হজ্জের ইতিহাস
হযরত ইবরাহীম আঃ মক্কায় ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন এবং তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র হযরত ইসমাঈল আঃ কে এখানেবসিয়েছিলেন, যেন তার পরে তিনি এ আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারেন। হযরত ইসমাঈল আঃ এর পর তার বংশধরগন কতকাল দীনইসলামের পথে চলেছে তা আল্লাহ তায়ালাই অবগত আছেন। কিন্ত পরবর্তী কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই তারা যে পূর্ববর্তী মহাপুরুষদেরশিক্ষা ও প্রদর্শিত পথ ভূলে গিয়েছিল এবং অন্যান্য জাহেল জাতির ন্যায় সর্বপ্রকার পাপ প্রথা ও গোমরাহীর প্রচলন করেছিল, তাতেসন্দেহ নেই। যে কা’বা ঘরকে কেন্দ্র করে এককাল এক আল্লাহর ইবাদাত ও প্রচার শুরু হয়েছিল, সেই কা’বা ঘরে শত শত মূর্তি স্থাপনকরা হলো। এমনকি, মূর্তি পূজা বন্ধ করার সাধনা ও আন্দোলনে যে হযরত ইবরাহীম আঃ ও ইসমাঈল আঃ এর সারাটি জীবনঅতিবাহিত হয়েছিল তাদের মূর্তি নির্মাণ করেও কা’বা ঘরে স্থাপন করা হয়েছিল। তাওহীদী ধর্মের অগ্রনেতা হযরত ইবরাহিম আঃ এরপরবর্তী বংশধরগন লাত, মানাত, উজ্জা, হুবাল, নসর, ইয়াগুস, আসাফ, নায়েলা আরও অসংখ্য নামের মূর্তি প্রস্তত করেছিল এবং সেসবের পূজা করছিল। চন্দ্র, বুধ, শুক্র, শনি ইত্যাদি গ্রহ-নক্ষত্রের পূজা করত। ভূত, প্রেত, ফেরেশতা এবং মৃত পূর্বপুরুষদের আত্নারপূজাও করতো। তাদের মূর্খতা এতদূর প্রচন্ড রূপ লাভ করেছিল যে, ঘর থেকে বের হওয়ার সময় নিজেদের বংশের মূর্তি না পেলে পথচলার সময় যে কোনো রঙ্গীন পাথর দেখতে পেত তারা তারই পূজা শুরু করতো। পাথর না পেলে মাটি ও পানির সংমিশ্রণে একটিপ্রতিমূর্তি বানিয়ে তারা তার উপর ছাগ দুগ্ধ ছিটিয়ে দিলেই তাদের মতে সে নিষ্প্রাণ পিন্ডটি খোদা হয়ে যেত এবং এরই পূজা শুরুকরতো। যে পৌরহিত্য ও ঠাকুরবাদের বিরূদ্ধে তাদের পিতা হযরত ইবরাহিম আঃ সমগ্র ইরাকের বিরূদ্ধে লড়াই করেছিলেন, তা-ইআবার তাদের ঘরে প্রবেশ করেছিল। কা’বাকে তারা মূর্তি পূজার আড্ডাখানা বানিয়ে তারাই সেখানকার পুরোহিত সেজেছিল। হজ্জকেতারা তীর্থযাত্রার অনুরূপ বানিয়ে তাওহীদ প্রচারের কেন্দ্রস্থল কা’বা ঘর থেকে মূর্তি পূজার প্রচার শুরু করেছিল এবং পূজারীদেরসর্বপ্রকার কলাকৌশল অবলম্বন করে আরবের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা লোকদের কাছ থেকে ”নযর-নিয়ায ও ভেট-বেগাড়” আদায়করতো। এভাবে হযরত ইবরাহিম আঃ ও ইসমাঈল আঃ যে মহান কাজ শুরু করেছিলেন এবং যে উদ্দেশ্যে তারা হজ্জ প্রথার প্রচলনকরেছিলেন, তা সবই বিনষ্ট হয়ে গেল।
