বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৪

উমরা ও হজ্ব কিভাবে আদায় করবেন ???

(হজ্বের মত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত কারো তাওফীক্ব হলে তা অত্যন্ত সৌভাগ্যের ব্যাপার। তবে হজ্বের মাসাইল ও নিয়ম নীতি সম্পর্কে সাধারণ লোক তো বটেই এমনকি অনেক জানাশোনা লোকও বিভ্রান্তির শিকার হন। সে কারণে হজ্বের পূর্বে এবং হজ্বে থাকাকালীন হজ্বের বিধিবিধান সম্পর্কে সম্মক জ্ঞাত থাকা আবশ্যক। সধারণের পক্ষে হজ্ব সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য কিতাব নির্বাচন করা মুশকিল। কারণ বাজারে নির্ভরযোগ্য অনেক বই যেমন পাওয়া যায় তেমনি হজ্ব সম্পর্কে অনির্ভরযোগ্য বইয়েরও অভাব নেই। বাংলাদেশের শীর্ষ আলেম ও মুরুব্বী ফক্বীহুল মিল্লাত মুফতী আব্দুর রহমান সাহেব আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর পূর্বে ‘মক্কা মদীনার পাথেয়’ নামে হজ্ব সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য কিতাব রচনা করেন। যা সর্বস্তরে সমাদৃত। বইটি এ পর্যন্ত বিভিন্ন কোম্পানি কর্তৃক বিভিন্ন ভার্শনে প্রকাশিত হয়ে আসছে। কেউ কেউ এটিকে সংক্ষিপ্ত করে হজ গাইড হিসেবে হাজীদের হাতে দিয়ে আসছিলেন। আমরাও বইটিকে সংক্ষিপ্ত করে হাজ্বীদের জন্য সহজ গাইড হিসেবে এখানে প্রকাশ করার প্রয়াস পাচ্ছি। আল-আবরার পরিবার)
ইহরাম :
প্রথমেই জেনে নিন আপনার গন্তব্য ঢাকা থেকে মক্কা শরীফ, নাকি মদীনা শরীফ। যদি মদীনা শরীফ হয়, তাহলে এখন ইহরাম বাঁধা নয়; যখন মদীনা শরীফ থেকে মক্কা শরীফ যাবেন, তখন ইহরাম বাঁধতে হবে। বেশির ভাগ হজযাত্রী আগে মক্কায় যান। এ ক্ষেত্রে ঢাকা থেকে বিমানে ওঠার আগে ইহরাম বাঁধা ভালো। কারণ, জেদ্দা পৌঁছার আগেই ‘ইয়ালামলাম’ মিকাত বা ইহরাম বাঁধার নির্দিষ্ট স্থানটি পড়ে। বিমানে যদিও ইহরাম বাঁধার কথা বলা হয়, কিন্তু ওই সময় অনেকে ঘুমিয়ে থাকেন; আর বিমানে পোশাক পরিবর্তন করাটাও দৃষ্টিকটু।
মনে রাখবেন ইহরামের কাপড় পরিধান করলেই ইহরাম বাঁধা হয়ে যায় না। যতক্ষণ পর্যন্ত নিয়ত করে ‘তালবিয়া’ তথা “লাব্বাইক …..” পড়া না হয়। তাই ইহরামের কাপড় পরিধানের পর সতর্কতামূলক বিমান ছাড়ার পর নিয়ত করে তালবিয়া আরম্ভ করা ভাল। বিনা ইহরামে মিকাত পার হলে এ জন্য দম বা কাফফারা দিতে হবে। তদুপরি গোনাহ হবে।
হজ বা উমরাহ পালনকারী ব্যক্তির জন্য বিনা ইহরামে যে নির্দিষ্ট স্থান অতিক্রম করা নিষিদ্ধ, তা-ই হলো মিকাত। বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘরের সম্মানার্থে প্রত্যেককে নিজ নিজ মিকাত থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়।
মিকাত পাঁচটি :
