মতিঝিল গণহত্যা : সরকারি ভাষ্য বনাম প্রকৃত ঘটনা
মতিঝিলের শাপলা চত্বরে গত ৫ মে দিবাগত রাতের অন্ধকারে হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে জড়ো হওয়া ধর্মপ্রাণ আলেম ও নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের (যার একটি বড় অংশ বয়োবৃদ্ধ ও মাদরাসার শিশুছাত্র) ওপর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পুলিশ, র্যাব ও আধাসামরিক বাহিনী বিজিবির ১০ হাজার সদস্যের চালানো নৃশংস হত্যাযজ্ঞকে বিশ্ববাসী ‘গণহত্যা’ বলে আখ্যায়িত করলেও বাংলাদেশ সরকার তা বেমালুম অস্বীকার করছে! ঘটনার পরদিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মুখপাত্র ও দলের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দেন শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতকর্মীদের ওয়াশআউট অভিযানে কোনো ‘হতাহতে’র ঘটনা ঘটেনি।
নিহত হওয়া তো দূরের কথা, কেউ আহতও হয়নি। ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদও বুধবার সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেও কৌশলে আরেক জায়গায় প্রশ্নের জবাবে বললেন, ওইদিনের সংঘর্ষে নিহত ৪টি লাশ শাপলা চত্বরের মঞ্চের কাছ থেকে এবং আরও ৩টি লাশ ঘটনার পর তারা রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে এসেছেন ওই রাতে। ৫ মে দিনে সংঘর্ষের ঘটনায় আরও ৩ জন নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করেন তিনি। একজন পুলিশ ওই রাতে মারা যাওয়ারও কথা বলেন। ডিএমপি কমিশনার তথা সরকারের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য অনুযায়ী ৫ মে সকাল থেকে ৬ মে ভোর পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১১ জন নিহত হয়েছেন। অথচ সরকারের বশংবদ মিডিয়ায় (পর্যবেক্ষকদের মতে, দেশের মিডিয়ায় আগে যাও কিছু ছাপা হতো, এখন দৈনিক আমার দেশ এবং দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দেয়ার পর ভীত হয়ে সরকারি ভাষ্য ও ইচ্ছার বাইরে তেমন কিছু ছাপে না) সর্বনিম্ন যে সংখ্যাটি ছাপা হয়েছে, তাতে ওই সময় ২২ জনের মৃত্যু ও পরে ওই ঘটনায় আরও একজনসহ ২৩ জনের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে (সূত্র প্রথম আলো)। অবশ্য ৬ মে দিনের বেলায় ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর, সিদ্ধিরগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে, হাটহাজারী ও বাগেরহাটে হেফাজতকর্মীদের সঙ্গে পুলিশ ও সরকারি দলের ক্যাডারদের সংঘর্ষে আরও ২৮ জন নিহত হন। নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর তার রিপোর্টার ও সূত্রের বরাতে বলেছেন, শাপলা চত্বরে কমপক্ষে একশ’ লোক নিহত হয়েছেন। ওই রাতে পুলিশের সঙ্গে ফকিরাপুল পয়েন্ট থেকে শাপলা চত্বর হয়ে হাটখোলা পর্যন্ত ছিলেন এমন একজন ফটো সাংবাদিক জানিয়েছেন, তিনি ৫১ জনের বডি রাস্তায় ও বিভিন্ন ভবনের বারান্দায় পড়ে থাকতে দেখেছেন, যার অধিকাংশের ছবি তার কাছে রয়েছে। তবে অভিযান হয়েছে অনেকগুলো রাস্তা দিয়ে, বহু অলিগলিতে। সেসব জায়গায় কী হয়েছে তা তিনি দেখেননি। তার ভাষ্যমতে, অপারেশনের সময় লক্ষাধিক লোক শাপলা চত্বরে অবস্থান করছিল। এরমধ্যে শিশু ও বয়োবৃদ্ধ লোকেরাও ছিল, যাদের অনেকে পদদলিত হয়ে মারা গিয়ে থাকতে পারে।
প্রশ্ন উঠেছে, মতিঝেলে ব্ল্যাকআউট করে অপারেশন চালানো হলো কেন? সব মিডিয়াকে তাদের মতো করে কেন অপারেশন পরিচালনার ঘটনা কভার করতে দেয়া হলো না? অন্য অর্থে মিডিয়াকে বহিষ্কার করে কেন অপারশেন চালানো হলো? জলকামানের পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসের পানিবাহী গাড়ি এবং সর্বশেষ ওয়াসার অনেক পানিবাহী গাড়িকে মতিঝিলে দেখা গেছে। বিভিন্ন দালান ও রাস্তার রক্ত পরিষ্কারে এসব পানিবাহী গাড়ি ব্যবহার করতে দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক ও হেফাজতকর্মীদের বর্ণনা অনুযায়ী, যৌথবাহিনী ওইদিন রাত ৩টার দিকে শাপলা চত্বরের মূল মঞ্চ দখল করে নিলেও অভিযান চলেছে সকাল প্রায় ৬টা পর্যন্ত। মূল