এ ঘোর জাহিলী যুগে হজ্জের যে চরম দূর্গতি হয়েছিল একটি ব্যাপার থেকে তা স্পষ্টরূপে অনুমান করা যায়। মক্কায় একটি বার্ষিকমেলা বসতো, আরবের বড় বড় বংশ ও গোত্রের কবি কিংবা কথক নিজ নিজ গোত্রের খ্যাতি, বীরত্ব, শক্তি, সম্মান ও বদান্যতারপ্রশংসায় আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলতো এবং পারস্পরিক গৌরব ও অহংকার প্রকাশের ব্যাপারে রীতিমত প্রতিযোগীতা করতো।এমনকি অপরের নিন্দার পর্যায়ও এসে যেত। সৌজন্য ও বদান্যতার পাল্লা দেওয়া হতো। প্রত্যেক গোত্র প্রধান নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণকরার জন্য ডেগ চড়াতো এবং অন্যের হেয় করার জন্য উটের পর উট জবেহ করতো। এ অপচয় ও অপব্যয়ের পিছনে তাদেরএকটিই মাত্র লক্ষ্য ছিল; তা এই যে, এ সময় কোন বদান্যতা করলে মেলায় আগত লোকদের মাধ্যমে আরবের সর্বত্র তাদের খ্যাতিছড়িয়ে পড়বে এবং কোন গোত্রপতি কতটি উট জবেহ করেছিল এবং কতলোককে খাইয়েছিল ঘরে ঘরে তার চর্চা শুরু হবে। এসবসম্মেলনে নাচ, গান, মদ, জুয়া, ব্যভিচার এবং সকল প্রকার নির্লজ্জ কাজ কর্মের অনুষ্ঠান বিশেষ জাঁক-জমকের সাথে সম্পন্ন হতো।এ উৎসবের সময় এক আল্লাহর দাসত্বের কথা কারো মনে জাগ্রত হতো কিনা সন্দেহ। কা’বা ঘরের চতুর্দিকে তাওয়াফ করা হতো।কিন্ত তার পদ্ধতি ছিল বিকৃত। নারী পুরুষ সকলেই উলঙ্গ হয়ে ঘুরতো আর বলতো আমরা আল্লাহর সামনে এমন অবস্থায় যাব, যেমনঅবস্থায় আমাদের মা আমদেরকে প্রসব করেছে। হযরত ইবরাহিম আঃ এর প্রতিষ্ঠিত মসজিদে ইবাদাত করা হতো, একথা ঠিক;কিভাবে? খুব জোরে হাত তালি দেওয়া হতো, বাঁশি বাজানো হতো, শিংগায় ফুঁক দেওয়া হতো। আল্লাহর নামও সেখানে নেওয়া হতো না,এমন নয়। কিন্ত কিরূপে? তারা বলতো-
لبيك اللهم لبيك لا شريك لك
إلا شريكا هو لك تمليكه وما ملك
”আমি এসেছি, হে আমার আল্লাহ! আমি এসেছি, তোমার কেউ শরীক নেই; কিন্ত যে তোমার আপন, সে তোমার অংশীদার। তুমিতারও মালিক এবং তার মালিকানারও মালিক।”
আল্লাহর নামে সেখানে কোরবানী দেওয়া হতো। কিন্ত তার পন্থা ছিল কত নিকৃষ্ট ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ। কুরবানীর রক্ত কা’বা ঘরের দেওয়ালেলাগিয়ে দিত এবং এর গোশত কা’বার দরজায় ফেলে রাখতো। কারন তাদের ধারণা মতে আল্লাহ এসব রক্ত ও মাংশ তাদের কাছ থেকেকবূল করেছন। হযরত ইবরাহিম আঃ এর সময়ই হজ্জের চার মাসে রক্তপাত হারাম করে দেওয়া হয়েছিল এবং এ সময় সকল প্রকারযুদ্ধ বিগ্রহ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরবর্তীকালের লোকেরা এ নিষেধ অনেকটা মেনে চলেছে বটে; কিন্ত যুদ্ধ করতে যখন ইচ্ছা হতোতখন তারা এক বছরের নিষিদ্ধ মাসগুলোকে হালাল গন্য করতো এবং পরের বছর তারা কাযা আদায় করতো।
এছাড়াও অন্যান্য যেসব লোক নিজ ধর্মের প্রতি নিষ্ঠাবান ছিল তারাও নিতান্ত মূর্খতার কারনে আশ্চার্য রকমের বহু রীতিনীতি পালনকরেছিল। একদল লোক কোন কোন সম্বল না নিয়ে হজ্জের যাত্রা করতো এবং পথে পথে ভিক্ষা চেয়ে দিন অতিবাহিত করতো।