১. যুল হুলায়ফা বা বীরে আলী : মদীনাবাসী এবং মদীনা হয়ে মক্কায় প্রবেশকারীদের মিকাত, ২. ইয়ালামলাম : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহ থেকে জেদ্দা হয়ে মক্কা প্রবেশকারীদের মিকাত। ৩. আল-জুহফা : সিরিয়া, মিসর এবং সেদিক থেকে আগতদের মিকাত। ৪. কারনুল মানাজিল বা আসসায়েল আল-কাবির : নাজদ থেকে আগতদের জন্য মিকাত এবং ৫. যাতুল ইর্ক : ইরাক থেকে আগতদের জন্য মিকাত।
ঢাকা বিমানবন্দর
উড্ডয়নের সঠিক সময় অনুযায়ী বিমানবন্দরে পৌঁছুন। আপনার নাম-ঠিকানা লেখা ব্যাগ বা সুটকেসে কোনো পচনশীল খাবার রাখবেন না। বিমানবন্দরে লাগেজে যে মাল দেবেন, তা ঠিকমতো বাঁধা হয়েছে কি না, দেখে নেবেন। বিমানের কাউন্টারে মাল রেখে এর টোকেন দিলে তা যতœ করে রাখবেন। কারণ, জেদ্দা বিমানবন্দরে ওই টোকেন দেখালে সেই ব্যাগ আপনাকে ফেরত দেবে। ইমিগ্রেশন, চেকিংয়ের পর নিজ মালপত্র সযতেœ রাখুন।
বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া পরিচয়পত্র, পিলগ্রিম পাস, বিমানের টিকিট, টিকা দেওয়ার কার্ড, অন্য কাগজপত্র, টাকা, বিমানে পড়ার জন্য ধর্মীয় বই ইত্যাদি গলায় ঝোলানোর ব্যাগে যতেœ রাখুন।
সময়মতো বিমানে উঠে নির্ধারিত আসনে বসুন।
জেদ্দা বিমানবন্দর :
মোয়াল্লেমের গাড়ি আপনাকে জেদ্দা থেকে মক্কায় যে বাড়িতে থাকবেন, সেখানে নামিয়ে দেবে। মোয়াল্লেমের নম্বর (আরবিতে লেখা) কব্জি বেল্ট দেওয়া হবে, তা হাতে পরে নেবেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া পরিচয়পত্র (যাতে পিলগ্রিম পাস নম্বর, নাম, ট্রাভেল এজেন্টের নাম ইত্যাদি থাকবে) গলায় ঝোলাবেন।
জেদ্দা থেকে মক্কায় পৌঁছাতে আনুমানিক দুই ঘণ্টা সময় লাগবে। যানবাহনের উঠানামার সময় ও চলার পথে বেশি বেশি তালবিয়া পড়ুন (লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা-শরিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়ালমুলক লা-শরীকা লাক্।)
মক্কায় পৌঁছে :
মক্কায় পৌঁছে আপনার থাকার জায়গায় মালপত্র রেখে ক্লান্ত হলে বিশ্রাম করুন। আর যদি নামাযের ওয়াক্ত হয়, নামায আদায় করুন। বিশ্রাম শেষে উমরাহর নিয়ত করে থাকলে উমরাহ পালন করুন।
মসজিদুল হারামে (কা’বা শরিফ) অনেকগুলো প্রবেশপথ আছে; সব কটি দেখতে একই রকম। কিন্তু প্রতিটি প্রবেশপথে আরবি ও ইংরেজিতে ১, ২, ৩ নম্বার ও প্রবেশপথের নাম আছে, যেমন-বাদশা আবদুল আজিজ প্রবেশপথ। আপনি আগে থেকে ঠিক করবেন, কোন প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকবেন বা বের হবেন। আপনার সফরসঙ্গীকেও স্থান চিনিয়ে দিন। তিনি যদি হারিয়ে যান, তাহলে নির্দিষ্ট নম্বরের গেটের সামনে থাকবেন। এতে ভেতরে ভিড়ে হারিয়ে গেলেও নির্দিষ্ট স্থানে এসে সঙ্গীকে খুঁজে পাবেন।
কা’বা শরিফে স্যান্ডেল রাখার ক্ষেত্রে খুব সতর্ক থাকবেন, নির্দিষ্ট স্থান তথা জুতা রাখার জায়গায় রাখুন। এখানে-সেখানে জুতা রাখলে পরে আর খুঁজে পাবেন না। প্রতিটি জুতা রাখার র‌্যাকেও নম্বর দেওয়া আছে। এই নম্বর মনে রাখুন।
