পার্থক্য সূচিত হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা খুবই কঠিন। কারণ সত্য হ’ল বাস্তব (দৃশ্য), আর মিথ্যা হ’ল অবাস্তব (অদৃশ্য)। বাস্তব ও অবাস্তবের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই। সুতরাং সত্য ও মিথ্যার মধ্যেও কোন সম্পর্ক নেই। আবার সত্য ও মিথ্যার মধ্যে আপোষ হওয়ারও কোন সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ সত্য ও মিথ্যার সংমিশ্রণ দ্বারা কোন নতুনত্বের সম্ভাবনাও বাতিল বলে গণ্য। পার্থিব জগতে সত্য ও মিথ্যার যে মিশ্রণ অব্যাহত আছে, তা আল্লাহর সন্তুষ্টির বিষয় নয়, এটা শুধু মুনাফিক বা অবিশ্বাসীদের অভিজ্ঞতার ফলাফল মাত্র। আসলে ইহজগতে সত্য ও মিথ্যার ন্যায় বহু সমস্যা সংকুল বিষয় আছে, যেগুলোর একত্রীকরণ বা সংমিশ্রণ অবিশ্বাস, অকল্পনীয় ও অবর্ণনীয়। উদাহরণতঃ খাদ্যের ও অখাদ্যের মিশ্রণ, পানীয় ও অপানীয়র মিশ্রণ, আগুন ও পানির মিশ্রণ, পূর্ণাঙ্গ ও অপূর্ণাঙ্গ (পঙ্গু)-র মিশ্রণ, প্রাচ্য ও প্রতিচ্যের মিশ্রণ, আকাশ ও পাতালের মিশ্রণ সুগন্ধ ও দুর্গন্ধের মিশ্রণ যেমন অসম্ভব, ঠিক সত্য ও মিথ্যাকে মিশ্রিত করাও তদ্রূপ অসম্ভব, অকল্পনীয় ও অবর্ণনীয়। মহান আল্লাহ বলেন,
وَلاَ تَلْبِسُواْ الْحَقَّ بِالْبَاطِلِ وَتَكْتُمُواْ الْحَقَّ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ-
‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না এবং জানা সত্ত্বেও সত্যকে গোপন করো না’ (বাক্বারাহ ৪২)।
আলোচ্য সূরায় সত্যের অনুকূলে পুনরায় প্রত্যাদেশ হয়েছে যে, الْحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَلاَ تَكُوْنَنَّ مِنَ الْمُمْتَرِيْنَ ‘বাস্তব সত্য সেটাই যা আপনার পালনকর্তা বলেন। কাজেই আপনি সন্দিহান হবেন না’ (বাক্বারাহ ১৪৭)।
সত্যের অনুকূলে পুনরায় বর্ণিত হয়েছে,
قُل لاَّ يَسْتَوِي الْخَبِيْثُ وَالطَّيِّبُ وَلَوْ أَعْجَبَكَ كَثْرَةُ الْخَبِيْثِ فَاتَّقُواْ اللّهَ يَا أُوْلِي الأَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ-
‘বলেদিন অপবিত্র ও পবিত্র সমান নয়, যদিও অপবিত্রের প্রাচুর্য আপনাকে বিস্মিত করে। অতএব হে বুদ্ধিমানগণ! আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা মুক্তি পাও’ (মায়েদাহ ১০০)।
সাধারণভাবে আজ আমরা সত্য ও মিথ্যা বলতে যা জানি বা বুঝি, তা মানুষের চিরাচরিত অভ্যাস মাত্র। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অসীম জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ, বিশ্বশ্রেষ্ঠ মহা সম্মানিত মহাগ্রন্থ আল-কুরআন এবং কুরআনের নির্দেশিত পবিত্র ইসলাম ধর্ম সত্যের এক মহাপ্রতীক। তাছাড়া ‘সত্য’ দ্বীন ইসলামের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এখানে মিথ্যা অনুপ্রবেশের কোন অবকাশ নেই, তবে কৃত্রিম কৌশল অবলম্বন করার সুযোগ রয়েছে- যা নিঃসন্দেহে ইসলাম ধর্মের পরিপন্থী। এমতাবস্থায় ইসলামের শ্রেষ্ঠ সত্য ও তথ্যের উৎস কুরআনের সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। এজন্যে করুণাময় ও দয়াশীল আল্লাহ তা‘আলার আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে আগামী সত্য দিনের উপর পবিত্রতা রক্ষার তাওফীক দান করুন।- আমীন! -