কিলিং হয়েছে দুই পর্যায়ে। হেফাজতকর্মীদের মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য অভিযান শুরুর পর মঞ্চ দখলের আগমুহূর্তে অর্থাত্ যে ১০ মিনিটের কথা বলা হয়েছে, তখন খুব কাছ থেকে সরাসরি হেফাজতকর্মীদের গুলি করা হয়। এতে অনেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ ঘটনার অবতারণা করে যৌথবাহিনী সফল হয়। সহকর্মীদের মাটিতে লুটিয়ে পড়ার দৃশ্য দেখে হেফাজতকর্মীরা ছোটাছুটি শুরু করেন। ১০ মিনিটেই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় সমাবেশ। দ্বিতীয় পর্যায়ে বড় কিলিংগুলো হয় সোনালী ব্যাংক ভবনের সিঁড়ি ও বারান্দা, বাংলাদেশ ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, ডিসিসিআই, আমিন মোহাম্মদ ভবন, পিপলস ইন্স্যুরেন্স ভবন, ইউনুস সেন্টার, সারা টাওয়ার, ঢাকা ব্যাংকসহ ওই এলাকার বিভিন্ন বড় বড় দালানের সিঁড়ি ও বারান্দায়। এসব স্থানে পলায়নপর হেফাজতকর্মীরা আশ্রয় নিয়েছিলেন। পুলিশ মাইকে ইত্তেফাক ও হাটখোলা ধরে যাত্রাবাড়ীর দিকে পালিয়ে যেতে বলেছিল। সে নির্দেশ তারা মানেননি। ভয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন—এই ছিল তাদের অপরাধ। অতিসম্প্রতি আমার দেশ থেকে অন্য পত্রিকায় যোগ দেয়া একজন সাংবাদিক ঘটনার সময় এ এলাকায় ছিলেন। তিনি জানান, বঙ্গভবনের আশপাশ এলাকায় দৌড়ে গিয়ে যারা আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদের অনেককে সরাসরি গুলি করে হত্যা করেছে পুলিশ। পুলিশ ভাবছিল, বঙ্গভবনে আক্রমণ করতে তারা সেদিকে যাচ্ছিল। রাজউক ভবনের আশপাশে তারা পুলিশের নৃশংসতার শিকার হয়। একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের আশপাশে যারা গিয়েছিল, তাদের ওপরও ব্যাপক গুলি চালিয়েছে পুলিশ। এতে অনেকে হতাহত হয়ে রাস্তায় পড়ে ছিল। ভবনগুলোতে যারা আশ্রয় নিতে গিয়েছিল, আক্রমণকারী ভেবে পুলিশ ও র্যাব তাদের ওপর গুলি চালিয়ে তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে গিয়েই বড় ধরনের হত্যাযজ্ঞ ঘটে গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, সরকারের তরফ থেকে মঞ্চ দখলের ১০ মিনিটের কিছু বর্ণনা ও হতাহতের কথা বলা হলেও তার আগে-পরে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের বিষয়টি চেপে যাওয়া হয়েছে।দুটি টিভি চ্যানেলের এমবেটেড জার্নালিস্টরা যৌথ বাহিনীর সঙ্গে থাকলেও তারা এসব দৃশ্য দেখাননি। এর মধ্যে সময় টিভির দীর্ঘ লাইভ সম্প্রচারে মাত্র দুজন হেফাজতকর্মীকে গুলি ও পরে পিটিয়ে মারার কয়েক সেকেন্ডের দৃশ্য দেখানো হয়। তাদের একাধিক ক্যামেরাম্যান ঘটনার দৃশ্য ধারণ করছিলেন। ফেরার পথেও অনেকের ওপর আক্রমণ হয়েছে। লালবাগে হেফাজতের অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও ৬ মে সকালে নিহত ও গুরুতর আহত শ’দুয়েক লোককে দেখা গেছে বলে পার্শ্ববর্তী একটি স্কুলের একজন শিক্ষক জানিয়েছেন। ঢাকা মেডিকেলে শ’পাঁচেক আহত লোক চিকিত্সা নিয়ে পুলিশের ভয়ে পালিয়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, আল-বারাকা হাসপাতালসহ মতিঝিলের আশপাশের হাসপাতালগুলোতে হতাহত বহু লোককে নেয়া হলেও পুলিশের হুমকিতে তারা নাম প্রকাশ করে বিস্তারিত বলতে অপারগতা জানিয়েছেন। সর্বোচ্চ তিন হাজার লোক নিহত ও নিখোঁজ থাকার কথা জানিয়েছে আয়োজক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে তারা লিখিত বিবৃতিতে এ সংখ্যা ২ হাজার বলেছিল। ৬ মে রাতেই সংশোধিত সংখ্যা ৩ হাজার বলে জানায়। বিএনপির পক্ষ থেকে ব্রিফিংয়ে বলা হয়েছে নিহতের সংখ্যা হাজারখানেক। কোনো কোনো নেতা বলেছেন দুই হাজার। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার শত শত নিহত ও নিখোঁজ হওয়ার কথা বলেছে। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বরাত দিয়ে নিহতের সংখ্যা আড়াই হাজার উল্লেখ করেছে। আমাদের দুজন ফটো সাংবাদিক ও দুজন রিপোর্টার ওইদিন রাতের অভিযান কাভার করতে চাইলেও যৌথবাহিনী তাদের পরিচয় জানার পর তাদের সহযোগী হতে বারণ করে। সময় টিভিতে আমরা সরাসরি অভিযানের অংশবিশেষ দেখেছি। দুজন হেফাজতকর্মীকে প্রথমে গুলি ও পরে পিটিয়ে মারার কয়েক মুহূর্তের দৃশ্য সময় টিভি দেখিয়েছে। বিভিন্ন ধরনের মারণাস্ত্রের গুলির আওয়াজও শুনিয়েছে। শটগানে ছোড়া রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ তো ছিলই।