উমরাহর নিয়মকানুন আগে জেনে নেবেন, যেমন-সাতবার তাওয়াফ করা, জমজমের পানি পান করা, নামায আদায় করা, সাঈ করা (সাফা-মারওয়া পাহাড়ে দৌড়ানো-যদিও মসৃণ পথ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত) মাথা মুন্ডানো অথবা চুল ছোট করা-এসব কাজ ধারাবাহিকভাবে করা। ওয়াক্তীয়া নামাযের সময় হলে যতটুকু হয়েছে ওই সময় নামায পড়ে আবার বাকিটুকু শেষ করা।
কা’বা শরিফ :
হারাম শরীফে প্রবেশ করার সময় বিসমিল্লাহ ও দরুদ শরিফ পড়ার পর “আল্লাহুম্ মাফ তাহলি আব-ওয়া-বা রাহমাতিকা” পড়বেন। মসজিদুল হারামে কোনো নারীর পাশে অথবা তাঁর সরাসরি পেছনে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করবেন না।
কোনো দরজার সামনে নামায পড়া ঠিক নয়, এতে পথচারীর কষ্ট হয়।
হাজরে আসওয়াদে চুমু দেওয়া সুন্নাত। তবে ভিড়ের কারণে না পারলে দূর থেকে চুমুর ইশারা করলেই চলবে। ভিড়ে অন্যকে কষ্ট দেওয়া যাবে না।
উমরাহ ও হজ্ব পালন :
উমরাহ
হিল (হারামের সীমানার বাইরে মিকাতের ভেতরের স্থান) থেকে অথবা মিকাত থেকে ইহরাম বেঁধে বায়তুল্লাহ শরিফ তাওয়াফ করা, সাফা-মারওয়া সাঈ করা এবং মাথার চুল ফেলে দেওয়া বা ছোট করাকে উমরাহ বলে।
হজ্ব তিন প্রকার-তামাত্তু, কিরান ও ইফরাদ।
হজ্জে তামাত্তু
হজ্বের মাসসমূহে (শাওয়াল, জিলকদ, জিলহজ্ব) উমরাহর নিয়তে ইহরাম করে, উমরাহ পালন করে, পরে হজ্বের নিয়ত করে হজ্ব পালন করাকে হজ্জে তামাত্তু বলে।
হজ্জে কিরান
হজ্বের মাসসমূহে একই সঙ্গে হজ্ব ও উমরাহ পালনের নিয়তে ইহরাম করে উমরাহ ও হজ্ব করাকে হজ্জে কিরান বলে।
হজ্জে ইফরাদ
শুধু হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে ইহরাম বেঁধে হজ্ব সম্পাদনকে হজ্জে ইফরাদ বলে।
তামাত্তু হজ্বের নিয়ম
১. উমরাহর ইহরাম (ফরজ)
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সেরে গোসল বা অজু করে নিন।
মিকাত অতিক্রমের আগেই সেলাইবিহীন একটি সাদা কাপড় পরিধান করুন, আরেকটি গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ইহরামের নিয়তে দুই রাকাত নামায পড়ে নিন।
শুধু উমরাহর নিয়ত করে এক বা তিনবার তালবিয়া পড়ে নিন।
তালবিয়া হলো-“লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা ওয়ান নিমাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।”
২. উমরার তাওয়াফ (ফরজ)
অজুর সঙ্গে ‘ইজতিবা’সহ তাওয়াফ করুন। ইহরামের চাদরকে ডান বগলের নিচের দিক থেকে পেঁচিয়ে এনে বাঁ কাঁধের ওপর রাখাকে ‘ইজতিবা’ বলে।
