আলোচ্যসূচি ঃ
১। লেখকের কৈফিয়ত
২। কতিপয় মূলনীতি
৩। ‘শবে বরাত’ এর অর্থ
৪। আল-কুরআনে শবে বরাতের কোন উল্লেখ নেই
৫। শবে বরাত নামটি হাদীসের কোথাও উল্লেখ হয়নি
৬। ফিকহের কিতাবে শবে বরাত
৭। শবে বরাত সম্পর্কিত প্রচলিত আকীদাহ-বিশ্বাস ও ‘আমল
৮। শবে বরাতের সম্পর্ক শুধু ‘আমলের সাথে নয়
৯। শাবানের মধ্যরজনীর ফযীলত সম্পর্কিত হাদীসসমূহের পর্যালোচনা
১০। শাবানের মধ্যরজনীর সম্পর্কিত হাদীসসমূহ পর্যালোচনার সারকথা
১১। ভাগ্য লিপিবদ্ধ করা সম্পর্কিত একটি হাদীস ও উহার পর্যালোচনা
১২। সৌভাগ্য রজনী ধর্ম বিকৃতির শামিল
১৩। শবে বরাত সম্পর্কে উলামায়ে কিরামের বক্তব্য
১৪। শবে বরাত সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহর অবস্থান
১৫। শবে বরাত সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করার দায়িত্ব উলামায়ে কিরামের
১৬। একটি বিভ্রান্তির নিরসন
১৭। বিদ‘আত সম্পর্কে কিছু কথা
১৮। বিদ‘আতের কুফল
১৯। সন্দেহজনক নফল ‘আমল থেকে দূরে থাকা উত্তম
২০। সর্বশেষ আহ্বান
লেখকের কৈফিয়ত
সকল প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার জন্য, যিনি পরিপূর্ণ দ্বীন হিসাবে আমাদেরকে ইসলাম দান করেছেন, যে দ্বীনে মানুষের পক্ষ থেকে কোন সংযোজন বা বিয়োজনের প্রয়োজন হয় না। সালাত ও সালাম তাঁরই রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি, যিনি আল্লাহর দ্বীনের রিসালাতের দায়িত্ব পূর্ণাঙ্গভাবে আদায় করেছেন, কোথাও কোন কার্পণ্য করেননি। দ্বীন হিসাবে যা কিছু এসেছে তিনি তা উম্মতের কাছে পৌছে দিয়েছেন ও নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করে গেছেন। তার সাহাবায়ে কিরামের প্রতি আল্লাহর রাহমাত বর্ষিত হোক, যারা ছিলেন উম্মতে মুহাম্মাদীর আদর্শ ও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ পালনে সকলের চেয়ে অগ্রগামী।
শবে বরাতের মত একটি বিষয় নিয়ে কিছু লেখার কি প্রয়োজন ছিল? আমি এর কৈফিয়ত স্বরূপ কিছু কথা না বলে পারছিনা।
(এক) গত ৪/১২/১৯৯৮ ইংরেজী তারিখে আমি গাজীপুরের একটি মাসজিদে জুমু‘আর খুতবাহ ও আলোচনায় শবে বরাত সম্পর্কে কিছু কথা বলেছিলাম। আলোচনা শেষে উপস্থিত মুসল্লীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। অনেকে বলেছেন ঃ “শবে বরাত সম্পর্কে এমন স্পষ্ট কথা আগে কোথাও শুনিনি।” আবার অনেকে “যতসব নুতন নুতন মাসালা” আখ্যায়িত করে আমার আলোচনাকে প্রত্যাখ্যান করলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন, লেখক ও গবেষক আবুল বাশার মুহাম্মাদ ইকবাল (রহঃ)। তিনি আমাকে বললেন ঃ আপনার এ বক্তব্যটি একটি প্রবন্ধ আকারে লিখে ফেলুন। তিনি আমাকে বার বার অনুরোধ করছিলেন, আর আমি লিখব লিখব বলে ওয়াদা করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু এর পরের বছর যখন ১৫ শাবান এলো তখন তিনি আবারো বললেন ঃ “আপনাকে এ বিষয়ে লেখার জন্য বলেছিলাম, আপনি কিন্তু এখনো লিখেননি। আগামী দশ দিনের মধ্যে লেখা জমা দিবেন। আমরা আমাদের মাসিক পত্রিকার শাবান সংখ্যায় আপনার শবে বরাত সম্পর্কিত লেখাটি প্রকাশ করতে চাই।” কিন্তু আমি তখনো তার অনুরোধ রক্ষা করতে পারিনি। তিনি প্রায়ই আক্ষেপ করে বলতেন ঃ “আপনি লিখলেন না!” কয়েক মাস পর তিনি ইন্তেকাল করেন। তার ইন্তেকালের পর থেকে আমি নিজেকে অপরাধী মনে করতে থাকি। তার জীবদ্দশায় তার একটি ইচ্ছা আমি পূরণ করতে পারিনি। এর প্রায়শ্চিত্ত করার অনুভূতি আমাকে তাড়া করতে থাকে।
(দুই) প্রতি বছর যখন ১৫ শাবান আসে তখন দেখি আলেম-উলামাগণ, ওয়াজীনে কিরাম, আইয়েম্মায়ে মাসাজিদ বিভিন্ন মাসজিদে, পত্র-পত্রিকায়, রেডিও
টিভিতে শবে বরাত সম্পর্কে লাগামহীন এবং মনগড়া আলোচনা করেন, যা শুনে একজন সাধারণ মানুষ ধারণা করে নেয় যে, শবে বরাত ইসলামের মূল পর্বগুলিার একটি। তাই তারা অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে তা পালন করেন। এ অবস্থা দেখে অত্যন্ত দুঃখ লাগে, ব্যথা পাই। সংকল্প করি দু একদিনের মধ্যেই এ বিষয়ে লিখতে হবে এবং লিখব। কিন্তু শবে বরাতের ডামাডোল যখন শেষ হয়ে যায় তখন সংকল্পে ভাটা পড়ে। মনে করি আবার এক বছর পর ১৫ শাবান আসবে, অনেক সময় হাতে আছে। আর এ রকম অলসতা করতে গিয়ে চলে গেছে ছয় ছয়টি বছর। আমার মনে হল অনেক দেরী হয়ে গেছে, আরও দেরী করা অন্যায় হবে।
(তিন) যখন ১৫ শাবান সমাগত হয় তখন সাধারণ মানুষ ও অনেক দা’য়ী ইলাল্লাহ, আলেম-উলামাগণ এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেন, জানতে চান। তাদের প্রশ্নের ভাষা এ রকম ঃ “অনেকে বলেন শবে বরাত বলতে কিছু নেই, এ সম্পর্কে কোন সহীহ হাদীস নেই। আবার অনেকে বলেন শবে বরাত, উহার ফাযীলাত ও ‘আমল রয়েছে, আছে তার বিশুদ্ধ প্রমাণ। আসলে বিষয়টির ব্যাপারে সঠিক অবস্থান কি হওয়া উচিত?” তাদের এ প্রশ্নের পূর্ণ জওয়াব দেয়া যেমন যরুরী তেমনি কঠিন। আর কিছু না বলে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এড়িয়ে গেলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। তাই এ ব্যাপারে আমি যে সিদ্ধান্তে পৌছেছি তা না লিখে কোন উপায় ছিল না।
এ বিষয়ে লিখতে গিয়ে আমি যে বড় ধরনের কোন গবেষণা করেছি তা কিন্তু দাবী করছি না। শবে বরাতের পক্ষে-বিপক্ষে লিখিত বিভিন্ন পুস্তিকাসহ অল্প কয়েকটি কিতাবের সাহায্য নিয়েছি মাত্র। এ বিষয়ে লেখার শুরুতে আমি একটি বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম যে, কোন শ্রেণীর লোকজনকে সম্বোধন করে লিখব। সাধারণ লোকদের না আলেম সমাজকে? অবশেষে উভয় প্রকারের লোকদের সম্বোধন করার চেষ্টা করেছি। এ কারণে যদি আমি বিষয়টিকে স্পষ্ট করে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হই তাহলে এটা আমার অযোগ্যতারই প্রমাণ।
(চার) বিদ‘আত সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঃ
শুরু থেকে আমি একজন কওমী মাদ্রাসার ছাত্র। কওমী মাদ্রাসায় পড়–য়া মানুষেরা ঐতিহ্যগতভাবেই অন্যের তুলনায় বিদ‘আত সম্পর্কে বেশী সচেতন হয়ে থাকে। আমি আমার আসাতিজায়ে কিরাম থেকে বিদ‘আত এর বিরুদ্ধে সচেতন হওয়ার ছবক লাভ করি। বিশেষ করে বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র আল-জামেয়াতুল আহলিয়্যা দারুল উলূম হাটহাজারী চট্রগ্রামে যখন ইংরেজী ১৯৯২ সনে দাওরায়ে হাদীস জামাতে পড়ছিলাম। তখন আমার মুহসিন ও মুখলিস উস্তাদগণের কাছ থেকে বিদ‘আত ও উহার মূল নীতি সম্পর্কে যথেষ্ট ইস্তেফাদা অর্জন করেছিলাম। তারা ছিলেন এ দেশে প্রচলিত র্শিক ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে সোচ্চার কন্ঠ। তবে তারা যে বিপদ আপদ দূর করার জন্য কিংবা বরকত লাভের উদ্দেশে কুরআন খতম ও খতমে বুখারীর অনুষ্ঠান করতেন, খতমে ইউনূস ও খতমে খাজেগান করতেন, তাবীজ-কবচ ব্যবহার করতে লোকজনকে উৎসাহ দিতেন, সেই কাজগুলো কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত কিনা এ প্রশ্ন আমার মনে থেকেই যেত। উস্তাতগণের সামনে এ সকল প্রশ্ন করাকে ‘না জানি বেয়াদবী হয়ে যায়’ এমন একটা অনুভূতির কারণে চূপ হয়ে যেতাম। আবার কখনো কোন উস্তাতগণের সাথে একটু ঘনিষ্ট হলেই সওয়াল করে বসতাম। অনেকে জবাব দেয়া থেকে এড়িয়ে যেতেন। আবার অনেকে সাধ্যমত জবাব দিতেন। কিন্তু তাতে পরিতৃপ্ত হওয়া যেত না। আর এভাবে দাওরায়ে হাদীস শেষ করলাম।
এরপর আমি বিভিন্ন আরব দেশ থেকে আগত একাধিক উস্তাদদের কাছে পড়াশুনা করার সুযোগ পেলাম। সত্যিই তাদের থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা আমার বিদ‘আত বিরোধী চেতনাকে পরিশুদ্ধ করেছে। আমি অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম। অনেক সংশয়ের অবসান হল। এ সকল মুহসিন আসাতিজার সকলের নাম আমার দুর্বল স্মরণশক্তি ধরে রাখতে পারেনি। কিন্তু তাতে কি! আমি তাদের নাম হাজার বার ভুলে গেলেও ঔ সকল মুহসিন বান্দাদের আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন প্রাপ্য পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করবেন না।
إن الله لا يضيع أجر المحسنين.
আমরা তাদের অবদানের যথার্থ মূল্যায়ন করতে না পারলেও যাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তারা সুদূর আরব থেকে এদেশে বার বার এসে দাওয়াত, তালীমসহ বহু জনকল্যাণমূলক কাজ করেছেন, তিনি তাদের কাজের যথার্থ মূল্যায়ন করবেন। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী অবদান যে ব্যক্তির, তিনি হলেন ই্িঞ্জনিয়ার মুহাম্মাদ মুজীবুর রহমান, যিনি এ দেশের হাজার হাজার আলেমে-দ্বীন, ইমাম ও দা’য়ীদের অভিভাবক। আল্লাহর এ মুহসিন বান্দার মাধ্যমে শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপকৃত হয়েছেন এ দেশের লাখ লাখ মানুষ। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে নির্মিত ও আবাদ হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে শত শত মাসজিদ ও ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সর্বদা প্রচারবিমুখ আল্লাহর এ মুহসিন বান্দা হয়ত এ মহান খিদমাতের স্বীকৃতি স্বরূপ কোন দিন কোন প্রতিষ্ঠান থেকে পদক পাবেন না। কিন্তু যাঁর জন্য সকল নেক ‘আমল নিবেদন করা হয় সেই মহান সত্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার প্রতিদান দিতে কোন কৃপণতা করবেন না। হৃদয় নিংড়ানো এ প্রার্থনা শুধু আমার একার নয়, আমরা যারা তার থেকে দ্বীনী শিক্ষা প্রসার ও দাওয়াতের চেতনায় সমৃদ্ধ হয়েছি, দিক-নির্দেশনা ও উৎসাহ পেয়েছি তাদের সকলের, আল্লাহর এ বিশাল দুনিয়ার যেখানেই আমরা থাকি না কেন।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদা তাঁর উম্মতকে বিদ’আত সম্পর্কে সতর্ক করতেন। তিনি প্রায় সকল খুতবায় বলতেন ঃ
أما بعد فإن خير الحديث كتاب الله وخير الهدي هدي محمد صلى الله عليه وسلم وشر الأمور محدثاتها وكل بدعة ضلالة.(رواه مسلم عن جابر بن عبد الله)
অর্থ ঃ শুনে রেখ! সর্বোত্তম কথা হল আল্লাহর কিতাব, সর্বোত্তম পথ-নির্দেশ হল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের পথ-নির্দেশ, আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হল দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্ট বিষয় এবং সকল বিদ’আতই পথ-ভ্রষ্টতা। (মুসলিম)
বিদায় হজ্জেও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদ’আতে লিপ্তদের পরিণাম সম্পর্কে ভাষণ দিয়েছেন।
আমি মনে করি আল্লাহর ফযলে যদি আমার এ পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয় তাহলে অনেক সম্মানিত আলেমে দ্বীন ভাইয়েরা এর প্রতিবাদ করবেন। এ বিষয়টা খন্ডন করে আবার কিতাব লিখবেন, সমালোচনা করবেন। করবেন না কেন? অবশ্যই করবেন। কিন্তু তাদের কাছে আমি সবিনয় আবেদন করব, তারা যেন তাদের এ সকল কাজ একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে করেন। তা হল বিদ’আতকে উৎপাটন ও সুন্নাহ কায়েম করা। বর্তমানে এ দুর্যোগময় ও বিপদ সংকুল সময়ে ইসলামের দিকে দাওয়াতে যারা নিবেদিত প্রাণ তাদের থেকে বিদ’আত প্রসারে সহায়তা করে এ রকম বিষয় প্রকাশ হওয়া মুসলিম উম্মাহর জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
আমাদের দেশে বা দেশের বাইরে যারা বিভিন্ন বিদ’আতী কাজ-কর্মে লিপ্ত তারা নিজেদের কাজের সমর্থনে কিন্তু জবরদস্ত দলীলাদি উপস্থাপন করে। কিন্তু এ সব দলীলা কি গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ? না, সেগুলো মোটেই বিশুদ্ধতার মানদন্ডে মাকবুল নয়। দলীল থাকলেই তা গ্রহণ করে ‘আমল করা যায় না। ‘আমল করার জন্য তা একশ ভাগ বিশুদ্ধ হতে হবে।
সর্বশেষে যাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে পারছিনা তারা হলেন বিশিষ্ট আলেমে-দ্বীন, ফাজেলে দারুল উলূম দেওবন্দ যাকারিয়া বিন খাজা আহমাদ। যিনি বইটি দু’ দু’ বার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পাদনা করেছেন। একটি অধ্যায় সংযোজন করেছেন।
আরো যারা সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন তারা হলেন সহকর্মী ইকবাল হোসাইন মাসূম, আবুল কালাম আযাদ, জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের ও নুমান আবুল বাশার সাহেব। তারা সকলে যথেষ্ট যোগ্য আলেম। বয়সে নবীন হলেও ইল্ম ও প্রজ্ঞায় নবীনতার ছাপ নেই।
এ ছাড়া বইটি নির্ভুল করার জন্য সময়, শ্রম ও মেধার কুরবানী দিয়েছেন মাদ্রাসা মুহাম্মাদিয়ার মুহতারম উস্তাদ হাফেয রফিকুল ইসলাম ও মাদ্রাসা দারুস সুন্নাহর পরিচালক শহীদুল্লাহ খাঁন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁদের সকলের এ খিদমাতকে علم ينتفع به হিসাবে কবুল করুন। আমীন!
আব্দুল্লাহ শহীদ
২৯-০৬-১৪২৬ হিজরী
কতিপয় মূলনীতি
মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে কতিপয় মূলনীতি উল্লেখ করছি যা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমার বিশ্বাস।
(এক) যদি কোন একটা প্রথা যুগ যুগ ধরে কোন অঞ্চলের মুসলিম সমাজে চলে আসে, তাহলে তা শরীয়ত সম্মত হওয়ার প্রমাণ বহন করেনা। এটা বলা ঠিক হবে না যে, শত শত বছর ধরে যা পালন করে আসছি তা না জায়েয হয় কিভাবে? বরং তা শরীয়ত সম্মত হওয়ার জন্য অবশ্যই শর’য়ী দলীল থাকতে হবে।
(দুই) ইসলামের যাবতীয় বিষয়াবলী দু’ প্রকার (ক) আকীদাহ বা বিশ্বাস (খ) ‘আমল বা কাজ। কোন ‘আমল বা কাজ ইসলামের শরীয়ত সম্মত হওয়ার জন্য অবশ্যই কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াস এই চারটির যে কোন একটি দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে। কিন্তু আকীদাগত কোন বিষয় অবশ্যই কুরআন অথবা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে। ইজমা অথবা কিয়াস দ্বারা আকীদাহর কোন বিষয় প্রমাণ করা যাবে না।
(তিন) যে সকল হাদীস কিতাব আকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লিখিত সবগুলো হাদীস বিশুদ্ধ বা সহীহ নয়। হাদীস বিশারদগণ যুগ যুগ ধরে গবেষণা করে নির্ধারণ করেছেন কোনটি সহীহ, কোনটি যয়ীফ (দুর্বল সূত্র), কোনটি মওজু (জাল বা বানোয়াট)। তাই সব ধরনের হাদীস মোতাবেক ‘আমল করা ঠিক নয়। হাদীসসমূহ থেকে শুধু সহীহগুলি ‘আমলে নেয়া হবে। যদি সব ধরনের হাদীস ‘আমলে নেয়া হয় তাহলে শত শত বছর ধরে এ বিষয় গবেষণা ও তা চর্চার সার্থকতা কি?
(চার) দুর্বল বা জাল হাদীসের উপর ভিত্তি করে ইসলামী শরীয়তে কোন আকীদাহ ও ‘আমল চালু করা যায় না। তবে কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত কোন ‘আমলের ফাযীলাতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করা যায়।
(পাঁচ) কোন স্থান বা সময়ের ফযীলাত কুরআন বা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলে তা দ্বারা সে স্থানে বা সে সময়ে ‘আমল (ইবাদাত-বন্দেগী) করার ফযীলাত প্রমাণিত হয়না। যদি ‘আমল করার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র শরয়ী দলীল থাকে তাহলেই ‘আমল করা যায়।
‘শবে বরাত’ এর অর্থ
‘শব’ একটি ফারসী শব্দ এর অর্থ রাত। ‘বারায়াত'কে যদি আরবী শব্দ ধরা হয় তাহলে এর অর্থ হচ্ছে সম্পর্কচ্ছেদ, পরোক্ষ অর্থে মুক্তি। যেমন কুরআন মাজীদে সূরা বারায়াত রয়েছে যা সূরা তাওবা নামেও পরিচিত। ইরশাদ হয়েছে ঃ
بَرَاءَةٌ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ (التوبة: ১)
অর্থ ঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা। (সূরা তাওবা, ১)
এখানে বারায়াতের অর্থ হল সম্পর্ক ছিন্ন করা। ‘বারায়াত’ মুক্তি অর্থেও আল-কুরআনে এসেছে যেমন ঃ
أَكُفَّارُكُمْ خَيْرٌ مِنْ أُولَئِكُمْ أَمْ لَكُمْ بَرَاءَةٌ فِي الزُّبُرِ . (سورة القمر :৪৩)
অর্থ ঃ তোমাদের মধ্যকার কাফিররা কি তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ? না কি তোমাদের মুক্তির সনদ রয়েছে কিতাবসমূহে? (সূরা কামার, ৩৪)
আর ‘বারায়াত’ শব্দক যদি ফারসী শব্দ ধরা হয় তাহলে উহার অর্থ হবে সৌভাগ্য। অতএব শবে বরাত শব্দটার অর্থ দাড়ায় মুক্তির রজনী, সম্পর্ক ছিন্ন করার রজনী। অথবা সৌভাগ্যের রাত, যদি ‘বরাত’ শব্দটিকে ফার্সী শব্দ ধরা হয়।
শবে বরাত শব্দটাকে যদি আরবীতে তর্জমা করতে চান তাহলে বলতে হবে ‘লাইলাতুল বারায়াত’। এখানে বলে রাখা ভাল যে এমন অনেক শব্দ আছে যার রূপ বা উচ্চারণ আরবী ও ফারসী ভাষায় একই রকম, কিন্তু অর্থ ভিন্ন।
যেমন ‘গোলাম’ শব্দটি আরবী ও ফারসী উভয় ভাষায় একই রকম লেখা হয় এবং একইভাবে উচ্চারণ করা হয়। কিন্তু আরবীতে এর অর্থ হল কিশোর আর ফারসীতে এর অর্থ হল দাস।
সার কথা হল ‘বারায়াত’ শব্দটিকে আরবী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সম্পর্কচ্ছেদ বা মুক্তি। আর ফারসী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সৌভাগ্য।
আল-কুরআনে শবে বরাতের কোন উল্লেখ নেই
শবে বরাত বলুন আর লাইলাতুল বারায়াত বলুন কোন আকৃতিতে শব্দটি কুরআন মাজীদে খুজে পাবেন না। সত্য কথাটাকে সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায় পবিত্র কুরআন মাজীদে শবে বরাতের কোন আলোচনা নেই। সরাসরি তো দূরের কথা আকার ইংগিতেও নেই।
অনেককে দেখা যায় শবে বরাতের গুরুত্ব আলোচনা করতে যেয়ে সূরা দুখানের প্রথম চারটি আয়াত পাঠ করেন। আয়াতসমূহ হল ঃ
حم ﴿১﴾ وَالْكِتَابِ الْمُبِينِ ﴿২﴾ إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ ﴿৩﴾ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ ﴿৪﴾ (الدخان: ১-৪)
অর্থ ঃ হা-মীম। শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। আমিতো এটা অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে। আমি তো সতর্ককারী। এই রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়। (সূরা দুখান, ১-৪)
শবে বরাত পন্থী আলেম উলামারা এখানে বরকতময় রাত বলতে ১৫ শাবানের রাতকে বুঝিয়ে থাকেন। আমি এখানে স্পষ্টভাবেই বলব যে, যারা এখানে বরকতময় রাতের অর্থ ১৫ শাবানের রাতকে বুঝিয়ে থাকেন তারা এমন বড় ভুল করেন যা আল্লাহর কালাম বিকৃত করার মত অপরাধ। কারণ ঃ
(এক) কুরআন মাজীদের এ আয়াতের তাফসীর বা ব্যাখ্যা সূরা আল-কদর দ্বারা করা হয়। সেই সূরায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন ঃ
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ ﴿১﴾ وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ ﴿২﴾ لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ ﴿৩﴾ تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ ﴿৪﴾ سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ ﴿৫﴾
অর্থ ঃ আমি এই কুরআন নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আপনি জানেন লাইলাতুল কদর কি? লাইলাতুল কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্য মালাইকা (ফেরেশ্তাগণ) ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশে। এই শান্তি ও নিরাপত্তা ফজর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। (সূরা কাদর, ১-৫)
অতএব বরকতময় রাত হল লাইলাতুল কদর। লাইলাতুল বারায়াত নয়। সূরা দুখানের প্রথম সাত আয়াতের ব্যাখ্যা হল এই সূরা আল-কদর। আর এ ধরনের ব্যাখ্যা অর্থাৎ আল-কুরআনের এক আয়াতের ব্যাখ্যা অন্য আয়াত দ্বারা করা হল সর্বোত্তম ব্যাখ্যা।
(দুই) সূরা দুখানের লাইলাতুল মুবারাকার অর্থ যদি শবে বরাত হয় তাহলে এ আয়াতের অর্থ দাড়ায় আল কুরআন শাবান মাসের শবে বরাতে নাযিল হয়েছে। অথচ আমরা সকলে জানি আল-কুরআন নাযিল হয়েছে রামাযান মাসের লাইলাতুল কদরে।
যেমন সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন ঃ
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآَنُ.
অর্থ ঃ রামাযান মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে আল-কুরআন।
(তিন) অধিকাংশ মুফাচ্ছিরে কিরামের মত হল উক্ত আয়াতে বরকতময় রাত বলতে লাইলাতুল কদরকেই বুঝানো হয়েছে। শুধু মাত্র তাবেয়ী ইকরামা রহ. এর একটা মত উল্লেখ করে বলা হয় যে, তিনি বলেছেন বরকতময় রাত বলতে শাবান মাসের পনের তারিখের রাতকেও বুঝানো যেতে পারে।
তিনি যদি এটা বলে থাকেন তাহলে এটা তার ব্যক্তিগত অভিমত। যা কুরআন ও হাদীসের বিরোধী হওয়ার কারণে পরিত্যাজ্য। এ বরকতময় রাতের দ্বারা উদ্দেশ্য যদি শবে বরাত হয় তাহলে শবে কদর অর্থ নেয়া চলবেনা।
(চার) উক্ত আয়াতে বরকতময় রাতের ব্যাখ্যা শবে বরাত করা হল তাফসীর বির-রায় (মনগড়া ব্যাখ্যা), আর বরকতময় রাতের ব্যাখ্যা লাইলাতুল কদর দ্বারা করা হল কুরআন ও হাদীস সম্মত তাফসীর। সকলেই জানেন কুরআন ও হাদীস সম্মত ব্যাখ্যার উপস্থিতিতে মনগড়া ব্যাখ্যা (তাফসীর বির-রায়) গ্রহণ করার কোন সুযোগ নেই।
(পাচ) সূরা দুখানের ৪ নং আয়াত ও সূরা কদরের ৪ নং আয়াত মিলিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বরকতময় রাত বলতে লাইলাতুল কদরকেই বুঝানো হয়েছে। সাহাবী ইবনে আব্বাস (রাঃ), ইবনে কাসীর, কুরতুবী প্রমুখ মুফাচ্ছিরে কিরাম এ কথাই জোর দিয়ে বলেছেন এবং সূরা দুখানের ‘লাইলাতুম মুবারাকা’র অর্থ শবে বরাত নেয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। (তাফসীরে মায়ারেফুল কুরআন দ্রষ্টব্য)
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) তাঁর তাফসীরে বলেছেন ঃ “কোন কোন আলেমের মতে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল মধ্য শাবানের রাত (শবে বরাত)। কিন্তু এটা একটা বাতিল ধারণা।”
অতএব এ আয়াতে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ এর অর্থ লাইলাতুল কদর। শাবান মাসের পনের তারিখের রাত নয়।
(ছয়) ইকরামা (রঃ) বরকতময় রজনীর যে ব্যাখ্যা শাবানের ১৫ তারিখ দ্বারা করেছেন তা ভুল হওয়া সত্ত্বেও প্রচার করতে হবে এমন কোন নিয়ম-কানুন নেই। বরং তা প্রত্যাখ্যান করাই হল হকের দাবী। তিনি যেমন ভুলের উর্ধ্বে নন, তেমনি যারা তার থেকে বর্ণনা করেছেন তারা ভুল শুনে থাকতে পারেন অথবা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বানোয়াট বর্ণনা দেয়াও অসম্ভব নয়।
(সাত) শবে বরাতের গুরুত্ব বর্ণনায় সূরা দুখানের উক্ত আয়াত উল্লেখ করার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এ আকীদাহ বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, শবে বরাতে সৃষ্টিকূলের হায়াত-মাউত, রিয্ক-দৌলত সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ও লিপিবদ্ধ করা হয়। আর শবে বরাত উদযাপনকারীদের শতকরা নিরানব্বই জনের বেশী এ ধারণাই পোষণ করেন। তারা এর উপর ভিত্তি করে লাইলাতুল কদরের চেয়ে ১৫ শাবানের রাতকে বেশী গুরুত্ব দেয়। অথচ কুরআন ও হাদীসের আলোকে এ বিষয়গুলি লাইলাতুল কদরের সাথে সম্পর্কিত। তাই যারা শবে বরাতের গুরুত্ব বুঝাতে উক্ত আয়াত উপস্থাপন করেন তারা মানুষকে সঠিক ইসলামী আকীদাহ থেকে দূরে সরানোর কাজে লিপ্ত, যদিও মনে-প্রাণে তারা তা ইচ্ছা করেন না।
(আট) ইমাম আবু বকর আল জাসসাস তার আল-জামে লি আহকামিল কুরআন তাফসীর গ্রন্থে লাইলালাতুন মুবারাকা দ্বারা মধ্য শাবানের রাত উদ্দেশ্য করা ঠিক নয় বলে বিস্তারিত আলোচনা করার পর বলেন : লাইলাতুল কদরের চারটি নাম রয়েছে, তা হল : লাইলাতুল কদর, লাইলাতু মুবারাকাহ, লাইলাতুল বারাআত ও লাইলাতুস সিক।
(আল জামে লি আহকামিল কুরআন, সূরা আদ-দুখানের তাফসীর দ্রষ্টব্য)
লাইলাতুল বারাআত হল লাইলাতুল কদরের একটি নাম। শাবান মাসের পনের তারিখের রাতের নাম নয়
ইমাম শাওকানী (রহ.) তার তাফসীর ফতহুল কাদীরে একই কথাই লিখেছেন।
(তাফসীর ফাতহুল কাদীর : ইমাম শাওকানী দ্রষ্টব্য)
এ সকল বিষয় জেনে বুঝেও যারা ‘লাইলাতুম মুবারাকা’র অর্থ করবেন শবে বরাত, তারা সাধারণ মানুষদের গোমরাহ করা এবং আল্লাহর কালামের অপব্যাখ্যা করার দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না।
শবে বরাত নামটি হাদীসের কোথাও উল্লেখ হয়নি
প্রশ্ন থেকে যায় হাদীসে কি লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাত নেই? সত্যিই হাদীসের কোথাও আপনি শবে বরাত বা লাইলাতুল বারায়াত নামের কোন রাতের নাম খ্ুেজ পাবেন না। যে সকল হাদীসে এ রাতের কথা বলা হয়েছে তার ভাষা হল ‘লাইলাতুন নিস্ফ মিন শাবান’ অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত্রি। শবে বরাত বা লাইলাতুল বারায়াত শব্দ আল-কুরআনে নেই, হাদীসে রাসূলেও নেই। এটা মানুষের বানানো একটা শব্দ। ভাবলে অবাক লাগে যে, একটি প্রথা ইসলামের নামে শত শত বছর ধরে পালন করা হচ্ছে অথচ এর আলোচনা আল-কুরআনে নেই। সহীহ হাদীসেও নেই। অথচ আপনি দেখতে পাবেন যে, সামান্য নফল ‘আমলের ব্যাপারেও হাদীসের কিতাবে এক একটি অধ্যায় বা শিরোনাম লেখা হয়েছে।
ফিকহের কিতাবে শবে বরাত
শুধু আল-কুরআনে কিংবা সহীহ হাদীসে নেই, বরং আপনি ফিক্হের নির্ভরযোগ্য কিতাবগুলো পড়ে দেখুন, কোথাও শবে বরাত নামের কিছু পাবেন না। বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে দ্বীনি মাদ্রাসাগুলিতে ফিক্হের যে সিলেবাস রয়েছে যেমন মালাবুদ্দা মিনহু, নুরুল ইজাহ, কদুরী, কানযুদ্ দাকায়েক, শরহে বিকায়া ও হিদায়াহ খুলে দেখুন না! কোথাও শবে বরাত নামের কিছু পাওয়া যায় কিনা! অথচ আমাদের পূর্বসূরী ফিকাহবিদগণ ইসলামের অতি সামান্য বিষয়গুলো আলোচনা করতেও কোন ধরনের কার্পণ্যতা দেখাননি। তারা সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণের সালাত সম্পর্কেও অধ্যায় রচনা করেছেন। অনুচ্ছেদ তৈরী করেছেন কবর যিয়ারতের মত বিষয়েরও। শবে বরাতের ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহর সামান্যতম ইশারা থাকলেও ফিকাহবিদগণ এর আলোচনা মাসয়ালা-মাসায়েল অবশ্যই বর্ণনা করতেন।
অতএব এ রাতকে শবে বরাত বা লাইলাতুল বারায়াত অভিহিত করা মানুষের মনগড়া বানানো একটি বিদ‘আত যা কুরআন বা হাদীস দ্বারা সমর্থিত নয়।
শবে বরাত সম্পর্কিত প্রচলিত আকীদাহ বিশ্বাস ও ‘আমল
শবে বরাত যারা পালন করেন তারা শবে বরাত সম্পর্কে যে সকল ধারণা পোষণ করেন ও উহাকে উপলক্ষ করে যে সকল কাজ করে থাকেন তার কিছু নিুে উল্লেখ করা হল।
তারা বিশ্বাস করে যে, শবে বরাতে আল্লাহ তা‘আলা সকল প্রাণীর এক বছরের খাওয়া দাওয়া বরাদ্দ করে থাকেন। এই বছর যারা মারা যাবে ও যারা জন্ম নিবে তাদের তালিকা তৈরী করা হয়। এ রাতে বান্দার পাপ ক্ষমা করা হয়। এ রাতে ইবাদাত-বন্দেগী করলে সৌভাগ্য অর্জিত হয়। এ রাতে কুরআন মাজীদ লাওহে মাহফুজ হতে প্রথম আকাশে নাযিল করা হয়েছে। এ রাতে গোসল করাকে সওয়াবের কাজ মনে করা হয়। মৃত ব্যক্তিদের রূহ এ রাতে দুনিয়ায় তাদের সাবেক গৃহে আসে। এ রাতে হালুয়া রুটি তৈরী করে নিজেরা খায় ও অন্যকে দেয়া হয়। বাড়ীতে বাড়ীতে মীলাদ পড়া হয়। আতশবাযী করা হয়। সরকারী- বেসরকারী ভবনে আলোক সজ্জা করা হয়। সরকারী ছুটি পালিত হয়। পরের দিন সিয়াম (রোযা) পালন করা হয় । কবরস্থানগুলো আগরবাতি ও মোমবাতি দিয়ে সজ্জিত করা হয়। লোকজন দলে দলে কবরস্থানে যায়। মাগরিবের পর থেকে মাসজিদগুলি লোকে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। যারা পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে ও জুমু‘আয় মাসজিদে আসেনা তারাও এ রাতে মাসজিদে আসে। মাসজিদগুলিতে মাইক চালু করে ওয়াজ নাসীহাত করা হয়। শেষ রাতে সমবেত হয়ে দু‘আ-মুনাজাত করা হয়। বহু লোক এ রাতে ঘুমানোকে অন্যায় মনে করে থাকে। নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে একশত রাকাত, হাজার রাকাত ইত্যাদি সালাত আদায় করা হয়।
লোকজন ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞেস করে ‘হুজুর! শবে বরাতের সালাতের নিয়ম ও নিয়্যতটা একটু বলে দিন।’ ইমাম সাহেব আরবী ও বাংলায় নিয়্যাত বলে দেন। কিভাবে সালাত আদায় করবে, কোন্ রাকা‘আতে কোন্ সূরা তিলাওয়াত করবে তাও বলে দিতে কৃপণতা করেননা।
যদি এ রাতে ইমাম সাহেব বা মুয়াজ্জিন সাহেব মাসজিদে অনুপস্থিত থাকেন তাহলে তাদের চাকুরী যাওয়ার উপক্রম হয়।
শবে বরাতের সম্পর্ক শুধু ‘আমলের সাথে নয়
শবে বরাত সম্পর্কে উপরোল্লিখিত কাজ ও আকীদাহসমূহ শবে বরাত উদযাপনকারীরা সকলেই করেন তা কিন্তু নয়। কেহ আছেন উল্লিখিত সকল কাজের সাথে একমত পোষণ করেন। আবার কেহ আতশবাযী, আলোক সজ্জা পছন্দ করেন না, কিন্তু কবরস্থানে যাওয়া, হালুয়া-রুটি, ইবাদাত-বন্দেগী করে থাকেন। আবার অনেক আছেন যারা এ রাতে শুধু সালাত আদায় করেন ও পরের দিন সিয়াম (রোযা) পালন করেন। এ ছাড়া অন্য কোন ‘আমল করেন না। আবার অঞ্চল ভেদে ‘আমলের পার্থক্য দেখা যায়।
কিন্তু একটি বিষয় হল, শবে বরাত সম্পর্কে যে সকল ধর্ম বিশ্বাস বা আকীদাহ পোষণ করা হয় তা কিন্তু কোন দুর্বল হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত হয় না। যেমন ভাগ্যলিপি ও বাজেট প্রনয়নের বিষয়টি। যারা বলেন ঃ ‘‘আমলের ফাযীলাতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করা যায়, অতএব এর উপর ভিত্তি করে শবে বরাতে ‘আমল করা যায়, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন ঃ তাহলে শবে বরাতের আকীদাহ সম্পর্কে কি দুর্বল হাদীসেরও দরকার নেই?