তাদের মতে এটা খুব পূণ্যের কাজ ছিল। মুখে তারা বলতো “ আমরা আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করেছি, আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করারজন্য যাচ্ছি, দুনিয়ার সম্বল নেওয়ার প্রয়োজন কি”। হজ্জে গমনকালে ব্যবসা করা কিংবা কামাই রোজগারের জন্য শ্রম করাকেসাধারণত নাজায়েয বলেই ধারণা করা হতো। অনেক লোক আবার হজ্জের সময় পানাহারই বন্ধ করে দিতো। এর নাম ছিল হজ্জেমুছমিত বা বোবা হজ্জ। এছাড়া আরো কত প্রকার ভ্রন্ত ও কুপ্রথার প্রচলন ছিল তার ইয়াত্তা নেই। এরূপ ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থা কমবেশী দু’ হাজার বছর পর্যন্ত ছিল। এ দীর্ঘ সময়ে আরবদেশে কোনো নবীর আবির্ভাব হয়নি, আর কোনো নবীর প্রকৃত শিক্ষাও সে দেশেপৌছেনি। অবশেষে হযরত ইবরাহিম আঃ এর দোয়া পূর্ণ হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসলো। তিনি কা’বা ঘর প্রতিষ্ঠার সময় আল্লাহরদরবারে দোয়া করেছিলেন- ”হে আল্লাহ! এদেশে একজন নবী এ জাতির মধ্য থেকেই প্রেরণ কর, যে এসে তাদেরকে তোমার বাণীশোনাবে; জ্ঞান ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দিবে এবং তাদের নৈতিক চরিত্র সংশোধন করবে”। এ দোয়া আল্লাহর কাছে মন্জুর হয়েছিল, তাই তারওঅধস্তন পুরুষে একজন কামেল ইনসান আবির্ভূত হলেন, যাঁর নাম মুহাম্মাদ মুসতাফা ইবনে আব্দুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)।
হযরত ইবরাহিম আঃ যেরূপ পুরোহিত ও পূজারীদের বংশে জন্ম লাভ করেছিলেন, এ কামেলে ইনসান হযরত মুহাম্মাদ সঃও অনুরূপ এক পরিবারে জন্মগ্রহন করেছিলেন শতাব্দীকাল ধরে যারা কা’বা ঘরের পৌরহিত্য করে আসছিল। একচ্ছত্র হযরত ইবরাহিম আঃ যেরূপ আপন বংশের পৌরহিত্যবাদের উপর আঘাত হেনেছিলেন, শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সঃও সেরূপ প্রচন্ড আঘাত হেনেছিলেন নিজ বংশীয় পৌরহিত্য ও পন্ডিতগিরির উপর। শুধু তাই নয়, তাঁর আঘাতে তা একেবারে মূলোৎপাটিত হয়েছিল। হযরত ইবরাহিম আঃ যেমন বাতিল মতবাদ ও সমগ্র মিথ্যা খোদায়ী ধ্বংশ করা এবং এক আল্লাহর প্রভূত্ব কয়েম করার উদ্দেশ্যে চেষ্টা করেছিলেন, শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সঃও তাই করেছিলেন। তিনি হযরত ইবরাহিম আঃ এর প্রচারিত প্রকৃত ও নির্মল দ্বীন ইসলামকে পূর্ণাঙ্গরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। একুশ বছর চেস্টায় তার এসব কাজ যখন পূর্ণতা লাভ করে তখন আল্লাহ তা’লার হুকুমে সমগ্র কা’বা ঘরকেই তিনি সমগ্র দুনিয়ার এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসীদের কেন্দ্ররূপে স্থাপনের কথা ঘোষণা করলেন এবং দুনিয়ার সকল দিক হতেই হজ্জ করার জন্য কা’বা ঘরে এসে জামায়েত হওয়ার জন্য আহ্বান জানালেনঃ
ولله علي الناس حج البيت من استطاع اليه سبيلا، ومن كفر فإن الله غني عن العالمين. ال عمران: 97
”মানুষের উপর আল্লাহর হক এই যে, এই কা’বা ঘর পর্যন্ত আসার সামর্থ যাদের আছে তারা হজ্জ করার জন্য এখানে আসবে। যারাঅস্বীকার করবে তারা জেনে রাখুক যে, আল্লাহ সৃস্টিজগতের প্রতি অমুখাপেক্ষী”।