হাজরে আসওয়াদকে সামনে রেখে তার বরাবর ডান পাশে দাঁড়ান (২০০৬ সাল থেকে মেঝেতে সাদা মার্বেল পাথর আর ডান পাশে সবুজ বাতি)। তারপর দাঁড়িয়ে তাওয়াফের নিয়ত করুন। তারপর ডানে গিয়ে এমনভাবে দাঁড়াবেন, যেন হাজরে আসওয়াদ পুরোপুরি আপনার সামনে থাকে। এরপর দুই হাত কাঁধ পর্যন্ত তুলে “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লাল্লা-হু ওয়া লিল্লাহিল হামদ, ওয়াস সালাতু ওয়াস-সালামু আলা রাসুলিল্লাহ” পড়ুন। পরে হাত ছেড়ে দিন এবং হাজরে আসওয়াদের দিকে হাত দিয়ে ইশারা করে হাতের তালুতে চুমু খেয়ে ডান দিকে চলতে থাকুন, যাতে পবিত্র কা’বাঘর পূর্ণ বাঁয়ে থাকে। পুরুষের জন্য প্রথম তিন চক্করে রমল করা সুন্নাত। রমল অর্থ বীরের মতো বুক ফুলিয়ে কাঁধ দুলিয়ে ঘন ঘন কদম রেখে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলা।
রুকনে ইয়ামানিকে সম্ভব হলে শুধু হাতে স্পর্শ করুন। রুকনে ইয়ামানিতে এলে “রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাওঁ ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাতাওঁ ওয়াকিনা আযাবান্নার, ওয়াআদখিলনাল জান্নাতা মা’আল আবরার, ইয়া আযিযু ইয়া গাফফার, ইয়া রাব্বাল আলামিন” বলুন। চুমু খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। অতঃপর হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত এসে চক্কর পুরো করুন।
পুনরায় হাজরে আসওয়াদ বরাবর দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে হাতের তালুতে চুমু খেয়ে দ্বিতীয় চক্কর শুরু করুন। এভাবে সাত চক্করে তাওয়াফ শেষ করুন।
হাতে সাত দানার তসবি অথবা গণনাযন্ত্র রাখতে পারেন । তাহলে সাত চক্কর ভুল হবে না।
৩. তাওয়াফের দুই রাকা’আত নামায (ওয়াজিব)
মাকামে ইবরাহিমের পেছনে বা হারামের যেকোনো স্থানে তাওয়াফের নিয়তে (মাকরুহ সময় ছাড়া) দুই রাকা’আত নামায পড়ে দুআ করুন। মনে রাখবেন, এটা দোয়া কবুলের সময়।
৪. উমরাহর সাঈ (ওয়াজিব)
সাফা পাহাড়ের কিছুটা ওপরে উঠে (এখন আর পাহাড় নেই, মেঝেতে মার্বেল পাথর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত) কা’বা শরিফের দিকে মুখ করে সাঈ-এর নিয়ত করে, দু’আর মতো করে হাত তুলে তিনবার তাকবির বলে দু’আ করুন। তারপর মারওয়ার দিকে রওনা হয়ে দুই সবুজ দাগের মধ্যে (এটা সেই জায়গা, যেখানে হজরত হাজেরা (রা.) পানির জন্য দৌড়েছিলেন) একটু দ্রুত পথ চলে মারওয়ায় পৌঁছালে এক চক্কর পূর্ণ হলো। মারওয়া পাহাড়ে উঠে কাবা শরিফের দিকে মুখ করে দু’আর মতো করে হাত তুলে তাকবির পড়ুন এবং আগের মতো চলে সেখান থেকে সাফায় পৌঁছালে দ্বিতীয় চক্কর পূর্ণ হলো এভাবে সপ্তম চক্করে মারওয়ায় গিয়ে সাঈ শেষ করে দোয়া করুন।
৫. হলক করা (ওয়াজিব)
পুরুষ হলে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আদশের অনুসরণে সম্পূর্ণ মাথা মু-ন করবেন, তবে মাথার চুল ছাঁটতেও পারেন। মহিলা হলে মাথার চুল এক ইঞ্চি পরিমাণ কাটবেন।