অথবা এ সকল প্রচলিত আকীদাহর ক্ষেত্রে যদি কোন দুর্বল হাদীস পাওয়াও যায় তাহলে তা দিয়ে কি আকীদাহগত কোন মাসয়ালা প্রমাণ করা যায়? আপনারা শবে বরাতের ‘আমলের পক্ষ সমর্থন করলেন কিন্তু আকীদাহর ব্যাপারে কি জবাব দিবেন?
কাজেই শবে বরাত শুধু ‘আমলের বিষয় নয়, আকীদাহরও বিষয়। তাই এ ব্যাপারে ইসলামের দা’য়ীদের সতর্ক হওয়ার দাওয়াত দিচ্ছি।
শবে বরাত সম্পর্কে এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহ তা‘আলা এ রাতে আল-কুরআন অবতীর্ণ করেছেন, তিনি এ রাতে মানুষের হায়াত, রিয্ক ও ভাগ্যের ফায়সালা করে থাকেন, এ রাতে ইবাদাত-বন্দেগীতে লিপ্ত হলে আল্লাহ হায়াত ও রিয্ক বাড়িয়ে সৌভাগ্যশালী করেন ইত্যাদি আকীদা কি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি মিথ্যা আরোপ করার মত অন্যায় নয়?
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন ঃ
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ. (الصف : ৭)
অর্থ ঃ তার চেয়ে বড় যালিম আর কে যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে? (সূরা সাফ, ৭)
শাবানের মধ্যরজনীর ফযীলত সম্পর্কিত হাদীসসমূহের পর্যালোচনা
১ নং হাদীস
১-حدثنا أحمد بن منيع أخبرنا يزيد بن هارون أخبرنا الحجاج بن أرطاة عن يحيى بن أبي كثير عن عروة عن عائشة رضى الله عنها قالت : فقدت رسول الله صلى الله عليه وسلم ليلة فخرجت فإذا هو بالبقيع فقال أكنت تخافين أن يحيف الله عليك ورسوله؟ قلت يا رسول الله ظننت أنك أتيت بعض نسائك.
فقال إن الله تبارك وتعالى ينزل ليلة النصف من شعبان إلى سماء الدنيا فيغفر لأكثر من عدد شعر غنم كلب.
قال أبو عيسى: حديث عائشة لا نعرفه إلا من هذا الوجه من حديث الحجاج، وسمعت محمدا يقول يضعف هذا الحديث، وقال: يحيى بن كثير لم يسمع من عروة، قال محمد والحجاج لم يسمع من يحيى بن كثير، انتهى كلامه، فهذا السند منقطع بوجهين.
ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেন ঃ আমাদের কাছে আহমাদ ইবনে মুনী’ হাদীস বর্ণনা করেছেন যে তিনি ইয়াযীদ ইবনে হারূন থেকে, তিনি হাজ্জাজ ইবনে আরতাহ থেকে, তিনি ইয়াহইয়া ইবনে আবি কাসির থেকে, তিনি উরওয়াহ থেকে, তিনি উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেছেন ঃ আমি এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিছানায় পেলাম না তাই আমি তাকে খুঁজতে বের হলাম, ‘বাকী’ নামক কবরস্থানে তাকে পেলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন ঃ তুমি কি আশংকা করেছো যে আল্লাহ ও তার রাসূল তোমার সাথে অন্যায় আচরণ করবেন?
আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি মনে করেছি আপনি আপনার অন্য কোন স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন, অতঃপর কালব গোত্রের পালিত বকরীর পশমের পরিমানের চেয়েও অধিক পরিমান লোকদের ক্ষমা করেন।
ইমাম তিরমিযী বলেন ঃ আয়িশা (রাঃ) এর এই হাদীস আমি হাজ্জাজের বর্ণিত সনদ (সূত্র) ছাড়া অন্য কোনভাবে চিনি না। আমি মুহাম্মাদকে (ইমাম বুখারী) বলতে শুনেছি যে, তিনি হাদীসটিকে দুর্বল বলতেন। তিরমিযী (রহঃ) বলেন ঃ ইয়াহ্ইয়া ইবনে কাসীর উরওয়াহ থেকে হাদীস শুনেননি। এবং মুহাম্মদ (ইমাম বুখারী) বলেছেন ঃ হাজ্জাজ ইয়াহ্ইয়াহ ইবনে কাসীর থেকে শুনেননি।
এ হাদীসটি সম্পর্কে ইমাম বুখারী ও ইমাম তিরমিযীর মন্তব্যে প্রমাণিত হয় যে, হাদীসটি দুটো দিক থেকে মুনকাতি অর্থাৎ উহার সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন।
অপর দিকে এ হাদীসের একজন বর্ণনাকারী হাজ্জাজ ইবনে আরতাহ মুহাদ্দিসীনদের নিকট দুর্বল বলে পরিচিত।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! যারা শবে বরাতের বেশী বেশী ফাযীলাত বয়ান করতে অভ্যস্ত তারা তিরমিযী বর্ণিত এ হাদীসটি খুব গুরুত্বের সাথে উপস্থাপন করেন অথচ যারা হাদীসটির অবস্থা সম্পর্কে ভাল জানেন তাদের এ মন্তব্যটুকু গ্রহণ করতে চাননা। এ হাদীসটি ‘আমলের ক্ষেত্রে পরিত্যাজ্য হওয়ার জন্য ইমাম তিরমিযীর এ মন্তব্যটুকু কি যথেষ্ট নয়? যদি তর্কের খাতিরে এ হাদীসটিকে বিশুদ্ধ বলে ধরে নেয়া হয় তাহলে কি প্রমাণিত হয়? আমরা যারা ঢাকঢোল পিটিয়ে মাসজিদে একত্র হয়ে যেভাবে শবে বরাত উদযাপন করি তাদের ‘আমলের সাথে এ হাদীসটির মিল কোথায়?
বরং এ হাদীসে দেখা গেল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিছানা ছেড়ে চলে গেলেন, আর পাশে শায়িত আয়িশা (রাঃ) কে ডাকলেন না। ডাকলেন না অন্য কাউকে। তাকে জাগালেন না বা সালাত আদায় করতে বললেন না। অথচ আমরা দেখতে পাই যে, রামাযানের শেষ দশকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রাত জেগে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন এবং পরিবারের সকলকে জাগিয়ে দিতেন। বেশী পরিমাণে ইবাদাত-বন্দেগী করতে বলতেন। যদি ১৫ শাবানের রাতে কোন ইবাদাত করার ফাযীলাত থাকত তাহলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন আয়িশাকে (রাঃ) বললেন না? কেন রামাযানের শেষ দশকের মত সকলকে জাগিয়ে দিলেন না, তিনি তো নেক কাজের প্রতি মানুষকে আহ্বান করার ক্ষেত্রে আমাদের সকলের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি তো কোন অলসতা বা কৃপণতা করেননি।
২ নং হাদীস
২-عن العلاء بن الحارث أن عائشة رضي الله عنها قالت : قام رسول الله صلى الله عليه وسلم من الليل يصلي، فأطال السجود، حتى ظننت أنه قد قبض، فلما رأيت ذلك قمت حتى حركت إبهامه فتحرك فرجعت فلما رفع رأسه من السجود وفرغ من صلاته قال: يا عائشة أو يا حميراء أظننت أن النبي قد خان بك؟ قلت لا والله يا رسول الله، لكني ظننت أنك قبضت لطول سجودك، فقال أتدرين أي ليلة هذه؟ قلت: الله ورسوله أعلم. قال: هذه ليلة النصف من شعبان
إن الله عز وجل يطلع على عباده في ليلة النصف من شعبان فيغفر للمستغفرين ويرحم المسترحمين ويؤخر أهل الحقد كما هو. (رواه البيهقي في شعب الإيمان، وهذا حديث مرسل لأن علاء ما سمع عن عائشة)
অর্থ ঃ আলা ইবনে হারিস থেকে বর্ণিত, আয়িশা (রাঃ) বলেন ঃ এক রাতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিলেন। সিজদাহ এত দীর্ঘ করলেন যে, আমি ধারণা করলাম তিনি ইন্তেকাল করেছেন। আমি এ অবস্থা দেখে দাড়িয়ে তার বৃদ্ধাঙ্গুল ধরে নাড়া দিলাম, আঙ্গুলটি নড়ে উঠল। আমি চলে এলাম। সালাত শেষ করে তিনি বললেন ঃ হে আয়িশা অথবা বললেন হে হুমায়রা! তুুমি কি মনে করেছ আল্লাহর নবী তোমার সাথে বিশ্বাস ভংগ করেছেন? আমি বললাম ঃ আল্লাহর কসম হে রাসূল! আমি এমন ধারণা করিনি। বরং আমি ধারণা করেছি আপনি না জানি ইন্তেকাল করলেন! অতঃপর তিনি বললেন ঃ তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম ঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভাল জানেন। তিনি বললেন ঃ এটা মধ্য শাবানের রাত। এ রাতে আল্লাহ তা’আলা তার বান্দাদের প্রতি মনোনিবেশ করেন। ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং রাহমাত প্রার্থনাকারীদের রহম করেন। আর হিংসুকদেরকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দেন। (বাইহাকী তার শুয়াবুল ঈমান কিতাবে বর্ণনা করেছেন)
হাদীসটি মুরসাল। সহীহ বা বিশুদ্ধ নয় । কেননা বর্ননাকারী ‘আলা' আয়িশা (রাঃ) থেকে শুনেননি।
৩ নং হাদীস
৩-عن علي بن أبي طالب رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا نهارها فإن الله ينـزل فيها لغروب الشمس إلى سماء الدنيا فيقول : ألا من مستغفر فأغفر له ألا من مسترزق فأرزق له ألا من مبتلى فأعافيه ألا كذا ألا كذا حتى يطلع الفجر. (رواه ابن ماجه، والبيهقي في شعب الإيمان. وهذا حديث ضعيف لأن في سنده ابن أبي سبرة وهو معروف بوضع الحديث عند المحدثين. المرجع : تحفة الأحوذي بشرح جامع الترمذي وقال ناصر الدين الألباني في هذا الحديث: إنه واه جداً)
অর্থ ঃ আলী ইবনে আবী তালেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় করবে আর দিবসে সিয়াম পালন করবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সূর্যাস্তের পর দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেন ঃ আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিয্ক প্রার্থনাকারী আমি রিয্ক দান করব। আছে কি কোন বিপদে নিপতিত ব্যক্তি আমি তাকে সুস্থ্যতা দান করব। এভাবে ফজর পর্যন্ত বলা হয়ে থাকে। (ইবনে মাজাহ ও বাইহাকী)
প্রথমতঃ এ হাদীসটি দুর্বল। কেননা এ হাদীসের সনদে (সূত্রে) ইবনে আবি সাবুরাহ নামে এক ব্যক্তি আছেন, যিনি অধিকাংশ হাদীস বিশারদের নিকট হাদীস জালকারী হিসাবে পরিচিত। এ যুগের বিখ্যাত মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আল-বানী (রহঃ) বলেছেন, হাদীসটি সনদের দিক দিয়ে একেবারেই দুর্বল।
দ্বিতীয়তঃ অপর একটি সহীহ হাদীসের বিরোধী হওয়ার কারণে এ হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয়। সে সহীহ হাদীসটি হাদীসে নুযুল নামে পরিচিত, যা ইমাম বুখারী ও মুসলিম তাদের কিতাবে বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি হল ঃ
عن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: ينزل ربنا تبارك وتعالى في كل ليلة إلى سماء الدنيا حين يبقى ثلث الليل الآخر فيقول من يدعوني فأستجيب له ومن يسألني فأعطيه ومن يستغفرني فأغفرله. (أخرجه البخاري ومسلم)
অর্থ ঃ আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ আমাদের রব আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন ও বলতে থাকেন ঃ কে আছ আমার কাছে দু‘আ করবে আমি কবুল করব। কে আছ আমার কাছে চাইবে আমি দান করব। কে আছ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করব। (বুখারী ও মুসলিম)
আর উল্লিখিত ৩ নং হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা মধ্য শাবানের রাতে নিকটতম আকাশে আসেন ও বান্দাদের দু‘আ কবুলের ঘোষণা দিতে থাকেন। কিন্তু বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত এই সহীহ হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের শেষের দিকে নিকটতম আকাশে অবতরণ করে দু‘আ কবুলের ঘোষণা দিতে থাকেন। আর এ হাদীসটি সর্বমোট ৩০ জন সাহাবী বর্ণনা করেছেন এবং বুখারী এবং মুসলিম ও সুনানের প্রায় সকল কিতাবে এসেছে। তাই হাদীসটি প্রসিদ্ধ। অতএব এই মশহুর হাদীসের বিরোধী হওয়ার কারণে ৩ নং হাদীসটি পরিত্যাজ্য হবে।
কেহ বলতে পারেন যে, এই দু হাদীসের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। কারণ ৩ নং হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন মধ্য শাবানের রাতের শুরু থেকে। আর এ হাদীসের বক্তব্য হল প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। অতএব দু হাদীসের মধ্যে কোন বিরোধ নেই যে কারণে ৩ নং হাদীসকে পরিত্যাগ করতে হবে।
আমি বলব আসলেই এ দু হাদীসের মধ্যে বিরোধ আছে। কেননা আবূ হুরাইরা (রাঃ) বর্ণিত বুখারী ও মুসলিমের হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের শেষ অংশে দুনিয়ার আকাশে আসেন। আর প্রতি রাতের মধ্যে শাবান মাসের পনের তারিখের রাতও অন্তর্ভুক্ত। অতএব এ হাদীস মতে অন্যান্য রাতের মত শাবান মাসের পনের তারিখের রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে আসেন। কিন্তু ৩ নং হাদীসের বক্তব্য হল শাবান মাসের পনের তারিখের রাতের প্রথম প্রহর থেকে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন।
৪ নং হাদীস
৪-عن عثمان بن أبي العاص رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: إذا كان ليلة النصف من شعبان نادى مناد : هل من مستغفر فأغفرله، هل من سائل فأعطيه ، فلا يسأل أحد إلا أعطي إلا زانية بفرجها أو مشرك. (أخرجه البيهقي في شعب الإيمان وضعفه الألباني في ضعيف الجامع رقم ৬৫২)
অর্থ ঃ উসমান ইবনে আবিল আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দেয় ঃ আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কেহ কিছু চাইবার আমি তাকে তা দিয়ে দিব। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন ঃ মুশরিক ও ব্যভিচারী বাদে সকল প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুল করা হয়। (বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান)
বিখ্যাত মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আল-বানী (রহঃ) হাদীসটিকে তার সংকলন ‘যয়ীফ আল-জামে’ নামক কিতাবের ৬৫২ নং ক্রমিকে দুর্বল প্রমাণ করেছেন।
শবে বরাত সম্পর্কে এ ছাড়া বর্ণিত অন্যান্য সকল হাদীস সম্পর্কে ইবনে রজব হাম্বলী (রহঃ) বলেন ঃ এ মর্মে বর্ণিত অন্য সকল হাদীসই দুর্বল।
শাবানের মধ্যরজনীর সম্পর্কিত হাদীসসমূহ পর্যালোচনার সারকথা
শবে বরাত সম্পর্কিত হাদীসগুলো উল্লেখ করা হল। আমি মনে করি এ সম্পর্কে যত হাদীস আছে তা এখানে এসেছে। বাকী যা আছে সেগুলোর অর্থ বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত। এ সকল হাদীসের দিকে লক্ষ্য করে আমরা কয়েকটি বিষয় স্পষ্টভাবেই বুঝে নিতে পারি।
(১) এ সকল হাদীসের কোন একটি দ্বারাও প্রমাণিত হয়নি যে, ১৫ শাবানের রাতে আল্লাহ তা’আলা আগামী এক বছরে যারা ইন্তেকাল করবে, যারা জন্ম গ্রহণ করবে, কে কি খাবে সেই ব্যাপারে ফায়সালা করেন। যদি থাকেও তাহলে তা আল-কুরআনের বক্তব্যের বিরোধী হওয়ায় তা গ্রহণ করা যাবে না। কারণ আল-কুরআনের স্পষ্ট কথা হল এ বিষয়গুলির ফায়সালা হয় লাইলাতুল কদরে।
(২) এ সকল হাদীসের কোথাও বলা হয়নি যে, এ রাতে মৃত ব্যক্তিদের আত্মা তাদের গৃহে আসে। বরং এটি একটি প্রচলিত বানোয়াট কথা। মৃত ব্যক্তির আত্মা কোন কোন সময় গৃহে ফিরে আসার ধারণাটা হিন্দুদের ধর্ম-বিশ্বাস।
(৩) এ সকল হাদীসের কোথাও এ কথা নেই যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরাম এ রাতে গোসল করেছেন, মাসজিদে উপস্থিত হয়ে নফল সালাত আদায় করেছেন, যিক্র-আযকার করেছেন, কুরআন তিলাওয়াত করেছেন, সারারাত জাগ্রত থেকেছেন, ওয়াজ নাসীহাত করেছেন কিংবা অন্যদের এ রাতে ইবাদাত বন্দেগীতে উৎসাহিত করেছেন অথবা শেষ রাতে জামাতের সাথে দু’আ-মুনাজাত করেছেন।
(৪) এ হাদীসসমূহের কোথাও এ কথা নেই যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) এ রাতের সাহরী খেয়ে পরের দিন সিয়াম (রোযা) পালন করেছেন।
(৫) আলোচিত হাদীসসমূহে কোথাও এ কথা নেই যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা সাহাবায়ে কিরাম এ রাতে হালুয়া-রুটি বা ভাল খানা তৈরী করে বিলিয়েছেন, বাড়ীতে বাড়ীতে যেয়ে মীলাদ পড়েছেন।
(৬) এ সকল হাদীসের কোথাও নেই যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা সাহাবায়ে' কিরাম (রাঃ) এ রাতে দলে দলে কবরস্থানে গিয়ে কবর যিয়ারত করেছেন কিংবা কবরে মোমবাতি জ্বালিয়েছেন।
এমনকি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ বাদ দিলে খুলাফায়ে রাশেদীনের ত্রিশ বছরের ইতিহাসেও কি এর কোন একটা ‘আমল পাওয়া যাবে?
যদি না যায় তাহলে শবে বরাত সম্পর্কিত এ সকল ‘আমল ও আকীদা কি বিদ’আত নয়? এ বিদ’আত সম্পর্কে উম্মাতে মুহাম্মাদীকে সতর্ক করার দায়িত্ব কারা পালন করবেন? এ দায়িত্ব পালন করতে হবে আলেম-উলামাদের, দ্বীন প্রচারক, মাসজিদের ইমাম ও খতীবদের। যে সকল বিষয়ে কুরআন ও সহীহ হাদীসের ইশারা নেই সে সকল ‘আমল থেকে সাধারণ মুসলিম সমাজকে বিরত রাখার দায়িত্ব পালন করতে হবে নবী-রাসূলগণের উত্তরসূরীদের।
ভাগ্য লিপিবদ্ধ করা সম্পর্কিত একটি হাদীস ও উহার পর্যালোচনা
এ বইটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশের পর একজন বিশিষ্ট আলেম আমাকে বলেছেন ঃ “শবে বরাতে সৌভাগ্য বা এক বছরের তাকদীর লেখা সম্পর্কিত কোন হাদীস নেই” বলে আপনি যে দাবী করেছেন তা সঠিক নয়। ‘মিশকাত আল-মাসাবীহ’ কিতাবে এ সম্পর্কে হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে।
পাঠকগণের অবগতির জন্য উক্ত হাদীসটির পর্যালোচনা নিুে তুলে ধরলাম। হাদীসটি হল ঃ
عن عائشة رضي الله عنها عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: هل تدرين ما هذه الليلة؟ يعني ليلة النصف من شعبان.
قالت ما فيها يا رسول الله ؟ فقال : فيها أن يكتب كل مولود (من) بني آدم في هذه السنة وفيها أن يكتب كل هالك من بني آدم في هذه السنة وفيها ترفع أعمالهم وفيها تنزل أرزاقهم.
من مشكاة المصبايح في باب قيام شهر رمضان، رواه البيهقي في الدعوات الكبير.
অর্থ ঃ আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ তুমি কি জানো এটা (অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত) কোন্ রাত? তিনি জিজ্ঞেস করলেন ঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! এ রাতে কি রয়েছে? তিনি বললেন ঃ এ রাতে এই বছরে যে সকল মানব-সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে তাদের ব্যাপারে লিপিবদ্ধ করা হয়, যারা মৃত্যু বরণ করবে তাদের তালিকা তৈরী হয়, এ রাতে ‘আমলসমূহ পেশ করা হয়, এ রাতে রিয্ক নাযিল করা হয়।
আলোচ্য হাদীসটি আল-মিশকাতুল মাসাবীহ কিতাবে ‘রামাযান মাসে কিয়াম’ (রামাযান মাসের রাতের সালাত) অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
তিনি লিখেছেন যে, ইমাম বাইহাকী (রঃ) তার ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর’ গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হাদীসটির পর্যালোচনা নিুে তুলে ধরলাম ঃ
(এক) উল্লিখিত হাদীসে ‘অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত’ বাক্যটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা নয়। এ বাক্যটি পরবর্তী কালের বর্ণনাকারীর নিজস্ব বক্তব্য বলে। আর আয়িশা (রাঃ) এমন কোন অজ্ঞ মহিলা ছিলেন না যে তাকে তারিখ বলে দিতে হবে।
(দুই) এ হাদীসে বর্ণিত ‘অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত’ কথাটি আয়িশার (রাঃ) বক্তব্য নয়। কারণ তার বক্তব্য শুরু হয়েছে ‘তিনি জিজ্ঞেস করলেন’ বাক্যটির পর। তাহলে এ বক্তব্যটি কার? এ বক্তব্যটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আয়িশা (রাঃ) ব্যতীত অন্য কোন বর্ণনাকারীর নিজস্ব মন্তব্য, যা মেনে নেয়া আমাদের জন্য যরুরী নয়।
(তিন) এ হাদীসের বিষয়বস্তুর দিকে তাকালে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, হাদীসে ভাগ্য লেখার বিষয়টি লাইলাতুল কদরের সাথে সম্পর্কিত। কেননা জন্ম, মৃত্যু, ‘আমল পেশ, রিয্ক ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী রামাযান মাসে লাইলাতুল কদরে স্থির করা হয়। এ কথা যেমন কুরআনের একাধিক আয়াত দ্বারা প্রমাণিত তেমনি বহু সংখ্যক সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
(চার) আল-মিশকাত আল-মাসাবীহর সংকলক বিষয়টি ভালভাবে বুঝেছেন বলে তিনি হাদীসটিকে রামাযান মাসের সালাত (কিয়ামে শাহরি রামাযান) অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। বুঝা গেল যে, তার মত হল হাদীসটি রামাযান মাসের লাইলাতুল কদর সম্পর্কিত। যদি তিনি বুঝতেন যে, হাদীসটি মধ্য শাবানের তাহলে তিনি তা রামাযান মাসের অধ্যায়ে আলোচনা করবেন কেন?
(পাঁচ) এ হাদীসটি আল-মিশকাত আল-মাসাবীহর সংকলক উল্লেখ করার পর বলেছেন, তিনি হাদীসটি ইমাম বাইহাকীর ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর’ কিতাব থেকে নিয়েছেন।
ইমাম বাইহাকী তার ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর’ গ্রন্থে শবে বরাত সম্পর্কে মাত্র দুটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। তার একটি হল এই হাদীস। তিনি তার ‘শুআ’বুল ঈমান’ গ্রন্থে শবে বরাত সম্পর্কিত এই বইয়ে আলোচিত ৫ নং হাদীসটি উল্লেখ করার পর লিখেছেন ঃ
وقد روي في هذا الباب أحاديث مناكير، رواتها قوم مجهولون ، ذكرنا في كتاب الدعوات منها حديثين.
অর্থ ঃ এ বিষয়ে বহু মুনকার হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যার বর্ণনাকারীরা অপরিচিত। আমি তা থেকে দু’টি হাদীস ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছি।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! তাহলে ফলাফল দাড়াল কি? ইমাম বাইহাকীর এ মন্তব্যে যা প্রমাণিত হল ঃ
(১) শবে বরাত সম্পর্কে অনেক মুনকার (অগ্রহণযোগ্য) হাদীস রয়েছে।
(২) আদ-দাওআত আল-কাবীর গ্রন্থে শবে বরাত সম্পর্কে বর্ণিত হাদীস দুটি মুনকার।
(৩) তাই আলোচ্য হাদীসটি হাদীসে মুনকার।
(৪) তিনি ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর’ গ্রন্থটি আগে সংকলন করেছেন, তারপরে শুআবুল ঈমান সংকলন করেছেন। এ কারণে তিনি পরবর্তী কিতাবে আগের কিতাবের ভুল সম্পর্কে পাঠকদের সতর্ক করেছেন। এটা তার আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার একটি বড় প্রমাণ।
(৫) মুনকার হাদীস ‘আমলের জন্য গ্রহণ করা যায় না।
(৬) যিনি হাদীসটি আমাদের কাছে পৌছিয়েছেন তিনি নিজেই যখন হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয় বলে মতামত দিয়েছেন তখন আমরা তা সঠিক বলে গ্রহণ করব কেন?
সৌভাগ্য রজনী ধর্ম বিকৃতির শামিল
ইসলাম ধর্মে সৌভাগ্য রজনী বলতে কিছু নেই। নিজেদের সৌভাগ্য রচনার জন্য কোন অনুষ্ঠান বা ইবাদাত-বন্দেগী ইসলামে অনুমোদিত নয়। শবে বরাতকে সৌভাগ্য রজনী বলে বিশ্বাস করা একটি বিদ‘আত তথা ধর্মে বিকৃতি ঘটানোর শামিল। এ ধরনের বিশ্বাস খুব সম্ভব হিন্দু ধর্ম থেকে এসেছে। তারা সৌভাগ্য লাভের জন্য গনেশ পূজা করে থাকে। সৌভাগ্য অর্জন করতে হলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহ অনুসরণ করতে হবে। কুরআন-সুন্নাহ বাদ দিয়ে এবং সারা জীবন সালাত-সিয়াম-যাকাত ত্যাগ করে শুধুমাত্র একটি রাতে মাসজিদে উপস্থিত হয়ে রাত জেগে ভাগ্য বদল করে সৌভাগ্য হাসিল করে নিবেন এমন ধারণা ইসলামে একটি হাস্যকর ব্যাপার।
ধর্মে বিকৃতির কৃতিত্বে শিয়া মতাবলম্বীদের জুড়ি নেই। এ শবে বরাত প্রচলনের কৃতিত্বও তাদের। ফারসী ভাষার “শবে বরাত” নামটা থেকে এ বিষয়টা বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়। তারা এ দিনটাকে ইমাম মাহদীর জন্ম দিন হিসাবে পালন করে থাকে। তারা বিশ্বাস করে যে, এ রাতে ইমাম মাহদীর জন্ম হয়েছে। এ রাতে তারা এক বিশেষ ধরনের সালাত আদায় করে। যার নাম দিয়েছে “সালাতে জাফর”।
শবে বরাত সম্পর্কে উলামায়ে কিরামের বক্তব্য
এ শিরোনামে আমি শবে বরাত সম্পর্কে বিশ্ব বরেণ্য আলেম শায়খ আবদুল আযীয আবদুল্লাহ বিন বায (রহঃ) এর প্রবন্ধ -
حكم الاحتفال بليلة النصف من شعبان، للشيخ عبد العزيز بن عبد الله بن باز رحمه الله.