এ নশ্বর জগতে জীবন যাপনে সত্য-মিথ্যার ন্যায় আরও বহু বিপরীতধর্মী বিষয় বিদ্যমান, তন্মধ্যে কয়েকটি হ’ল, ধর্ম-অধর্ম, ভাল-মন্দ, সৎ-অসৎ, ন্যায়-অন্যায়, সুবিচার-অবিচার, কল্যাণ-অকল্যাণ, শান্তি-অশান্তি, জন্ম-মৃত্যু, আকাশ-পাতাল, হাসি-কান্না, আলো-অন্ধকার, উত্তম-অধম, সম্ভব-অসম্ভব, উত্তীর্ণ-অনুত্তীর্ণ, কৃতকার্য-অকৃতকার্য ইত্যাদি। তবে মানব জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য এবং আধ্যাত্মিক বিজয় অর্জনের প্রক্রিয়ায় সত্য ও মিথ্যার ভূমিকা সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি ধর্মীয় জীবন-যাপনে সত্যের কোন বিকল্প নেই। তবুও অলৌকিক উপায়েই সত্যের বিপরীতে মিথ্যা জন্ম লাভ করেছে। মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানব প্রতিনিধিকে সত্য ও মিথ্যা নির্ণয় করার জ্ঞান-বুদ্ধির পক্ষে বিপক্ষে অসংখ্য বাণী অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّ هـذَا لَهُوَ الْقَصَصُ الْحَقُّ وَمَا مِنْ إِلـهٍ إِلاَّ اللهُ وَإِنَّ اللهَ لَهُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ- ‘নিঃসন্দেহে এটাই হ’ল সত্য ভাষণ। এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ (উপাস্য) নেই। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ, তিনিই হ’লেন পরাক্রমশালী মহাপ্রাজ্ঞ’ (আলে ইমরান ৬২)।
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, ذَلِكَ بِأَنَّ اللهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِهِ الْبَاطِلُ وَأَنَّ اللهَ هُوَ الْعَلِيُّ الْكَبِيْرُ- ‘এটাই প্রমাণ যে, আল্লাহই সত্য এবং আল্লাহ ব্যতীত তারা যাদের পূজা করে সব মিথ্যা। আল্লাহ সর্বোচ্চ মহান’ (লোক্বমান ৩০)।
একই ভাবার্থে পুনরায় আল্লাহ প্রত্যাদেশ করেন,
ذَلِكَ بِأَنَّ اللهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِهِ هُوَ الْبَاطِلُ وَأَنَّ اللهَ هُوَ الْعَلِيُّ الْكَبِيْرُ-
‘আল্লাহই সত্য, আর তাঁর পরিবর্তে তারা যাকে ডাকে, তা অসত্য এবং আল্লাহই সবার উচ্চে, মহান’ (হজ্জ ৬২)।
আলোচ্য বিষয়ের প্রমাণে ঈষৎ পরিবর্তিত আকারে মহান আল্লাহ বলেন,
وَالَّذِيْ جَاءَ بِالصِّدْقِ وَصَدَّقَ بِهِ أُوْلَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُوْنَ-
‘যারা সত্য নিয়ে আগমন করেছে এবং সত্যকে সত্য মেনে নিয়েছে তারাই তো আল্লাহভীরু’ (যুমার ৩৩)।
সত্যের অনুকূলে মহান আল্লাহ আরও বলেন,
وَيُحِقُّ اللهُ الْحَقَّ بِكَلِمَاتِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُجْرِمُوْنَ-
‘আল্লাহ সত্যকে সত্যে পরিণত করেন স্বীয় নির্দেশে, যদিও পাপীদের তা মনঃপূত নয়’ (ইউনুস ৮২)।
নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী ও বহির্ভূত দৃশ্য অদৃশ্য সবার উপরে আল্লাহ সত্য, তাঁর উপরে কেউ নেই। এই মহা সত্যের আলোচনায় উপরের আয়াতগুলো উপস্থাপিত হ’ল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, সত্যের মূলে কুঠারাঘাত করার জন্যই মিথ্যার উদ্ভব হয়েছে এবং মিথ্যার কর্ণধার হিসাবে শয়তানের আবেদন নিবেদন অনুমোদিত হয়েছে মহান আল্লাহর দরবারে। শয়তানের এই আবেদন ছিল, মূলতঃ কৃত্রিমভাবে অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন হয়ে মানব জাতিকে সত্যের পথে বাধাগ্রস্ত করা, যা মানব জাতির অজ্ঞাত নয়। বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যতের মালিক মহাপরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহ তা‘আলা উদভূত পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মহাব্যবস্থাকল্পেই তাঁর প্রতি অবিচল থাকার জন্য বিভিন্নভাবে নির্দেশ প্রদান করেন।
এক ও অদ্বিতীয় মহাপবিত্র সত্তা আল্লাহকে অকৃত্রিমভাবে সর্বান্তকরণে সত্যরূপে গ্রহণ করা, পক্ষান্তরে এই সুন্দরতম ধারণাকে শয়তানের প্ররোচনায় সন্দেহ বা মিথ্যায় রূপান্তরিত করার চক্রান্ত হ’তে মুক্তির প্রয়াসেই সত্য-মিথ্যা অভিযানের অবতারণা।