এ পর্যন্ত উমরাহর কাজ শেষ।
হজ্বের ইহরাম না বাঁধা পর্যন্ত ইহরামের আগের মতো সব কাজ করতে পারবেন।
৬. হজ্বের ইহরাম (ফরজ)
হারাম শরিফ বা বাসা থেকে আগের নিয়মে শুধু হজ্বের নিয়তে ইহরাম বেঁধে ৮ জিলহজ্ব জোহরের আগেই মিনায় পৌঁছে যাবেন।
৭. মিনায় অবস্থান (সুন্নাত)
৮ জিলহজ্ব জোহর থেকে ৯ জিলহজ ফজরসহ মোট পাঁচ ওয়াক্ত নামায মিনায় আদায় করুন এবং এ সময়ে মিনায় অবস্থান করুন।
৮. আরাফাতের ময়দানে অবস্থান (ফরজ)
আরাফাতের ময়দানে অবস্থান হজ্বের অন্যতম ফরজ।
৯ জিলহজ্ব দুপুরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করুন। এদিন নিজ তাঁবুতে জোহর ও আসরের নামাজ স্ব স্ব সময়ে আলাদাভাবে আদায় করুন। মুকিম হলে চার রাকাত পূর্ণ পড়ুন। মসজিদে নামিরায় উভয় নামায জামা’আতে পড়লে একসঙ্গে আদায় করতে পারেন। যদি ইমাম মুসাফির হন আর মসজিদে নামিরা যদি আপনার কাছ থেকে দূরে থাকে, তাহলে নিজ স্থানে অবস্থান করবেন। মাগরিবের নামায না পড়ে মুজদালিফার দিকে রওনা হোন।
৯. মুজদালিফায় অবস্থান (ওয়াজিব) রাত্রি যাপন (সুন্নাত)
আরাফায় সূর্যাস্তের পর মুজদালিফায় গিয়ে এশার সময়ে মাগরিব ও এশা এক আজান ও এক ইকামতে একসঙ্গে আদায় করুন।
এখানেই রাত যাপন করুন (এটি সুন্নাত) এবং ১০ জিলহজ ফজরের পর সূর্যোদয়ের আগে কিছু সময় মুজদালিফায় অবশ্যই অবস্থান করুন (এটি ওয়াজিব)। তবে দুর্বল (অপারগ) ও নারীদের বেলায় এটা অপরিহার্য নয়। রাতে ছোট ছোট ছোলার দানার মতো ৭০টি কঙ্কর সংগ্রহ করুন। মুজদালিফায় কঙ্কর খুব সহজেই পেয়ে যাবেন।
১০. কঙ্কর মারা (প্রথম দিন)
১০ জিলহজ্ব ফজর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত শুধু বড় জামারাকে (বড় শয়তান) সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করুন (ওয়াজিব)। এ সময়ে সম্ভব না হলে এ রাতের শেষ পর্যন্ত কঙ্কর মারতে পারেন। দুর্বল ও নারীদের জন্য রাতেই কঙ্কর মারা উত্তম ও নিরাপদ।
কঙ্কর মারার স্থানে বাংলা ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়; তা মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবং মেনে চলুন।
১১. কোরবানি করা (ওয়াজিব)
১০ জিলহজ্ব কঙ্কর মারার পরই কেবল কোরবানি নিশ্চিত পন্থায় আদায় করুন।
কোরবানির পরেই কেবল রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদর্শের অনুসরণে মাথা হলক করুন (ওয়াজিব)। তবে চুল ছোটও করতে পারেন।
খেয়াল রাখবেন : কঙ্কর মারা, কোরবানি করা ও চুল কাটার মধ্যে ধারাবাহিকতা জরুরি ও ওয়াজিব; অন্যথায় দম বা কাফফারা দিয়ে হজ শুদ্ধ করতে হবে। বর্তমানে এই সমস্যা সমাধানের সহজ উপায় হজ্জে ইফরাদ করা। যেখানে কোরবানি নেই।
হজ্বের পরে কেউ ওমরা পালন করতে চাইলে ১৩ তারিখ দিবাগত রাত থেকে উমরাহ পালন করতে পারবেন।