‘মধ্য শাবানের রাত উদযাপনের বিধান’ এর সার-সংক্ষেপ তুলে ধরব। তার এ প্রবন্ধে অনেক উলামায়ে কিরামের মতামত তুলে ধরা হয়েছে।
তিনি বলেছেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন ঃ
اليوم أكملت لكم دينكم وأتممت عليكم نعمتي ورضيت لكم الإسلام دينا. (المائدة : ৩)
অর্থ ঃ আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে তোমাদের জন্য পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের জন্য আমার নেআমাত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম। (সূরা মায়িদা, ৩)
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন ঃ
أم لهم شركاء شرعوا لهم من الدين ما لم يأذن به الله. (الشورى : ২১)
অর্থ ঃ তাদের কি এমন কতগুলো শরীক আছে যারা তাদের জন্য ধর্মের এমন বিধান দিয়েছে যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? (সূরা শুরা, ২১)
হাদীসে এসেছে ঃ
عن عائشة رضى الله عنها عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قال : من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد. (رواه البخاري ومسلم)
অর্থ ঃ যে আমাদের এ ধর্মে এমন কিছুর প্রচলন করবে যা দ্বীনের মধ্যে ছিল না তা প্রত্যাখ্যাত হবে। (বুখারী ও মুসলিম)
হাদীসে আরও এসেছে ঃ
عن جابر رضي الله عنه أن النبى صلى الله عليه وسلم كان يقول في خطبة يوم الجمعة: أما بعد فإن خير الحديث كتاب الله وخير الهدي هدي محمد صلى الله عليه وسلم وشر الأمور محدثاتها وكل بدعة ضلالة. (رواه مسلم)
অর্থ ঃ সাহাবী জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমু‘আর খুতবায় বলতেন ঃ আর শুনে রেখ! সর্বোত্তম কথা হল আল্লাহর কিতাব ও সর্বোত্তম পথ-নির্দেশ হল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের পথ-নির্দেশ। আর ধর্মে নতুন বিষয় প্রচলন করা হল সর্ব নিকৃষ্ট বিষয়। এবং সব ধরনের বিদ‘আতই পথভ্রষ্টতা। (মুসলিম)
এ বিষয়ে অনেক আয়াতে কারীমা ও হাদীস রয়েছে যা থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা ইসলাম ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। আর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে কোন রকম অলসতা করেননি বা কার্পণ্যতা দেখাননি। ইসলাম ধর্মের সকল খুটিনাটি বিষয় তিনি স্পষ্টভাবে তাঁর উম্মতের সামনে বর্ণনা করে গেছেন যা আজ পর্যন্ত সুরক্ষিত রয়েছে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর যে সমস্ত নতুন আচার-অনুষ্ঠান, কাজ ও বিশ্বাস ধর্মের আচার বলে যা চালিয়ে দেয়া হবে তা সবগুলো প্রত্যাখ্যাত বিদ‘আত বলেই পরিগণিত হবে, তা উহার প্রচলনকারী যে কেউ হোক না কেন এবং উদ্দেশ্য যত মহৎ হোক না কেন। সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) ও তাদের পরবর্তী উলামায়ে ইসলাম এ ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন বলে তারা বিদ‘আতকে প্রত্যাখ্যান করেছেন ও অন্যদের বিদ‘আতের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন।
এ ধারাবাহিকতায় উলামায়ে কিরাম মধ্য শাবানের রাত উদযাপন ও ঐদিন সিয়াম পালন করাকে বিদ‘আত বলেছেন। কারণ এ বিষয়ের উপর ভিত্তি করে ‘আমল করা যেতে পারে এমন কোন দলীল নেই। যা আছে তা হল কিছু দুর্বল হাদীস যার উপর ভিত্তি করে ‘আমল করা যায় না। উক্ত রাতে সালাত আদায়ের ফাযীলাতের যে সকল হাদীস পাওয়া যায় তা বানোয়াট। এ ব্যাপারে হাফেয ইবনে রজব তার কিতাব লাতায়িফুল মায়ারিফে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
একটি কথা অবশ্যই বলতে হয় যে, দুর্বল হাদীস ঐ সকল ‘আমল ও ইবাদাতের ক্ষেত্রে গ্রহণ করা যায় যে সকল ‘আমল কোন সহীহ হাদীস দ্বারা ইতোপূর্বে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু মধ্য শাবানের রাতে একত্র হয়ে ইবাদাত-বন্দেগী করার ক্ষেত্রে কোন সহীহ হাদীস নেই। এ মূল নীতিটি ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) উল্লেখ করেছেন।
সকল উলামায়ে কিরামের একটি ব্যাপারে ইজমা (ঐকমত্য) হয়েছে যে, যে সকল ব্যাপারে বিতর্ক বা ইখতিলাফ রয়েছে সে সকল বিষয় কুরআন ও সুন্নাহর কাছে ন্যস্ত করা হবে। কুরআন অথবা হাদীস যে সিদ্ধান্ত দিবে সেই মোতাবেক ‘আমল করা ওয়াজিব।
এ কথা তো আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই বলেছেন ঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا. (النساء : ৫৯)
অর্থ ঃ হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তাহলে আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং তাদের, যারা তোমাদের মধ্যে (ধর্মীয় জ্ঞানে ও শাসনের ক্ষেত্রে) ক্ষমতার অধিকারী; কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ হলে তা ন্যস্ত কর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর। এটাই উত্তম ও পরিণামে উৎকৃষ্টতর। (সূরা নিসা, ৫৯)
এ বিষয়ে অসংখ্য আয়াত ও হাদীস রয়েছে।
হাফেয ইবনে রজব (রহঃ) তার কিতাব লাতায়িফুল মায়ারিফে লিখেছেন ঃ
“তাবেয়ীদের যুগে সিরিয়ায় খালিদ ইবনে মা’দান, মকহুল, লুকমান ইবনে আমের প্রমুখ আলিম এ রাতকে মর্যাদা দিতে শুরু করেন এবং এ রাতে বেশী পরিমাণে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন। তখন লোকেরা তাদের থেকে এটা অনুসরণ করতে আরম্ভ করল। এরপর লোকদের মধ্যে মতানৈক্য শুরু হল; বসরা অঞ্চলের অনেক আবেদগণ এ রাতকে গুরুত্ব দিতেন। কিন্তু মক্কা ও মদীনার আলিমগণ এটাকে বিদ‘আত বলে প্রত্যাখ্যান করলেন। অতঃপর সিরিয়াবাসী আলিমগণ দুই ভাগ হয়ে গেলেন। একদল এ রাতে মাসজিদে একত্র হয়ে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন। এদের মধ্যে ছিলেন খালেদ ইবনে মা’দান, লোকমান ইবনে আমের। ইসহাক ইবনে রাহভিয়াহও তাদের অনুরূপ মত পোষণ করতেন।
আলিমদের অন্যদল বলতেন ঃ এ রাতে মাসজিদে একত্র হয়ে ইবাদাত-বন্দেগী করা মাকরূহ, তবে কেহ ব্যক্তিগতভাবে ইবাদাত-বন্দেগী করলে তাতে দোষের কিছু নেই। ইমাম আওযায়ী এ মত পোষণ করতেন।
মোট কথা হল, মধ্য শাবানের রাতের ‘আমল সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরামদের থেকে কোন কিছু প্রমাণিত নয়। যা কিছু পাওয়া যায় তা তাবেয়ীগণের যুগে সিরিয়ার একদল আলেমের ‘আমল।”
বিশুদ্ধ কথা হল, এ রাতে ব্যক্তিগত ‘আমল সম্পর্কে ইমাম আওযায়ী ও ইবনে রজব (রহঃ) এর মতামত যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে তা তাদের ব্যক্তিগত অভিমত যা সহীহ নয়। আর এটাতো সকল আলেমে দ্বীনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত যে, শরয়ীভাবে প্রমাণিত নয় তা ব্যক্তিগত হোক বা সমষ্টিগত, প্রকাশ্যে হোক অথবা গোপনে হোক তা কোন মুসলিমের ধর্মীয় ‘আমল হিসাবে পালন করা জায়েয নয়। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত নিম্নের হাদীস হল আম তথা ব্যাপক অর্থবোধক। তিনি বলেছেন ঃ
من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد. (رواه مسلم)
অর্থ ঃ যে কেহ এমন ‘আমল করবে যা করতে আমরা (ধর্মীয়ভাবে) নির্দেশ দেইনি তা প্রত্যাখ্যাত। (মুসলিম)
ইমাম আবূ বকর আত-তারতূশী (রহঃ) তার কিতাব (الحوادث والبدع) ‘আল-হাওয়াদিছ ওয়াল বিদ’আ’তে উল্লেখ করেন ঃ ইবনে ওয়াদ্দাহ যায়েদ বিন আসলাম সূত্রে বর্ণনা করে বলেন ঃ আমাদের কোন উস্তাদ বা কোন ফকীহকে মধ্য শাবানের রাতকে কোন রকম গুরুত্ব দিতে দেখিনি। তারা মাকহূলের হাদীসের দিকেও তাকাননি এবং এ রাতকে অন্য রাতের চেয়ে ‘আমলের ক্ষেত্রে মর্যাদা সম্পন্ন মনে করতেন না।
হাফেয ইরাকী (রহঃ) বলেন ঃ মধ্য শাবানের রাতে সালাত আদায় সম্পর্কিত হাদীসগুলো বানোয়াট বা জাল এবং এটা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি মিথ্যা আরোপের শামিল।
এ সম্পর্কে সকল উলামাদের মতামত যদি উল্লেখ করতে যাই তাহলে বিরাট এক গ্রন্থ হয়ে যাবে। তবে সত্যানুরাগীদের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যা ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
মধ্য শাবানের রাতে সালাত আদায়ের জন্য একত্র হওয়া, ঐ দিন সিয়াম পালন করা ইত্যাদি নিকৃষ্ট বিদ‘আত। অধিকাংশ উলামায়ে কিরাম এটাই বলেছেন। এ ধরনের ‘আমল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে যেমন ছিল না তেমনি ছিল না তাঁর সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) এর সময়ে। যদি এ রাতে ইবাদাত- বন্দেগী করা সওয়াবের কাজ হত তাহলে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতকে সে সম্পর্কে সতর্ক ও উৎসাহিত করতে কার্পণ্য করতেন না, যেমন তিনি কার্পণ্য করেননি লাইলাতুল কদর ও রামাযানের শেষ দশ দিন ইবাদাত-বন্দেগী করার ব্যাপারে মুসলিমদের উৎসাহিত করতে।
যদি মধ্য শাবানের রাতে অথবা রজব মাসের প্রথম জুমু‘আর রাতে বা মি’রাজের রাতে ইবাদাত-বন্দেগী করা সওয়াবের কাজ হত তাহলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতকে এ ব্যাপারে অবশ্যই দিক-নির্দেশনা দিতেন। আর তিনি যদি দিক-নির্দেশনা দিতেন তাহলে তার সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) কোনভাবেই তা গোপন করতেন না। তারা তা অবশ্যই জোরে শোরে প্রচার করতেন। তারা তো নবীগণের পর উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।”
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! চলমান শিরোনামে এতক্ষণ যা বলা হল তা ছিল শায়খ আবদুল আযীয আবদুল্লাহ বিন বাযের বক্তব্যের সার কথা।
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, শবে বরাতের বিপক্ষে উলামাদের বক্তব্য উল্লেখ করলেন, কিন্তু শবে বরাত উদযাপনের পক্ষেও তো অনেক বিখ্যাত উলামাদের বক্তব্য আছে তা তো উল্লেখ করলেন না। তাই ব্যাপারটা কি একপেশে ও ইনসাফ বহির্ভূত হয়ে গেল না?
এর জবাবে আমি বলব ঃ দেখুন, কোন বিষয় বিদ‘আত হওয়ার ক্ষেত্রে উলামাদের বক্তব্য যথেষ্ট। কেননা কুরআন ও হাদীসে কোন বিষয়কে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি যে, অমুক কাজটি বিদ‘আত। তাই আলেমগণ যেটাকে বিদ‘আত বলে রায় দিবেন সেটা বিদ‘আতই হবে। বিদ‘আত নির্ধারণের দায়িত্ব আলেমদের । কিন্তু কোন বিষয়কে ওয়াজিব, সুন্নাত বা মুস্তাহাব অথবা সওয়াবের কাজ বলে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আলেমদের বক্তব্য যথেষ্ট হবে না যদি না উহার পক্ষে কুরআন ও হাদীসের সহীহ দলীল থাকে। অতএব কোন বিষয় বিদ‘আত হওয়ার ক্ষেত্রে উলামাদের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য, কিন্তু সুন্নাত হওয়ার ব্যাপারে নয়।
আর এ কারণে আমরা শবে বরাত প্রচলনের সমর্থনে আলেমদের বক্তব্য উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করিনা।
এ বিবেচনায় যে সকল আলেম শবে বরাত উদযাপন করাকে বিদ‘আত বলেছেন তাদের বক্তব্য গ্রহণ করতে হবে। যারা শবে বরাতের পক্ষে বলেছেন তাদের বক্তব্য এ জন্য গ্রহণ করা যাবে না যে, তা কুরআন ও সুন্নাহর সহীহ দলীলে উত্তীর্ণ নয়।
শবে বরাত সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহর অবস্থান
শবে বরাত উদযাপন করা ও না করার ক্ষেত্রে বিশ্বের মুসলিমদেরকে চার ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রথমতঃ যারা কোনভাবেই শবে বরাত উদযাপন করেন না ও উদযাপন করাকে ইসলাম সম্মত মনে করেন না।
দ্বিতীয়তঃ যারা সম্মিলিতভাবে শবে বরাত উদযাপন করেন না ঠিকই, কিন্তু এ রাতে ব্যক্তিগতভাবে চুপে চুপে ‘আমল করা ফাযীলাতপূর্ণ মনে করেন, দিবসে সিয়াম পালন করেন ও রাত্রি জাগরণ করেন।
তৃতীয়তঃ যারা ১৫ শাবানের রাতে মাসজিদে জমায়েত হয়ে ইবাদাত-বন্দেগী করেন, কবর যিয়ারত করেন, মাসজিদে ওয়াজ-নাসীহাতে শরীক হন, পরের দিন সিয়াম পালন করেন, এই রাতে হায়াত-মউত, রিয্ক-দৌলত সম্পর্কে আল্লাহ সিদ্ধান্ত নেন বলে বিশ্বাস করেন। সারা রাত জেগে ইবাদাত-বন্দেগী করেন। তবে আতশ-বাযি, মোমবাতি জ্বালানো ও আলোকসজ্জা ইত্যাদিকে নাজায়েয বলে জানেন।
চতুর্থতঃ যারা ১৫ শাবানের রাতে আতশবাজি, আলোক সজ্জা ও আমোদ ফুর্তি করেন ও সময় সুযোগ মত ইবাদাত-বন্দেগীও করেন।
এ চার প্রকার লোকদের মধ্যে প্রথম প্রকারের মানুষের সংখ্যাই বেশী। আমি কিন্তু এ কথা বলতে চাচ্ছিনা যে, অধিকাংশ মুসলিম শবে বরাত পালন করেন না বলে তা করা ঠিক নয়। বরং আমি বলতে চাচ্ছি যে, শবে বরাত সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহর এ বিভক্তি শবে বরাত উদযাপন বিদ‘আত হওয়ার একটা স্পষ্ট আলামত। এ ক্ষেত্রে আমি বিশ্ববরেণ্য আলেমে দ্বীন আবুল হাসান আলী নদভী (রহঃ) এর কিতাব ‘র্শিক ও বিদয়াত’ থেকে একটি উদ্ধৃতি দেয়া যথার্থ মনে করছি। তিনি লিখেছেন ঃ “আল্লাহর দ্বীন ও শরীয়তের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হলো বিশ্বব্যাপী সম-আদর্শতা। এই সমাদর্শ ও স্বাদৃশ্যতা যেমন কাল ও সময়ের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় তেমনি স্থানের ক্ষেত্রেও। আল্লাহ হচ্ছেন রাব্বুল মাশরিকাইন ওয়া রাব্বুল মাগরিবাইন; পূর্ব-পশ্চিম সকল কিছুর রব ও মালিক। তিনি স্থান ও কালের সীমা ও বাধার উর্দ্ধে। তাই তাঁর শরীয়াত ও তাঁর দ্বীনে এক অত্যাশ্চর্য সমতা ও সমাদর্শ বিদ্যমান। তাঁর আখিরী শরীয়াত ও আখিরী নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনাদর্শে এসে যা হয়েছে তাকমীল -পূর্ণতা প্রদীপ্ত সূর্যের মতই সকলের জন্য সমান এবং আকাশ ও মাটির মত সকলের জন্য সম উপযোগীতাপূর্ণ। প্রথম যুগে এর যে রূপ ও আকৃতি ছিল হিজরী পনের শতকেও উহার রূপ ও আকৃতি সেই একই। প্রাচ্যবাসীদের জন্য এটি যেমন ও যতটুকু, ঠিক তেমন ও ততটুকুই প্রতীচ্যের জন্য। যে সমস্ত নীতি ও নির্দেশ, ইবাদাতের যে রূপ ও আকৃতি, আল্লাহর নৈকট্য লাভের যে সমস্ত সুনির্ধারিত পন্থা ও উপায় আরবদের জন্য ছিল ঠিক তদ্রƒপ আছে তা ভারতবাসীর জন্যও। তাই দুনিয়ার যে কোন অংশের একজন মুসলিম অধিবাসী অপর কোন অংশে যদি চলে যায় তাহলে ইসলামী ফরয আদায় এবং ইবাদাত-বন্দেগী করার ক্ষেত্রে তার কোন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় না। তার জন্য কোন স্থানীয় গাইডের প্রয়োজন পড়ে না। তিনি যদি আলিম হন, শরীয়ত সম্পর্কে বিজ্ঞ হন তাহলে কেবল মুক্তাদীই নয় অধিকন্তু যে কোন স্থানে তিনি ইমামও হতে পারেন।
বিদ‘আতের অবস্থা এর বিপরীত। এতে সমদৃশ্যতা ও একত্বতা নেই। স্থান ও কালের প্রভাব এতে পরিস্ফুট থাকে। গোটা মুসলিম বিশ্বে এর একটিমাত্র রূপে প্রচলনও হয়ে ওঠে না।”
সকল ধরনের বিদ‘আতের ক্ষেত্রে উপরোক্ত কথা প্রযোজ্য। শবে বরাত এমনি একটা বিষয় যা আমরা ভারতীয় উপমহাদেশের লোকেরা মহা ধুমধামে উদযাপন করছি, কিন্তু অন্য এলাকার মুসলিমদের কাছে এ সম্পর্কে কোন খবর নেই। কি আশ্চর্য! এমন এক মহা-নিয়ামাত যা মক্কা-মদীনার লোকেরা পেলনা, অন্যান্য আরবরা পেলনা, আফ্রিকানরা পেলনা, ইন্দোনেশীয়, মালয়েশীয়রা পেলনা, ইউরোপ-আমেরিকা-অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশের লোকেরা পেলনা; অথচ ভাগ্যক্রমে সৌভাগ্যের মহান রাত পেয়ে গেলাম আমরা উপ-মহাদেশের কিছু লোকেরা ও শিয়া মতাবলম্বীরা!
এ বিষয়টি যদি বিভ্রান্তিকর না হত তাহলে সকল মুসলিমের পাওয়ার কথা ছিল। হাদীসে এসেছে ঃ
عن عبد الله بن عمر رضي الله عنهما أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: إن الله تعالى لا يجمع أمتي على ضلالة. (رواه الترمذي وصححه الألباني في صحيح الجامع رقم ১৮৪৮)
অর্থ ঃ সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃআল্লাহ তাআলা আমার উম্মতকে কোন গোমরাহী বা বিভ্রান্তিতে একমত হতে দিবেন না। (তিরমিযী)
অন্য বর্ণনায় এসেছে ঃ
عن أنس رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: إن الله تعالى قد أجار أمتي أن تجمع على ضلالة. (صحيح الجامع ১৭৪৬ رقم ১৭৪৬)
অর্থ ঃ সাহাবী আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ আল্লাহ তা’আলা আমার উম্মতকে কোন ভ্রান্ত বিষয়ে একমত হওয়া থেকে মুক্তি দিয়েছেন। (সহীহ জামেয়)
এ হাদীসের অর্থ হল আমার উম্মত যদি কোন বিষয়ে একমত হয় তাহলে সে বিষয়টি বিভ্রান্তিকর হতে পারে না। আর আমার উম্মতের কোন বিষয়ে একমত না হওয়ার বিষয়টি বিভ্রান্ত হওয়ার একটা আলামত হতে পারে।
শবে বরাত এমনি একটি ‘আমল যে উম্মতে মুসলিমাহ এ বিষয়ে কখনো একমত হয়নি, হওয়া সম্ভবও নয়। আবার যারা উদযাপন করেন তাদের মধ্যেও দেখা যায় ‘আমল ও বিশ্বাসের বিভিন্নতা।
শবে বরাত সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করার দায়িত্ব উলামায়ে কিরামের
ইসলাম ধর্মে যতগুলো বিদ‘আত চালু হয়েছে তা কিন্তু সাধারণ মানুষ বা কাফির মুশরিকদের মাধ্যমে প্রসার ঘটেনি। উহার প্রসারের জন্য দায়ী যেমন এক শ্রেণীর উলামা, তেমনি উলামায়ে কিরামই যুগে যুগে বিদ‘আতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন, দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, জেল-যুল্ম বরদাশত করেছেন।
তাই বিদ‘আত যে নামেই প্রতিষ্ঠা লাভ করুক না কেন উহার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করতে হবে আলেমদেরকেই। তারা যদি এটা না করে কারো অন্ধ অনুসরণ বা অনুকরণ করেন, বিভ্রান্তি ছড়ান বা কোন বিদ‘আতী কাজ-কর্ম প্রসারে ভূমিকা রাখেন, তাহলে এ জন্য তাদেরকে আল্লাহর সম্মুখে জবাবদিহি করতে হবে। যে দিন বলা হবে ঃ
وَيَوْمَ يُنَادِيهِمْ فَيَقُولُ مَاذَا أَجَبْتُمُ الْمُرْسَلِينَ.(القصص :৬৫)
অর্থ ঃ আর সে দিন আল্লাহ তাদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা রাসূলদের আহ্বানে কিভাবে সাড়া দিয়েছিলে? (সূরা কাসাস, ৬৫)
সেদিন তো এ প্রশ্ন করা হবে না যে, তোমরা অমুক পীরের মত অনুযায়ী বা অমুক ইমামের মত অনুযায়ী ‘আমল করেছিলে কিনা। যারা সহীহ সুন্নাহ মত ‘আমল করবে তারাই সেদিন সফলকাম হবে।
একটি বিভ্রান্তির নিরসন
১৫ শাবানে দিনের সিয়াম ও রাতের ইবাদাত-বন্দেগী, কুরআন তেলাওয়াত, নফল সালাত, কান্নাকাটি, দু‘আ-মুনাজাত, কবর যিয়ারাত, দান-সাদকাহ, ওয়াজ-নাসীহাত প্রভৃতি নেক ‘আমল গুরুত্বসহকারে পালন করাকে যখন কুরআন ও হাদীস সম্মত নয় বলে আলোচনা করা হয় তখন সাধারণ ধর্ম-প্রাণ ভাই-বোনদের পক্ষ থেকে একটি প্রশ্ন আসে যে, জনাব! আপনি শবে বরাতে উল্লিখিত ইবাদাত-বন্দেগীকে বিদ‘আত বা কুরআন ও সুন্নাহ সম্মত নয় বলেছেন, কিন্তু রোযা রাখা সওয়াবের কাজ ও রুটি তৈরী করে গরীব দুঃখীকে দান করা ভাল কাজ নয় কি? আমরা কান্নাকাটি করে আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে দোষের কি?
সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দ! নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দ‘ুআ-মুনাজাত, সালাত, সিয়াম, দান-ছাদাকাহ, কুরআন তিলাওয়াত, রাত্রি জাগরণ হল নেক ‘আমল। এতে কারও দ্বি-মত নেই। আমরা কখনো এগুলিকে বিদ‘আত বলি না। যা বিদ‘আত বলি এবং যে সম্পর্কে উম্মাহকে সতর্ক করতে চাই তা হল এ রাতকে শবে বরাত বা সৌভাগ্য রজনী অথবা মুক্তি রজনী মনে করে বিভিন্ন প্রকার ‘আমল ও ইবাদাত বন্দেগীর মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করা। এটা কুরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থী। এটাই ধর্মে বাড়াবাড়ি। যা ধর্মে নেই তা উদযাপন করা ও প্রচলন করার নাম বিদ‘আত।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নবুওয়াতের তেইশ বছরের জীবনে কখনো তার সাহাবীগণকে সাথে নিয়ে মক্কায় মাসজিদুল হারামে অথবা মদীনায় মাসজিদে নবুবীতে কিংবা অন্য কোন মাসজিদে একত্র হয়ে উল্লিখিত ইবাদাত-বন্দেগীসমূহ করেছেন এমন কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। তাঁর ইন্তেকালের পরে তাঁর সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) তথা খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে কেহ জানতো না শবে বরাত কি এবং এতে কি করতে হয়। তারা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের ‘আমল প্রত্যক্ষ করেছেন। আমাদের চেয়ে উত্তম রূপে কুরআন অধ্যয়ন করেছেন। তারা তাতে শবে বরাত সম্পর্কে কোন দিক-নির্দেশনা পেলেন না। তারা তাদের জীবন কাটালেন আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে, অথচ জীবনের একটি বারও তাঁর কাছ থেকে শবে বরাত বা মুক্তির রজনীর ছবক পেলেন না? যা পালন করতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে যাননি, যা কুরআনে নেই, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের তা’লীমে নেই, সাহাবীগণের ‘আমলে নেই, তাদের সোনালী যুগের বহু বছর পরে প্রচলন করা শবে বরাতকে আমরা বিদ‘আত বলতে চাই। আমরা বলতে চাই, এটা একটা মনগড়া পর্ব। আমরা মানুষকে বুঝাতে চাই, এই সব প্রচলিত ও বানোয়াট মুক্তির রজনী উদযাপন থেকে দূরে থাকতে হবে। আমরা উম্মতকে কুরআন ও সুন্নাহমুখী করতে এবং সেই অনুযায়ী ‘আমল করাতে অভ্যস্ত করতে চাই।
বিদ‘আত সম্পর্কে কিছু কথা
বিদ‘আত কাকে বলে এ বিষয়ে অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই। অনেকের ধারণা যা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে ছিলনা তা-ই বিদ‘আত। আবার অনেকে মনে করেন বর্তমান নিয়মতান্ত্রিক মাদ্রাসা শিক্ষা পদ্ধতি একটি বিদ‘আত, তাবলীগ জামাতের পদ্ধতি বিদ‘আত, বিমানে হজ্জে যাওয়া বিদ‘আত, মাইকে আজান দেয়া বিদ‘আত ইত্যাদি। এ সকল দিক বিবেচনা করে তারা বিদ‘আতকে নিজেদের খেয়াল খুশি মত দুই ভাগ করে কোনটাকে হাসানাহ (ভাল বিদ‘আত) আবার কোনটাকে সাইয়্যেআহ (মন্দ বিদ‘আত) বলে চালিয়ে দেন। আসলে বিদ‘আত সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার কারণে এ বিভ্রান্তি।
বিদ‘আতের আভিধানিক অর্থ হল ঃ
الشيء المخترع على غير مثال سابق ومنه قوله تعالى (قل ما كنت بدعا من الرسل) وجاء على هذا المعنى قول عمر رضي الله عنه (نعمت البدعة)
অর্থ ঃ পূর্বের দৃষ্টান্ত ব্যতীত নতুন সৃষ্ট কোন বিষয় বা বস্তু। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন ঃ “বলুন, আমি তো কোন নতুন রাসূল নই।
আসলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাসূল হিসাবে নতুনই। কিন্তু এ আয়াতে বিদ‘আত শব্দের অর্থ হল এমন নতুন যার দৃষ্টান্ত ইতোপূর্বে গত হয়নি। আর উমার (রাঃ) তারাবীহর জামাত কায়েম করে বলেছিলেন “এটা উত্তম বিদ‘আত।” এখানেও বিদ‘আতের আভিধানিক অর্থ প্রযোজ্য।
ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় বিদ‘আতের সংজ্ঞা
ما أحدث في دين الله وليس له أصل عام ولا خاص يدل عليه.
‘যা কিছু আল্লাহর দ্বীনে নতুন সৃষ্টি করা হয় অথচ এর সমর্থনে কোন ব্যাপক বা বিশেষ দলীল প্রমাণ নেই।’
অর্থাৎ নব সৃষ্ট বিষয়টি অবশ্যই ধর্মীয় ব্যাপারে হতে হবে। যদি ধর্মীয় ব্যাপার ব্যতীত অন্য কোন বিষয়ে নব-আবিস্কৃত কিছু দেখা যায় তা শরীয়তের পরিভাষায় বিদ‘আত বলে গণ্য হবে না, যদিও শাব্দিক অর্থে তা বিদ‘আত।
এ প্রসঙ্গে আবুল হাসান আলী নদভী (রহঃ) তার ‘র্শিক ও বিদ‘আত’ কিতাবে বিদ‘আতের পরিচ্ছন্ন সংজ্ঞা উল্লেখ করেছেন। তা হল ঃ যে বিশ্বাস বা কাজ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করেননি কিংবা পালন করার নির্দেশ দেননি সেই ধরনের বিশ্বাস বা কাজকে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করা, এর অঙ্গ বলে সাব্যস্ত করা, সওয়াব বা আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় মনে করে এই ধরনের কাজ করার নাম বিদ‘আত।
যে সকল বিশ্বাস ও কাজকে দ্বীনের অংশ মনে করে অথবা সওয়াব হবে ধারণা করে ‘আমল করা হয় তা বিদ‘আত। কারণ হাদীসে এসেছে ঃ
عن عائشة رضي الله عنها قالت قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد. (أخرجه البخاري ومسلم)
অর্থ ঃ আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ যে আমাদের এ ধর্মে এমন কোন নতুন বিষয় উদ্ভাবন করবে যা ধর্মে অন্তর্ভুক্ত ছিল না তা প্রত্যাখ্যাত হবে। (বুখারী ও মুসলিম)
এ হাদীস দ্বারা স্পষ্ট হল যে, নতুন আবিস্কৃত বিষয়টি যদি ধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে ধরে নেয়া হয় তাহলে তা বিদ‘আত ও প্রত্যাখ্যাত।
হাদীসে আরো এসেছে ঃ
من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد. (رواه مسلم)
অর্থ ঃ যে ব্যক্তি এমন কাজ করল যার প্রতি আমাদের (ইসলামের) নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত। (মুসলিম)
এ হাদীসে “যার প্রতি আমাদের নির্দেশ নেই” বাক্যটি দ্বারা এ কথা বুঝানো হয়েছে যে, বিষয়টি ধর্মীয় হতে হবে। ধর্মীয় বিষয় হিসাবে কোন নতুন ‘আমল করলেই বিদ‘আত হবে। যারা মাইকে আজান দেন তারা জানেন যে, মাইকে আজান দেয়ার আলাদা কোন মর্যাদা নেই বা আজানে মাইক ব্যবহার করা সওয়াবের কাজ বলে তারা মনে করেন না। এমনিভাবে বিমানে হজ্জে যাওয়া, প্রাতিষ্ঠানিক মাদ্রাসার প্রচলন, নাহু সরফের শিক্ষা গ্রহণ প্রভৃতি বিষয় ধর্মীয় বিষয় বলে মনে করা হয় না, তাই তা বিদ‘আত হওয়ার প্রশ্ন আসে না। এ ধরনের বিষয়গুলি বিদ‘আত নয় বরং সুন্নাতে হাসানাহ বলা যেতে পারে।
অনেকে এ বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বিদ‘আতকে দু’ভাগে ভাগ করার চেষ্টা করেন। বিদ‘আতে হাসানাহ ও বিদ‘আতে সাইয়্যেআহ। সত্যি কথা হল বিদ‘আতকে এভাবে ভাগ করাটা হল আরেকটি বিদ‘আত এবং তা হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিপন্থী।
কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ
إياكم ومحدثات الأمور، فإن كل محدثة بدعة وكل بدعة ضلالة. (رواه أبو داود والترمذي وابن ماجه والبيهقي في السنن عن العرباض بن سارية.)
অর্থ ঃ সকল নব-আবিস্কৃত (দীনের মধ্যে) বিষয় হতে সাবধান! কেননা প্রত্যেকটি নব-আবিস্কৃত বিষয় বিদ‘আত, আর প্রত্যেকটি বিদ‘আত হল পথভ্রষ্টতা। (আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও বাইহাকী)
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন সকল প্রকার বিদ‘আত ভ্রষ্টতা। এখন যদি বলা হয় কোন কোন বিদ‘আত আছে যা হাসানাহ বা উত্তম, তাহলে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ হাদীসবিরোধী হয়ে যায়। তাই তো ইমাম মালিক (রঃ) বলেছেন ঃ
من ابتدع فى الإسلام بدعة يراها حسنة فقد زعم أن محمدا صلى الله عليه وسلم خان الرسالة، فإن الله سبحانه وتعالى يقول (اليوم أكملت لكم دينكم) فما لم يكن يومئذ دينا فلا يكون اليوم دينا.