সত্যের মধ্যে মিথ্যার অনুপ্রবেশ, বিশেষ করে আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে মিথ্যা চিন্তা বা মিথ্যা রচনার কথা একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির পক্ষে কল্পনা করাও সম্পূর্ণ অসম্ভব। অথচ শয়তান এরূপ গর্হিত ও অবিশ্বাস্য কাজেও সুযোগমত কোন কোন বান্দার মধ্যে ইন্ধন যুগিয়ে থাকে। মহান আল্লাহ বলেন,
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللهِ كَذِباً أَوْ كَذَّبَ بِآيَاتِهِ إِنَّهُ لاَ يُفْلِحُ الظَّالِمُوْنَ-
‘যে আল্লাহর প্রতি অপবাদ (মিথ্যা) আরোপ করে অথবা তাঁর নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা বলে, তার চাইতে বড় যালেম কে? নিশ্চয়ই যালেমরা সফলকাম হবে না’ (আন‘আম ২১)।
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,
فَمَنِ افْتَرَى عَلَى اللهِ الْكَذِبَ مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الظَّالِمُوْنَ-
‘অতঃপর আল্লাহর প্রতি যারা মিথ্যা আরোপ করেছে, তারাই যালেম, সীমালংঘনকারী’ (আলে ইমরান ৯৪)।
তিনি আরো বলেন,
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللهِ كَذِباً أَوْ كَذَّبَ بِالْحَقِّ لَمَّا جَاءَهُ أَلَيْسَ فِيْ جَهَنَّمَ مَثْوًى لِّلْكَافِرِيْنَ- وَالَّذِيْنَ جَاهَدُوْا فِيْنَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِيْنَ-
‘যে আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলে অথবা তার কাছে সত্য আসার পর তাকে অস্বীকার করে, তার কি স্মরণ করা উচিত নয় যে, জাহান্নামই সে সব কাফেরের আশ্রয়স্থল হবে। যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎ কর্মপরায়ণদের সাথে আছেন’ (আনকাবূত ৬৮-৬৯)।
সত্যকে নিয়ে প্রতারণার প্রেক্ষাপটে, মিথ্যাবাদীদের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ বলেন,
وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللهُ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِيْنَ- أَمْ حَسِبَ الَّذِيْنَ يَعْمَلُوْنَ السَّيِّئَاتِ أَنْ يَسْبِقُوْنَا سَاءَ مَا يَحْكُمُوْنَ-
‘আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যারা সত্যবাদী এবং নিশ্চয়ই জেনে নিবেন মিথ্যুকদেরকে। যারা মন্দ কাজ করে, তারা কি মনে করে যে, তারা আমার হাত থেকে বেঁচে যাবে? তাদের ফায়ছালা খুবই মন্দ’ (আনকাবূত ৩-৪)।
আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য প্রয়োজন অনুপাতে জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেক-বিবেচনা দান করেছেন। এই জ্ঞানের দ্বারা যারা আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করেছে, তারা অবশ্যই আল্লাহর আশ্রয় লাভ করেছে। শয়তান শত চেষ্টা দ্বারাও এদের কোন ক্ষতি করতে পারে না, এটা প্রমাণিত। পক্ষান্তরে যারা এই জ্ঞানের দ্বারা অনধিকার চর্চায় মত্ত হয়েছে, শয়তান সেখানেই একটা সুন্দর আশ্রয় ও সুযোগ লাভ করেছে। অতঃপর চিত্তাকর্ষক ও লোভনীয় বস্ত্ত সামগ্রী দ্বারা তাদের হৃদয় জয় করে, আল্লাহর পথে অগ্রসর হওয়া স্তব্ধ করে দেয়। মানব জীবনে সমস্ত পাপকর্মের জন্মদাতা শয়তান কোন ব্যক্তিকে বিভিন্ন পাপে আচ্ছাদিত করেও পুরোপুরি স্বস্তি পায় না, যতক্ষণ না তাকে আল্লাহর চরম অসন্তুষ্টির পাপ শিরকে লিপ্ত করতে পারে। কারণ শিরকে লিপ্ত হওয়ার অর্থই আল্লাহদ্রোহীতায় লিপ্ত হওয়া। এক পর্যায়ে এরা আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা রটনাও করে এবং আল্লাহর নিদর্শনকেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। মহাজ্ঞানী আল্লাহ এদেরকে সীমালংঘনকারী ও শ্রেষ্ঠ যালেম বলে ঘোষণা দিয়ে উপরোক্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেছেন।