এভাবে নব পর্যায়ে হজ্জ প্রবর্তন করার সাথে সাথে জাহেলী যুগে দু’হাজার বছর যাবত প্রচলিত যাবতীয় কুসংস্কার একবারে বন্ধ করাহলো। কা’বা গৃহের মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলা হলো। মেলা এবং উৎসব তামাশা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া হলো। আল্লাহর ইবাদাতকরার সঠিক এবং স্বাভাবিত পদ্ধতির প্রচলন করা হলো। আল্লাহর আদেশ হলোঃ
واذكروه كما هداكم، وان كنتم من قبله لمن الضالين. –البقرة- 198
”আল্লাহর স্বরণ এবং ইবাদাত করার যে পন্থা তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন, ঠিক তদানুযায়ী আল্লাহর স্বরণ ও ইবাদাত করযদিও এর পূর্বে তোমরা পথ ভ্রষ্ট ছিলে।
সকল অন্যায় ও বাজে তৎপরতা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হলোঃ
فلا رفث ولا فسوق ولا جدال في الحج. –البقرة- 197
”হজ্জ উপলক্ষে কোনরূপ ব্যভিচার, অশ্লীলতা, আল্লাহদ্রোহিতা, ফাসেকী কাজ এবং ঝগড়া বিবাদ বা যুদ্ধ বিগ্রহ করা যাবে না।”
কাব্য আর কবিত্বের প্রতিযোগীতা, পূর্বপুরুষদের কাজ কর্মের কথা নিয়ে গৌরব অহংকার এবং পরের দোষ ত্রুটি প্রচার করা বাগালাগাল দেয়া বন্ধ করা হলোঃ
فاذا قضيتم مناسككم فاذكروا الله كذكركم آبائكم او أشد ذكرى. البقرة- 200
”হজ্জের অনুষ্ঠানগুলো যখন সম্পন্ন হয়ে যাবে তখন তোমরা পূর্বপুরুষগন যেভাবে বাপ-দাদার স্বরণ করতো ঠিক অনুরূপ কিংবাতদপেক্ষা বেশী করে তোমরা আল্লাহর স্বরণ কর।”
শুধু লোকদের দেখাবার জন্য বা খ্যাতি অর্জনের জন্য যেসব বদান্যতা ও দানশীলতার গৌরব করা হতো তা সবই বন্ধ হলো এবংতদাস্থলে হযরত ইবরাহিম আঃ এর আমলের পশু জবেহ করার রীতি প্রচলিত হলো কারণ এর ফলে গরীব হাজীদেরও করবানীরগোশত খাওয়ার সুযোগ মিলতো।
كلوا واشربوا ولا تسرفوا، انه لا يحب المسرفين. الاعراف- 31
”খাও, পান কর, কিন্ত অপচয় কর না; কারণ আল্লাহ তা’লা অপচয়কারীদেরকে ভালোবাসেন না।”
فاذكروا اسم الله عليها صواف، فاذا وجبت جنوبها فكلوا منها واطعموا القانع والمعتر. الحج- 36
”খালেছ আল্লাহর উদ্দেশ্যেই এবং তাঁরই নামে এ জন্তুগুলোকে জবেহ কর। জবেহ করার পর যখন প্রাণ একেবারে বের হয়ে যাবে,তখন নিজেরা তা খাও এবং ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্থকেও খেতে দাও।”
কুরবানির পশুর রক্ত খানায়ে কা’বার দেয়ালে মর্দন করা এবং গোশত নিক্ষেপ করার কু্প্রথা বন্ধ হলো। পরিষ্কার বলে দেওয়া হলোঃ
لن ينال الله لحومها ولا دمائها ولكن يناله التقوى منكم. الحج- 37
”এসব পশুর রক্ত বা গোশত আল্লাহর কাছে পৌছায় না, তোমাদের তাকওয়া এবং পরহেযগারিই আল্লাহর কাছে পৌছাতে পারে।”
উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফ করা একেবারে নিষিদ্ধ হয়ে গেল এবং বলা হলোঃ
قل من حرم زينة الله اللتي اخرج لعباده. الاعراف- 32
“হে নবী! আপনি তাদেরকে বলে দিন যে, আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য যেসব সৌন্দর্যবর্ধক জিনিস মনোনীত করেছেন, তা কে হারামকরলো?”