অর্থ ঃ যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে কোন বিদ‘আতের প্রচলন করে আর ইহাকে হাসানাহ বা ভাল বলে মনে করে, সে যেন প্রকারান্তরে এ বিশ্বাস পোষণ করে যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর পয়গাম পৌছাতে খিয়ানাত করেছেন। কারণ আল্লাহ তা‘আলা নিজেই বলেন ঃ ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূর্ণ করে দিলাম।’ সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে যা ধর্ম রূপে গণ্য ছিল না আজও তা ধর্ম বলে গণ্য হতে পারে না।
তাই বিদ‘আতে হাসানাহ বলে কোন কিছু নেই। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বলেছেন আমরা তাই বলব; সকল প্রকার বিদ‘আত গোমরাহী ও ভ্রষ্টতা।
বিদ‘আতে হাসানায় বিশ্বাসীরা যা কিছু বিদ‘আতে হাসানাহ হিসাবে দেখাতে চান সেগুলো হয়ত শাব্দিক অর্থে বিদ‘আত, শরয়ী অর্থে নয় অথবা সেগুলো সুন্নাতে হাসানাহ। যে সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ
من سن فى الإسلام سنة حسنة فله أجرها وأجر من عمل بها بعده من غير أن ينقص من أجورهم شيء، ومن سن في الإسلام سنة سيئة فله وزرها ووزر من عمل بها من بعده من غير أن ينقص من أوزارهم شيء. (رواه مسلم عن جرير بن عبد الله رضي الله عنهما)
অর্থ ঃ যে ইসলামে কোন ভাল পদ্ধতি প্রচলন করল সে উহার সওয়াব পাবে এবং সেই পদ্ধতি অনুযায়ী যারা কাজ করবে তাদের সওয়াবও সে পাবে, তাতে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামে কোন খারাপ পদ্ধতি প্রবর্তন করবে সে উহার পাপ বহন করবে, এবং যারা সেই পদ্ধতি অনুসরণ করবে তাদের পাপও সে বহন করবে, তাতে তাদের পাপের কোন কমতি হবে না। (মুসলিম)
এখানে একটা প্রশ্ন হতে পারে যে, শবে বরাত উদযাপন, মীলাদ মাহফিল, মীলাদুন্নবী প্রভৃতি আচার-অনুষ্ঠানকে কি সুন্নাতে হাসানাহ হিসাবে গণ্য করা যায় না? মাইকে আজান দেয়া, মাদ্রাসার পদ্ধতি প্রচলন, আরবী ব্যাকরণ শিক্ষা ইত্যাদি কাজগুলো যদি সুন্নাতে হাসানাহ হিসাবে ধরা হয় তাহলে শবে বরাত, মীলাদ ইত্যাদিকে কেন সুন্নতে হাসানাহ হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না?
পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, বিদ‘আত হবে ধর্মীয় ক্ষেত্রে। যদি নতুন কাজটি ধর্মের অংশ মনে করে অথবা সওয়াব লাভের আশায় করা হয়, তাহলে তা বিদ‘আত হওয়ার প্রশ্ন আসে। আর যদি কাজটি ধর্মীয় হিসাবে নয় বরং একটা পদ্ধতি হিসাবে করা হয় তাহলে তা বিদ‘আত হওয়ার প্রশ্ন আসে না। যেমন ধরুন মাইকে আজান দেয়া। কেহ মনে করেনা যে, মাইকে আজান দিলে সওয়াব বেশী হয় অথবা মাইক ছাড়া আজান দিলে সওয়াব হবে না। তাই সালাত ও আজানের ক্ষেত্রে মাইক ব্যবহারকে বিদ‘আত বলা যায় না।
তাই বলতে হয় বিদ‘আত ও সুন্নাতে হাসানার মধ্যে পার্থক্য এখানেই যে, কোন কোন নতুন কাজ ধর্মীয় ও সওয়াব লাভের নিয়াত হিসাবে করা হয় আবার কোন কোন নতুন কাজ দ্বীনি কাজ ও সওয়াবের নিয়াতে করা হয় না বরং সংশ্লিষ্ট কাজটি সহজে সম্পাদন করার জন্য একটা নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়।
যেমন আমরা যদি ইতিপূর্বে উল্লিখিত হাদীসটির প্রেক্ষাপটের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, একবার মুদার গোত্রের কতিপয় অনাহারী ও অভাবগ্রস্থ লোক আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এলো। তিনি সালাত আদায়ের পর তাদের জন্য উপস্থিত লোকজনের কাছে সাহায্য চাইলেন। সকলে এতে ব্যাপকভাবে সাড়া দিলেন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কিরামের আগ্রহ ও খাদ্য সামগ্রী দান করার পদ্ধতি দেখে উল্লিখিত কথাগুলি বললেন।
অভাবগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য যে পদ্ধতি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে ওটাকে সুন্নাতে হাসানাহ বলা হয়েছে।
বলা যেতে পারে, সকল পদ্ধতি যদি হাসানাহ হয় তাহলে সুন্নাতে সাইয়্যেআহ বলতে কি বুঝাবে?
উত্তরে বলব, মনে করুন কোন দেশের শাসক বা জনগণ প্রচলন করে দিল যে এখন থেকে স্থানীয় ভাষায় আজান দেয়া হবে, আরবী ভাষায় দেয়া চলবে না। এ অনুযায়ী ‘আমল করা শুরু হল। এটাকে আপনি কি বলবেন? বিদ‘আত বলতে পারবেন না, কারণ যারা এ কাজটা করল তারা সকলে জানে অনারবী ভাষায় আজান দেয়া ধর্মের নির্দেশ নয় এবং এতে সওয়াবও নেই। তাই আপনি এ কাজটাকে সুন্নাতে সাইয়্যেআহ হিসাবে অভিহিত করবেন। এর প্রচলনকারী পাপের শাস্তি প্রাপ্ত হবে, আর যারা ‘আমল করবে তারাও।
আবার অনেক উলামায়ে কিরাম বিদ‘আতকে অন্যভাবে দু ভাগে ভাগ করে থাকেন। তারা বলেন বিদ‘আত দু প্রকার। একটা হল বিদ‘আত ফিদ্দীন (البدعة في الدين) বা ধর্মের ভিতর বিদ‘আত। অন্যটা হল বিদ‘আত লিদ্দীন (البدعة للدين) অর্থাৎ ধর্মের জন্য বিদ‘আত। প্রথমটি প্রত্যাখ্যাত আর অন্যটি গ্রহণযোগ্য।
আমার মতে এ ধরণের ভাগ নি¯প্রয়োজন, বরং বিভ্রান্তি সৃষ্টিতে সহায়ক। কারণ প্রথমতঃ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন সকল বিদ‘আত পথভ্রষ্টতা বা গোমরাহী। এতে উভয় প্রকার বিদ‘আত শামিল।
দ্বিতীয়তঃ অনেকে বিদ‘আত ফিদ্দীন করে বলবেন, আমি যা করেছি তা হল বিদ‘আত লিদ্দীন। যেমন কেহ মীলাদ পড়লেন। অতঃপর যারা এর প্রতিবাদ করলেন তাদের সাথে তর্কে লিপ্ত হয়ে অনেক দূর যেয়ে বললেন, মীলাদ পড়া হল বিদ‘আত লিদ্দীন। এর দ্বারা মানুষকে ইসলামের পথে ডাকা যায়।
আসলে যা বিদ‘আত লিদ্দীন বা দ্বীনের স্বার্থে বিদ‘আত তা শরীয়তের পরিভাষায় বিদ‘আতের মধ্যে গণ্য করা যায় না। সেগুলোকে সুন্নাতে হাসানাহ হিসাবে গণ্য করাটাই হাদীসে রাসূল দ্বারা সমর্থিত।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! বিদ‘আত সম্পর্কে এ কথাগুলো এখানে এ জন্য আলোচনা করলাম যাতে আলোচ্য বিষয়ের উপর কোন প্রশ্ন বা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হলে তার সমাধান যেন পাঠকবৃন্দ সহজে অনুধাবন করতে পারেন।
বিদ‘আতের কুফল
এমন অনেকের সাক্ষাত পাবেন যারা ইসলামী চেতনায় সমৃদ্ধ। কিন্তু বলেন, বিদ‘আতের বিরোধিতায় এত বাড়াবাড়ির কি দরকার? কেহ একটু মীলাদ পড়লে, কুলখানি বা চল্লিশা-চেহলাম পালন কিংবা এ জাতীয় কিছু করলে দ্বীন ইসলামের কি এমন ক্ষতি হয়ে যায়?
আমি একদিন এক মাসজিদের ইমাম সাহেবের বক্তব্য শুনছিলাম। তিনি বলছিলেন শবে মিরাজ উপলক্ষ্যে এ রাতে কোন বিশেষ সালাত, ইবাদাত-বন্দেগী বা সিয়াম নেই। যদি শবে মিরাজ উপলক্ষ্যে কোন ‘আমল করা হয় তা বিদ‘আত হিসাবেই গণ্য হবে।
তার এ বক্তব্য শেষ হতে না হতেই কয়েকজন শিক্ষিত শ্রেণীর মুসল্লী বলে উঠলেন, হুজুর এ কি বলেন! রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুহাব্বতে এ রাতে কিছু করলে বিদ‘আত হবে কেন? প্রশ্নকারী লোকগুলো যে বিভ্রান্ত বা বিদ‘আতপন্থী তা কিন্তু নয়। তাদের খারাপ কোন উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু তারা যা করার ইচ্ছা করেছেন, উহার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই।
অবশ্যই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুহব্বত ঈমানের অঙ্গ। আর সব ধরনের মুহাব্বতেই আবেগ থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুহব্বতেও থাকবে। কিন্তু সেই আবেগ যেন মুহব্বতের নীতিমালা লংঘন না করে। সেই আবেগভরা মুহাব্বত যেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ ও সুন্নাহর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত না হয়। যদি এমনটি হয় তাহলে বুঝতে হবে যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুহাব্বতের নামে শয়তান তাকে ধোকায় ফেলেছে।
এ কথাতো মুসলিমদের কাছে দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, খৃষ্টানরা বিদ‘আতী কাজ-কর্ম করে ও তাদের নবীর মুহব্বতে বাড়াবাড়ি করে পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। এ কথা যেমন আল-কুরআনে এসেছে, তেমনি হাদীসেও আলোচনা করা হয়েছে। আমি অতি সংক্ষেপে এখানে বিদ‘আতের কতিপয় পরিণাম সম্পর্কে আলোচনা করছি যার অধিকাংশ شرح رياض الصالحين من كلام سيد المرسلين، للشيخ محمد بن صالح العثيمين- رحمه الله নামক কিতাব থেকে নেয়া হয়েছে।
(১) বিদআত মানুষকে পথভ্রষ্ট করে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা উম্মতের জন্য নিয়ে এসেছেন তা হল হক্ক। এ ছাড়া যা কিছু ধর্মীয় আচার হিসাবে পালিত হবে তা পথভ্রষ্টতা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন ঃ
فماذَا بَعْدَ الْحَقِّ إِلَّا الضَّلَالُ (يونس : ৩২)
অর্থ ঃ হক আসার পর বিভ্রান্তি ব্যতীত আর কি থাকে? (সূরা ইউনূস, ৩২)
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ
كل بدعة ضلالة.
অর্থ ঃ সকল ধরনের বিদ‘আত পথভ্রষ্টতা। (মুসলিম, ইবনে মাজাহ)
(২) বিদ‘আত রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য থেকে মানুষকে বের করে দেয় এবং সুন্নাতের বিলুপ্তি ঘটায়।
কেননা বিদ‘আত অনুযায়ী কেউ ‘আমল করলে অবশ্যই সে এক বা একাধিক সুন্নাত পরিত্যাগ করে। উলামায়ে কিরাম বলেছেন ঃ “যখন কোন দল সমাজে একটা বিদ‘আতের প্রচলন করে, তখন সমাজ থেকে কম করে হলেও একটি সুন্নাত বিলুপ্ত হয়ে যায়।”
আর এটা অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত যে, যখনই কোন বিদ‘আত ‘আমলে আনা হয়েছে তখনই সেই স্থান থেকে একটি সুন্নাত চলে গেছে বা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে মুজাদ্দিদ আলফেসানীর মাকতুবাত থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যায়। তিনি লিখেছেন ঃ এক ব্যক্তি আমাকে প্রশ্ন করল ‘আপনারা বলেছেন ঃ যে কোন বিদ‘আত নাকি একটি সুন্নাতকে বিলুপ্ত করে। আচ্ছা, যদি মৃত ব্যক্তিকে কাফনের সাথে একটি পাগড়ী পড়িয়ে দেয়া হয় তাহলে কোন সুন্নাতটি বিলুপ্ত হয়? কি কারণে এটা বিদ‘আত বলা হবে?’ আমি জবাবে লিখলাম ঃ অবশ্যই একটি সুন্নাত বিলুপ্ত হয় যদি মৃতের কাফনে পাগড়ী দেয়া হয়। কারণ পুরুষের কাফনের সুন্নাত হল কাপড়ের সংখ্যা হবে তিন। পাগড়ী পড়ালে এ সংখ্যা আর ‘তিন’ থাকেনা, সংখ্যা দাড়ায় ‘চার।’
উদাহরণ হিসাবে আরো বলা যায়, এক ব্যক্তি ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ল। ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। এ সমস্যার জন্য এক পীর সাহেবের কাছে গেল। পীর সাহেব তাকে বললেন, তুমি এক খতম কুরআন বখশে দাও অথবা নির্দেশ দিলেন একটা মীলাদ দাও বা খতমে ইউনূসের ব্যবস্থা কর। সে তাই করল। ফলাফল কি দাড়াল? ঋণ পরিশোধে অক্ষম ব্যক্তির জন্য একটি দু‘আ রয়েছে যা ‘আমল করা সুন্নাত। বিদ‘আত অনুযায়ী ‘আমল করার কারণে সে সেই সুন্নাতটি পরিত্যাগ করল। জানার চেষ্টা করলনা যে, এ ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি ব্যবস্থা দিয়ে গেছেন। অন্যদিকে সে মিলাদ, কুরআন খতম ইত্যাদি বিদ‘আতী কাজ করে আরও আর্থিক ঋণভারে জর্জরিত হলো।
রামাযানের শেষ দশ দিনের রাতসমূহে রাত জেগে ইবাদাত-বন্দেগী করা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত, যা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু ১৫ শাবানে রাত জাগাকে যেমন গুরুত্ব দেয়া হয় তেমনভাবে এ সুন্নাতী ‘আমলের প্রচলন দেখা যায় না। বরং শবে কদরের মূল্যায়ন শবে বরাতকে করা হচ্ছে।
ফরয সালাত আদায়ের পর সর্বদা জামাতবদ্ধ হয়ে মুনাজাত করা একটি বিদ‘আত। এটা ‘আমল করার কারণে ফরয সালাত আদায়ের পর যে সকল যিক্র-আযকার সুন্নাত হিসাবে বর্ণিত আছে তা পরিত্যাগ করা হয়।
আপনি দেখবেন এভাবে প্রতিটি বিদ‘আত একটি সুন্নাতকে অপসারিত করে উহার স্থান দখল করে নিয়েছে।
(৩) বিদ‘আত আল্লাহর দ্বীনকে বিকৃত করে।
এর জ্বলন্ত উদাহরণ আজকের খৃষ্টান ধর্ম। তারা ধর্মে বিদ‘আত প্রচলন করতে করতে উহার মূল কাঠামো পরিবর্তন করে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে পথভ্রষ্ট হিসাবে অভিহিত হয়েছে। তাদের বিদ‘আত প্রচলনের কথা আল-কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে ঃ
وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ إِلَّا ابْتِغَاءَ رِضْوَانِ اللَّهِ (سورةالحديد: ২৭)
অর্থ ঃ আর সন্ন্যাসবাদ! ইহাতো তারা নিজেরাই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় প্রচলন করেছিল। আমি তাদের এ বিধান দেইনি। (সূরা হাদীদ. ২৭)
সন্ন্যাস তথা বৈরাগ্যবাদের বিদ‘আত খৃষ্টানেরা তাদের ধর্মে প্রবর্তন করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ভাল ছিল; উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি। কিন্তু ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে নিজেদের ইচ্ছামত যে কোন কাজ করলেই তা গ্রহণযোগ্য হয় না। এ জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুমোদন প্রয়োজন। এভাবে যারা ধর্মে বিদ‘আতের প্রচলন করে তাদের অনেকেরই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভাল থাকে। কিন্তু তাতে নাজাত পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। ইয়াহুদী ও খৃষ্টানেরা তাদের ধর্মে অন্য জাতির রসম-রেওয়াজ ও বিদ‘আত প্রচলন করে ধর্মকে এমন বিকৃত করেছে যে, তাদের নবীগণ যদি আবার পৃথিবীতে ফিরে আসেন তাহলে তাদের রেখে যাওয়া ধর্ম তাঁরা নিজেরাই চিনতে পারবেন না।
আমাদের মুসলিম সমাজে শিয়া স¤প্রদায় বিদ‘আতের প্রচলন করে দ্বীন ইসলামকে কিভাবে বিকৃত করেছে তা নতুন করে বর্ণনা করার প্রয়োজন নেই।
(৪) বিদ‘আত ইসলামের উপর একটি আঘাত।
যে ইসলামে কোন বিদ‘আতের প্রচলন করল সে মূলতঃ অজ্ঞ লোকদের মত এ কথা স্বীকার করে নিল যে, ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন বিধান নয়, তাতে সংযোজনের প্রয়োজন আছে। যদিও সে মুখে এ ধরনের বক্তব্য দেয় না, কিন্তু তার কাজ এ কথার স্বাক্ষী দেয়। অথচ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন ঃ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। (সূরা মায়িদা, ৩)
(৫) বিদ‘আত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে খিয়ানাতের এক ধরনের অভিযোগ।
যে ব্যক্তি কোন বিদ‘আতের প্রচলন করল বা ‘আমল করল আপনি তাকে জিজ্ঞেস করুন “এ কথা বা কাজটি যে ইসলাম ধর্মে পছন্দের বিষয় এটা কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানতেন? তিনি উত্তরে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ বলবেন। যদি ‘না’ বলেন তাহলে তিনি স্বীকার করে নিলেন যে, ইসলাম সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কম জানতেন। আর যদি ‘হ্যাঁ’ বলেন তাহলে তিনি স্বীকার করে নিলেন যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিষয়টি জানতেন, কিন্তু উম্মাতের মধ্যে প্রচার করেননি। এ অবস্থায় তিনি তাবলীগে শিথিলতা করেছেন। (নাউ‘যুবিল্লাহ!)
(৬) বিদ‘আত মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করে ও ঐক্য সংহতিতে আঘাত করে।
বিদ‘আত মুসলিম উম্মাহর মধ্যে শত্র“তা ও বিবাদ-বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে তাদের মারামারি হানাহানিতে লিপ্ত করে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, একদল লোক মীলাদ বা মীলাদুন্নবী পালন করল। আরেক দল বিদ‘আত হওয়ায় তা বর্জন বা বিরোধিতা করল। যারা এটা পালন করল তারা প্রচার করতে লাগল যে, অমুক দল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিনে আনন্দিত হওয়া পছন্দ করে না। তাঁর গুণ-গান করা তাদের কাছে ভাল লাগেনা। তাদের অন্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুহাব্বত নেই। যাদের অন্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুহাব্বত নেই তারা বেঈমান, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুশমন। আর এ ধরনের প্রচারনায় তারা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে একে অপরের দুশমনে পরিণত হয়ে হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে পড়ল।
এভাবে ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই বিদ‘আতকে গ্রহণ ও বর্জনের প্রশ্নে মুসলিম উম্মাহ শিয়া ও সুন্নী এবং পরবর্তী কালে আরো শত দলে বিভক্ত হয়ে গেল। কত প্রাণহানির ঘটনা ঘটল, রক্তপাত হল।
তাই মুসলিম উম্মাহকে আবার একত্র করতে হলে সকলকে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে আহ্বান ও বিদ‘আত বর্জনের জন্য অহিংস ও শান্তিপূর্ণ পন্থায় পরম ধৈর্যের সাথে আন্দোলন করতে হবে। আন্দোলন করতে হবে সকল মানুষ ও মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা প্রদর্শন করে । কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন আচরণ করা যাবে না। এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, যা হক ও সত্য তা-ই শুধু টিকে থাকবে। আর যা বাতিল তা দেরীতে হলেও বিলুপ্ত হবে।
(৭) বিদ‘আত ‘আমলকারীর তাওবা করার সুযোগ হয় না।
বিদ‘আত যিনি প্রচলন করেন বা সেই অনুযায়ী ‘আমল করেন তিনি এটাকে এক মহৎ কাজ বলে মনে করেন। তিনি মনে করেন এ কাজে আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্ট হবেন। যেমন আল্লাহ খৃষ্টানদের সম্পর্কে বলেছেন তারা ধর্মে বৈরাগ্যবাদের বিদ‘আত চালু করেছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। যেহেতু বিদ‘আতে লিপ্ত ব্যক্তি বিদ‘আতকে পাপের কাজ মনে করেন না, তাই তিনি এ কাজ থেকে তাওবা করার প্রয়োজন মনে করেন না এবং তাওবা করার সুযোগও হয় না। অন্যান্য পাপের বেলায় কমপক্ষে যিনি পাপে লিপ্ত হন তিনি এটাকে অন্যায় মনে করেই করেন। পরবর্তীতে তার অনুশোচনা আসে, এক সময় তাওবা করে আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমা লাভ করেন। কিন্তু বিদ‘আতে লিপ্ত ব্যক্তির এ অবস্থা কখনো হয় না।
(৮) বিদ‘আত প্রচলনকারী রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফাআত পাবে না।
রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর গুনাহগার উম্মাতের শাফায়াতের ব্যাপারে হাশরের ময়দানে খুব আগ্রহী হবেন । আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে অনুমতি লাভ করার পর তিনি বহু গুনাহগার বান্দা-যাদের জন্য শাফাআত করতে আল্লাহ তা‘আলা অনুমতি দিবেন-তাদের জন্য শাফাআত করবেন। কিন্তু বিদ‘আত প্রচলনকারীর জন্য তিনি শাফাআত করবেন না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ
ألا وإني فرطكم على الحوض وأكاثر بكم الأمم فلا تسودوا وجهي، ألا وإني مستنقذ أناسا ومستنقذ مني أناس، فأقول يا رب أصيحابي! فيقول إنك لا تدري ما أحدثوا بعدك. (رواه ابن ماجه، وصححه الألباني في صحيح سنن ابن ماجه)
অর্থ ঃ শুনে রেখ! হাউজে কাউছারের কাছে তোমাদের সাথে আমার দেখা হবে। তোমাদের সংখ্যার আধিক্য নিয়ে আমি গর্ব করব। সেই দিন তোমরা আমার চেহারা মলিন করে দিওনা। জেনে রেখ! আমি সেদিন অনেক মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করার চেষ্টা চালাব। কিন্তু তাদের অনেককে আমার থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া হবে। আমি বলব ঃ হে আমার প্রতিপালক! তারা তো আমার প্রিয় সাথী-সংগী, আমার অনুসারী। কেন তাদের দূরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে? তিনি উত্তর দিবেন ঃ আপনি জানেন না যে, আপনার চলে আসার পর তারা ধর্মের মধ্যে কি কি নতুন বিষয় আবিস্কার করেছে। (ইবনে মাজাহ)
অন্য এক বর্ণনায় আছে এর পর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই তাদের উদ্দেশে বলবেন ঃ দূর হও! দূর হও!!
(৯) বিদ‘আত মুসলিম সমাজে কুরআন ও হাদীসের গুরুত্ব কমিয়ে দেয়।
কুরআন ও সুন্নাহ হল মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামের রক্ষা কবচ। ইসলাম ধর্মের অস্তিত্বের একমাত্র উপাদান। তাইতো বিদায় হজ্বেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি যতক্ষণ তোমরা তা আঁকড়ে রাখবে ততক্ষণ বিভ্রান্ত হবে না।
বিদ‘আত অনুযায়ী ‘আমল করলে কুরআন ও সুন্নাহর মর্যাদা মানুষের অন্তর থেকে কমে যায়। ‘যে কোন নেক ‘আমল কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে’ - এ অনুভূতি মানুষের অন্তর থেকে ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে। তারা কুরআন ও হাদীসের উদ্ধৃতি বাদ দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি, পীর-মাশায়েখ ও ইমামদের উদ্ধৃতি দিয়ে থাকে।
(১০) বিদ‘আত প্রচলনকারী অহংকারের দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ে ও নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে দ্বীনকে ব্যবহার ও বিকৃত করতে চেষ্টা করে।
বিদ‘আত প্রচলনকারী তার নিজ দলের একটি আলাদা কাঠামো দাঁড় করিয়ে ব্যবসায়িক বা আর্থিক সুবিধা লাভের জন্য এমন কাজের প্রচলন করে থাকে যা সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মীয় রূপ লাভ করলেও কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা সমর্থিত হয় না। কারণ সেই কাজটা যদি কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা সমর্থিত হয় তাহলে তার দলের আলাদা কোন বৈশিষ্ট থাকে না। কেননা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত ‘আমল সকল মুসলিমের জন্যই প্রযোজ্য। তাই সে এমন কিছু আবিস্কার করতে চায় যার মাধ্যমে তার দলের আলাদা পরিচয় প্রতিষ্ঠা করা যায়।
এ অবস্থায় যখন হাক্কানী উলামায়ে কিরামগণ এর প্রতিবাদ করেন বা এ কাজটি চ্যালেঞ্জ করেন তখন তার ঔদ্ধত্য বেড়ে যায়। নিজেকে সে কুতুবুল আলম, ইমাম-সম্রাট, হাদীয়ে উম্মাত, রাহবারে মিল্লাত, যিল্লুর রহমান বলে দাবী করতে থাকে। প্রচার করতে থাকে এ দুনিয়ায় সে’ই একমাত্র হক পথে আছে, বাকী সবাই ভ্রান্ত।
সন্দেহজনক নফল ‘আমল থেকে দূরে থাকা উত্তম
যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেই যে, শবে বরাত শর’য়ীভাবে প্রমাণিত, তাহলে উহার মর্যাদা কতটুকু হবে? বেশী হলে মুস্তাহাব। কেহ যদি সারা জীবন মুস্তাহাব শবে বরাতটা বর্জন করে তাহলে তার কি ক্ষতি হবে?
কিন্তু যদি এটা বিদ‘আত হয়, আর যারা এর দিকে মানুষকে আহ্বান করল, উৎসাহিত করল, মানুষকে বিভ্রান্ত হতে প্ররোচিত করল, আকীদা-বিশ্বাসে বিকৃতি ঘটালো, এর প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রাখল তাহলে তাদের পরিণাম কি হবে? একটু ভেবে দেখবেন কি?
ফিকাহর মূলনীতিতে একটি কথা আছে, “নতীজা আরজালের তাবে হয়” অন্যভাবে বলা যায় ঃ
دفع المضر أقدم من جلب المنافع.