উক্ত কাফের, যালেম ও অপবাদকারীদেরকে সংশোধন করার সুযোগ হিসাবে যুগে যুগে নবী-রাসূলগণের আগমন ঘটেছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশই আল্লাহ ও নবী-রাসূল উভয়কেই প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহদ্রোহীই থেকে যায়। এদের সম্পর্কে সর্বজ্ঞানী আল্লাহ তাঁর মহাসত্য কিতাবে প্রত্যাদেশ করেন যে,
ثُمَّ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا تَتْرَا كُلَّمَا جَاءَ أُمَّةً رَّسُوْلُهَا كَذَّبُوْهُ فَأَتْبَعْنَا بَعْضَهُمْ بَعْضاً وَجَعَلْنَاهُمْ أَحَادِيْثَ فَبُعْداً لِّقَوْمٍ لاَّ يُؤْمِنُوْنَ-
‘এরপর আমি একাদিক্রমে রাসূল প্রেরণ করেছি। যখনই কোন উম্মতের কাছে তাঁর রাসূল আগমন করেছেন, তখনই তারা তাঁকে মিথ্যাবাদী বলেছে। অতঃপর আমি তাদের একের পর এক ধ্বংস করেছি এবং তাদেরকে কাহিনীর বিষয়ে পরিণত করেছি। সুতরাং ধ্বংস হোক অবিশ্বাসীরা’ (মুমিনূন ৪৪)।
একই মর্মার্থে অন্যত্র মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীব (ছাঃ)-কে বলেন,
قُلْ أَطِيْعُوا اللهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْهِ مَا حُمِّلَ وَعَلَيْكُم مَّا حُمِّلْتُمْ وَإِنْ تُطِيْعُوْهُ تَهْتَدُوْا وَمَا عَلَى الرَّسُوْلِ إِلاَّ الْبَلاَغُ الْمُبِيْنُ-
‘বলুন, আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর। অতঃপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তার উপর ন্যস্ত দায়িত্বের জন্য সে দায়ী এবং তোমাদের উপর ন্যস্ত দায়িত্বের জন্য তোমরা দায়ী। তোমরা যদি তাঁর আনুগত্য কর, তবে সৎপথ পাবে। রাসূলের দায়িত্ব তো কেবল সুস্পষ্টরূপে পৌঁছে দেয়া’ (নূর ৫৪)।
অতঃপর মিথ্যাবাদী বান্দাদের সন্বোধন করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
بَلَى قَدْ جَاءَتْكَ آيَاتِيْ فَكَذَّبْتَ بِهَا وَاسْتَكْبَرْتَ وَكُنْتَ مِنَ الْكَافِرِيْنَ- وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ تَرَى الَّذِيْنَ كَذَبُواْ عَلَى اللهِ وُجُوْهُهُم مُّسْوَدَّةٌ أَلَيْسَ فِيْ جَهَنَّمَ مَثْوًى لِّلْمُتَكَبِّرِيْنَ-
‘হ্যাঁ, তোমার কাছে আমার নির্দেশ এসেছিল। অতঃপর তুমি তাকে মিথ্যা বলেছিলে, অহংকার করেছিলে এবং কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিলে। যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে, ক্বিয়ামতের দিন আপনি তাদের মুখ কালো দেখবেন। অহংকারীদের আবাসস্থল জাহান্নাম নয় কি?’ (যুমার ৫৯-৬০)।
একই বিষয়ে পুনরায় বর্ণিত হয়েছে,
إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا بِالذِّكْرِ لَمَّا جَاءَهُمْ وَإِنَّهُ لَكِتَابٌ عَزِيْزٌ- لاَ يَأْتِيْهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلاَ مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيْلٌ مِّنْ حَكِيْمٍ حَمِيْدٍ- مَا يُقَالُ لَكَ إِلاَّ مَا قَدْ قِيْلَ لِلرُّسُلِ مِنْ قَبْلِكَ إِنَّ رَبَّكَ لَذُوْ مَغْفِرَةٍ وَذُوْ عِقَابٍ أَلِيْمٍ-
‘নিশ্চয়ই যারা কুরআন আসার পর তা অস্বীকার করে, তাদের মধ্যে চিন্তা-ভাবনার অভাব রয়েছে। এটা অবশ্যই এক সম্মানিত গ্রন্থ। এতে মিথ্যার প্রভাব নেই, সামনের দিক থেকেও নেই এবং পিছন দিক থেকেও নেই। এটা প্রজ্ঞাময়, প্রশংসিত আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। আপনাকে তো তাই বলা হয়, যা বলা হ’ত পূর্ববর্তী রাসূলগণকে। নিশ্চয়ই আপনার পালনকর্তার কাছে রয়েছে ক্ষমা এবং রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (হা-মীম-সাজদাহ ৪১-৪৩)।