قل ان الله لا يأمر بالفحشاء. الاعراف- 68
”হে নবী! আপনি বলে দিন যে, আল্লাহ কখনো নির্লজ্জতার হুকুম দেন না।”
يبني آدم خذوا زينتكم عند كل مسجد. الاعراف- 31
”হে আদম সন্তান! সকল ইবাদাতের সময় তোমাদের সৌন্দর্য গ্রহন কর।”
হজ্জের নির্দিস্ট মাসগুলোকে উল্টিয়ে দেওয়া এবং নিষিদ্ধ মাসকে যুদ্ধের জন্য হালাল মনে করাকে বিশেষ কড়াকড়ির সাথে বন্ধ করাহলোঃ
انما النسيء زيادة في الكفر، يضل به اللذين كفروا، يحلونه عاما ويحرمونه عاما ليواطئوا عدة ما حرم الله، فيحلوا ما حرم الله. التوبة- 37
“নাসী কুফরীকে অধিকতর বাড়িয়ে দেয়। কাফেরগন এভাবে আরো অধিক গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়। এক বছর এক মাসকে হালালমনে করে আবার তার দ্বিতীয় বছর তার বদলে আর একটি মাসকে হারাম বেধে নেয়- যেন আল্লাহর নিষিদ্ধ মাসগুলোর সংখ্যা সমানথাকে। কিন্ত এরকম কাজ করলে আল্লাহর নিষিদ্ধ মাসকেই হালাল করা হয়।”
সম্বল না নিয়ে হজ্জ যাত্রা করা নিষিদ্ধ হলো এবং পরিষ্কার বলে দেওয়া হলোঃ
وتزودوا، فان خير الزاد البتقوى. البقرة- 196
”হজ্জ গমনকালে সম্বল অবশ্যই নেবে। কারণ, (দুনিয়ার সফরের সম্বল না নেওয়া আখেরাতের সম্বল নয়) আখেরাতের উত্তম সম্বলতোহচ্ছে তাকওয়া।”
হজ্জের সময় ব্যবসা করা বা অন্যকোন রুজি রোজগার করা নিতান্ত অপরাধের কাজ, আর এসব না করাকেই বড় পুণ্যের কাজ মনেকরা হতো। আল্লাহ তা’লা এ ভুল ধারণার প্রতিবাদ করে নাযিল করলেনঃ ليس عليكم جناح ان تبتغوا فضلا من ربكم. البقرة – 197
“(হজ্জে গমনকালে) ব্যবসা করে আল্লাহর অনুগ্রহস্বরূপ কিছু কামাই রোযগার করলে তাতে কোন অসুবিধা নাই”।
বোবা হজ্জ এবং ক্ষুধার্ত-পিপাসার্ত হজ্জ হতেও মানুষকে বিরত রাখা হলো। শুধু তাই নয়, জাহেলী যুগের আরো অসংখ্য কুসংস্কারনির্মূল করে দিয়ে তাকওয়া, আল্লাহর ভয়, পবিত্রতা এবং অনাড়ম্বরতাকে মানবতার পূর্ণাঙ্গ আদেশ বলে ঘোষণা করা হলো। হজ্জযাত্রীদের নির্দেশ দেওয়া হলো যে, তারা যেন ঘর থেকে বের হওয়ার সময় নিজেদেরকে সকল প্রকার প্রার্থিব সম্পর্ক থেকে মুক্ত করেনেয়, নফসের খাহেশ ও লালসা যেন ত্যাগ করে হজ্জ গমন পথে স্ত্রী সহবাসও যেন না করে, গালাগাল, কুৎসা রটানো, অশ্লীল উক্তিপ্রভৃত্তি জঘন্য আচরন থেকে যেন দূরে সরে থাকে। কা’বায় পৌছার যত পথ আছে, প্রত্যেক পথেই একটি স্থান নির্দিস্ট করে দেওয়াহয়েছে। সে স্থান অতিক্রম করে কা’বা ঘরের দিকে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে এহরাম বেধে গরীবানা পোষাক পরিধান করে নেবে। এতেআমীর, গরীব সকলেই সমান হবে, পৃথক পৃথক কওম, গোত্র প্রভৃতি ঘুচে যাবে। সকলেই এক বেশে নিতান্তই গরীবের বেশে একআল্লাহর সামনে বিনয় ও নম্রতার সাথে উপস্থিত হবে। এহরাম বাধার পর মানুষের রক্তপাততো দূরের কথা, পশু শিকার করাও নিষিদ্ধ।