অর্থাৎ একটা বিষয় লাভ ও ক্ষতি উভয়ের সম্ভাবনা থাকলে ক্ষতির বিষয়টি প্রাধান্য পাবে এবং বিবেচনায় আনা হবে।
হাদীসে এসেছে ঃ
عن أبي عبد الله النعمان بن بشير رضي الله عنهما قال: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: إن الحلال بين وإن الحرام بين وبينهما أمور مشتبهات لا يعلمهن كثير من الناس، فمن اتقى الشبهات فقد استبرأ لدينه وعرضه، ومن وقع في الشبهات وقع في الحرام، كالراعي يرعى حول الحمى يوشك أن يرتع فيه، ألا وإن لكل ملك حمى، ألا وإن حمى الله محارمه. (رواه البخاري ومسلم)
অর্থ ঃ আবূ আব্দুল্লাহ নুমান ইবনে বাশীর (রাঃ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনেছি ঃ নিশ্চয়ই হালাল স্পষ্ট করে বলা হয়েছে ও হারাম পরিস্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আর এ দুটোর মাঝে কিছু সন্দেহজনক বিষয় আছে যা অনেক মানুষই জানে না। সুতরাং যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বিষয় থেকে বেঁচে থাকল সে নিজের দ্বীন ও ইয্যাত আবরুকে বাঁচাল। আর যে সন্দেহজনক বিষয়ে লিপ্ত হয় সে প্রকারান্তরে হারামে লিপ্ত হয়ে পড়ল। যেমন কোন রাখাল যদি তার গবাদিপশু নিষিদ্ধ চারণভূমির পাশে নিয়ে যায় তাহলে তার অচিরেই নিষিদ্ধ চারণভূমিতে ঢুকে যাওয়ার আশংকা থাকে। তোমরা সাবধানতা অবলম্বন কর! প্রত্যেক রাজা-বাদশার সংরক্ষিত এলাকা রয়েছে, আর আল্লাহ তা‘আলার সংরক্ষিত এলাকা হল তাঁর নিষিদ্ধ বিষয়সমুহ। (বুখারী ও মুসলিম)
সর্বশেষ আহ্বান
উপরোক্ত আলোচনার শেষ কথা হল, শবে বরাত একটি বিদ‘আতী পর্ব। অতএব আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সক্ষম হলাম যে ঃ
(১) এ রাতকে কেন্দ্র করে কোন ধরনের ‘আমল করার সমর্থনে কোন সহীহ হাদীস নেই।
(২) এ রাত সম্পর্কে যা কিছু আকীদাহ বিশ্বাস প্রচলিত আছে তা পোষণ করা জায়েয নয়।
(৩) এ রাতে ইবাদাত বন্দেগী করলে সৌভাগ্য খুলে যায় এমন ধারণা একটি বাতিল আকীদাহ।
(৪) এ রাতে হায়াত, মউত ও রিয্ক বন্টনের বিষয় লেখা হয় বলে যে বিশ্বাস তা কুরআন ও হাদীসের বিরোধী। তাই তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
(৫) এ রাতকে কেন্দ্র করে যেমন সম্মিলিতভাবে ইবাদাত বন্দেগী করা, রাত্রি জাগরণ করা ঠিক নয় তেমনি ব্যক্তিগত ইবাদাত বন্দেগী করাও ঠিক হবে না। তবে নিয়ম বা রুটিন মাফিক ইবাদাত বন্দেগীর কথা আলাদা। যেমন কেহ সপ্তাহের দু দিন রাত্রি জাগরণ করে থাকে। ঘটনাচক্রে এ রাত সেদিনের মধ্যে পড়লে অসুবিধা নেই। কিন্তু এ রাতে ইবাদাত-বন্দেগী করলে অধিক সওয়াব হবে এমন ধারণায় ব্যক্তিগতভাবে বা চুপিসারে কিছু করাও ঠিক হবে না।
(৬) ১৫ শাবানের রাতই দ‘ুআ কবূলের রাত নয়। বরং প্রতি রাতের শেষ অংশ দু‘আ কবূলের সময়।
(৭) শুধু ১৫ শাবানের রাতেই আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন প্রথম আকাশে অবতরণ করেন না, বরং প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে তিনি প্রথম আকাশে অবতরণ করে বান্দাদেরকে তাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য প্রার্থনা করতে আহ্বান জানান।
(৮) শবে বরাতের ‘আমল সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসগুলো কোনটা জাল, আবার কোনটা যয়ীফ বা দুর্বলসূত্রের।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! একটি বিষয় আপনারা অবশ্যই খেয়াল করে থাকবেন যে, মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যত ফিরকা বন্দী, দলাদলি ও অনৈক্যের জন্ম হয়েছে উহার প্রায় সবগুলোই কিন্তু বিদ‘আত চালু করাকে কেন্দ্র করে হয়েছে।
একদল লোক কোন একটা বিদ‘আতী কাজের ‘আমল শুরু করে দিল, অন্য একদল আলেম তার প্রতিবাদ করলেন। ব্যাস শুরু হল ফিরকাবাজী; শেষ পর্যন্ত মারামারি খুনাখুনি। অতঃপর ঐ বিদ‘আত-পন্থীদের আক্রোশ আরো বেড়ে গেল। তারা এ কাজটাকে তাদের দলের শ্লোগানে পরিণত করল। এরপর তারা এ তরবারি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করে মুসলিম উম্মাহর সুদৃঢ় বন্ধনকে রক্তাক্ত করতে থাকল। মুসলিমগণ হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে পড়ল। কেন তারা আল্লাহ তা’আলার হুকুমের প্রতি একটু খেয়াল করে না যেখানে তিনি বলেছেন ঃ
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
(سورة النساء : ৫৯)
অর্থ ঃ কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ হলে তা উপস্থাপিত কর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট। এটাই উত্তম ও পরিণামে উৎকৃষ্টতর। (সূরা নিসা, ৫৯)
অতএব এ রাত উদযাপন করা থেকে মানুষদেরকে নিষেধ করতে হবে। যে কোন ধরনের বিদ‘আতী কাজ থেকে মানুষকে সাধ্যমত বিরত রাখা ‘আল-আমর বিল-মারূফ ওয়ান নাহয়ি আনিল মুনকার’ এর অন্তর্ভুক্ত।
আর এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা পালন করতে পারেন মুহতারাম উলামায়ে কিরাম, শ্রদ্ধেয় আইয়েম্মায়ে মাসাজিদ, দায়ী‘গণ ও ইসলামী আন্দোলনে শরীক ব্যক্তিবর্গ।
সমস্ত প্রশংসা উভয় জাহানের মালিক আল্লাহর। তাঁর রাহমাত বর্ষিত হোক তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর, তাঁর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের) পরিবারবর্গ এবং সাহাবীগণের (রাঃ) উপর। আমীন!!! ওয়া আখিরুদ দাওয়ানা আনিল হামদুলিল্লাহি রাব্বিল ‘আলামিন।
এ আহ্বান রেখে এবং মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে সকল ব্যাপারে সকল ঈমানদারদের জন্য সত্য-সঠিক পথের দিশা প্রার্থনা করে শেষ করছি।
----------------------------------------------------------------------------------
'' শুধু নিজে শিক্ষিত হলে হবেনা, প্রথমে বিবেকটাকে শিক্ষিত করুন। ''
১। লেখকের কৈফিয়ত
২। কতিপয় মূলনীতি
৩। ‘শবে বরাত’ এর অর্থ
৪। আল-কুরআনে শবে বরাতের কোন উল্লেখ নেই
৫। শবে বরাত নামটি হাদীসের কোথাও উল্লেখ হয়নি
৬। ফিকহের কিতাবে শবে বরাত
৭। শবে বরাত সম্পর্কিত প্রচলিত আকীদাহ-বিশ্বাস ও ‘আমল
৮। শবে বরাতের সম্পর্ক শুধু ‘আমলের সাথে নয়
৯। শাবানের মধ্যরজনীর ফযীলত সম্পর্কিত হাদীসসমূহের পর্যালোচনা
১০। শাবানের মধ্যরজনীর সম্পর্কিত হাদীসসমূহ পর্যালোচনার সারকথা
১১। ভাগ্য লিপিবদ্ধ করা সম্পর্কিত একটি হাদীস ও উহার পর্যালোচনা
১২। সৌভাগ্য রজনী ধর্ম বিকৃতির শামিল
১৩। শবে বরাত সম্পর্কে উলামায়ে কিরামের বক্তব্য
১৪। শবে বরাত সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহর অবস্থান
১৫। শবে বরাত সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করার দায়িত্ব উলামায়ে কিরামের
১৬। একটি বিভ্রান্তির নিরসন
১৭। বিদ‘আত সম্পর্কে কিছু কথা
১৮। বিদ‘আতের কুফল
১৯। সন্দেহজনক নফল ‘আমল থেকে দূরে থাকা উত্তম
২০। সর্বশেষ আহ্বান
লেখকের কৈফিয়ত
সকল প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার জন্য, যিনি পরিপূর্ণ দ্বীন হিসাবে আমাদেরকে ইসলাম দান করেছেন, যে দ্বীনে মানুষের পক্ষ থেকে কোন সংযোজন বা বিয়োজনের প্রয়োজন হয় না। সালাত ও সালাম তাঁরই রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি, যিনি আল্লাহর দ্বীনের রিসালাতের দায়িত্ব পূর্ণাঙ্গভাবে আদায় করেছেন, কোথাও কোন কার্পণ্য করেননি। দ্বীন হিসাবে যা কিছু এসেছে তিনি তা উম্মতের কাছে পৌছে দিয়েছেন ও নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করে গেছেন। তার সাহাবায়ে কিরামের প্রতি আল্লাহর রাহমাত বর্ষিত হোক, যারা ছিলেন উম্মতে মুহাম্মাদীর আদর্শ ও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ পালনে সকলের চেয়ে অগ্রগামী।
শবে বরাতের মত একটি বিষয় নিয়ে কিছু লেখার কি প্রয়োজন ছিল? আমি এর কৈফিয়ত স্বরূপ কিছু কথা না বলে পারছিনা।
(এক) গত ৪/১২/১৯৯৮ ইংরেজী তারিখে আমি গাজীপুরের একটি মাসজিদে জুমু‘আর খুতবাহ ও আলোচনায় শবে বরাত সম্পর্কে কিছু কথা বলেছিলাম। আলোচনা শেষে উপস্থিত মুসল্লীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। অনেকে বলেছেন ঃ “শবে বরাত সম্পর্কে এমন স্পষ্ট কথা আগে কোথাও শুনিনি।” আবার অনেকে “যতসব নুতন নুতন মাসালা” আখ্যায়িত করে আমার আলোচনাকে প্রত্যাখ্যান করলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন, লেখক ও গবেষক আবুল বাশার মুহাম্মাদ ইকবাল (রহঃ)। তিনি আমাকে বললেন ঃ আপনার এ বক্তব্যটি একটি প্রবন্ধ আকারে লিখে ফেলুন। তিনি আমাকে বার বার অনুরোধ করছিলেন, আর আমি লিখব লিখব বলে ওয়াদা করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু এর পরের বছর যখন ১৫ শাবান এলো তখন তিনি আবারো বললেন ঃ “আপনাকে এ বিষয়ে লেখার জন্য বলেছিলাম, আপনি কিন্তু এখনো লিখেননি। আগামী দশ দিনের মধ্যে লেখা জমা দিবেন। আমরা আমাদের মাসিক পত্রিকার শাবান সংখ্যায় আপনার শবে বরাত সম্পর্কিত লেখাটি প্রকাশ করতে চাই।” কিন্তু আমি তখনো তার অনুরোধ রক্ষা করতে পারিনি। তিনি প্রায়ই আক্ষেপ করে বলতেন ঃ “আপনি লিখলেন না!” কয়েক মাস পর তিনি ইন্তেকাল করেন। তার ইন্তেকালের পর থেকে আমি নিজেকে অপরাধী মনে করতে থাকি। তার জীবদ্দশায় তার একটি ইচ্ছা আমি পূরণ করতে পারিনি। এর প্রায়শ্চিত্ত করার অনুভূতি আমাকে তাড়া করতে থাকে।
(দুই) প্রতি বছর যখন ১৫ শাবান আসে তখন দেখি আলেম-উলামাগণ, ওয়াজীনে কিরাম, আইয়েম্মায়ে মাসাজিদ বিভিন্ন মাসজিদে, পত্র-পত্রিকায়, রেডিও
টিভিতে শবে বরাত সম্পর্কে লাগামহীন এবং মনগড়া আলোচনা করেন, যা শুনে একজন সাধারণ মানুষ ধারণা করে নেয় যে, শবে বরাত ইসলামের মূল পর্বগুলিার একটি। তাই তারা অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে তা পালন করেন। এ অবস্থা দেখে অত্যন্ত দুঃখ লাগে, ব্যথা পাই। সংকল্প করি দু একদিনের মধ্যেই এ বিষয়ে লিখতে হবে এবং লিখব। কিন্তু শবে বরাতের ডামাডোল যখন শেষ হয়ে যায় তখন সংকল্পে ভাটা পড়ে। মনে করি আবার এক বছর পর ১৫ শাবান আসবে, অনেক সময় হাতে আছে। আর এ রকম অলসতা করতে গিয়ে চলে গেছে ছয় ছয়টি বছর। আমার মনে হল অনেক দেরী হয়ে গেছে, আরও দেরী করা অন্যায় হবে।
(তিন) যখন ১৫ শাবান সমাগত হয় তখন সাধারণ মানুষ ও অনেক দা’য়ী ইলাল্লাহ, আলেম-উলামাগণ এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেন, জানতে চান। তাদের প্রশ্নের ভাষা এ রকম ঃ “অনেকে বলেন শবে বরাত বলতে কিছু নেই, এ সম্পর্কে কোন সহীহ হাদীস নেই। আবার অনেকে বলেন শবে বরাত, উহার ফাযীলাত ও ‘আমল রয়েছে, আছে তার বিশুদ্ধ প্রমাণ। আসলে বিষয়টির ব্যাপারে সঠিক অবস্থান কি হওয়া উচিত?” তাদের এ প্রশ্নের পূর্ণ জওয়াব দেয়া যেমন যরুরী তেমনি কঠিন। আর কিছু না বলে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এড়িয়ে গেলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। তাই এ ব্যাপারে আমি যে সিদ্ধান্তে পৌছেছি তা না লিখে কোন উপায় ছিল না।
এ বিষয়ে লিখতে গিয়ে আমি যে বড় ধরনের কোন গবেষণা করেছি তা কিন্তু দাবী করছি না। শবে বরাতের পক্ষে-বিপক্ষে লিখিত বিভিন্ন পুস্তিকাসহ অল্প কয়েকটি কিতাবের সাহায্য নিয়েছি মাত্র। এ বিষয়ে লেখার শুরুতে আমি একটি বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম যে, কোন শ্রেণীর লোকজনকে সম্বোধন করে লিখব। সাধারণ লোকদের না আলেম সমাজকে? অবশেষে উভয় প্রকারের লোকদের সম্বোধন করার চেষ্টা করেছি। এ কারণে যদি আমি বিষয়টিকে স্পষ্ট করে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হই তাহলে এটা আমার অযোগ্যতারই প্রমাণ।
(চার) বিদ‘আত সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঃ
শুরু থেকে আমি একজন কওমী মাদ্রাসার ছাত্র। কওমী মাদ্রাসায় পড়–য়া মানুষেরা ঐতিহ্যগতভাবেই অন্যের তুলনায় বিদ‘আত সম্পর্কে বেশী সচেতন হয়ে থাকে। আমি আমার আসাতিজায়ে কিরাম থেকে বিদ‘আত এর বিরুদ্ধে সচেতন হওয়ার ছবক লাভ করি। বিশেষ করে বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র আল-জামেয়াতুল আহলিয়্যা দারুল উলূম হাটহাজারী চট্রগ্রামে যখন ইংরেজী ১৯৯২ সনে দাওরায়ে হাদীস জামাতে পড়ছিলাম। তখন আমার মুহসিন ও মুখলিস উস্তাদগণের কাছ থেকে বিদ‘আত ও উহার মূল নীতি সম্পর্কে যথেষ্ট ইস্তেফাদা অর্জন করেছিলাম। তারা ছিলেন এ দেশে প্রচলিত র্শিক ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে সোচ্চার কন্ঠ। তবে তারা যে বিপদ আপদ দূর করার জন্য কিংবা বরকত লাভের উদ্দেশে কুরআন খতম ও খতমে বুখারীর অনুষ্ঠান করতেন, খতমে ইউনূস ও খতমে খাজেগান করতেন, তাবীজ-কবচ ব্যবহার করতে লোকজনকে উৎসাহ দিতেন, সেই কাজগুলো কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত কিনা এ প্রশ্ন আমার মনে থেকেই যেত। উস্তাতগণের সামনে এ সকল প্রশ্ন করাকে ‘না জানি বেয়াদবী হয়ে যায়’ এমন একটা অনুভূতির কারণে চূপ হয়ে যেতাম। আবার কখনো কোন উস্তাতগণের সাথে একটু ঘনিষ্ট হলেই সওয়াল করে বসতাম। অনেকে জবাব দেয়া থেকে এড়িয়ে যেতেন। আবার অনেকে সাধ্যমত জবাব দিতেন। কিন্তু তাতে পরিতৃপ্ত হওয়া যেত না। আর এভাবে দাওরায়ে হাদীস শেষ করলাম।
এরপর আমি বিভিন্ন আরব দেশ থেকে আগত একাধিক উস্তাদদের কাছে পড়াশুনা করার সুযোগ পেলাম। সত্যিই তাদের থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা আমার বিদ‘আত বিরোধী চেতনাকে পরিশুদ্ধ করেছে। আমি অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম। অনেক সংশয়ের অবসান হল। এ সকল মুহসিন আসাতিজার সকলের নাম আমার দুর্বল স্মরণশক্তি ধরে রাখতে পারেনি। কিন্তু তাতে কি! আমি তাদের নাম হাজার বার ভুলে গেলেও ঔ সকল মুহসিন বান্দাদের আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন প্রাপ্য পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করবেন না।
إن الله لا يضيع أجر المحسنين.
আমরা তাদের অবদানের যথার্থ মূল্যায়ন করতে না পারলেও যাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তারা সুদূর আরব থেকে এদেশে বার বার এসে দাওয়াত, তালীমসহ বহু জনকল্যাণমূলক কাজ করেছেন, তিনি তাদের কাজের যথার্থ মূল্যায়ন করবেন। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী অবদান যে ব্যক্তির, তিনি হলেন ই্িঞ্জনিয়ার মুহাম্মাদ মুজীবুর রহমান, যিনি এ দেশের হাজার হাজার আলেমে-দ্বীন, ইমাম ও দা’য়ীদের অভিভাবক। আল্লাহর এ মুহসিন বান্দার মাধ্যমে শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপকৃত হয়েছেন এ দেশের লাখ লাখ মানুষ। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে নির্মিত ও আবাদ হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে শত শত মাসজিদ ও ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সর্বদা প্রচারবিমুখ আল্লাহর এ মুহসিন বান্দা হয়ত এ মহান খিদমাতের স্বীকৃতি স্বরূপ কোন দিন কোন প্রতিষ্ঠান থেকে পদক পাবেন না। কিন্তু যাঁর জন্য সকল নেক ‘আমল নিবেদন করা হয় সেই মহান সত্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার প্রতিদান দিতে কোন কৃপণতা করবেন না। হৃদয় নিংড়ানো এ প্রার্থনা শুধু আমার একার নয়, আমরা যারা তার থেকে দ্বীনী শিক্ষা প্রসার ও দাওয়াতের চেতনায় সমৃদ্ধ হয়েছি, দিক-নির্দেশনা ও উৎসাহ পেয়েছি তাদের সকলের, আল্লাহর এ বিশাল দুনিয়ার যেখানেই আমরা থাকি না কেন।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদা তাঁর উম্মতকে বিদ’আত সম্পর্কে সতর্ক করতেন। তিনি প্রায় সকল খুতবায় বলতেন ঃ
أما بعد فإن خير الحديث كتاب الله وخير الهدي هدي محمد صلى الله عليه وسلم وشر الأمور محدثاتها وكل بدعة ضلالة.(رواه مسلم عن جابر بن عبد الله)
অর্থ ঃ শুনে রেখ! সর্বোত্তম কথা হল আল্লাহর কিতাব, সর্বোত্তম পথ-নির্দেশ হল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের পথ-নির্দেশ, আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হল দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্ট বিষয় এবং সকল বিদ’আতই পথ-ভ্রষ্টতা। (মুসলিম)
বিদায় হজ্জেও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদ’আতে লিপ্তদের পরিণাম সম্পর্কে ভাষণ দিয়েছেন।
আমি মনে করি আল্লাহর ফযলে যদি আমার এ পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয় তাহলে অনেক সম্মানিত আলেমে দ্বীন ভাইয়েরা এর প্রতিবাদ করবেন। এ বিষয়টা খন্ডন করে আবার কিতাব লিখবেন, সমালোচনা করবেন। করবেন না কেন? অবশ্যই করবেন। কিন্তু তাদের কাছে আমি সবিনয় আবেদন করব, তারা যেন তাদের এ সকল কাজ একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে করেন। তা হল বিদ’আতকে উৎপাটন ও সুন্নাহ কায়েম করা। বর্তমানে এ দুর্যোগময় ও বিপদ সংকুল সময়ে ইসলামের দিকে দাওয়াতে যারা নিবেদিত প্রাণ তাদের থেকে বিদ’আত প্রসারে সহায়তা করে এ রকম বিষয় প্রকাশ হওয়া মুসলিম উম্মাহর জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
আমাদের দেশে বা দেশের বাইরে যারা বিভিন্ন বিদ’আতী কাজ-কর্মে লিপ্ত তারা নিজেদের কাজের সমর্থনে কিন্তু জবরদস্ত দলীলাদি উপস্থাপন করে। কিন্তু এ সব দলীলা কি গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ? না, সেগুলো মোটেই বিশুদ্ধতার মানদন্ডে মাকবুল নয়। দলীল থাকলেই তা গ্রহণ করে ‘আমল করা যায় না। ‘আমল করার জন্য তা একশ ভাগ বিশুদ্ধ হতে হবে।
সর্বশেষে যাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে পারছিনা তারা হলেন বিশিষ্ট আলেমে-দ্বীন, ফাজেলে দারুল উলূম দেওবন্দ যাকারিয়া বিন খাজা আহমাদ। যিনি বইটি দু’ দু’ বার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পাদনা করেছেন। একটি অধ্যায় সংযোজন করেছেন।
আরো যারা সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন তারা হলেন সহকর্মী ইকবাল হোসাইন মাসূম, আবুল কালাম আযাদ, জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের ও নুমান আবুল বাশার সাহেব। তারা সকলে যথেষ্ট যোগ্য আলেম। বয়সে নবীন হলেও ইল্ম ও প্রজ্ঞায় নবীনতার ছাপ নেই।
এ ছাড়া বইটি নির্ভুল করার জন্য সময়, শ্রম ও মেধার কুরবানী দিয়েছেন মাদ্রাসা মুহাম্মাদিয়ার মুহতারম উস্তাদ হাফেয রফিকুল ইসলাম ও মাদ্রাসা দারুস সুন্নাহর পরিচালক শহীদুল্লাহ খাঁন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁদের সকলের এ খিদমাতকে علم ينتفع به হিসাবে কবুল করুন। আমীন!
আব্দুল্লাহ শহীদ
২৯-০৬-১৪২৬ হিজরী
কতিপয় মূলনীতি
মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে কতিপয় মূলনীতি উল্লেখ করছি যা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমার বিশ্বাস।
(এক) যদি কোন একটা প্রথা যুগ যুগ ধরে কোন অঞ্চলের মুসলিম সমাজে চলে আসে, তাহলে তা শরীয়ত সম্মত হওয়ার প্রমাণ বহন করেনা। এটা বলা ঠিক হবে না যে, শত শত বছর ধরে যা পালন করে আসছি তা না জায়েয হয় কিভাবে? বরং তা শরীয়ত সম্মত হওয়ার জন্য অবশ্যই শর’য়ী দলীল থাকতে হবে।
(দুই) ইসলামের যাবতীয় বিষয়াবলী দু’ প্রকার (ক) আকীদাহ বা বিশ্বাস (খ) ‘আমল বা কাজ। কোন ‘আমল বা কাজ ইসলামের শরীয়ত সম্মত হওয়ার জন্য অবশ্যই কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াস এই চারটির যে কোন একটি দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে। কিন্তু আকীদাগত কোন বিষয় অবশ্যই কুরআন অথবা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে। ইজমা অথবা কিয়াস দ্বারা আকীদাহর কোন বিষয় প্রমাণ করা যাবে না।
(তিন) যে সকল হাদীস কিতাব আকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লিখিত সবগুলো হাদীস বিশুদ্ধ বা সহীহ নয়। হাদীস বিশারদগণ যুগ যুগ ধরে গবেষণা করে নির্ধারণ করেছেন কোনটি সহীহ, কোনটি যয়ীফ (দুর্বল সূত্র), কোনটি মওজু (জাল বা বানোয়াট)। তাই সব ধরনের হাদীস মোতাবেক ‘আমল করা ঠিক নয়। হাদীসসমূহ থেকে শুধু সহীহগুলি ‘আমলে নেয়া হবে। যদি সব ধরনের হাদীস ‘আমলে নেয়া হয় তাহলে শত শত বছর ধরে এ বিষয় গবেষণা ও তা চর্চার সার্থকতা কি?
(চার) দুর্বল বা জাল হাদীসের উপর ভিত্তি করে ইসলামী শরীয়তে কোন আকীদাহ ও ‘আমল চালু করা যায় না। তবে কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত কোন ‘আমলের ফাযীলাতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করা যায়।
(পাঁচ) কোন স্থান বা সময়ের ফযীলাত কুরআন বা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলে তা দ্বারা সে স্থানে বা সে সময়ে ‘আমল (ইবাদাত-বন্দেগী) করার ফযীলাত প্রমাণিত হয়না। যদি ‘আমল করার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র শরয়ী দলীল থাকে তাহলেই ‘আমল করা যায়।
‘শবে বরাত’ এর অর্থ
‘শব’ একটি ফারসী শব্দ এর অর্থ রাত। ‘বারায়াত'কে যদি আরবী শব্দ ধরা হয় তাহলে এর অর্থ হচ্ছে সম্পর্কচ্ছেদ, পরোক্ষ অর্থে মুক্তি। যেমন কুরআন মাজীদে সূরা বারায়াত রয়েছে যা সূরা তাওবা নামেও পরিচিত। ইরশাদ হয়েছে ঃ
بَرَاءَةٌ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ (التوبة: ১)
অর্থ ঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা। (সূরা তাওবা, ১)
এখানে বারায়াতের অর্থ হল সম্পর্ক ছিন্ন করা। ‘বারায়াত’ মুক্তি অর্থেও আল-কুরআনে এসেছে যেমন ঃ
أَكُفَّارُكُمْ خَيْرٌ مِنْ أُولَئِكُمْ أَمْ لَكُمْ بَرَاءَةٌ فِي الزُّبُرِ . (سورة القمر :৪৩)
অর্থ ঃ তোমাদের মধ্যকার কাফিররা কি তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ? না কি তোমাদের মুক্তির সনদ রয়েছে কিতাবসমূহে? (সূরা কামার, ৩৪)
আর ‘বারায়াত’ শব্দক যদি ফারসী শব্দ ধরা হয় তাহলে উহার অর্থ হবে সৌভাগ্য। অতএব শবে বরাত শব্দটার অর্থ দাড়ায় মুক্তির রজনী, সম্পর্ক ছিন্ন করার রজনী। অথবা সৌভাগ্যের রাত, যদি ‘বরাত’ শব্দটিকে ফার্সী শব্দ ধরা হয়।
শবে বরাত শব্দটাকে যদি আরবীতে তর্জমা করতে চান তাহলে বলতে হবে ‘লাইলাতুল বারায়াত’। এখানে বলে রাখা ভাল যে এমন অনেক শব্দ আছে যার রূপ বা উচ্চারণ আরবী ও ফারসী ভাষায় একই রকম, কিন্তু অর্থ ভিন্ন।
যেমন ‘গোলাম’ শব্দটি আরবী ও ফারসী উভয় ভাষায় একই রকম লেখা হয় এবং একইভাবে উচ্চারণ করা হয়। কিন্তু আরবীতে এর অর্থ হল কিশোর আর ফারসীতে এর অর্থ হল দাস।
সার কথা হল ‘বারায়াত’ শব্দটিকে আরবী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সম্পর্কচ্ছেদ বা মুক্তি। আর ফারসী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সৌভাগ্য।
আল-কুরআনে শবে বরাতের কোন উল্লেখ নেই
শবে বরাত বলুন আর লাইলাতুল বারায়াত বলুন কোন আকৃতিতে শব্দটি কুরআন মাজীদে খুজে পাবেন না। সত্য কথাটাকে সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায় পবিত্র কুরআন মাজীদে শবে বরাতের কোন আলোচনা নেই। সরাসরি তো দূরের কথা আকার ইংগিতেও নেই।
অনেককে দেখা যায় শবে বরাতের গুরুত্ব আলোচনা করতে যেয়ে সূরা দুখানের প্রথম চারটি আয়াত পাঠ করেন। আয়াতসমূহ হল ঃ
حم ﴿১﴾ وَالْكِتَابِ الْمُبِينِ ﴿২﴾ إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ ﴿৩﴾ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ ﴿৪﴾ (الدخان: ১-৪)
অর্থ ঃ হা-মীম। শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। আমিতো এটা অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে। আমি তো সতর্ককারী। এই রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়। (সূরা দুখান, ১-৪)
শবে বরাত পন্থী আলেম উলামারা এখানে বরকতময় রাত বলতে ১৫ শাবানের রাতকে বুঝিয়ে থাকেন। আমি এখানে স্পষ্টভাবেই বলব যে, যারা এখানে বরকতময় রাতের অর্থ ১৫ শাবানের রাতকে বুঝিয়ে থাকেন তারা এমন বড় ভুল করেন যা আল্লাহর কালাম বিকৃত করার মত অপরাধ। কারণ ঃ
(এক) কুরআন মাজীদের এ আয়াতের তাফসীর বা ব্যাখ্যা সূরা আল-কদর দ্বারা করা হয়। সেই সূরায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন ঃ
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ ﴿১﴾ وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ ﴿২﴾ لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ ﴿৩﴾ تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ ﴿৪﴾ سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ ﴿৫﴾
অর্থ ঃ আমি এই কুরআন নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আপনি জানেন লাইলাতুল কদর কি? লাইলাতুল কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্য মালাইকা (ফেরেশ্তাগণ) ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশে। এই শান্তি ও নিরাপত্তা ফজর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। (সূরা কাদর, ১-৫)
অতএব বরকতময় রাত হল লাইলাতুল কদর। লাইলাতুল বারায়াত নয়। সূরা দুখানের প্রথম সাত আয়াতের ব্যাখ্যা হল এই সূরা আল-কদর। আর এ ধরনের ব্যাখ্যা অর্থাৎ আল-কুরআনের এক আয়াতের ব্যাখ্যা অন্য আয়াত দ্বারা করা হল সর্বোত্তম ব্যাখ্যা।
(দুই) সূরা দুখানের লাইলাতুল মুবারাকার অর্থ যদি শবে বরাত হয় তাহলে এ আয়াতের অর্থ দাড়ায় আল কুরআন শাবান মাসের শবে বরাতে নাযিল হয়েছে। অথচ আমরা সকলে জানি আল-কুরআন নাযিল হয়েছে রামাযান মাসের লাইলাতুল কদরে।
যেমন সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন ঃ
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآَنُ.
অর্থ ঃ রামাযান মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে আল-কুরআন।
(তিন) অধিকাংশ মুফাচ্ছিরে কিরামের মত হল উক্ত আয়াতে বরকতময় রাত বলতে লাইলাতুল কদরকেই বুঝানো হয়েছে। শুধু মাত্র তাবেয়ী ইকরামা রহ. এর একটা মত উল্লেখ করে বলা হয় যে, তিনি বলেছেন বরকতময় রাত বলতে শাবান মাসের পনের তারিখের রাতকেও বুঝানো যেতে পারে।
তিনি যদি এটা বলে থাকেন তাহলে এটা তার ব্যক্তিগত অভিমত। যা কুরআন ও হাদীসের বিরোধী হওয়ার কারণে পরিত্যাজ্য। এ বরকতময় রাতের দ্বারা উদ্দেশ্য যদি শবে বরাত হয় তাহলে শবে কদর অর্থ নেয়া চলবেনা।
(চার) উক্ত আয়াতে বরকতময় রাতের ব্যাখ্যা শবে বরাত করা হল তাফসীর বির-রায় (মনগড়া ব্যাখ্যা), আর বরকতময় রাতের ব্যাখ্যা লাইলাতুল কদর দ্বারা করা হল কুরআন ও হাদীস সম্মত তাফসীর। সকলেই জানেন কুরআন ও হাদীস সম্মত ব্যাখ্যার উপস্থিতিতে মনগড়া ব্যাখ্যা (তাফসীর বির-রায়) গ্রহণ করার কোন সুযোগ নেই।
(পাচ) সূরা দুখানের ৪ নং আয়াত ও সূরা কদরের ৪ নং আয়াত মিলিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বরকতময় রাত বলতে লাইলাতুল কদরকেই বুঝানো হয়েছে। সাহাবী ইবনে আব্বাস (রাঃ), ইবনে কাসীর, কুরতুবী প্রমুখ মুফাচ্ছিরে কিরাম এ কথাই জোর দিয়ে বলেছেন এবং সূরা দুখানের ‘লাইলাতুম মুবারাকা’র অর্থ শবে বরাত নেয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। (তাফসীরে মায়ারেফুল কুরআন দ্রষ্টব্য)
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) তাঁর তাফসীরে বলেছেন ঃ “কোন কোন আলেমের মতে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল মধ্য শাবানের রাত (শবে বরাত)। কিন্তু এটা একটা বাতিল ধারণা।”
অতএব এ আয়াতে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ এর অর্থ লাইলাতুল কদর। শাবান মাসের পনের তারিখের রাত নয়।
(ছয়) ইকরামা (রঃ) বরকতময় রজনীর যে ব্যাখ্যা শাবানের ১৫ তারিখ দ্বারা করেছেন তা ভুল হওয়া সত্ত্বেও প্রচার করতে হবে এমন কোন নিয়ম-কানুন নেই। বরং তা প্রত্যাখ্যান করাই হল হকের দাবী। তিনি যেমন ভুলের উর্ধ্বে নন, তেমনি যারা তার থেকে বর্ণনা করেছেন তারা ভুল শুনে থাকতে পারেন অথবা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বানোয়াট বর্ণনা দেয়াও অসম্ভব নয়।
(সাত) শবে বরাতের গুরুত্ব বর্ণনায় সূরা দুখানের উক্ত আয়াত উল্লেখ করার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এ আকীদাহ বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, শবে বরাতে সৃষ্টিকূলের হায়াত-মাউত, রিয্ক-দৌলত সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ও লিপিবদ্ধ করা হয়। আর শবে বরাত উদযাপনকারীদের শতকরা নিরানব্বই জনের বেশী এ ধারণাই পোষণ করেন। তারা এর উপর ভিত্তি করে লাইলাতুল কদরের চেয়ে ১৫ শাবানের রাতকে বেশী গুরুত্ব দেয়। অথচ কুরআন ও হাদীসের আলোকে এ বিষয়গুলি লাইলাতুল কদরের সাথে সম্পর্কিত। তাই যারা শবে বরাতের গুরুত্ব বুঝাতে উক্ত আয়াত উপস্থাপন করেন তারা মানুষকে সঠিক ইসলামী আকীদাহ থেকে দূরে সরানোর কাজে লিপ্ত, যদিও মনে-প্রাণে তারা তা ইচ্ছা করেন না।
(আট) ইমাম আবু বকর আল জাসসাস তার আল-জামে লি আহকামিল কুরআন তাফসীর গ্রন্থে লাইলালাতুন মুবারাকা দ্বারা মধ্য শাবানের রাত উদ্দেশ্য করা ঠিক নয় বলে বিস্তারিত আলোচনা করার পর বলেন : লাইলাতুল কদরের চারটি নাম রয়েছে, তা হল : লাইলাতুল কদর, লাইলাতু মুবারাকাহ, লাইলাতুল বারাআত ও লাইলাতুস সিক।
(আল জামে লি আহকামিল কুরআন, সূরা আদ-দুখানের তাফসীর দ্রষ্টব্য)
লাইলাতুল বারাআত হল লাইলাতুল কদরের একটি নাম। শাবান মাসের পনের তারিখের রাতের নাম নয়
ইমাম শাওকানী (রহ.) তার তাফসীর ফতহুল কাদীরে একই কথাই লিখেছেন।
(তাফসীর ফাতহুল কাদীর : ইমাম শাওকানী দ্রষ্টব্য)
এ সকল বিষয় জেনে বুঝেও যারা ‘লাইলাতুম মুবারাকা’র অর্থ করবেন শবে বরাত, তারা সাধারণ মানুষদের গোমরাহ করা এবং আল্লাহর কালামের অপব্যাখ্যা করার দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না।
শবে বরাত নামটি হাদীসের কোথাও উল্লেখ হয়নি
প্রশ্ন থেকে যায় হাদীসে কি লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাত নেই? সত্যিই হাদীসের কোথাও আপনি শবে বরাত বা লাইলাতুল বারায়াত নামের কোন রাতের নাম খ্ুেজ পাবেন না। যে সকল হাদীসে এ রাতের কথা বলা হয়েছে তার ভাষা হল ‘লাইলাতুন নিস্ফ মিন শাবান’ অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত্রি। শবে বরাত বা লাইলাতুল বারায়াত শব্দ আল-কুরআনে নেই, হাদীসে রাসূলেও নেই। এটা মানুষের বানানো একটা শব্দ। ভাবলে অবাক লাগে যে, একটি প্রথা ইসলামের নামে শত শত বছর ধরে পালন করা হচ্ছে অথচ এর আলোচনা আল-কুরআনে নেই। সহীহ হাদীসেও নেই। অথচ আপনি দেখতে পাবেন যে, সামান্য নফল ‘আমলের ব্যাপারেও হাদীসের কিতাবে এক একটি অধ্যায় বা শিরোনাম লেখা হয়েছে।
ফিকহের কিতাবে শবে বরাত
শুধু আল-কুরআনে কিংবা সহীহ হাদীসে নেই, বরং আপনি ফিক্হের নির্ভরযোগ্য কিতাবগুলো পড়ে দেখুন, কোথাও শবে বরাত নামের কিছু পাবেন না। বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে দ্বীনি মাদ্রাসাগুলিতে ফিক্হের যে সিলেবাস রয়েছে যেমন মালাবুদ্দা মিনহু, নুরুল ইজাহ, কদুরী, কানযুদ্ দাকায়েক, শরহে বিকায়া ও হিদায়াহ খুলে দেখুন না! কোথাও শবে বরাত নামের কিছু পাওয়া যায় কিনা! অথচ আমাদের পূর্বসূরী ফিকাহবিদগণ ইসলামের অতি সামান্য বিষয়গুলো আলোচনা করতেও কোন ধরনের কার্পণ্যতা দেখাননি। তারা সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণের সালাত সম্পর্কেও অধ্যায় রচনা করেছেন। অনুচ্ছেদ তৈরী করেছেন কবর যিয়ারতের মত বিষয়েরও। শবে বরাতের ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহর সামান্যতম ইশারা থাকলেও ফিকাহবিদগণ এর আলোচনা মাসয়ালা-মাসায়েল অবশ্যই বর্ণনা করতেন।
অতএব এ রাতকে শবে বরাত বা লাইলাতুল বারায়াত অভিহিত করা মানুষের মনগড়া বানানো একটি বিদ‘আত যা কুরআন বা হাদীস দ্বারা সমর্থিত নয়।
শবে বরাত সম্পর্কিত প্রচলিত আকীদাহ বিশ্বাস ও ‘আমল
শবে বরাত যারা পালন করেন তারা শবে বরাত সম্পর্কে যে সকল ধারণা পোষণ করেন ও উহাকে উপলক্ষ করে যে সকল কাজ করে থাকেন তার কিছু নিুে উল্লেখ করা হল।
তারা বিশ্বাস করে যে, শবে বরাতে আল্লাহ তা‘আলা সকল প্রাণীর এক বছরের খাওয়া দাওয়া বরাদ্দ করে থাকেন। এই বছর যারা মারা যাবে ও যারা জন্ম নিবে তাদের তালিকা তৈরী করা হয়। এ রাতে বান্দার পাপ ক্ষমা করা হয়। এ রাতে ইবাদাত-বন্দেগী করলে সৌভাগ্য অর্জিত হয়। এ রাতে কুরআন মাজীদ লাওহে মাহফুজ হতে প্রথম আকাশে নাযিল করা হয়েছে। এ রাতে গোসল করাকে সওয়াবের কাজ মনে করা হয়। মৃত ব্যক্তিদের রূহ এ রাতে দুনিয়ায় তাদের সাবেক গৃহে আসে। এ রাতে হালুয়া রুটি তৈরী করে নিজেরা খায় ও অন্যকে দেয়া হয়। বাড়ীতে বাড়ীতে মীলাদ পড়া হয়। আতশবাযী করা হয়। সরকারী- বেসরকারী ভবনে আলোক সজ্জা করা হয়। সরকারী ছুটি পালিত হয়। পরের দিন সিয়াম (রোযা) পালন করা হয় । কবরস্থানগুলো আগরবাতি ও মোমবাতি দিয়ে সজ্জিত করা হয়। লোকজন দলে দলে কবরস্থানে যায়। মাগরিবের পর থেকে মাসজিদগুলি লোকে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। যারা পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে ও জুমু‘আয় মাসজিদে আসেনা তারাও এ রাতে মাসজিদে আসে। মাসজিদগুলিতে মাইক চালু করে ওয়াজ নাসীহাত করা হয়। শেষ রাতে সমবেত হয়ে দু‘আ-মুনাজাত করা হয়। বহু লোক এ রাতে ঘুমানোকে অন্যায় মনে করে থাকে। নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে একশত রাকাত, হাজার রাকাত ইত্যাদি সালাত আদায় করা হয়।
লোকজন ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞেস করে ‘হুজুর! শবে বরাতের সালাতের নিয়ম ও নিয়্যতটা একটু বলে দিন।’ ইমাম সাহেব আরবী ও বাংলায় নিয়্যাত বলে দেন। কিভাবে সালাত আদায় করবে, কোন্ রাকা‘আতে কোন্ সূরা তিলাওয়াত করবে তাও বলে দিতে কৃপণতা করেননা।
যদি এ রাতে ইমাম সাহেব বা মুয়াজ্জিন সাহেব মাসজিদে অনুপস্থিত থাকেন তাহলে তাদের চাকুরী যাওয়ার উপক্রম হয়।
শবে বরাতের সম্পর্ক শুধু ‘আমলের সাথে নয়
শবে বরাত সম্পর্কে উপরোল্লিখিত কাজ ও আকীদাহসমূহ শবে বরাত উদযাপনকারীরা সকলেই করেন তা কিন্তু নয়। কেহ আছেন উল্লিখিত সকল কাজের সাথে একমত পোষণ করেন। আবার কেহ আতশবাযী, আলোক সজ্জা পছন্দ করেন না, কিন্তু কবরস্থানে যাওয়া, হালুয়া-রুটি, ইবাদাত-বন্দেগী করে থাকেন। আবার অনেক আছেন যারা এ রাতে শুধু সালাত আদায় করেন ও পরের দিন সিয়াম (রোযা) পালন করেন। এ ছাড়া অন্য কোন ‘আমল করেন না। আবার অঞ্চল ভেদে ‘আমলের পার্থক্য দেখা যায়।
কিন্তু একটি বিষয় হল, শবে বরাত সম্পর্কে যে সকল ধর্ম বিশ্বাস বা আকীদাহ পোষণ করা হয় তা কিন্তু কোন দুর্বল হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত হয় না। যেমন ভাগ্যলিপি ও বাজেট প্রনয়নের বিষয়টি। যারা বলেন ঃ ‘‘আমলের ফাযীলাতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করা যায়, অতএব এর উপর ভিত্তি করে শবে বরাতে ‘আমল করা যায়, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন ঃ তাহলে শবে বরাতের আকীদাহ সম্পর্কে কি দুর্বল হাদীসেরও দরকার নেই?