মিথ্যাবাদীদের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ আরও বলেন,
وَالَّذِيْنَ كَذَّبُواْ بِآيَاتِنَا يَمَسُّهُمُ الْعَذَابُ بِمَا كَانُواْ يَفْسُقُوْنَ-
‘যারা আমার নিদর্শনাবলীকে (আয়াত সমূহকে) মিথ্যা বলে, তাদেরকে তাদের নাফারমানীর কারণে আযাব স্পর্শ করবে’ (আন‘আম ৪৯)।
মানব সৃষ্টির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে অনায়াসেই দৃষ্টিগোচর হবে যে, সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্ব নিয়েই মানুষ প্রথম হ’তেই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। অতঃপর জন্ম-মৃত্যুর ন্যায় প্রতিটি মানুষের মধ্যে সত্য ও মিথ্যার জন্ম-মৃত্যু ঘটছে আবহমানকাল ধরে। জন্ম-মৃত্যু মহাক্ষমতার মালিক আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্ট প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত সত্য। মিথ্যা কখনও এই মহাসত্যের অবমাননা করতে পারবে না। তবে সন্দেহের ধূম্রজাল এঁকে আচ্ছন্ন করে রাখার ব্যাপক কৌশল অবলম্বন করতে পারে মাত্র। যেমন মিথ্যাবাদীদের ধারণা, মৃত্যুর পর তাদের কোন অস্তিত্ব থাকবে না বা পুনরুত্থিত হবে না এবং ক্বিয়ামতও হবে না। এ ধারণার বশবর্তী হয়েই মিথ্যাবাদীরা আল্লাহ ও রাসূলদের অবিশ্বাস ও অস্বীকার করেছে। কিন্তু মিথ্যাবাদীরা যদি তাদের গোড়ার ইতিহাসে ফিরে তাকায় তবে মৃত্যুর পরের চাইতেও তা কঠিন দেখবে। অর্থাৎ মৃত্যুর পরেও কিছু উপাদান থাকে, কিন্তু জন্মের পূর্বে তার কিছুই থাকে না, সামান্য ঘৃণিত পদার্থের সূত্র ধরে কত সুন্দর মানুষের আবির্ভাব হয়। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অসীম সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জ্ঞানের দ্বারা মানব সৃষ্টি করেন, অতঃপর তুচ্ছ মানবের কাছেই অস্বীকৃতি ও অবিশ্বাসের প্রত্যুত্তর লাভ করেন। মহা ধৈর্যশীল আল্লাহ তা‘আলা সীমালংঘনকারী এই সব সম্প্রদায়কে কখনও রেহাই দিবেন না। এদের কাউকে হইজগতেই পাকড়াও করেছেন এবং পরজগতেও পাকড়াও করবেন। আর কিছু সংখ্যককে ইহজগতে সুখভোগের সুযোগ দিয়েছেন, কিন্তু মৃত্যুর মুহূর্ত হ’তেই সাংঘাতিকভাবে পাকড়াও করবেন, এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
পৃথিবীর শেষ অধ্যায়ে মানব জাতির নৈতিক পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার জন্যই পবিত্র কুরআনের ধারক ও বাহক মহানবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আবির্ভাব হয়েছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় জ্ঞান-বিজ্ঞানে ভরপুর মানব সমাজের অনেকেই তাঁকে মিথ্যাবাদী হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। তাদের ভ্রম সংশোধনের জন্যে আল্লাহ তা‘আলা পুনঃপুনঃ প্রত্যাদেশ বাণী প্রেরণ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,
وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقاً وَعَدْلاً لاَّ مُبَدِّلِ لِكَلِمَاتِهِ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ- وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الأَرْضِ يُضِلُّوْكَ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ إِنْ يَتَّبِعُوْنَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَخْرُصُوْنَ-
‘আপনার প্রতিপালকের বাক্য পূর্ণ সত্য ও সুষম। তাঁর বাক্যের কোন পরিবর্তনকারী নেই। তিনিই শ্রবণকারী, মহাজ্ঞানী। আর যদি আপনি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথা মেনে নেন, তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী করে দিবে। তারা শুধু অলীক কল্পনার অনুসরণ করে এবং সম্পূর্ণ অনুমান ভিত্তিক কথাবার্তা বলে থাকে’ (আন‘আম ১১৫-১১৬)।