মানুষের মধ্য থেকে পশু স্বভাব দূর করে শান্তি প্রিয়তার গুণ সৃস্টি এবং মানুষকে আধ্যাত্নিক ভাবধারায় মহীয়ান করে তোলাই এর মূলউদ্দেশ্য। হজ্জের চার মাসকালের মধ্যে যেন কোন যুদ্ধ বিগ্রহ না হয়, এজন্য এ চারটি মাসকে হারাম করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলেকা’বা গমনের সমস্ত পথ নিরাপদ হবে; হজ্জ যাত্রীদের পথে কোনরূপ বিপদের আশংকা থাকবে না। এরূপ পবিত্র ভাবধারা সহকারেতারা হেরেম শরীফে প্রবেশ করবে- কোনরূপ রং তামাশা, নাচ গান এবং মেলা আর খেলা দেখার উদ্দেশ্যে নয়। এখানে প্রতি পদে পদেআল্লাহর স্বরণ- আল্লাহর নামে জিকির , নামায, ইবাদাত ও কুরবানী এবং কা’বা ঘর প্রদক্ষিন করতে হয়। আর এখানে একটি মাত্রআওয়াজই মুখরিত হয়ে উঠে, হেরেম শরীফের প্রাচীর আর পাহাড়ের চড়াই উৎরাইয়ের প্রতিটি পথে উচ্ছারিত হয়ঃ
لبيك اللهم لبيك، لبيك لا شريك لك لبيك، ان الحمد والنعمة لك والملك، لا شريك لك.
”তোমার ডাকেই হাজির হয়েছি, হে আল্লাহ! আমি এসেছি, তোমার কোন শরীক নাই, আমি তোমারই কাছে এসেছি। সকল তা’রীফএকমাত্র তোমারই জন্য। সব নেয়ামত তোমারই দান, রাজত্ব আর প্রভুত্ব সবই তোমার। তুমি এক, কেউ তোমার শরীক নেই।”
এরূপ পূত-পবিত্র এবং ঐকান্তিক নিষ্ঠাপূর্ণ হজ্জ সম্পর্কে বিশ্বনবী ইরশাদ করেছেনঃ
من حج لله فلم يرفث ولم يفسق رجع كيوم ولدته امه.
”যে ব্যক্তি খাঁটিভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ করে এবং এ ব্যপারে সকল প্রকার লালসা এবং ফাসেকী থেকে দূরে থাকে, সে সদ্যজাতশিশুর মতই (নিস্পাপ হয়ে) ফিরে আসে।
অতঃপর হজ্জের কল্যাণ এবং কার্যকরীতা বর্ণনা করার পূর্বে হজ্জ কি রকমের ফরজ তা বলা আবশ্যক। আল্লাহ কালামে পাকেবলেনঃ
ولله علي الناس حج البيت من استطاع اليه سبيلا، ومن كفر فإن الله غني عن العالمين. ال عمران: 97
”মানূষের উপর আল্লাহর হক এই যে, এই কা’বা ঘর পর্যন্ত আসার সামর্থ যাদের আছে তারা হজ্জ করার জন্য এখানে আসবে। যারাঅস্বীকার করবে তারা জেনে রাখুক যে, আল্লাহ সৃস্টিজগতের প্রতি অমুখাপেক্ষী”।
এ আয়াতে হজ্জ করার সামর্থ থাকা সত্বেও হজ্জ না করাকে পরিস্কার কুফরী বলা হয়েছে। নবী করীম সঃ এর ব্যাখ্যা সম্পর্কে যাবলেছেন, তার মধ্যে দুটি হাদিস উল্লেখ করা হয়েছেঃ
من ملك زادا وراحلة تبلغه الي بيت الله ولم يحج فلا عليه ان يموت يهوديا او نصرانيا.