অথবা এ সকল প্রচলিত আকীদাহর ক্ষেত্রে যদি কোন দুর্বল হাদীস পাওয়াও যায় তাহলে তা দিয়ে কি আকীদাহগত কোন মাসয়ালা প্রমাণ করা যায়? আপনারা শবে বরাতের ‘আমলের পক্ষ সমর্থন করলেন কিন্তু আকীদাহর ব্যাপারে কি জবাব দিবেন?
কাজেই শবে বরাত শুধু ‘আমলের বিষয় নয়, আকীদাহরও বিষয়। তাই এ ব্যাপারে ইসলামের দা’য়ীদের সতর্ক হওয়ার দাওয়াত দিচ্ছি।
শবে বরাত সম্পর্কে এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহ তা‘আলা এ রাতে আল-কুরআন অবতীর্ণ করেছেন, তিনি এ রাতে মানুষের হায়াত, রিয্ক ও ভাগ্যের ফায়সালা করে থাকেন, এ রাতে ইবাদাত-বন্দেগীতে লিপ্ত হলে আল্লাহ হায়াত ও রিয্ক বাড়িয়ে সৌভাগ্যশালী করেন ইত্যাদি আকীদা কি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি মিথ্যা আরোপ করার মত অন্যায় নয়?
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন ঃ
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ. (الصف : ৭)
অর্থ ঃ তার চেয়ে বড় যালিম আর কে যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে? (সূরা সাফ, ৭)
শাবানের মধ্যরজনীর ফযীলত সম্পর্কিত হাদীসসমূহের পর্যালোচনা
১ নং হাদীস
১-حدثنا أحمد بن منيع أخبرنا يزيد بن هارون أخبرنا الحجاج بن أرطاة عن يحيى بن أبي كثير عن عروة عن عائشة رضى الله عنها قالت : فقدت رسول الله صلى الله عليه وسلم ليلة فخرجت فإذا هو بالبقيع فقال أكنت تخافين أن يحيف الله عليك ورسوله؟ قلت يا رسول الله ظننت أنك أتيت بعض نسائك.
فقال إن الله تبارك وتعالى ينزل ليلة النصف من شعبان إلى سماء الدنيا فيغفر لأكثر من عدد شعر غنم كلب.
قال أبو عيسى: حديث عائشة لا نعرفه إلا من هذا الوجه من حديث الحجاج، وسمعت محمدا يقول يضعف هذا الحديث، وقال: يحيى بن كثير لم يسمع من عروة، قال محمد والحجاج لم يسمع من يحيى بن كثير، انتهى كلامه، فهذا السند منقطع بوجهين.
ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেন ঃ আমাদের কাছে আহমাদ ইবনে মুনী’ হাদীস বর্ণনা করেছেন যে তিনি ইয়াযীদ ইবনে হারূন থেকে, তিনি হাজ্জাজ ইবনে আরতাহ থেকে, তিনি ইয়াহইয়া ইবনে আবি কাসির থেকে, তিনি উরওয়াহ থেকে, তিনি উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেছেন ঃ আমি এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিছানায় পেলাম না তাই আমি তাকে খুঁজতে বের হলাম, ‘বাকী’ নামক কবরস্থানে তাকে পেলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন ঃ তুমি কি আশংকা করেছো যে আল্লাহ ও তার রাসূল তোমার সাথে অন্যায় আচরণ করবেন?
আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি মনে করেছি আপনি আপনার অন্য কোন স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন, অতঃপর কালব গোত্রের পালিত বকরীর পশমের পরিমানের চেয়েও অধিক পরিমান লোকদের ক্ষমা করেন।
ইমাম তিরমিযী বলেন ঃ আয়িশা (রাঃ) এর এই হাদীস আমি হাজ্জাজের বর্ণিত সনদ (সূত্র) ছাড়া অন্য কোনভাবে চিনি না। আমি মুহাম্মাদকে (ইমাম বুখারী) বলতে শুনেছি যে, তিনি হাদীসটিকে দুর্বল বলতেন। তিরমিযী (রহঃ) বলেন ঃ ইয়াহ্ইয়া ইবনে কাসীর উরওয়াহ থেকে হাদীস শুনেননি। এবং মুহাম্মদ (ইমাম বুখারী) বলেছেন ঃ হাজ্জাজ ইয়াহ্ইয়াহ ইবনে কাসীর থেকে শুনেননি।
এ হাদীসটি সম্পর্কে ইমাম বুখারী ও ইমাম তিরমিযীর মন্তব্যে প্রমাণিত হয় যে, হাদীসটি দুটো দিক থেকে মুনকাতি অর্থাৎ উহার সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন।
অপর দিকে এ হাদীসের একজন বর্ণনাকারী হাজ্জাজ ইবনে আরতাহ মুহাদ্দিসীনদের নিকট দুর্বল বলে পরিচিত।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! যারা শবে বরাতের বেশী বেশী ফাযীলাত বয়ান করতে অভ্যস্ত তারা তিরমিযী বর্ণিত এ হাদীসটি খুব গুরুত্বের সাথে উপস্থাপন করেন অথচ যারা হাদীসটির অবস্থা সম্পর্কে ভাল জানেন তাদের এ মন্তব্যটুকু গ্রহণ করতে চাননা। এ হাদীসটি ‘আমলের ক্ষেত্রে পরিত্যাজ্য হওয়ার জন্য ইমাম তিরমিযীর এ মন্তব্যটুকু কি যথেষ্ট নয়? যদি তর্কের খাতিরে এ হাদীসটিকে বিশুদ্ধ বলে ধরে নেয়া হয় তাহলে কি প্রমাণিত হয়? আমরা যারা ঢাকঢোল পিটিয়ে মাসজিদে একত্র হয়ে যেভাবে শবে বরাত উদযাপন করি তাদের ‘আমলের সাথে এ হাদীসটির মিল কোথায়?
বরং এ হাদীসে দেখা গেল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিছানা ছেড়ে চলে গেলেন, আর পাশে শায়িত আয়িশা (রাঃ) কে ডাকলেন না। ডাকলেন না অন্য কাউকে। তাকে জাগালেন না বা সালাত আদায় করতে বললেন না। অথচ আমরা দেখতে পাই যে, রামাযানের শেষ দশকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রাত জেগে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন এবং পরিবারের সকলকে জাগিয়ে দিতেন। বেশী পরিমাণে ইবাদাত-বন্দেগী করতে বলতেন। যদি ১৫ শাবানের রাতে কোন ইবাদাত করার ফাযীলাত থাকত তাহলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন আয়িশাকে (রাঃ) বললেন না? কেন রামাযানের শেষ দশকের মত সকলকে জাগিয়ে দিলেন না, তিনি তো নেক কাজের প্রতি মানুষকে আহ্বান করার ক্ষেত্রে আমাদের সকলের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি তো কোন অলসতা বা কৃপণতা করেননি।
২ নং হাদীস
২-عن العلاء بن الحارث أن عائشة رضي الله عنها قالت : قام رسول الله صلى الله عليه وسلم من الليل يصلي، فأطال السجود، حتى ظننت أنه قد قبض، فلما رأيت ذلك قمت حتى حركت إبهامه فتحرك فرجعت فلما رفع رأسه من السجود وفرغ من صلاته قال: يا عائشة أو يا حميراء أظننت أن النبي قد خان بك؟ قلت لا والله يا رسول الله، لكني ظننت أنك قبضت لطول سجودك، فقال أتدرين أي ليلة هذه؟ قلت: الله ورسوله أعلم. قال: هذه ليلة النصف من شعبان
إن الله عز وجل يطلع على عباده في ليلة النصف من شعبان فيغفر للمستغفرين ويرحم المسترحمين ويؤخر أهل الحقد كما هو. (رواه البيهقي في شعب الإيمان، وهذا حديث مرسل لأن علاء ما سمع عن عائشة)
অর্থ ঃ আলা ইবনে হারিস থেকে বর্ণিত, আয়িশা (রাঃ) বলেন ঃ এক রাতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিলেন। সিজদাহ এত দীর্ঘ করলেন যে, আমি ধারণা করলাম তিনি ইন্তেকাল করেছেন। আমি এ অবস্থা দেখে দাড়িয়ে তার বৃদ্ধাঙ্গুল ধরে নাড়া দিলাম, আঙ্গুলটি নড়ে উঠল। আমি চলে এলাম। সালাত শেষ করে তিনি বললেন ঃ হে আয়িশা অথবা বললেন হে হুমায়রা! তুুমি কি মনে করেছ আল্লাহর নবী তোমার সাথে বিশ্বাস ভংগ করেছেন? আমি বললাম ঃ আল্লাহর কসম হে রাসূল! আমি এমন ধারণা করিনি। বরং আমি ধারণা করেছি আপনি না জানি ইন্তেকাল করলেন! অতঃপর তিনি বললেন ঃ তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম ঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভাল জানেন। তিনি বললেন ঃ এটা মধ্য শাবানের রাত। এ রাতে আল্লাহ তা’আলা তার বান্দাদের প্রতি মনোনিবেশ করেন। ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং রাহমাত প্রার্থনাকারীদের রহম করেন। আর হিংসুকদেরকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দেন। (বাইহাকী তার শুয়াবুল ঈমান কিতাবে বর্ণনা করেছেন)
হাদীসটি মুরসাল। সহীহ বা বিশুদ্ধ নয় । কেননা বর্ননাকারী ‘আলা' আয়িশা (রাঃ) থেকে শুনেননি।
৩ নং হাদীস
৩-عن علي بن أبي طالب رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا نهارها فإن الله ينـزل فيها لغروب الشمس إلى سماء الدنيا فيقول : ألا من مستغفر فأغفر له ألا من مسترزق فأرزق له ألا من مبتلى فأعافيه ألا كذا ألا كذا حتى يطلع الفجر. (رواه ابن ماجه، والبيهقي في شعب الإيمان. وهذا حديث ضعيف لأن في سنده ابن أبي سبرة وهو معروف بوضع الحديث عند المحدثين. المرجع : تحفة الأحوذي بشرح جامع الترمذي وقال ناصر الدين الألباني في هذا الحديث: إنه واه جداً)
অর্থ ঃ আলী ইবনে আবী তালেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় করবে আর দিবসে সিয়াম পালন করবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সূর্যাস্তের পর দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেন ঃ আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিয্ক প্রার্থনাকারী আমি রিয্ক দান করব। আছে কি কোন বিপদে নিপতিত ব্যক্তি আমি তাকে সুস্থ্যতা দান করব। এভাবে ফজর পর্যন্ত বলা হয়ে থাকে। (ইবনে মাজাহ ও বাইহাকী)
প্রথমতঃ এ হাদীসটি দুর্বল। কেননা এ হাদীসের সনদে (সূত্রে) ইবনে আবি সাবুরাহ নামে এক ব্যক্তি আছেন, যিনি অধিকাংশ হাদীস বিশারদের নিকট হাদীস জালকারী হিসাবে পরিচিত। এ যুগের বিখ্যাত মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আল-বানী (রহঃ) বলেছেন, হাদীসটি সনদের দিক দিয়ে একেবারেই দুর্বল।
দ্বিতীয়তঃ অপর একটি সহীহ হাদীসের বিরোধী হওয়ার কারণে এ হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয়। সে সহীহ হাদীসটি হাদীসে নুযুল নামে পরিচিত, যা ইমাম বুখারী ও মুসলিম তাদের কিতাবে বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি হল ঃ
عن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: ينزل ربنا تبارك وتعالى في كل ليلة إلى سماء الدنيا حين يبقى ثلث الليل الآخر فيقول من يدعوني فأستجيب له ومن يسألني فأعطيه ومن يستغفرني فأغفرله. (أخرجه البخاري ومسلم)
অর্থ ঃ আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ আমাদের রব আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন ও বলতে থাকেন ঃ কে আছ আমার কাছে দু‘আ করবে আমি কবুল করব। কে আছ আমার কাছে চাইবে আমি দান করব। কে আছ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করব। (বুখারী ও মুসলিম)
আর উল্লিখিত ৩ নং হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা মধ্য শাবানের রাতে নিকটতম আকাশে আসেন ও বান্দাদের দু‘আ কবুলের ঘোষণা দিতে থাকেন। কিন্তু বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত এই সহীহ হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের শেষের দিকে নিকটতম আকাশে অবতরণ করে দু‘আ কবুলের ঘোষণা দিতে থাকেন। আর এ হাদীসটি সর্বমোট ৩০ জন সাহাবী বর্ণনা করেছেন এবং বুখারী এবং মুসলিম ও সুনানের প্রায় সকল কিতাবে এসেছে। তাই হাদীসটি প্রসিদ্ধ। অতএব এই মশহুর হাদীসের বিরোধী হওয়ার কারণে ৩ নং হাদীসটি পরিত্যাজ্য হবে।
কেহ বলতে পারেন যে, এই দু হাদীসের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। কারণ ৩ নং হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন মধ্য শাবানের রাতের শুরু থেকে। আর এ হাদীসের বক্তব্য হল প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। অতএব দু হাদীসের মধ্যে কোন বিরোধ নেই যে কারণে ৩ নং হাদীসকে পরিত্যাগ করতে হবে।
আমি বলব আসলেই এ দু হাদীসের মধ্যে বিরোধ আছে। কেননা আবূ হুরাইরা (রাঃ) বর্ণিত বুখারী ও মুসলিমের হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের শেষ অংশে দুনিয়ার আকাশে আসেন। আর প্রতি রাতের মধ্যে শাবান মাসের পনের তারিখের রাতও অন্তর্ভুক্ত। অতএব এ হাদীস মতে অন্যান্য রাতের মত শাবান মাসের পনের তারিখের রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে আসেন। কিন্তু ৩ নং হাদীসের বক্তব্য হল শাবান মাসের পনের তারিখের রাতের প্রথম প্রহর থেকে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন।
৪ নং হাদীস
৪-عن عثمان بن أبي العاص رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: إذا كان ليلة النصف من شعبان نادى مناد : هل من مستغفر فأغفرله، هل من سائل فأعطيه ، فلا يسأل أحد إلا أعطي إلا زانية بفرجها أو مشرك. (أخرجه البيهقي في شعب الإيمان وضعفه الألباني في ضعيف الجامع رقم ৬৫২)
অর্থ ঃ উসমান ইবনে আবিল আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দেয় ঃ আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কেহ কিছু চাইবার আমি তাকে তা দিয়ে দিব। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন ঃ মুশরিক ও ব্যভিচারী বাদে সকল প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুল করা হয়। (বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান)
বিখ্যাত মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আল-বানী (রহঃ) হাদীসটিকে তার সংকলন ‘যয়ীফ আল-জামে’ নামক কিতাবের ৬৫২ নং ক্রমিকে দুর্বল প্রমাণ করেছেন।
শবে বরাত সম্পর্কে এ ছাড়া বর্ণিত অন্যান্য সকল হাদীস সম্পর্কে ইবনে রজব হাম্বলী (রহঃ) বলেন ঃ এ মর্মে বর্ণিত অন্য সকল হাদীসই দুর্বল।
শাবানের মধ্যরজনীর সম্পর্কিত হাদীসসমূহ পর্যালোচনার সারকথা
শবে বরাত সম্পর্কিত হাদীসগুলো উল্লেখ করা হল। আমি মনে করি এ সম্পর্কে যত হাদীস আছে তা এখানে এসেছে। বাকী যা আছে সেগুলোর অর্থ বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত। এ সকল হাদীসের দিকে লক্ষ্য করে আমরা কয়েকটি বিষয় স্পষ্টভাবেই বুঝে নিতে পারি।
(১) এ সকল হাদীসের কোন একটি দ্বারাও প্রমাণিত হয়নি যে, ১৫ শাবানের রাতে আল্লাহ তা’আলা আগামী এক বছরে যারা ইন্তেকাল করবে, যারা জন্ম গ্রহণ করবে, কে কি খাবে সেই ব্যাপারে ফায়সালা করেন। যদি থাকেও তাহলে তা আল-কুরআনের বক্তব্যের বিরোধী হওয়ায় তা গ্রহণ করা যাবে না। কারণ আল-কুরআনের স্পষ্ট কথা হল এ বিষয়গুলির ফায়সালা হয় লাইলাতুল কদরে।
(২) এ সকল হাদীসের কোথাও বলা হয়নি যে, এ রাতে মৃত ব্যক্তিদের আত্মা তাদের গৃহে আসে। বরং এটি একটি প্রচলিত বানোয়াট কথা। মৃত ব্যক্তির আত্মা কোন কোন সময় গৃহে ফিরে আসার ধারণাটা হিন্দুদের ধর্ম-বিশ্বাস।
(৩) এ সকল হাদীসের কোথাও এ কথা নেই যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরাম এ রাতে গোসল করেছেন, মাসজিদে উপস্থিত হয়ে নফল সালাত আদায় করেছেন, যিক্র-আযকার করেছেন, কুরআন তিলাওয়াত করেছেন, সারারাত জাগ্রত থেকেছেন, ওয়াজ নাসীহাত করেছেন কিংবা অন্যদের এ রাতে ইবাদাত বন্দেগীতে উৎসাহিত করেছেন অথবা শেষ রাতে জামাতের সাথে দু’আ-মুনাজাত করেছেন।
(৪) এ হাদীসসমূহের কোথাও এ কথা নেই যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) এ রাতের সাহরী খেয়ে পরের দিন সিয়াম (রোযা) পালন করেছেন।
(৫) আলোচিত হাদীসসমূহে কোথাও এ কথা নেই যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা সাহাবায়ে কিরাম এ রাতে হালুয়া-রুটি বা ভাল খানা তৈরী করে বিলিয়েছেন, বাড়ীতে বাড়ীতে যেয়ে মীলাদ পড়েছেন।
(৬) এ সকল হাদীসের কোথাও নেই যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা সাহাবায়ে' কিরাম (রাঃ) এ রাতে দলে দলে কবরস্থানে গিয়ে কবর যিয়ারত করেছেন কিংবা কবরে মোমবাতি জ্বালিয়েছেন।
এমনকি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ বাদ দিলে খুলাফায়ে রাশেদীনের ত্রিশ বছরের ইতিহাসেও কি এর কোন একটা ‘আমল পাওয়া যাবে?
যদি না যায় তাহলে শবে বরাত সম্পর্কিত এ সকল ‘আমল ও আকীদা কি বিদ’আত নয়? এ বিদ’আত সম্পর্কে উম্মাতে মুহাম্মাদীকে সতর্ক করার দায়িত্ব কারা পালন করবেন? এ দায়িত্ব পালন করতে হবে আলেম-উলামাদের, দ্বীন প্রচারক, মাসজিদের ইমাম ও খতীবদের। যে সকল বিষয়ে কুরআন ও সহীহ হাদীসের ইশারা নেই সে সকল ‘আমল থেকে সাধারণ মুসলিম সমাজকে বিরত রাখার দায়িত্ব পালন করতে হবে নবী-রাসূলগণের উত্তরসূরীদের।
ভাগ্য লিপিবদ্ধ করা সম্পর্কিত একটি হাদীস ও উহার পর্যালোচনা
এ বইটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশের পর একজন বিশিষ্ট আলেম আমাকে বলেছেন ঃ “শবে বরাতে সৌভাগ্য বা এক বছরের তাকদীর লেখা সম্পর্কিত কোন হাদীস নেই” বলে আপনি যে দাবী করেছেন তা সঠিক নয়। ‘মিশকাত আল-মাসাবীহ’ কিতাবে এ সম্পর্কে হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে।
পাঠকগণের অবগতির জন্য উক্ত হাদীসটির পর্যালোচনা নিুে তুলে ধরলাম। হাদীসটি হল ঃ
عن عائشة رضي الله عنها عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: هل تدرين ما هذه الليلة؟ يعني ليلة النصف من شعبان.
قالت ما فيها يا رسول الله ؟ فقال : فيها أن يكتب كل مولود (من) بني آدم في هذه السنة وفيها أن يكتب كل هالك من بني آدم في هذه السنة وفيها ترفع أعمالهم وفيها تنزل أرزاقهم.
من مشكاة المصبايح في باب قيام شهر رمضان، رواه البيهقي في الدعوات الكبير.
অর্থ ঃ আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ তুমি কি জানো এটা (অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত) কোন্ রাত? তিনি জিজ্ঞেস করলেন ঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! এ রাতে কি রয়েছে? তিনি বললেন ঃ এ রাতে এই বছরে যে সকল মানব-সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে তাদের ব্যাপারে লিপিবদ্ধ করা হয়, যারা মৃত্যু বরণ করবে তাদের তালিকা তৈরী হয়, এ রাতে ‘আমলসমূহ পেশ করা হয়, এ রাতে রিয্ক নাযিল করা হয়।
আলোচ্য হাদীসটি আল-মিশকাতুল মাসাবীহ কিতাবে ‘রামাযান মাসে কিয়াম’ (রামাযান মাসের রাতের সালাত) অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
তিনি লিখেছেন যে, ইমাম বাইহাকী (রঃ) তার ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর’ গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হাদীসটির পর্যালোচনা নিুে তুলে ধরলাম ঃ
(এক) উল্লিখিত হাদীসে ‘অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত’ বাক্যটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা নয়। এ বাক্যটি পরবর্তী কালের বর্ণনাকারীর নিজস্ব বক্তব্য বলে। আর আয়িশা (রাঃ) এমন কোন অজ্ঞ মহিলা ছিলেন না যে তাকে তারিখ বলে দিতে হবে।
(দুই) এ হাদীসে বর্ণিত ‘অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত’ কথাটি আয়িশার (রাঃ) বক্তব্য নয়। কারণ তার বক্তব্য শুরু হয়েছে ‘তিনি জিজ্ঞেস করলেন’ বাক্যটির পর। তাহলে এ বক্তব্যটি কার? এ বক্তব্যটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আয়িশা (রাঃ) ব্যতীত অন্য কোন বর্ণনাকারীর নিজস্ব মন্তব্য, যা মেনে নেয়া আমাদের জন্য যরুরী নয়।
(তিন) এ হাদীসের বিষয়বস্তুর দিকে তাকালে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, হাদীসে ভাগ্য লেখার বিষয়টি লাইলাতুল কদরের সাথে সম্পর্কিত। কেননা জন্ম, মৃত্যু, ‘আমল পেশ, রিয্ক ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী রামাযান মাসে লাইলাতুল কদরে স্থির করা হয়। এ কথা যেমন কুরআনের একাধিক আয়াত দ্বারা প্রমাণিত তেমনি বহু সংখ্যক সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
(চার) আল-মিশকাত আল-মাসাবীহর সংকলক বিষয়টি ভালভাবে বুঝেছেন বলে তিনি হাদীসটিকে রামাযান মাসের সালাত (কিয়ামে শাহরি রামাযান) অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। বুঝা গেল যে, তার মত হল হাদীসটি রামাযান মাসের লাইলাতুল কদর সম্পর্কিত। যদি তিনি বুঝতেন যে, হাদীসটি মধ্য শাবানের তাহলে তিনি তা রামাযান মাসের অধ্যায়ে আলোচনা করবেন কেন?
(পাঁচ) এ হাদীসটি আল-মিশকাত আল-মাসাবীহর সংকলক উল্লেখ করার পর বলেছেন, তিনি হাদীসটি ইমাম বাইহাকীর ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর’ কিতাব থেকে নিয়েছেন।
ইমাম বাইহাকী তার ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর’ গ্রন্থে শবে বরাত সম্পর্কে মাত্র দুটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। তার একটি হল এই হাদীস। তিনি তার ‘শুআ’বুল ঈমান’ গ্রন্থে শবে বরাত সম্পর্কিত এই বইয়ে আলোচিত ৫ নং হাদীসটি উল্লেখ করার পর লিখেছেন ঃ
وقد روي في هذا الباب أحاديث مناكير، رواتها قوم مجهولون ، ذكرنا في كتاب الدعوات منها حديثين.
অর্থ ঃ এ বিষয়ে বহু মুনকার হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যার বর্ণনাকারীরা অপরিচিত। আমি তা থেকে দু’টি হাদীস ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছি।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! তাহলে ফলাফল দাড়াল কি? ইমাম বাইহাকীর এ মন্তব্যে যা প্রমাণিত হল ঃ
(১) শবে বরাত সম্পর্কে অনেক মুনকার (অগ্রহণযোগ্য) হাদীস রয়েছে।
(২) আদ-দাওআত আল-কাবীর গ্রন্থে শবে বরাত সম্পর্কে বর্ণিত হাদীস দুটি মুনকার।
(৩) তাই আলোচ্য হাদীসটি হাদীসে মুনকার।
(৪) তিনি ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর’ গ্রন্থটি আগে সংকলন করেছেন, তারপরে শুআবুল ঈমান সংকলন করেছেন। এ কারণে তিনি পরবর্তী কিতাবে আগের কিতাবের ভুল সম্পর্কে পাঠকদের সতর্ক করেছেন। এটা তার আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার একটি বড় প্রমাণ।
(৫) মুনকার হাদীস ‘আমলের জন্য গ্রহণ করা যায় না।
(৬) যিনি হাদীসটি আমাদের কাছে পৌছিয়েছেন তিনি নিজেই যখন হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয় বলে মতামত দিয়েছেন তখন আমরা তা সঠিক বলে গ্রহণ করব কেন?
সৌভাগ্য রজনী ধর্ম বিকৃতির শামিল
ইসলাম ধর্মে সৌভাগ্য রজনী বলতে কিছু নেই। নিজেদের সৌভাগ্য রচনার জন্য কোন অনুষ্ঠান বা ইবাদাত-বন্দেগী ইসলামে অনুমোদিত নয়। শবে বরাতকে সৌভাগ্য রজনী বলে বিশ্বাস করা একটি বিদ‘আত তথা ধর্মে বিকৃতি ঘটানোর শামিল। এ ধরনের বিশ্বাস খুব সম্ভব হিন্দু ধর্ম থেকে এসেছে। তারা সৌভাগ্য লাভের জন্য গনেশ পূজা করে থাকে। সৌভাগ্য অর্জন করতে হলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহ অনুসরণ করতে হবে। কুরআন-সুন্নাহ বাদ দিয়ে এবং সারা জীবন সালাত-সিয়াম-যাকাত ত্যাগ করে শুধুমাত্র একটি রাতে মাসজিদে উপস্থিত হয়ে রাত জেগে ভাগ্য বদল করে সৌভাগ্য হাসিল করে নিবেন এমন ধারণা ইসলামে একটি হাস্যকর ব্যাপার।
ধর্মে বিকৃতির কৃতিত্বে শিয়া মতাবলম্বীদের জুড়ি নেই। এ শবে বরাত প্রচলনের কৃতিত্বও তাদের। ফারসী ভাষার “শবে বরাত” নামটা থেকে এ বিষয়টা বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়। তারা এ দিনটাকে ইমাম মাহদীর জন্ম দিন হিসাবে পালন করে থাকে। তারা বিশ্বাস করে যে, এ রাতে ইমাম মাহদীর জন্ম হয়েছে। এ রাতে তারা এক বিশেষ ধরনের সালাত আদায় করে। যার নাম দিয়েছে “সালাতে জাফর”।
শবে বরাত সম্পর্কে উলামায়ে কিরামের বক্তব্য
এ শিরোনামে আমি শবে বরাত সম্পর্কে বিশ্ব বরেণ্য আলেম শায়খ আবদুল আযীয আবদুল্লাহ বিন বায (রহঃ) এর প্রবন্ধ -
حكم الاحتفال بليلة النصف من شعبان، للشيخ عبد العزيز بن عبد الله بن باز رحمه الله.