রাসূল (ছাঃ)-এর সম্পর্কে বাণী হ’ল,
إِذَا جَاءَكَ الْمُنَافِقُوْنَ قَالُوْا نَشْهَدُ إِنَّكَ لَرَسُوْلُ اللهِِ وَاللهُ يَعْلَمُ إِنَّكَ لَرَسُوْلُهُ وَاللهُ يَشْهَدُ إِنَّ الْمُنَافِقِيْنَ لَكَاذِبُوْنَ-
‘মুনাফিকরা আপনার কাছে এসে বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ জানেন যে, আপনি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী’ (মুনাফিকূন ১)।
সূরা ইউনুস-এর ১০৮ নং আয়াতে সর্বজ্ঞ আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীব (ছাঃ)-কে প্রত্যাদেশ করেন,
قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَكُمُ الْحَقُّ مِن رَّبِّكُمْ فَمَنِ اهْتَدَى فَإِنَّمَا يَهْتَدِيْ لِنَفْسِهِ وَمَنْ ضَلَّ فَإِنَّمَا يَضِلُّ عَلَيْهَا وَمَا أَنَاْ عَلَيْكُمْ بِوَكِيْلٍ-
‘বলুন, হে মানবকূল! সত্য তোমাদের কাছে পৌঁছে গেছে তোমাদের পরওয়ারদেগারের তরফ থেকে। এখন যে কেউ পথে আসে সে পথপ্রাপ্ত হয় স্বীয় মঙ্গলের জন্য। আর যে বিভ্রান্ত ঘুরতে থাকে, সে স্বীয় অমঙ্গলের জন্য বিভ্রান্ত অবস্থায় ঘুরতে থাকবে। অনন্তর আমি তোমাদের উপর অধিকারী নই’ (ইউনুস ১০৮)।
একইভাবে অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُواْ اتَّقُوْا اللهَ وَكُوْنُوْا مَعَ الصَّادِقِيْنَ-
‘হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক’ (তওবাহ ১১৯)। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
وَبِالْحَقِّ أَنْزَلْنَاهُ وَبِالْحَقِّ نَزَلَ وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلاَّ مُبَشِّراً وَنَذِيْراً-
‘আমি সত্যসহ এ কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং সত্যসহ এটা অবতীর্ণ হয়েছে। আমি তো আপনাকে শুধু সুসংবাদদাতা ও ভয়প্রদর্শক করেই প্রেরণ করেছি’ (বনী ইসরাঈল ১০৫)।
মানুষ হ’ল প্রেমময় আল্লাহর ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ শ্রেষ্ঠ জ্ঞান সম্পন্ন প্রাণী। তাই মানুষ বার বার ভুল করলে বা অন্যায় করলেও আল্লাহ তাকে সংশোধন করতে চান, ভাল করতে চান। এজন্যে উত্তম ব্যবহারের প্রতীক হিসাবে মহানবী (ছাঃ)-কে নবুওয়াত দিয়ে তাদের কাছে প্রেরণ করেন। মহানবী (ছাঃ) তাঁর অসাধারণ মানবত্ব দ্বারা আল্লাহর অমীয় বাণী নিয়ে লোকদের মাঝে আল্লাহর প্রেমের বাণী, হেদায়াতের বাণী, ভীতির বাণীসহ পবিত্র সত্যময় ইসলামের বাণী প্রচার করতে থাকেন। উপরের আয়াতগুলোতে আল্লাহর প্রসংশিত বাণী সম্বলিত পবিত্র কুরআনের সত্যতা এবং মহানবী (ছাঃ)-এর সত্যতার কথাও পুনঃ পুনঃ ঘোষিত হয়েছে। মিথ্যাকে দুর্বল হ’তে দুর্বলতর করে সত্যের জয়ধ্বনিকে মহাউন্নত করাই এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
এখানে সত্য ও অসত্যের প্রতিযোগিতায় সত্যের জয়যাত্রা তুলে ধরা হয়েছে এবং আল্লাহ ঘোষিত যে কোন বাক্যকে সকল সত্যের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর বাণী অমর ও অপরিবর্তনীয় এবং তাঁর প্রিয় রাসূলের রাণীও তদ্রূপ বলে স্বীকৃত হয়েছে। মহাজ্ঞানী আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় রাসূলকে পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের মিথ্যা বাণী মেনে নিতে নিষেধ করেছেন। এতদ্ব্যতীত প্রতারক ও মিথ্যুক মুনাফেকদের মিথ্যাচারিতার কথাও অদৃশ্যের জ্ঞাতা আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন। অতঃপর বিশ্ববাসীর প্রতি সত্যের আহবান জানাবার জন্য বিশ্বনবীর উপর পুনঃ পুনঃ প্রত্যাদেশ আসতে থাকে। এক পর্যায়ে সমগ্র বিশ্ববাসীর প্রতি ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যে মহাপ্রজ্ঞাময় আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যাদেশ করেন,
وَلَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيْرًا مِّنَ الْجِنِّ وَالإِنْسِ لَهُمْ قُلُوْبٌ لاَّ يَفْقَهُوْنَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لاَّ يُبْصِرُوْنَ بِهَا وَلَهُمْ آذَانٌ لاَّ يَسْمَعُوْنَ بِهَا أُوْلَـئِكَ كَالأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُوْلَـئِكَ هُمُ الْغَافِلُوْنَ-
‘আর আমি সৃষ্টি করেছি জাহান্নামের জন্য বহু জিন ও মানুষ। তাদের অন্তর রয়েছে, কিন্তু তার দ্বারা বিবেচনা করে না, তাদের চোখ রয়েছে, তার দ্বারা দেখে না, তাদের কান রয়েছে, তার দ্বারা শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত, বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারাই হ’ল গাফেল, শৈথিল্যপরায়ণ’ (আ‘রাফ ১৭৯)।
একই বিষয় অন্য জায়গায় আল্লাহ বলেন,
وَلَوْ شِئْنَا لَآتَيْنَا كُلَّ نَفْسٍ هُدَاهَا وَلَكِنْ حَقَّ الْقَوْلُ مِنِّيْ لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِيْنَ-
‘আমার এ উক্তি অবধারিত সত্য যে, আমি জিন ও মানব সকলকে দিয়ে অবশ্যই জাহান্নাম পূর্ণ করব’ (সিজদাহ ১৩)।
মানব সম্প্রদায়ের উপর ভীতি প্রদর্শন মূলক সর্বশেষ বাণী দ্বারা মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মহাক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে মানব ও জিন জাতিকে সত্যের অবমাননার জন্য জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়ার সংবাদ পরিবেশন করেন। উপরের আয়াত দু’টির প্রথমটিতে অভিযোগের সুরে বলেন, মানুষের মনুষ্য উপযোগী অন্তর আছে, বিবেক আছে, চোখ আছে, কান আছে, কিন্তু এগুলো তারা কাজে না লাগিয়ে চতুষ্পদ জন্তুর মত আচরণ করে। শেষোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাঁর বাণীকে অবধারিত সত্য বলে ঘোষণা দিয়ে মানুষ ও জিন জাতির দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
পূর্বে উল্লেখ করেছি, আল্লাহর মহাসত্য বাণী ‘অমর ও অপরিবর্তিত। নিম্নোক্ত আয়াতেও সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘আমার উক্তি অবধারিত সত্য’ (সাজদা ১৩)। সুতরাং সত্যকে অস্বীকার, অবিশ্বাস ও অবমাননার জন্যই মানব জাতিকে তাদের শেষ পরিণতির কথা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। বস্ত্ততঃ সমগ্র কুরআনে আল্লাহর আদেশ, নির্দেশ, ঘোষণা ইত্যাদির শতভাগই মহাসত্যের অন্তর্ভুক্ত। আর সকল সত্যের অধিকাংশই আল্লাহর ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতির মধ্যে গণ্য। এ ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতিকেও আল্লাহ অব্যর্থ সত্য বলে আয়াত অবতীর্ণ করেন। মহান আল্লাহ বলেন,
فَاصْبِرْ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ وَلَا يَسْتَخِفَّنَّكَ الَّذِيْنَ لاَ يُوْقِنُوْنَ-
‘আপনি ছবর করুন! আল্লাহর ওয়াদা সত্য। যারা বিশ্বাসী নয়, তারা যেন আপনাকে বিচলিত করতে না পারে’ (রূম ৬০)।
পরবর্তী সূরা লোক্বমানে আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمْ وَاخْشَوْا يَوْماً لاَّ يَجْزِيْ وَالِدٌ عَنْ وَلَدِهِ وَلَا مَوْلُوْدٌ هُوَ جَازٍ عَنْ وَالِدِهِ شَيْئاً إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ فَلاَ تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَلَا يَغُرَّنَّكُم بِاللَّهِ الْغَرُوْرُ-