”আল্লাহর ঘর পর্যন্ত পৌছার জন্য পথের সম্বল এবং বাহন যার আছে সে যদি হজ্জ না করে, তবে এ অবস্থায় তার মৃত্যু ইহুদী ওনাসারার মৃত্যুর সমান বিবেচিত হবে”।
من لم يمنعه من الحج حاجة ظاهرة او سلطان جائر او مرض حابس فمات ولم يحج فليمت ان شاء يهوديا وان شاء نصرانيا.
”যার কোনো প্রকাশ্য অসুবিধা নাই, কোনো জালেম বাদশাও তার পথ রোধ করেনি এবং যাকে কোনো রোগ অসমর্থ করে রাখনি;এতদসত্বেও সে যদি হজ্জ না করেই মারা যায়, তবে সে ইহুদী বা খৃস্টান হয়েই মারা যেতে পারে।”
হযরত ওমর ফারুক রাঃ এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, ”সামর্থ্য থাকা সত্বেও যারা হজ্জ করে না, তাদের উপর জিযিয়া কর আরোপ করতেইচ্ছা হয়; কারন তারা মুসলমান নয়।”
আল্লাহ তা’লার উল্লেখিত এরশাদ এবং রাসূলে কারীম সঃ ও তাঁর খলিফার এ ব্যাখ্যা দ্বারা প্রত্যেকেই বুঝতে পারেন যে, হজ্জ করাসামান্য ফরয নয়। তা আদায় করা না করা মুসলমানদের ইচ্ছাধীন করে দেওয়া হয়নি। বস্তুত যেসব মুসলমানদের কা’বা পর্যন্ত যাওয়াআসার সামর্থ আছে, শারীরিক দিক দিয়েও যারা অক্ষম নয় তাদের পক্ষে জীবনের মধ্যে একবার হজ্জ করা কর্তব্য। তা না করেকিছুতেই মুক্তি নেই। দুনিয়ার যে কোনেই বাসা করুক না কেন, সামর্থ্য থাকা সত্তেও একজন মুসলমান যদি হজ্জকে এড়াতে চায় এবংঅসংখ্য ব্যস্ততার অজুহাতে বছরের পর বছর তাকে ক্রমাগত পিছিয়ে দেয়; সময় থাকতে আদায় না করে, তবে তার ঈমান আছেকিনা সন্দেহ। আর যাদের সমগ্র জীবনেও হজ্জ আদায় করার কর্তব্য পালনের কথা মনে জাগেনা, দুনিয়ার দিকে দিকে, দেশে দেশেঘুরে বেড়ায়, ইউরোপ আমেরিকা যাতায়াতকালে হেজাজের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে, কা’বা ঘর যেখান থেকে মাত্র কয়েক ঘন্টার পথ, তবুও হজ্জ আদায় করার খেয়াল তাদের মনে জাগ্রতা হয় না- তারা কিছুতেই মুসলমান নয়; মুসলমান বলে দাবী করার কোনোইঅধিকার তাদের নেই। দাবী করলেও সেই দাবী হবে মিথ্যা। আর যারা তাদেরকে মুসলমান বলে মনে করে, তারা কুরআন শরীফেরবিধান সম্পর্কে অজ্ঞ, জাহেল। এসব লোকের জন্য যদি মুসলিম জাহানের জন্য দরদ থাকে তবে থাকতে পারে; কিন্ত তার কোনইস্বার্থকতা নেই। কারন তাদের হৃদয় মনে আল্লাহর আনুগত্য ও তার বিধানের প্রতি ঈমানের কোনো অস্তিত্ব নেই, একথা শতঃসিদ্ধ।
----------------------------------------------------------------------------------
'' শুধু নিজে শিক্ষিত হলে হবেনা, প্রথমে বিবেকটাকে শিক্ষিত করুন। ''
কোন মন্তব্য নেই:
/>