‘মধ্য শাবানের রাত উদযাপনের বিধান’ এর সার-সংক্ষেপ তুলে ধরব। তার এ প্রবন্ধে অনেক উলামায়ে কিরামের মতামত তুলে ধরা হয়েছে।
তিনি বলেছেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন ঃ
اليوم أكملت لكم دينكم وأتممت عليكم نعمتي ورضيت لكم الإسلام دينا. (المائدة : ৩)
অর্থ ঃ আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে তোমাদের জন্য পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের জন্য আমার নেআমাত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম। (সূরা মায়িদা, ৩)
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন ঃ
أم لهم شركاء شرعوا لهم من الدين ما لم يأذن به الله. (الشورى : ২১)
অর্থ ঃ তাদের কি এমন কতগুলো শরীক আছে যারা তাদের জন্য ধর্মের এমন বিধান দিয়েছে যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? (সূরা শুরা, ২১)
হাদীসে এসেছে ঃ
عن عائشة رضى الله عنها عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قال : من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد. (رواه البخاري ومسلم)
অর্থ ঃ যে আমাদের এ ধর্মে এমন কিছুর প্রচলন করবে যা দ্বীনের মধ্যে ছিল না তা প্রত্যাখ্যাত হবে। (বুখারী ও মুসলিম)
হাদীসে আরও এসেছে ঃ
عن جابر رضي الله عنه أن النبى صلى الله عليه وسلم كان يقول في خطبة يوم الجمعة: أما بعد فإن خير الحديث كتاب الله وخير الهدي هدي محمد صلى الله عليه وسلم وشر الأمور محدثاتها وكل بدعة ضلالة. (رواه مسلم)
অর্থ ঃ সাহাবী জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমু‘আর খুতবায় বলতেন ঃ আর শুনে রেখ! সর্বোত্তম কথা হল আল্লাহর কিতাব ও সর্বোত্তম পথ-নির্দেশ হল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের পথ-নির্দেশ। আর ধর্মে নতুন বিষয় প্রচলন করা হল সর্ব নিকৃষ্ট বিষয়। এবং সব ধরনের বিদ‘আতই পথভ্রষ্টতা। (মুসলিম)
এ বিষয়ে অনেক আয়াতে কারীমা ও হাদীস রয়েছে যা থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা ইসলাম ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। আর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে কোন রকম অলসতা করেননি বা কার্পণ্যতা দেখাননি। ইসলাম ধর্মের সকল খুটিনাটি বিষয় তিনি স্পষ্টভাবে তাঁর উম্মতের সামনে বর্ণনা করে গেছেন যা আজ পর্যন্ত সুরক্ষিত রয়েছে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর যে সমস্ত নতুন আচার-অনুষ্ঠান, কাজ ও বিশ্বাস ধর্মের আচার বলে যা চালিয়ে দেয়া হবে তা সবগুলো প্রত্যাখ্যাত বিদ‘আত বলেই পরিগণিত হবে, তা উহার প্রচলনকারী যে কেউ হোক না কেন এবং উদ্দেশ্য যত মহৎ হোক না কেন। সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) ও তাদের পরবর্তী উলামায়ে ইসলাম এ ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন বলে তারা বিদ‘আতকে প্রত্যাখ্যান করেছেন ও অন্যদের বিদ‘আতের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন।
এ ধারাবাহিকতায় উলামায়ে কিরাম মধ্য শাবানের রাত উদযাপন ও ঐদিন সিয়াম পালন করাকে বিদ‘আত বলেছেন। কারণ এ বিষয়ের উপর ভিত্তি করে ‘আমল করা যেতে পারে এমন কোন দলীল নেই। যা আছে তা হল কিছু দুর্বল হাদীস যার উপর ভিত্তি করে ‘আমল করা যায় না। উক্ত রাতে সালাত আদায়ের ফাযীলাতের যে সকল হাদীস পাওয়া যায় তা বানোয়াট। এ ব্যাপারে হাফেয ইবনে রজব তার কিতাব লাতায়িফুল মায়ারিফে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
একটি কথা অবশ্যই বলতে হয় যে, দুর্বল হাদীস ঐ সকল ‘আমল ও ইবাদাতের ক্ষেত্রে গ্রহণ করা যায় যে সকল ‘আমল কোন সহীহ হাদীস দ্বারা ইতোপূর্বে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু মধ্য শাবানের রাতে একত্র হয়ে ইবাদাত-বন্দেগী করার ক্ষেত্রে কোন সহীহ হাদীস নেই। এ মূল নীতিটি ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) উল্লেখ করেছেন।
সকল উলামায়ে কিরামের একটি ব্যাপারে ইজমা (ঐকমত্য) হয়েছে যে, যে সকল ব্যাপারে বিতর্ক বা ইখতিলাফ রয়েছে সে সকল বিষয় কুরআন ও সুন্নাহর কাছে ন্যস্ত করা হবে। কুরআন অথবা হাদীস যে সিদ্ধান্ত দিবে সেই মোতাবেক ‘আমল করা ওয়াজিব।
এ কথা তো আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই বলেছেন ঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا. (النساء : ৫৯)
অর্থ ঃ হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তাহলে আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং তাদের, যারা তোমাদের মধ্যে (ধর্মীয় জ্ঞানে ও শাসনের ক্ষেত্রে) ক্ষমতার অধিকারী; কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ হলে তা ন্যস্ত কর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর। এটাই উত্তম ও পরিণামে উৎকৃষ্টতর। (সূরা নিসা, ৫৯)
এ বিষয়ে অসংখ্য আয়াত ও হাদীস রয়েছে।
হাফেয ইবনে রজব (রহঃ) তার কিতাব লাতায়িফুল মায়ারিফে লিখেছেন ঃ
“তাবেয়ীদের যুগে সিরিয়ায় খালিদ ইবনে মা’দান, মকহুল, লুকমান ইবনে আমের প্রমুখ আলিম এ রাতকে মর্যাদা দিতে শুরু করেন এবং এ রাতে বেশী পরিমাণে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন। তখন লোকেরা তাদের থেকে এটা অনুসরণ করতে আরম্ভ করল। এরপর লোকদের মধ্যে মতানৈক্য শুরু হল; বসরা অঞ্চলের অনেক আবেদগণ এ রাতকে গুরুত্ব দিতেন। কিন্তু মক্কা ও মদীনার আলিমগণ এটাকে বিদ‘আত বলে প্রত্যাখ্যান করলেন। অতঃপর সিরিয়াবাসী আলিমগণ দুই ভাগ হয়ে গেলেন। একদল এ রাতে মাসজিদে একত্র হয়ে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন। এদের মধ্যে ছিলেন খালেদ ইবনে মা’দান, লোকমান ইবনে আমের। ইসহাক ইবনে রাহভিয়াহও তাদের অনুরূপ মত পোষণ করতেন।
আলিমদের অন্যদল বলতেন ঃ এ রাতে মাসজিদে একত্র হয়ে ইবাদাত-বন্দেগী করা মাকরূহ, তবে কেহ ব্যক্তিগতভাবে ইবাদাত-বন্দেগী করলে তাতে দোষের কিছু নেই। ইমাম আওযায়ী এ মত পোষণ করতেন।
মোট কথা হল, মধ্য শাবানের রাতের ‘আমল সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরামদের থেকে কোন কিছু প্রমাণিত নয়। যা কিছু পাওয়া যায় তা তাবেয়ীগণের যুগে সিরিয়ার একদল আলেমের ‘আমল।”
বিশুদ্ধ কথা হল, এ রাতে ব্যক্তিগত ‘আমল সম্পর্কে ইমাম আওযায়ী ও ইবনে রজব (রহঃ) এর মতামত যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে তা তাদের ব্যক্তিগত অভিমত যা সহীহ নয়। আর এটাতো সকল আলেমে দ্বীনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত যে, শরয়ীভাবে প্রমাণিত নয় তা ব্যক্তিগত হোক বা সমষ্টিগত, প্রকাশ্যে হোক অথবা গোপনে হোক তা কোন মুসলিমের ধর্মীয় ‘আমল হিসাবে পালন করা জায়েয নয়। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত নিম্নের হাদীস হল আম তথা ব্যাপক অর্থবোধক। তিনি বলেছেন ঃ
من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد. (رواه مسلم)
অর্থ ঃ যে কেহ এমন ‘আমল করবে যা করতে আমরা (ধর্মীয়ভাবে) নির্দেশ দেইনি তা প্রত্যাখ্যাত। (মুসলিম)
ইমাম আবূ বকর আত-তারতূশী (রহঃ) তার কিতাব (الحوادث والبدع) ‘আল-হাওয়াদিছ ওয়াল বিদ’আ’তে উল্লেখ করেন ঃ ইবনে ওয়াদ্দাহ যায়েদ বিন আসলাম সূত্রে বর্ণনা করে বলেন ঃ আমাদের কোন উস্তাদ বা কোন ফকীহকে মধ্য শাবানের রাতকে কোন রকম গুরুত্ব দিতে দেখিনি। তারা মাকহূলের হাদীসের দিকেও তাকাননি এবং এ রাতকে অন্য রাতের চেয়ে ‘আমলের ক্ষেত্রে মর্যাদা সম্পন্ন মনে করতেন না।
হাফেয ইরাকী (রহঃ) বলেন ঃ মধ্য শাবানের রাতে সালাত আদায় সম্পর্কিত হাদীসগুলো বানোয়াট বা জাল এবং এটা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি মিথ্যা আরোপের শামিল।
এ সম্পর্কে সকল উলামাদের মতামত যদি উল্লেখ করতে যাই তাহলে বিরাট এক গ্রন্থ হয়ে যাবে। তবে সত্যানুরাগীদের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যা ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
মধ্য শাবানের রাতে সালাত আদায়ের জন্য একত্র হওয়া, ঐ দিন সিয়াম পালন করা ইত্যাদি নিকৃষ্ট বিদ‘আত। অধিকাংশ উলামায়ে কিরাম এটাই বলেছেন। এ ধরনের ‘আমল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে যেমন ছিল না তেমনি ছিল না তাঁর সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) এর সময়ে। যদি এ রাতে ইবাদাত- বন্দেগী করা সওয়াবের কাজ হত তাহলে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতকে সে সম্পর্কে সতর্ক ও উৎসাহিত করতে কার্পণ্য করতেন না, যেমন তিনি কার্পণ্য করেননি লাইলাতুল কদর ও রামাযানের শেষ দশ দিন ইবাদাত-বন্দেগী করার ব্যাপারে মুসলিমদের উৎসাহিত করতে।
যদি মধ্য শাবানের রাতে অথবা রজব মাসের প্রথম জুমু‘আর রাতে বা মি’রাজের রাতে ইবাদাত-বন্দেগী করা সওয়াবের কাজ হত তাহলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতকে এ ব্যাপারে অবশ্যই দিক-নির্দেশনা দিতেন। আর তিনি যদি দিক-নির্দেশনা দিতেন তাহলে তার সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) কোনভাবেই তা গোপন করতেন না। তারা তা অবশ্যই জোরে শোরে প্রচার করতেন। তারা তো নবীগণের পর উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।”
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! চলমান শিরোনামে এতক্ষণ যা বলা হল তা ছিল শায়খ আবদুল আযীয আবদুল্লাহ বিন বাযের বক্তব্যের সার কথা।
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, শবে বরাতের বিপক্ষে উলামাদের বক্তব্য উল্লেখ করলেন, কিন্তু শবে বরাত উদযাপনের পক্ষেও তো অনেক বিখ্যাত উলামাদের বক্তব্য আছে তা তো উল্লেখ করলেন না। তাই ব্যাপারটা কি একপেশে ও ইনসাফ বহির্ভূত হয়ে গেল না?
এর জবাবে আমি বলব ঃ দেখুন, কোন বিষয় বিদ‘আত হওয়ার ক্ষেত্রে উলামাদের বক্তব্য যথেষ্ট। কেননা কুরআন ও হাদীসে কোন বিষয়কে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি যে, অমুক কাজটি বিদ‘আত। তাই আলেমগণ যেটাকে বিদ‘আত বলে রায় দিবেন সেটা বিদ‘আতই হবে। বিদ‘আত নির্ধারণের দায়িত্ব আলেমদের । কিন্তু কোন বিষয়কে ওয়াজিব, সুন্নাত বা মুস্তাহাব অথবা সওয়াবের কাজ বলে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আলেমদের বক্তব্য যথেষ্ট হবে না যদি না উহার পক্ষে কুরআন ও হাদীসের সহীহ দলীল থাকে। অতএব কোন বিষয় বিদ‘আত হওয়ার ক্ষেত্রে উলামাদের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য, কিন্তু সুন্নাত হওয়ার ব্যাপারে নয়।
আর এ কারণে আমরা শবে বরাত প্রচলনের সমর্থনে আলেমদের বক্তব্য উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করিনা।
এ বিবেচনায় যে সকল আলেম শবে বরাত উদযাপন করাকে বিদ‘আত বলেছেন তাদের বক্তব্য গ্রহণ করতে হবে। যারা শবে বরাতের পক্ষে বলেছেন তাদের বক্তব্য এ জন্য গ্রহণ করা যাবে না যে, তা কুরআন ও সুন্নাহর সহীহ দলীলে উত্তীর্ণ নয়।
শবে বরাত সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহর অবস্থান
শবে বরাত উদযাপন করা ও না করার ক্ষেত্রে বিশ্বের মুসলিমদেরকে চার ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রথমতঃ যারা কোনভাবেই শবে বরাত উদযাপন করেন না ও উদযাপন করাকে ইসলাম সম্মত মনে করেন না।
দ্বিতীয়তঃ যারা সম্মিলিতভাবে শবে বরাত উদযাপন করেন না ঠিকই, কিন্তু এ রাতে ব্যক্তিগতভাবে চুপে চুপে ‘আমল করা ফাযীলাতপূর্ণ মনে করেন, দিবসে সিয়াম পালন করেন ও রাত্রি জাগরণ করেন।
তৃতীয়তঃ যারা ১৫ শাবানের রাতে মাসজিদে জমায়েত হয়ে ইবাদাত-বন্দেগী করেন, কবর যিয়ারত করেন, মাসজিদে ওয়াজ-নাসীহাতে শরীক হন, পরের দিন সিয়াম পালন করেন, এই রাতে হায়াত-মউত, রিয্ক-দৌলত সম্পর্কে আল্লাহ সিদ্ধান্ত নেন বলে বিশ্বাস করেন। সারা রাত জেগে ইবাদাত-বন্দেগী করেন। তবে আতশ-বাযি, মোমবাতি জ্বালানো ও আলোকসজ্জা ইত্যাদিকে নাজায়েয বলে জানেন।
চতুর্থতঃ যারা ১৫ শাবানের রাতে আতশবাজি, আলোক সজ্জা ও আমোদ ফুর্তি করেন ও সময় সুযোগ মত ইবাদাত-বন্দেগীও করেন।
এ চার প্রকার লোকদের মধ্যে প্রথম প্রকারের মানুষের সংখ্যাই বেশী। আমি কিন্তু এ কথা বলতে চাচ্ছিনা যে, অধিকাংশ মুসলিম শবে বরাত পালন করেন না বলে তা করা ঠিক নয়। বরং আমি বলতে চাচ্ছি যে, শবে বরাত সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহর এ বিভক্তি শবে বরাত উদযাপন বিদ‘আত হওয়ার একটা স্পষ্ট আলামত। এ ক্ষেত্রে আমি বিশ্ববরেণ্য আলেমে দ্বীন আবুল হাসান আলী নদভী (রহঃ) এর কিতাব ‘র্শিক ও বিদয়াত’ থেকে একটি উদ্ধৃতি দেয়া যথার্থ মনে করছি। তিনি লিখেছেন ঃ “আল্লাহর দ্বীন ও শরীয়তের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হলো বিশ্বব্যাপী সম-আদর্শতা। এই সমাদর্শ ও স্বাদৃশ্যতা যেমন কাল ও সময়ের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় তেমনি স্থানের ক্ষেত্রেও। আল্লাহ হচ্ছেন রাব্বুল মাশরিকাইন ওয়া রাব্বুল মাগরিবাইন; পূর্ব-পশ্চিম সকল কিছুর রব ও মালিক। তিনি স্থান ও কালের সীমা ও বাধার উর্দ্ধে। তাই তাঁর শরীয়াত ও তাঁর দ্বীনে এক অত্যাশ্চর্য সমতা ও সমাদর্শ বিদ্যমান। তাঁর আখিরী শরীয়াত ও আখিরী নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনাদর্শে এসে যা হয়েছে তাকমীল -পূর্ণতা প্রদীপ্ত সূর্যের মতই সকলের জন্য সমান এবং আকাশ ও মাটির মত সকলের জন্য সম উপযোগীতাপূর্ণ। প্রথম যুগে এর যে রূপ ও আকৃতি ছিল হিজরী পনের শতকেও উহার রূপ ও আকৃতি সেই একই। প্রাচ্যবাসীদের জন্য এটি যেমন ও যতটুকু, ঠিক তেমন ও ততটুকুই প্রতীচ্যের জন্য। যে সমস্ত নীতি ও নির্দেশ, ইবাদাতের যে রূপ ও আকৃতি, আল্লাহর নৈকট্য লাভের যে সমস্ত সুনির্ধারিত পন্থা ও উপায় আরবদের জন্য ছিল ঠিক তদ্রƒপ আছে তা ভারতবাসীর জন্যও। তাই দুনিয়ার যে কোন অংশের একজন মুসলিম অধিবাসী অপর কোন অংশে যদি চলে যায় তাহলে ইসলামী ফরয আদায় এবং ইবাদাত-বন্দেগী করার ক্ষেত্রে তার কোন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় না। তার জন্য কোন স্থানীয় গাইডের প্রয়োজন পড়ে না। তিনি যদি আলিম হন, শরীয়ত সম্পর্কে বিজ্ঞ হন তাহলে কেবল মুক্তাদীই নয় অধিকন্তু যে কোন স্থানে তিনি ইমামও হতে পারেন।
বিদ‘আতের অবস্থা এর বিপরীত। এতে সমদৃশ্যতা ও একত্বতা নেই। স্থান ও কালের প্রভাব এতে পরিস্ফুট থাকে। গোটা মুসলিম বিশ্বে এর একটিমাত্র রূপে প্রচলনও হয়ে ওঠে না।”
সকল ধরনের বিদ‘আতের ক্ষেত্রে উপরোক্ত কথা প্রযোজ্য। শবে বরাত এমনি একটা বিষয় যা আমরা ভারতীয় উপমহাদেশের লোকেরা মহা ধুমধামে উদযাপন করছি, কিন্তু অন্য এলাকার মুসলিমদের কাছে এ সম্পর্কে কোন খবর নেই। কি আশ্চর্য! এমন এক মহা-নিয়ামাত যা মক্কা-মদীনার লোকেরা পেলনা, অন্যান্য আরবরা পেলনা, আফ্রিকানরা পেলনা, ইন্দোনেশীয়, মালয়েশীয়রা পেলনা, ইউরোপ-আমেরিকা-অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশের লোকেরা পেলনা; অথচ ভাগ্যক্রমে সৌভাগ্যের মহান রাত পেয়ে গেলাম আমরা উপ-মহাদেশের কিছু লোকেরা ও শিয়া মতাবলম্বীরা!
এ বিষয়টি যদি বিভ্রান্তিকর না হত তাহলে সকল মুসলিমের পাওয়ার কথা ছিল। হাদীসে এসেছে ঃ
عن عبد الله بن عمر رضي الله عنهما أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: إن الله تعالى لا يجمع أمتي على ضلالة. (رواه الترمذي وصححه الألباني في صحيح الجامع رقم ১৮৪৮)
অর্থ ঃ সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃআল্লাহ তাআলা আমার উম্মতকে কোন গোমরাহী বা বিভ্রান্তিতে একমত হতে দিবেন না। (তিরমিযী)
অন্য বর্ণনায় এসেছে ঃ
عن أنس رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: إن الله تعالى قد أجار أمتي أن تجمع على ضلالة. (صحيح الجامع ১৭৪৬ رقم ১৭৪৬)
অর্থ ঃ সাহাবী আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ আল্লাহ তা’আলা আমার উম্মতকে কোন ভ্রান্ত বিষয়ে একমত হওয়া থেকে মুক্তি দিয়েছেন। (সহীহ জামেয়)
এ হাদীসের অর্থ হল আমার উম্মত যদি কোন বিষয়ে একমত হয় তাহলে সে বিষয়টি বিভ্রান্তিকর হতে পারে না। আর আমার উম্মতের কোন বিষয়ে একমত না হওয়ার বিষয়টি বিভ্রান্ত হওয়ার একটা আলামত হতে পারে।
শবে বরাত এমনি একটি ‘আমল যে উম্মতে মুসলিমাহ এ বিষয়ে কখনো একমত হয়নি, হওয়া সম্ভবও নয়। আবার যারা উদযাপন করেন তাদের মধ্যেও দেখা যায় ‘আমল ও বিশ্বাসের বিভিন্নতা।
শবে বরাত সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করার দায়িত্ব উলামায়ে কিরামের
ইসলাম ধর্মে যতগুলো বিদ‘আত চালু হয়েছে তা কিন্তু সাধারণ মানুষ বা কাফির মুশরিকদের মাধ্যমে প্রসার ঘটেনি। উহার প্রসারের জন্য দায়ী যেমন এক শ্রেণীর উলামা, তেমনি উলামায়ে কিরামই যুগে যুগে বিদ‘আতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন, দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, জেল-যুল্ম বরদাশত করেছেন।
তাই বিদ‘আত যে নামেই প্রতিষ্ঠা লাভ করুক না কেন উহার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করতে হবে আলেমদেরকেই। তারা যদি এটা না করে কারো অন্ধ অনুসরণ বা অনুকরণ করেন, বিভ্রান্তি ছড়ান বা কোন বিদ‘আতী কাজ-কর্ম প্রসারে ভূমিকা রাখেন, তাহলে এ জন্য তাদেরকে আল্লাহর সম্মুখে জবাবদিহি করতে হবে। যে দিন বলা হবে ঃ
وَيَوْمَ يُنَادِيهِمْ فَيَقُولُ مَاذَا أَجَبْتُمُ الْمُرْسَلِينَ.(القصص :৬৫)
অর্থ ঃ আর সে দিন আল্লাহ তাদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা রাসূলদের আহ্বানে কিভাবে সাড়া দিয়েছিলে? (সূরা কাসাস, ৬৫)
সেদিন তো এ প্রশ্ন করা হবে না যে, তোমরা অমুক পীরের মত অনুযায়ী বা অমুক ইমামের মত অনুযায়ী ‘আমল করেছিলে কিনা। যারা সহীহ সুন্নাহ মত ‘আমল করবে তারাই সেদিন সফলকাম হবে।
একটি বিভ্রান্তির নিরসন
১৫ শাবানে দিনের সিয়াম ও রাতের ইবাদাত-বন্দেগী, কুরআন তেলাওয়াত, নফল সালাত, কান্নাকাটি, দু‘আ-মুনাজাত, কবর যিয়ারাত, দান-সাদকাহ, ওয়াজ-নাসীহাত প্রভৃতি নেক ‘আমল গুরুত্বসহকারে পালন করাকে যখন কুরআন ও হাদীস সম্মত নয় বলে আলোচনা করা হয় তখন সাধারণ ধর্ম-প্রাণ ভাই-বোনদের পক্ষ থেকে একটি প্রশ্ন আসে যে, জনাব! আপনি শবে বরাতে উল্লিখিত ইবাদাত-বন্দেগীকে বিদ‘আত বা কুরআন ও সুন্নাহ সম্মত নয় বলেছেন, কিন্তু রোযা রাখা সওয়াবের কাজ ও রুটি তৈরী করে গরীব দুঃখীকে দান করা ভাল কাজ নয় কি? আমরা কান্নাকাটি করে আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে দোষের কি?
সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দ! নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দ‘ুআ-মুনাজাত, সালাত, সিয়াম, দান-ছাদাকাহ, কুরআন তিলাওয়াত, রাত্রি জাগরণ হল নেক ‘আমল। এতে কারও দ্বি-মত নেই। আমরা কখনো এগুলিকে বিদ‘আত বলি না। যা বিদ‘আত বলি এবং যে সম্পর্কে উম্মাহকে সতর্ক করতে চাই তা হল এ রাতকে শবে বরাত বা সৌভাগ্য রজনী অথবা মুক্তি রজনী মনে করে বিভিন্ন প্রকার ‘আমল ও ইবাদাত বন্দেগীর মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করা। এটা কুরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থী। এটাই ধর্মে বাড়াবাড়ি। যা ধর্মে নেই তা উদযাপন করা ও প্রচলন করার নাম বিদ‘আত।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নবুওয়াতের তেইশ বছরের জীবনে কখনো তার সাহাবীগণকে সাথে নিয়ে মক্কায় মাসজিদুল হারামে অথবা মদীনায় মাসজিদে নবুবীতে কিংবা অন্য কোন মাসজিদে একত্র হয়ে উল্লিখিত ইবাদাত-বন্দেগীসমূহ করেছেন এমন কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। তাঁর ইন্তেকালের পরে তাঁর সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) তথা খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে কেহ জানতো না শবে বরাত কি এবং এতে কি করতে হয়। তারা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের ‘আমল প্রত্যক্ষ করেছেন। আমাদের চেয়ে উত্তম রূপে কুরআন অধ্যয়ন করেছেন। তারা তাতে শবে বরাত সম্পর্কে কোন দিক-নির্দেশনা পেলেন না। তারা তাদের জীবন কাটালেন আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে, অথচ জীবনের একটি বারও তাঁর কাছ থেকে শবে বরাত বা মুক্তির রজনীর ছবক পেলেন না? যা পালন করতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে যাননি, যা কুরআনে নেই, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের তা’লীমে নেই, সাহাবীগণের ‘আমলে নেই, তাদের সোনালী যুগের বহু বছর পরে প্রচলন করা শবে বরাতকে আমরা বিদ‘আত বলতে চাই। আমরা বলতে চাই, এটা একটা মনগড়া পর্ব। আমরা মানুষকে বুঝাতে চাই, এই সব প্রচলিত ও বানোয়াট মুক্তির রজনী উদযাপন থেকে দূরে থাকতে হবে। আমরা উম্মতকে কুরআন ও সুন্নাহমুখী করতে এবং সেই অনুযায়ী ‘আমল করাতে অভ্যস্ত করতে চাই।
বিদ‘আত সম্পর্কে কিছু কথা
বিদ‘আত কাকে বলে এ বিষয়ে অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই। অনেকের ধারণা যা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে ছিলনা তা-ই বিদ‘আত। আবার অনেকে মনে করেন বর্তমান নিয়মতান্ত্রিক মাদ্রাসা শিক্ষা পদ্ধতি একটি বিদ‘আত, তাবলীগ জামাতের পদ্ধতি বিদ‘আত, বিমানে হজ্জে যাওয়া বিদ‘আত, মাইকে আজান দেয়া বিদ‘আত ইত্যাদি। এ সকল দিক বিবেচনা করে তারা বিদ‘আতকে নিজেদের খেয়াল খুশি মত দুই ভাগ করে কোনটাকে হাসানাহ (ভাল বিদ‘আত) আবার কোনটাকে সাইয়্যেআহ (মন্দ বিদ‘আত) বলে চালিয়ে দেন। আসলে বিদ‘আত সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার কারণে এ বিভ্রান্তি।
বিদ‘আতের আভিধানিক অর্থ হল ঃ
الشيء المخترع على غير مثال سابق ومنه قوله تعالى (قل ما كنت بدعا من الرسل) وجاء على هذا المعنى قول عمر رضي الله عنه (نعمت البدعة)
অর্থ ঃ পূর্বের দৃষ্টান্ত ব্যতীত নতুন সৃষ্ট কোন বিষয় বা বস্তু। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন ঃ “বলুন, আমি তো কোন নতুন রাসূল নই।
আসলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাসূল হিসাবে নতুনই। কিন্তু এ আয়াতে বিদ‘আত শব্দের অর্থ হল এমন নতুন যার দৃষ্টান্ত ইতোপূর্বে গত হয়নি। আর উমার (রাঃ) তারাবীহর জামাত কায়েম করে বলেছিলেন “এটা উত্তম বিদ‘আত।” এখানেও বিদ‘আতের আভিধানিক অর্থ প্রযোজ্য।
ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় বিদ‘আতের সংজ্ঞা
ما أحدث في دين الله وليس له أصل عام ولا خاص يدل عليه.
‘যা কিছু আল্লাহর দ্বীনে নতুন সৃষ্টি করা হয় অথচ এর সমর্থনে কোন ব্যাপক বা বিশেষ দলীল প্রমাণ নেই।’
অর্থাৎ নব সৃষ্ট বিষয়টি অবশ্যই ধর্মীয় ব্যাপারে হতে হবে। যদি ধর্মীয় ব্যাপার ব্যতীত অন্য কোন বিষয়ে নব-আবিস্কৃত কিছু দেখা যায় তা শরীয়তের পরিভাষায় বিদ‘আত বলে গণ্য হবে না, যদিও শাব্দিক অর্থে তা বিদ‘আত।
এ প্রসঙ্গে আবুল হাসান আলী নদভী (রহঃ) তার ‘র্শিক ও বিদ‘আত’ কিতাবে বিদ‘আতের পরিচ্ছন্ন সংজ্ঞা উল্লেখ করেছেন। তা হল ঃ যে বিশ্বাস বা কাজ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করেননি কিংবা পালন করার নির্দেশ দেননি সেই ধরনের বিশ্বাস বা কাজকে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করা, এর অঙ্গ বলে সাব্যস্ত করা, সওয়াব বা আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় মনে করে এই ধরনের কাজ করার নাম বিদ‘আত।
যে সকল বিশ্বাস ও কাজকে দ্বীনের অংশ মনে করে অথবা সওয়াব হবে ধারণা করে ‘আমল করা হয় তা বিদ‘আত। কারণ হাদীসে এসেছে ঃ
عن عائشة رضي الله عنها قالت قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد. (أخرجه البخاري ومسلم)
অর্থ ঃ আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ যে আমাদের এ ধর্মে এমন কোন নতুন বিষয় উদ্ভাবন করবে যা ধর্মে অন্তর্ভুক্ত ছিল না তা প্রত্যাখ্যাত হবে। (বুখারী ও মুসলিম)
এ হাদীস দ্বারা স্পষ্ট হল যে, নতুন আবিস্কৃত বিষয়টি যদি ধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে ধরে নেয়া হয় তাহলে তা বিদ‘আত ও প্রত্যাখ্যাত।
হাদীসে আরো এসেছে ঃ
من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد. (رواه مسلم)
অর্থ ঃ যে ব্যক্তি এমন কাজ করল যার প্রতি আমাদের (ইসলামের) নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত। (মুসলিম)
এ হাদীসে “যার প্রতি আমাদের নির্দেশ নেই” বাক্যটি দ্বারা এ কথা বুঝানো হয়েছে যে, বিষয়টি ধর্মীয় হতে হবে। ধর্মীয় বিষয় হিসাবে কোন নতুন ‘আমল করলেই বিদ‘আত হবে। যারা মাইকে আজান দেন তারা জানেন যে, মাইকে আজান দেয়ার আলাদা কোন মর্যাদা নেই বা আজানে মাইক ব্যবহার করা সওয়াবের কাজ বলে তারা মনে করেন না। এমনিভাবে বিমানে হজ্জে যাওয়া, প্রাতিষ্ঠানিক মাদ্রাসার প্রচলন, নাহু সরফের শিক্ষা গ্রহণ প্রভৃতি বিষয় ধর্মীয় বিষয় বলে মনে করা হয় না, তাই তা বিদ‘আত হওয়ার প্রশ্ন আসে না। এ ধরনের বিষয়গুলি বিদ‘আত নয় বরং সুন্নাতে হাসানাহ বলা যেতে পারে।
অনেকে এ বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বিদ‘আতকে দু’ভাগে ভাগ করার চেষ্টা করেন। বিদ‘আতে হাসানাহ ও বিদ‘আতে সাইয়্যেআহ। সত্যি কথা হল বিদ‘আতকে এভাবে ভাগ করাটা হল আরেকটি বিদ‘আত এবং তা হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিপন্থী।
কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ
إياكم ومحدثات الأمور، فإن كل محدثة بدعة وكل بدعة ضلالة. (رواه أبو داود والترمذي وابن ماجه والبيهقي في السنن عن العرباض بن سارية.)
অর্থ ঃ সকল নব-আবিস্কৃত (দীনের মধ্যে) বিষয় হতে সাবধান! কেননা প্রত্যেকটি নব-আবিস্কৃত বিষয় বিদ‘আত, আর প্রত্যেকটি বিদ‘আত হল পথভ্রষ্টতা। (আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও বাইহাকী)
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন সকল প্রকার বিদ‘আত ভ্রষ্টতা। এখন যদি বলা হয় কোন কোন বিদ‘আত আছে যা হাসানাহ বা উত্তম, তাহলে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ হাদীসবিরোধী হয়ে যায়। তাই তো ইমাম মালিক (রঃ) বলেছেন ঃ
من ابتدع فى الإسلام بدعة يراها حسنة فقد زعم أن محمدا صلى الله عليه وسلم خان الرسالة، فإن الله سبحانه وتعالى يقول (اليوم أكملت لكم دينكم) فما لم يكن يومئذ دينا فلا يكون اليوم دينا.