‘হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর এবং ভয় কর এমন এক দিবসকে, যখন পিতা পুত্রের কোন কাজে আসবে না এবং পুত্রও তার পিতার কোন উপকার করতে পারবে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহর ওয়াদা সত্য। অতএব পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে ধোঁকা না দেয় এবং আল্লাহ সম্পর্কে প্রতারক শয়তান যেন তোমাদেরকে প্রতারিত না করে’ (লোক্বমান ৩৩)।
উপরের আলোচনার ধারাবাহিকতায় সত্য ও মিথ্যার যে পার্থক্য সূচিত হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা খুবই কঠিন। কারণ সত্য হ’ল বাস্তব (দৃশ্য), আর মিথ্যা হ’ল অবাস্তব (অদৃশ্য)। বাস্তব ও অবাস্তবের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই। সুতরাং সত্য ও মিথ্যার মধ্যেও কোন সম্পর্ক নেই। আবার সত্য ও মিথ্যার মধ্যে আপোষ হওয়ারও কোন সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ সত্য ও মিথ্যার সংমিশ্রণ দ্বারা কোন নতুনত্বের সম্ভাবনাও বাতিল বলে গণ্য। পার্থিব জগতে সত্য ও মিথ্যার যে মিশ্রণ অব্যাহত আছে, তা আল্লাহর সন্তুষ্টির বিষয় নয়, এটা শুধু মুনাফিক বা অবিশ্বাসীদের অভিজ্ঞতার ফলাফল মাত্র। আসলে ইহজগতে সত্য ও মিথ্যার ন্যায় বহু সমস্যা সংকুল বিষয় আছে, যেগুলোর একত্রীকরণ বা সংমিশ্রণ অবিশ্বাস, অকল্পনীয় ও অবর্ণনীয়। উদাহরণতঃ খাদ্যের ও অখাদ্যের মিশ্রণ, পানীয় ও অপানীয়র মিশ্রণ, আগুন ও পানির মিশ্রণ, পূর্ণাঙ্গ ও অপূর্ণাঙ্গ (পঙ্গু)-র মিশ্রণ, প্রাচ্য ও প্রতিচ্যের মিশ্রণ, আকাশ ও পাতালের মিশ্রণ সুগন্ধ ও দুর্গন্ধের মিশ্রণ যেমন অসম্ভব, ঠিক সত্য ও মিথ্যাকে মিশ্রিত করাও তদ্রূপ অসম্ভব, অকল্পনীয় ও অবর্ণনীয়। মহান আল্লাহ বলেন,
وَلاَ تَلْبِسُواْ الْحَقَّ بِالْبَاطِلِ وَتَكْتُمُواْ الْحَقَّ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ-
‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না এবং জানা সত্ত্বেও সত্যকে গোপন করো না’ (বাক্বারাহ ৪২)।
আলোচ্য সূরায় সত্যের অনুকূলে পুনরায় প্রত্যাদেশ হয়েছে যে, الْحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَلاَ تَكُوْنَنَّ مِنَ الْمُمْتَرِيْنَ ‘বাস্তব সত্য সেটাই যা আপনার পালনকর্তা বলেন। কাজেই আপনি সন্দিহান হবেন না’ (বাক্বারাহ ১৪৭)।
সত্যের অনুকূলে পুনরায় বর্ণিত হয়েছে,
قُل لاَّ يَسْتَوِي الْخَبِيْثُ وَالطَّيِّبُ وَلَوْ أَعْجَبَكَ كَثْرَةُ الْخَبِيْثِ فَاتَّقُواْ اللّهَ يَا أُوْلِي الأَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ-
‘বলেদিন অপবিত্র ও পবিত্র সমান নয়, যদিও অপবিত্রের প্রাচুর্য আপনাকে বিস্মিত করে। অতএব হে বুদ্ধিমানগণ! আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা মুক্তি পাও’ (মায়েদাহ ১০০)।
সাধারণভাবে আজ আমরা সত্য ও মিথ্যা বলতে যা জানি বা বুঝি, তা মানুষের চিরাচরিত অভ্যাস মাত্র। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অসীম জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ, বিশ্বশ্রেষ্ঠ মহা সম্মানিত মহাগ্রন্থ আল-কুরআন এবং কুরআনের নির্দেশিত পবিত্র ইসলাম ধর্ম সত্যের এক মহাপ্রতীক। তাছাড়া ‘সত্য’ দ্বীন ইসলামের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এখানে মিথ্যা অনুপ্রবেশের কোন অবকাশ নেই, তবে কৃত্রিম কৌশল অবলম্বন করার সুযোগ রয়েছে- যা নিঃসন্দেহে ইসলাম ধর্মের পরিপন্থী। এমতাবস্থায় ইসলামের শ্রেষ্ঠ সত্য ও তথ্যের উৎস কুরআনের সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। এজন্যে করুণাময় ও দয়াশীল আল্লাহ তা‘আলার আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে আগামী সত্য দিনের উপর পবিত্রতা রক্ষার তাওফীক দান করুন।- আমীন! -
কোন মন্তব্য নেই:
/>