১২. তাওয়াফে জিয়ারত (ফরজ)
১২ জিলহজ্ব সূর্যাস্তের আগেই তাওয়াফে জিয়ারত করে নিতে হবে। তা না হলে ১২ জিলহজের পরে তাওয়াফটি করে দম দিতে হবে। তবে নারীরা প্রাকৃতিক কারণে করতে না পারলে পবিত্র হওয়ার পরে করবেন।
১৩. কঙ্কর মারা (ওয়াজিব)
১১ ও ১২ জিলহজ্ব কঙ্কর মারা (ওয়াজিব)। ১১-১২ জিলহজ্ব দুপুর থেকে সময় আরম্ভ হয়। ভিড় এড়ানোর জন্য আসরের পর অথবা আপনার সুবিধাজনক সময়ে সাতটি করে কঙ্কর মারবেন-প্রথমে ছোট, মধ্যম, তারপর বড় শয়তানকে। ছোট জামারা থেকে শুরু করে বড় জামারায় শেষ করুন। সম্ভব না হলে শেষরাত পর্যন্ত মারতে পারেন। দুর্বল ও নারীদের জন্য রাতেই নিরাপদ।
১৪. মিনা ত্যাগ
১৩ জিলহজ্ব মিনায় না থাকতে চাইলে ১২ জিলহজ্ব সন্ধ্যার আগে অথবা সন্ধ্যার পর ভোর হওয়ার আগে মিনা ত্যাগ করুন। সূর্যাস্তের আগে মিনা ত্যাগ করতেই হবে-এটা ঠিক নয়। তবে সূর্যাস্তের আগে মিনা ত্যাগ করা উত্তম।
১৫. বিদায়ী তাওয়াফ (ওয়াজিব)
বাংলাদেশ থেকে আগত হজযাত্রীদের হজ শেষে বিদায়ী তাওয়াফ করতে হয় (ওয়াজিব)। তবে হজ শেষে যেকোনো নফল তাওয়াফই বিদায়ী তাওয়াফে পরিণত হয়ে যায়।
নারীদের মাসিকের কারণে বিদায়ী তাওয়াফ করতে না পারলে কোনো ক্ষতি নেই; দম বা কাফফারাও দিতে হয় না।
১৬. মিনায় অবস্থানরত দিনগুলোতে (১০, ১১ জিলহজ) মিনাতেই রাত যাপন করুন। আর ১২ তারিখ রাত যাপন করুন যদি ১৩ তারিখ রমি (কঙ্কর ছুড়ে মারা) শেষ করে ফিরতে চান (সুন্নাত)।
কিরান হজ্বের নিয়ম
১. ইহরাম বাঁধা (ফরজ)
জেদ্দা পৌঁছানোর আগে একই নিয়মে ইহরাম করার কাজ সমাপ্ত করুন। তবে তালবিয়ার আগেই হজ ও উমরাহ উভয়ের নিয়ত একসঙ্গে করুন।
২. উমরাহর তাওয়াফ (পূর্বে বর্ণিত) নিয়মে আদায় করুন (ওয়াজিব)।
৩. উমরাহর সাঈ করুন, তবে এরপর চুল ছাঁটবেন না; বরং ইহরামের সব বিধিবিধান মেনে চলুন (ওয়াজিব)।
৪. তাওয়াফে কুদুম করুন (সুন্নাত)।
৫. এরপর সাঈ করুন, যদি এ সময় সাঈ করতে না পারা যায় তাওয়াফে জিয়ারতের পরে করুন (ওয়াজিব)।
৬. আট জিলহজ্ব জোহর থেকে ৯ জিলহজ্ব ফজর পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামায মিনাতে পড়ুন। এ সময়ে মিনাতে অবস্থান করুন (সুন্নাত)।
৭. আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করুন (ফরজ)।
৮. নয় জিলহজ সূর্যাস্তের পর থেকে মুজদালিফায় অবস্থান এবং মাগরিব ও এশা একসঙ্গে এশার সময়ে আদায় করুন (সুন্নাত)। তবে ১০ জিলহজ ফজরের পর কিছু সময় অবস্থান করুন (ওয়াজিব)।
৯. ওপরে বর্ণিত নিয়ম ও সময় অনুসারে ১০ জিলহজ্ব কঙ্কর নিক্ষেপ করুন (ওয়াজিব)।
১০. কোরবানি করুন (ওয়াজিব)।
১১. মাথার চুল মু-ন করে নিন (ওয়াজিব)। তবে চুল ছেঁটেও নিতে পারেন।
১২. তাওয়াফে জিয়ারত করুন (ফরজ) এবং সাঈ করে নিন, যদি তাওয়াফে কুদুমের পরে না করে থাকেন।