অর্থ ঃ যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে কোন বিদ‘আতের প্রচলন করে আর ইহাকে হাসানাহ বা ভাল বলে মনে করে, সে যেন প্রকারান্তরে এ বিশ্বাস পোষণ করে যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর পয়গাম পৌছাতে খিয়ানাত করেছেন। কারণ আল্লাহ তা‘আলা নিজেই বলেন ঃ ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূর্ণ করে দিলাম।’ সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে যা ধর্ম রূপে গণ্য ছিল না আজও তা ধর্ম বলে গণ্য হতে পারে না।
তাই বিদ‘আতে হাসানাহ বলে কোন কিছু নেই। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বলেছেন আমরা তাই বলব; সকল প্রকার বিদ‘আত গোমরাহী ও ভ্রষ্টতা।
বিদ‘আতে হাসানায় বিশ্বাসীরা যা কিছু বিদ‘আতে হাসানাহ হিসাবে দেখাতে চান সেগুলো হয়ত শাব্দিক অর্থে বিদ‘আত, শরয়ী অর্থে নয় অথবা সেগুলো সুন্নাতে হাসানাহ। যে সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ
من سن فى الإسلام سنة حسنة فله أجرها وأجر من عمل بها بعده من غير أن ينقص من أجورهم شيء، ومن سن في الإسلام سنة سيئة فله وزرها ووزر من عمل بها من بعده من غير أن ينقص من أوزارهم شيء. (رواه مسلم عن جرير بن عبد الله رضي الله عنهما)
অর্থ ঃ যে ইসলামে কোন ভাল পদ্ধতি প্রচলন করল সে উহার সওয়াব পাবে এবং সেই পদ্ধতি অনুযায়ী যারা কাজ করবে তাদের সওয়াবও সে পাবে, তাতে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামে কোন খারাপ পদ্ধতি প্রবর্তন করবে সে উহার পাপ বহন করবে, এবং যারা সেই পদ্ধতি অনুসরণ করবে তাদের পাপও সে বহন করবে, তাতে তাদের পাপের কোন কমতি হবে না। (মুসলিম)
এখানে একটা প্রশ্ন হতে পারে যে, শবে বরাত উদযাপন, মীলাদ মাহফিল, মীলাদুন্নবী প্রভৃতি আচার-অনুষ্ঠানকে কি সুন্নাতে হাসানাহ হিসাবে গণ্য করা যায় না? মাইকে আজান দেয়া, মাদ্রাসার পদ্ধতি প্রচলন, আরবী ব্যাকরণ শিক্ষা ইত্যাদি কাজগুলো যদি সুন্নাতে হাসানাহ হিসাবে ধরা হয় তাহলে শবে বরাত, মীলাদ ইত্যাদিকে কেন সুন্নতে হাসানাহ হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না?
পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, বিদ‘আত হবে ধর্মীয় ক্ষেত্রে। যদি নতুন কাজটি ধর্মের অংশ মনে করে অথবা সওয়াব লাভের আশায় করা হয়, তাহলে তা বিদ‘আত হওয়ার প্রশ্ন আসে। আর যদি কাজটি ধর্মীয় হিসাবে নয় বরং একটা পদ্ধতি হিসাবে করা হয় তাহলে তা বিদ‘আত হওয়ার প্রশ্ন আসে না। যেমন ধরুন মাইকে আজান দেয়া। কেহ মনে করেনা যে, মাইকে আজান দিলে সওয়াব বেশী হয় অথবা মাইক ছাড়া আজান দিলে সওয়াব হবে না। তাই সালাত ও আজানের ক্ষেত্রে মাইক ব্যবহারকে বিদ‘আত বলা যায় না।
তাই বলতে হয় বিদ‘আত ও সুন্নাতে হাসানার মধ্যে পার্থক্য এখানেই যে, কোন কোন নতুন কাজ ধর্মীয় ও সওয়াব লাভের নিয়াত হিসাবে করা হয় আবার কোন কোন নতুন কাজ দ্বীনি কাজ ও সওয়াবের নিয়াতে করা হয় না বরং সংশ্লিষ্ট কাজটি সহজে সম্পাদন করার জন্য একটা নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়।
যেমন আমরা যদি ইতিপূর্বে উল্লিখিত হাদীসটির প্রেক্ষাপটের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, একবার মুদার গোত্রের কতিপয় অনাহারী ও অভাবগ্রস্থ লোক আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এলো। তিনি সালাত আদায়ের পর তাদের জন্য উপস্থিত লোকজনের কাছে সাহায্য চাইলেন। সকলে এতে ব্যাপকভাবে সাড়া দিলেন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কিরামের আগ্রহ ও খাদ্য সামগ্রী দান করার পদ্ধতি দেখে উল্লিখিত কথাগুলি বললেন।
অভাবগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য যে পদ্ধতি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে ওটাকে সুন্নাতে হাসানাহ বলা হয়েছে।
বলা যেতে পারে, সকল পদ্ধতি যদি হাসানাহ হয় তাহলে সুন্নাতে সাইয়্যেআহ বলতে কি বুঝাবে?
উত্তরে বলব, মনে করুন কোন দেশের শাসক বা জনগণ প্রচলন করে দিল যে এখন থেকে স্থানীয় ভাষায় আজান দেয়া হবে, আরবী ভাষায় দেয়া চলবে না। এ অনুযায়ী ‘আমল করা শুরু হল। এটাকে আপনি কি বলবেন? বিদ‘আত বলতে পারবেন না, কারণ যারা এ কাজটা করল তারা সকলে জানে অনারবী ভাষায় আজান দেয়া ধর্মের নির্দেশ নয় এবং এতে সওয়াবও নেই। তাই আপনি এ কাজটাকে সুন্নাতে সাইয়্যেআহ হিসাবে অভিহিত করবেন। এর প্রচলনকারী পাপের শাস্তি প্রাপ্ত হবে, আর যারা ‘আমল করবে তারাও।
আবার অনেক উলামায়ে কিরাম বিদ‘আতকে অন্যভাবে দু ভাগে ভাগ করে থাকেন। তারা বলেন বিদ‘আত দু প্রকার। একটা হল বিদ‘আত ফিদ্দীন (البدعة في الدين) বা ধর্মের ভিতর বিদ‘আত। অন্যটা হল বিদ‘আত লিদ্দীন (البدعة للدين) অর্থাৎ ধর্মের জন্য বিদ‘আত। প্রথমটি প্রত্যাখ্যাত আর অন্যটি গ্রহণযোগ্য।
আমার মতে এ ধরণের ভাগ নি¯প্রয়োজন, বরং বিভ্রান্তি সৃষ্টিতে সহায়ক। কারণ প্রথমতঃ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন সকল বিদ‘আত পথভ্রষ্টতা বা গোমরাহী। এতে উভয় প্রকার বিদ‘আত শামিল।
দ্বিতীয়তঃ অনেকে বিদ‘আত ফিদ্দীন করে বলবেন, আমি যা করেছি তা হল বিদ‘আত লিদ্দীন। যেমন কেহ মীলাদ পড়লেন। অতঃপর যারা এর প্রতিবাদ করলেন তাদের সাথে তর্কে লিপ্ত হয়ে অনেক দূর যেয়ে বললেন, মীলাদ পড়া হল বিদ‘আত লিদ্দীন। এর দ্বারা মানুষকে ইসলামের পথে ডাকা যায়।
আসলে যা বিদ‘আত লিদ্দীন বা দ্বীনের স্বার্থে বিদ‘আত তা শরীয়তের পরিভাষায় বিদ‘আতের মধ্যে গণ্য করা যায় না। সেগুলোকে সুন্নাতে হাসানাহ হিসাবে গণ্য করাটাই হাদীসে রাসূল দ্বারা সমর্থিত।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! বিদ‘আত সম্পর্কে এ কথাগুলো এখানে এ জন্য আলোচনা করলাম যাতে আলোচ্য বিষয়ের উপর কোন প্রশ্ন বা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হলে তার সমাধান যেন পাঠকবৃন্দ সহজে অনুধাবন করতে পারেন।
বিদ‘আতের কুফল
এমন অনেকের সাক্ষাত পাবেন যারা ইসলামী চেতনায় সমৃদ্ধ। কিন্তু বলেন, বিদ‘আতের বিরোধিতায় এত বাড়াবাড়ির কি দরকার? কেহ একটু মীলাদ পড়লে, কুলখানি বা চল্লিশা-চেহলাম পালন কিংবা এ জাতীয় কিছু করলে দ্বীন ইসলামের কি এমন ক্ষতি হয়ে যায়?
আমি একদিন এক মাসজিদের ইমাম সাহেবের বক্তব্য শুনছিলাম। তিনি বলছিলেন শবে মিরাজ উপলক্ষ্যে এ রাতে কোন বিশেষ সালাত, ইবাদাত-বন্দেগী বা সিয়াম নেই। যদি শবে মিরাজ উপলক্ষ্যে কোন ‘আমল করা হয় তা বিদ‘আত হিসাবেই গণ্য হবে।
তার এ বক্তব্য শেষ হতে না হতেই কয়েকজন শিক্ষিত শ্রেণীর মুসল্লী বলে উঠলেন, হুজুর এ কি বলেন! রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুহাব্বতে এ রাতে কিছু করলে বিদ‘আত হবে কেন? প্রশ্নকারী লোকগুলো যে বিভ্রান্ত বা বিদ‘আতপন্থী তা কিন্তু নয়। তাদের খারাপ কোন উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু তারা যা করার ইচ্ছা করেছেন, উহার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই।
অবশ্যই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুহব্বত ঈমানের অঙ্গ। আর সব ধরনের মুহাব্বতেই আবেগ থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুহব্বতেও থাকবে। কিন্তু সেই আবেগ যেন মুহব্বতের নীতিমালা লংঘন না করে। সেই আবেগভরা মুহাব্বত যেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ ও সুন্নাহর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত না হয়। যদি এমনটি হয় তাহলে বুঝতে হবে যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুহাব্বতের নামে শয়তান তাকে ধোকায় ফেলেছে।
এ কথাতো মুসলিমদের কাছে দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, খৃষ্টানরা বিদ‘আতী কাজ-কর্ম করে ও তাদের নবীর মুহব্বতে বাড়াবাড়ি করে পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। এ কথা যেমন আল-কুরআনে এসেছে, তেমনি হাদীসেও আলোচনা করা হয়েছে। আমি অতি সংক্ষেপে এখানে বিদ‘আতের কতিপয় পরিণাম সম্পর্কে আলোচনা করছি যার অধিকাংশ شرح رياض الصالحين من كلام سيد المرسلين، للشيخ محمد بن صالح العثيمين- رحمه الله নামক কিতাব থেকে নেয়া হয়েছে।
(১) বিদআত মানুষকে পথভ্রষ্ট করে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা উম্মতের জন্য নিয়ে এসেছেন তা হল হক্ক। এ ছাড়া যা কিছু ধর্মীয় আচার হিসাবে পালিত হবে তা পথভ্রষ্টতা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন ঃ
فماذَا بَعْدَ الْحَقِّ إِلَّا الضَّلَالُ (يونس : ৩২)
অর্থ ঃ হক আসার পর বিভ্রান্তি ব্যতীত আর কি থাকে? (সূরা ইউনূস, ৩২)
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ
كل بدعة ضلالة.
অর্থ ঃ সকল ধরনের বিদ‘আত পথভ্রষ্টতা। (মুসলিম, ইবনে মাজাহ)
(২) বিদ‘আত রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য থেকে মানুষকে বের করে দেয় এবং সুন্নাতের বিলুপ্তি ঘটায়।
কেননা বিদ‘আত অনুযায়ী কেউ ‘আমল করলে অবশ্যই সে এক বা একাধিক সুন্নাত পরিত্যাগ করে। উলামায়ে কিরাম বলেছেন ঃ “যখন কোন দল সমাজে একটা বিদ‘আতের প্রচলন করে, তখন সমাজ থেকে কম করে হলেও একটি সুন্নাত বিলুপ্ত হয়ে যায়।”
আর এটা অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত যে, যখনই কোন বিদ‘আত ‘আমলে আনা হয়েছে তখনই সেই স্থান থেকে একটি সুন্নাত চলে গেছে বা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে মুজাদ্দিদ আলফেসানীর মাকতুবাত থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যায়। তিনি লিখেছেন ঃ এক ব্যক্তি আমাকে প্রশ্ন করল ‘আপনারা বলেছেন ঃ যে কোন বিদ‘আত নাকি একটি সুন্নাতকে বিলুপ্ত করে। আচ্ছা, যদি মৃত ব্যক্তিকে কাফনের সাথে একটি পাগড়ী পড়িয়ে দেয়া হয় তাহলে কোন সুন্নাতটি বিলুপ্ত হয়? কি কারণে এটা বিদ‘আত বলা হবে?’ আমি জবাবে লিখলাম ঃ অবশ্যই একটি সুন্নাত বিলুপ্ত হয় যদি মৃতের কাফনে পাগড়ী দেয়া হয়। কারণ পুরুষের কাফনের সুন্নাত হল কাপড়ের সংখ্যা হবে তিন। পাগড়ী পড়ালে এ সংখ্যা আর ‘তিন’ থাকেনা, সংখ্যা দাড়ায় ‘চার।’
উদাহরণ হিসাবে আরো বলা যায়, এক ব্যক্তি ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ল। ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। এ সমস্যার জন্য এক পীর সাহেবের কাছে গেল। পীর সাহেব তাকে বললেন, তুমি এক খতম কুরআন বখশে দাও অথবা নির্দেশ দিলেন একটা মীলাদ দাও বা খতমে ইউনূসের ব্যবস্থা কর। সে তাই করল। ফলাফল কি দাড়াল? ঋণ পরিশোধে অক্ষম ব্যক্তির জন্য একটি দু‘আ রয়েছে যা ‘আমল করা সুন্নাত। বিদ‘আত অনুযায়ী ‘আমল করার কারণে সে সেই সুন্নাতটি পরিত্যাগ করল। জানার চেষ্টা করলনা যে, এ ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি ব্যবস্থা দিয়ে গেছেন। অন্যদিকে সে মিলাদ, কুরআন খতম ইত্যাদি বিদ‘আতী কাজ করে আরও আর্থিক ঋণভারে জর্জরিত হলো।
রামাযানের শেষ দশ দিনের রাতসমূহে রাত জেগে ইবাদাত-বন্দেগী করা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত, যা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু ১৫ শাবানে রাত জাগাকে যেমন গুরুত্ব দেয়া হয় তেমনভাবে এ সুন্নাতী ‘আমলের প্রচলন দেখা যায় না। বরং শবে কদরের মূল্যায়ন শবে বরাতকে করা হচ্ছে।
ফরয সালাত আদায়ের পর সর্বদা জামাতবদ্ধ হয়ে মুনাজাত করা একটি বিদ‘আত। এটা ‘আমল করার কারণে ফরয সালাত আদায়ের পর যে সকল যিক্র-আযকার সুন্নাত হিসাবে বর্ণিত আছে তা পরিত্যাগ করা হয়।
আপনি দেখবেন এভাবে প্রতিটি বিদ‘আত একটি সুন্নাতকে অপসারিত করে উহার স্থান দখল করে নিয়েছে।
(৩) বিদ‘আত আল্লাহর দ্বীনকে বিকৃত করে।
এর জ্বলন্ত উদাহরণ আজকের খৃষ্টান ধর্ম। তারা ধর্মে বিদ‘আত প্রচলন করতে করতে উহার মূল কাঠামো পরিবর্তন করে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে পথভ্রষ্ট হিসাবে অভিহিত হয়েছে। তাদের বিদ‘আত প্রচলনের কথা আল-কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে ঃ
وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ إِلَّا ابْتِغَاءَ رِضْوَانِ اللَّهِ (سورةالحديد: ২৭)
অর্থ ঃ আর সন্ন্যাসবাদ! ইহাতো তারা নিজেরাই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় প্রচলন করেছিল। আমি তাদের এ বিধান দেইনি। (সূরা হাদীদ. ২৭)
সন্ন্যাস তথা বৈরাগ্যবাদের বিদ‘আত খৃষ্টানেরা তাদের ধর্মে প্রবর্তন করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ভাল ছিল; উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি। কিন্তু ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে নিজেদের ইচ্ছামত যে কোন কাজ করলেই তা গ্রহণযোগ্য হয় না। এ জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুমোদন প্রয়োজন। এভাবে যারা ধর্মে বিদ‘আতের প্রচলন করে তাদের অনেকেরই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভাল থাকে। কিন্তু তাতে নাজাত পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। ইয়াহুদী ও খৃষ্টানেরা তাদের ধর্মে অন্য জাতির রসম-রেওয়াজ ও বিদ‘আত প্রচলন করে ধর্মকে এমন বিকৃত করেছে যে, তাদের নবীগণ যদি আবার পৃথিবীতে ফিরে আসেন তাহলে তাদের রেখে যাওয়া ধর্ম তাঁরা নিজেরাই চিনতে পারবেন না।
আমাদের মুসলিম সমাজে শিয়া স¤প্রদায় বিদ‘আতের প্রচলন করে দ্বীন ইসলামকে কিভাবে বিকৃত করেছে তা নতুন করে বর্ণনা করার প্রয়োজন নেই।
(৪) বিদ‘আত ইসলামের উপর একটি আঘাত।
যে ইসলামে কোন বিদ‘আতের প্রচলন করল সে মূলতঃ অজ্ঞ লোকদের মত এ কথা স্বীকার করে নিল যে, ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন বিধান নয়, তাতে সংযোজনের প্রয়োজন আছে। যদিও সে মুখে এ ধরনের বক্তব্য দেয় না, কিন্তু তার কাজ এ কথার স্বাক্ষী দেয়। অথচ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন ঃ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। (সূরা মায়িদা, ৩)
(৫) বিদ‘আত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে খিয়ানাতের এক ধরনের অভিযোগ।
যে ব্যক্তি কোন বিদ‘আতের প্রচলন করল বা ‘আমল করল আপনি তাকে জিজ্ঞেস করুন “এ কথা বা কাজটি যে ইসলাম ধর্মে পছন্দের বিষয় এটা কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানতেন? তিনি উত্তরে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ বলবেন। যদি ‘না’ বলেন তাহলে তিনি স্বীকার করে নিলেন যে, ইসলাম সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কম জানতেন। আর যদি ‘হ্যাঁ’ বলেন তাহলে তিনি স্বীকার করে নিলেন যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিষয়টি জানতেন, কিন্তু উম্মাতের মধ্যে প্রচার করেননি। এ অবস্থায় তিনি তাবলীগে শিথিলতা করেছেন। (নাউ‘যুবিল্লাহ!)
(৬) বিদ‘আত মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করে ও ঐক্য সংহতিতে আঘাত করে।
বিদ‘আত মুসলিম উম্মাহর মধ্যে শত্র“তা ও বিবাদ-বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে তাদের মারামারি হানাহানিতে লিপ্ত করে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, একদল লোক মীলাদ বা মীলাদুন্নবী পালন করল। আরেক দল বিদ‘আত হওয়ায় তা বর্জন বা বিরোধিতা করল। যারা এটা পালন করল তারা প্রচার করতে লাগল যে, অমুক দল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিনে আনন্দিত হওয়া পছন্দ করে না। তাঁর গুণ-গান করা তাদের কাছে ভাল লাগেনা। তাদের অন্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুহাব্বত নেই। যাদের অন্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুহাব্বত নেই তারা বেঈমান, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুশমন। আর এ ধরনের প্রচারনায় তারা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে একে অপরের দুশমনে পরিণত হয়ে হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে পড়ল।
এভাবে ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই বিদ‘আতকে গ্রহণ ও বর্জনের প্রশ্নে মুসলিম উম্মাহ শিয়া ও সুন্নী এবং পরবর্তী কালে আরো শত দলে বিভক্ত হয়ে গেল। কত প্রাণহানির ঘটনা ঘটল, রক্তপাত হল।
তাই মুসলিম উম্মাহকে আবার একত্র করতে হলে সকলকে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে আহ্বান ও বিদ‘আত বর্জনের জন্য অহিংস ও শান্তিপূর্ণ পন্থায় পরম ধৈর্যের সাথে আন্দোলন করতে হবে। আন্দোলন করতে হবে সকল মানুষ ও মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা প্রদর্শন করে । কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন আচরণ করা যাবে না। এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, যা হক ও সত্য তা-ই শুধু টিকে থাকবে। আর যা বাতিল তা দেরীতে হলেও বিলুপ্ত হবে।
(৭) বিদ‘আত ‘আমলকারীর তাওবা করার সুযোগ হয় না।
বিদ‘আত যিনি প্রচলন করেন বা সেই অনুযায়ী ‘আমল করেন তিনি এটাকে এক মহৎ কাজ বলে মনে করেন। তিনি মনে করেন এ কাজে আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্ট হবেন। যেমন আল্লাহ খৃষ্টানদের সম্পর্কে বলেছেন তারা ধর্মে বৈরাগ্যবাদের বিদ‘আত চালু করেছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। যেহেতু বিদ‘আতে লিপ্ত ব্যক্তি বিদ‘আতকে পাপের কাজ মনে করেন না, তাই তিনি এ কাজ থেকে তাওবা করার প্রয়োজন মনে করেন না এবং তাওবা করার সুযোগও হয় না। অন্যান্য পাপের বেলায় কমপক্ষে যিনি পাপে লিপ্ত হন তিনি এটাকে অন্যায় মনে করেই করেন। পরবর্তীতে তার অনুশোচনা আসে, এক সময় তাওবা করে আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমা লাভ করেন। কিন্তু বিদ‘আতে লিপ্ত ব্যক্তির এ অবস্থা কখনো হয় না।
(৮) বিদ‘আত প্রচলনকারী রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফাআত পাবে না।
রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর গুনাহগার উম্মাতের শাফায়াতের ব্যাপারে হাশরের ময়দানে খুব আগ্রহী হবেন । আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে অনুমতি লাভ করার পর তিনি বহু গুনাহগার বান্দা-যাদের জন্য শাফাআত করতে আল্লাহ তা‘আলা অনুমতি দিবেন-তাদের জন্য শাফাআত করবেন। কিন্তু বিদ‘আত প্রচলনকারীর জন্য তিনি শাফাআত করবেন না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ
ألا وإني فرطكم على الحوض وأكاثر بكم الأمم فلا تسودوا وجهي، ألا وإني مستنقذ أناسا ومستنقذ مني أناس، فأقول يا رب أصيحابي! فيقول إنك لا تدري ما أحدثوا بعدك. (رواه ابن ماجه، وصححه الألباني في صحيح سنن ابن ماجه)
অর্থ ঃ শুনে রেখ! হাউজে কাউছারের কাছে তোমাদের সাথে আমার দেখা হবে। তোমাদের সংখ্যার আধিক্য নিয়ে আমি গর্ব করব। সেই দিন তোমরা আমার চেহারা মলিন করে দিওনা। জেনে রেখ! আমি সেদিন অনেক মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করার চেষ্টা চালাব। কিন্তু তাদের অনেককে আমার থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া হবে। আমি বলব ঃ হে আমার প্রতিপালক! তারা তো আমার প্রিয় সাথী-সংগী, আমার অনুসারী। কেন তাদের দূরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে? তিনি উত্তর দিবেন ঃ আপনি জানেন না যে, আপনার চলে আসার পর তারা ধর্মের মধ্যে কি কি নতুন বিষয় আবিস্কার করেছে। (ইবনে মাজাহ)
অন্য এক বর্ণনায় আছে এর পর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই তাদের উদ্দেশে বলবেন ঃ দূর হও! দূর হও!!
(৯) বিদ‘আত মুসলিম সমাজে কুরআন ও হাদীসের গুরুত্ব কমিয়ে দেয়।
কুরআন ও সুন্নাহ হল মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামের রক্ষা কবচ। ইসলাম ধর্মের অস্তিত্বের একমাত্র উপাদান। তাইতো বিদায় হজ্বেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি যতক্ষণ তোমরা তা আঁকড়ে রাখবে ততক্ষণ বিভ্রান্ত হবে না।
বিদ‘আত অনুযায়ী ‘আমল করলে কুরআন ও সুন্নাহর মর্যাদা মানুষের অন্তর থেকে কমে যায়। ‘যে কোন নেক ‘আমল কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে’ - এ অনুভূতি মানুষের অন্তর থেকে ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে। তারা কুরআন ও হাদীসের উদ্ধৃতি বাদ দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি, পীর-মাশায়েখ ও ইমামদের উদ্ধৃতি দিয়ে থাকে।
(১০) বিদ‘আত প্রচলনকারী অহংকারের দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ে ও নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে দ্বীনকে ব্যবহার ও বিকৃত করতে চেষ্টা করে।
বিদ‘আত প্রচলনকারী তার নিজ দলের একটি আলাদা কাঠামো দাঁড় করিয়ে ব্যবসায়িক বা আর্থিক সুবিধা লাভের জন্য এমন কাজের প্রচলন করে থাকে যা সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মীয় রূপ লাভ করলেও কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা সমর্থিত হয় না। কারণ সেই কাজটা যদি কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা সমর্থিত হয় তাহলে তার দলের আলাদা কোন বৈশিষ্ট থাকে না। কেননা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত ‘আমল সকল মুসলিমের জন্যই প্রযোজ্য। তাই সে এমন কিছু আবিস্কার করতে চায় যার মাধ্যমে তার দলের আলাদা পরিচয় প্রতিষ্ঠা করা যায়।
এ অবস্থায় যখন হাক্কানী উলামায়ে কিরামগণ এর প্রতিবাদ করেন বা এ কাজটি চ্যালেঞ্জ করেন তখন তার ঔদ্ধত্য বেড়ে যায়। নিজেকে সে কুতুবুল আলম, ইমাম-সম্রাট, হাদীয়ে উম্মাত, রাহবারে মিল্লাত, যিল্লুর রহমান বলে দাবী করতে থাকে। প্রচার করতে থাকে এ দুনিয়ায় সে’ই একমাত্র হক পথে আছে, বাকী সবাই ভ্রান্ত।
সন্দেহজনক নফল ‘আমল থেকে দূরে থাকা উত্তম
যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেই যে, শবে বরাত শর’য়ীভাবে প্রমাণিত, তাহলে উহার মর্যাদা কতটুকু হবে? বেশী হলে মুস্তাহাব। কেহ যদি সারা জীবন মুস্তাহাব শবে বরাতটা বর্জন করে তাহলে তার কি ক্ষতি হবে?
কিন্তু যদি এটা বিদ‘আত হয়, আর যারা এর দিকে মানুষকে আহ্বান করল, উৎসাহিত করল, মানুষকে বিভ্রান্ত হতে প্ররোচিত করল, আকীদা-বিশ্বাসে বিকৃতি ঘটালো, এর প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রাখল তাহলে তাদের পরিণাম কি হবে? একটু ভেবে দেখবেন কি?
ফিকাহর মূলনীতিতে একটি কথা আছে, “নতীজা আরজালের তাবে হয়” অন্যভাবে বলা যায় ঃ
دفع المضر أقدم من جلب المنافع.
অর্থাৎ একটা বিষয় লাভ ও ক্ষতি উভয়ের সম্ভাবনা থাকলে ক্ষতির বিষয়টি প্রাধান্য পাবে এবং বিবেচনায় আনা হবে।
হাদীসে এসেছে ঃ
عن أبي عبد الله النعمان بن بشير رضي الله عنهما قال: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: إن الحلال بين وإن الحرام بين وبينهما أمور مشتبهات لا يعلمهن كثير من الناس، فمن اتقى الشبهات فقد استبرأ لدينه وعرضه، ومن وقع في الشبهات وقع في الحرام، كالراعي يرعى حول الحمى يوشك أن يرتع فيه، ألا وإن لكل ملك حمى، ألا وإن حمى الله محارمه. (رواه البخاري ومسلم)
অর্থ ঃ আবূ আব্দুল্লাহ নুমান ইবনে বাশীর (রাঃ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনেছি ঃ নিশ্চয়ই হালাল স্পষ্ট করে বলা হয়েছে ও হারাম পরিস্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আর এ দুটোর মাঝে কিছু সন্দেহজনক বিষয় আছে যা অনেক মানুষই জানে না। সুতরাং যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বিষয় থেকে বেঁচে থাকল সে নিজের দ্বীন ও ইয্যাত আবরুকে বাঁচাল। আর যে সন্দেহজনক বিষয়ে লিপ্ত হয় সে প্রকারান্তরে হারামে লিপ্ত হয়ে পড়ল। যেমন কোন রাখাল যদি তার গবাদিপশু নিষিদ্ধ চারণভূমির পাশে নিয়ে যায় তাহলে তার অচিরেই নিষিদ্ধ চারণভূমিতে ঢুকে যাওয়ার আশংকা থাকে। তোমরা সাবধানতা অবলম্বন কর! প্রত্যেক রাজা-বাদশার সংরক্ষিত এলাকা রয়েছে, আর আল্লাহ তা‘আলার সংরক্ষিত এলাকা হল তাঁর নিষিদ্ধ বিষয়সমুহ। (বুখারী ও মুসলিম)
সর্বশেষ আহ্বান
উপরোক্ত আলোচনার শেষ কথা হল, শবে বরাত একটি বিদ‘আতী পর্ব। অতএব আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সক্ষম হলাম যে ঃ
(১) এ রাতকে কেন্দ্র করে কোন ধরনের ‘আমল করার সমর্থনে কোন সহীহ হাদীস নেই।
(২) এ রাত সম্পর্কে যা কিছু আকীদাহ বিশ্বাস প্রচলিত আছে তা পোষণ করা জায়েয নয়।
(৩) এ রাতে ইবাদাত বন্দেগী করলে সৌভাগ্য খুলে যায় এমন ধারণা একটি বাতিল আকীদাহ।
(৪) এ রাতে হায়াত, মউত ও রিয্ক বন্টনের বিষয় লেখা হয় বলে যে বিশ্বাস তা কুরআন ও হাদীসের বিরোধী। তাই তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
(৫) এ রাতকে কেন্দ্র করে যেমন সম্মিলিতভাবে ইবাদাত বন্দেগী করা, রাত্রি জাগরণ করা ঠিক নয় তেমনি ব্যক্তিগত ইবাদাত বন্দেগী করাও ঠিক হবে না। তবে নিয়ম বা রুটিন মাফিক ইবাদাত বন্দেগীর কথা আলাদা। যেমন কেহ সপ্তাহের দু দিন রাত্রি জাগরণ করে থাকে। ঘটনাচক্রে এ রাত সেদিনের মধ্যে পড়লে অসুবিধা নেই। কিন্তু এ রাতে ইবাদাত-বন্দেগী করলে অধিক সওয়াব হবে এমন ধারণায় ব্যক্তিগতভাবে বা চুপিসারে কিছু করাও ঠিক হবে না।
(৬) ১৫ শাবানের রাতই দ‘ুআ কবূলের রাত নয়। বরং প্রতি রাতের শেষ অংশ দু‘আ কবূলের সময়।
(৭) শুধু ১৫ শাবানের রাতেই আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন প্রথম আকাশে অবতরণ করেন না, বরং প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে তিনি প্রথম আকাশে অবতরণ করে বান্দাদেরকে তাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য প্রার্থনা করতে আহ্বান জানান।
(৮) শবে বরাতের ‘আমল সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসগুলো কোনটা জাল, আবার কোনটা যয়ীফ বা দুর্বলসূত্রের।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! একটি বিষয় আপনারা অবশ্যই খেয়াল করে থাকবেন যে, মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যত ফিরকা বন্দী, দলাদলি ও অনৈক্যের জন্ম হয়েছে উহার প্রায় সবগুলোই কিন্তু বিদ‘আত চালু করাকে কেন্দ্র করে হয়েছে।
একদল লোক কোন একটা বিদ‘আতী কাজের ‘আমল শুরু করে দিল, অন্য একদল আলেম তার প্রতিবাদ করলেন। ব্যাস শুরু হল ফিরকাবাজী; শেষ পর্যন্ত মারামারি খুনাখুনি। অতঃপর ঐ বিদ‘আত-পন্থীদের আক্রোশ আরো বেড়ে গেল। তারা এ কাজটাকে তাদের দলের শ্লোগানে পরিণত করল। এরপর তারা এ তরবারি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করে মুসলিম উম্মাহর সুদৃঢ় বন্ধনকে রক্তাক্ত করতে থাকল। মুসলিমগণ হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে পড়ল। কেন তারা আল্লাহ তা’আলার হুকুমের প্রতি একটু খেয়াল করে না যেখানে তিনি বলেছেন ঃ
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
(سورة النساء : ৫৯)
অর্থ ঃ কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ হলে তা উপস্থাপিত কর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট। এটাই উত্তম ও পরিণামে উৎকৃষ্টতর। (সূরা নিসা, ৫৯)
অতএব এ রাত উদযাপন করা থেকে মানুষদেরকে নিষেধ করতে হবে। যে কোন ধরনের বিদ‘আতী কাজ থেকে মানুষকে সাধ্যমত বিরত রাখা ‘আল-আমর বিল-মারূফ ওয়ান নাহয়ি আনিল মুনকার’ এর অন্তর্ভুক্ত।
আর এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা পালন করতে পারেন মুহতারাম উলামায়ে কিরাম, শ্রদ্ধেয় আইয়েম্মায়ে মাসাজিদ, দায়ী‘গণ ও ইসলামী আন্দোলনে শরীক ব্যক্তিবর্গ।
সমস্ত প্রশংসা উভয় জাহানের মালিক আল্লাহর। তাঁর রাহমাত বর্ষিত হোক তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর, তাঁর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের) পরিবারবর্গ এবং সাহাবীগণের (রাঃ) উপর। আমীন!!! ওয়া আখিরুদ দাওয়ানা আনিল হামদুলিল্লাহি রাব্বিল ‘আলামিন।
এ আহ্বান রেখে এবং মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে সকল ব্যাপারে সকল ঈমানদারদের জন্য সত্য-সঠিক পথের দিশা প্রার্থনা করে শেষ করছি।
----------------------------------------------------------------------------------
'' শুধু নিজে শিক্ষিত হলে হবেনা, প্রথমে বিবেকটাকে শিক্ষিত করুন। ''
কোন মন্তব্য নেই:
/>