১৩. এগারো-বারো জিলহজ কঙ্কর নিক্ষেপ করুন (ওয়াজিব)। ১৩ জিলহজ কঙ্কর মারা রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আদর্শ।
১৪. মিনায় থাকাকালীন মিনাতেই রাত যাপন করুন (সুন্নাত)।
১৫. মিকাতের বাইরে থেকে আগত হাজিরা বিদায়ী তাওয়াফ করুন (ওয়াজিব)।
ইফরাদ হজ্বের নিয়ম
১. শুধু হজ্বের নিয়তে (আগে বর্ণিত) ইহরাম বাঁধুন (ফরজ)।
২. মক্কা শরিফ পৌঁছে তাওয়াফে কুদুম করুন (সুন্নাত)।
৩. সাঈ করুন (ওয়াজিব)। এ সময়ে সম্ভব না হলে সাঈ তাওয়াফে জিয়ারতের পরে করুন।
৪. মিনায় পাঁচ ওয়াক্ত নামায ও রাত যাপন করুন (সুন্নাত)।
৫. আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করুন (ফরজ)।
৬. মুজদালিফায় অবস্থান করুন (সুন্নাত)। তবে ১০ জিলহজ্ব ফজরের পর কিছু সময় অবস্থান ওয়াজিব।
৭. ১০ জিলহজে জামারাতে সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করুন (ওয়াজিব)।
৮. যেহেতু এ হজ্বে কোরবানি ওয়াজিব নয়, তাই কঙ্কর নিক্ষেপের পর মাথা হলক করে নিন; তবে চুল ছেঁটেও নিতে পারেন (ওয়াজিব)।
৯. তাওয়াফে জিয়ারত করুন (ফরজ) এবং যদি তাওয়াফে কুদুমের পর সাঈ না করে থাকেন, তাহলে সাঈ করে নিন (ওয়াজিব)।
১০. ১১-১২ জিলহজ্ব আগে বর্ণিত নিয়ম ও সময়ে কঙ্কর নিক্ষেপ করুন (ওয়াজিব)।
১১. বদলি হজকারী ইফরাদ হজ্ব করবেন।
ইহরাম, অন্যান্য পরামর্শ
ইহরাম সম্পর্কে জরুরি বিষয়
যাঁরা সরাসরি বাংলাদেশ থেকে মক্কা শরিফ যাবেন, তাঁরা বাড়িতে, হাজি ক্যাম্পে বা বিমানে ইহরাম করে নেবেন। বাড়িতে বা হাজি ক্যাম্পে ইহরাম করে নেওয়া সহজ। ইহরাম ছাড়া যেন মিকাত অতিক্রম না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
যাঁরা মদিনা শরিফ যাবেন, তাঁরা মদিনা শরিফ থেকে মক্কা যাওয়ার সময় ইহরাম করবেন। কোনো নারী প্রাকৃতিক কারণে অপবিত্র হয়ে থাকলে ইহরামের প্রয়োজন হলে অজু-গোসল করে নামাজ ব্যতীত লাব্বাইক পড়ে ইহরাম করে নেবেন। তাওয়াফ ছাড়া হজ্ব, উমরাহর সমস্ত কাজ নির্ধারিত নিয়মে আদায় করবেন।
তাওয়াফ ও সাঈ করার সময় বিশেষভাবে লক্ষণীয়
তাওয়াফের সময় অজু থাকা জরুরি। তবে সাঈ করার সময় অজু না থাকলেও সাঈ সম্পন্ন হয়ে যাবে।
হাজরে আসওয়াদে চুমু দেওয়া একটি সুন্নত। তা আদায় করতে গিয়ে লোকজনকে ধাক্কাধাক্কির মাধ্যমে কষ্ট দেওয়া বড় গুনাহ। তাই তাওয়াফকালে বেশি ভিড় দেখলে ইশারায় চুমু দেবেন।
সাঈ করার সময় সাফা থেকে মারওয়া কিংবা মারওয়া থেকে সাফা প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন চক্কর। এভাবে সাতটি চক্কর সম্পূর্ণ হলে একটি সাঈ পূর্ণ হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

Comment here />

Widget ByBlogger Maruf
Widget ByBlogger Maruf