গত মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে বিশ্বখ্যাত সাময়িকী দি ইকোনমিস্ট এবং ৬ মে এক বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন এ ঘটনাকে গণহত্যা (ম্যাসাকার) বলে উল্লেখ করে। এছাড়া ঘটনার পর তাত্ক্ষণিকভাবে সিএনএন, এএফপি, এপিসহ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোতে বহু হতাহতের খবর প্রচার ও প্রকাশ হয়।
বুধবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের ওপর যৌথবাহিনীর অভিযানে একজনও নিহত হননি বলে দাবি করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার বেনজীর আহমেদ! কন্ট্রোল রুম থেকে অভিযানটির নিয়ন্ত্রণকারী এ পুলিশ কর্মকর্তা আরও দাবি করেন, যৌথবাহিনী সেদিন কোনো ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র’ ব্যবহার করেনি।
তার হিসাবমতে, ৫ মে (রোববার) সকাল থেকে শুরু করে সোমবার রাতে ‘অপারেশন সিকিউরড শাপলা ওয়াচ’ সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত একজন পুলিশসহ মোট ১১ জন নিহত হন। বেনজীর আহমেদ বলেছেন, এই ১১ জনের কেউ অপারেশনের সময় নয়, রোববার দিনে ও অপারেশনের পরে তাদের বডি উদ্ধার করা হয়েছে। তবে সরকারের ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে গত ১ মে নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল সারওয়ার্দী সাভারে রানা প্লাজায় ওই মুহূর্তে নিখোঁজের সংখ্যা হঠাত্ কমবেশি ১৩শ’ থেকে নামিয়ে ১৪৯ জনে নিয়ে এসেছিলেন। ওই সময় পর্যন্ত মাত্র চারশ’র মতো মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছিল। জিওসি ১৪৯ জন বলার পর বিরোধীদলীয় নেতা লাশ গুমের অভিযোগ আনেন। অবশেষে জিওসির বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণ হয়ে আরও প্রায় পাঁচশ’ লাশ উদ্ধার হয়েছে। এখনও তিনটি তলায় উদ্ধার অভিযান বাকি রয়েছে। এই তিন তলায় এখনও বহু লাশ রয়েছে। বুধবার জিওসি দু-একদিনের মধ্যে অভিযান বন্ধ করে দেয়ার কথা বলেছেন। আগে বলেছিলেন, একটি লাশ থাকা পর্যন্ত তিনি অভিযান চালিয়ে যাবেন।
হেফাজত ওয়াশআউট শাপলা অভিযানে সাংবাদিকদের ক্যামেরায় ধরা পড়া ওই রাতের বেশকিছু ছবি এবং ভিডিও ফুটেজ, আহতদের সাক্ষাত্কার ও বিভিন্ন হাসপাতাল সূত্রের দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করলে ডিএমপি কমিশনারের দাবি জঘন্য মিথ্যাচার বলেই প্রতীয়মান হয়।
বুধবার সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদের দেয়া মূল বিষয়গুলো হলো—এক. রাত ২টা থেকে শুরু হয়ে মাত্র ১০ মিনিটে অপারেশন শেষ হয়। দুই. এ সময় বিভিন্ন ধরনের ‘নন-লেথাল অস্ত্র’ এবং ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস লজিস্টিক’ (সারা বিশ্বে স্বীকৃত বিক্ষোভ দমনের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি) ব্যবহার করা হয়। তিন. মিডিয়ার সামনে অপারেশন হয়েছে এবং দুটি টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করেছে। ‘দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দিয়ে অপারেশন চালানো হয়েছে বলে যে কথা বলা হচ্ছে, তা সত্য নয়’(!). চার. কম্পিউটারে ফটোশপ করে বানানো ছবি দিয়ে ইন্টারনেটে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। পাঁচ. হেফাজত পুলিশকে নিহতদের তালিকা দেয় না কেন? ছয়. সচিবালয়ে হামলা ও ব্যাংক লুটের পরিকল্পনা ছিল হেফাজতের। সাত. তিরিশ লাখ টাকা লুট, বায়তুল মোকাররম ও জুয়েলারি মার্কেটে আগুন দেয় হেফাজত।
সরকারের পক্ষে ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদের দেয়া বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার ব্যাপক ফারাক রয়েছে। প্রথমত, নিহতের সংখ্যা নিয়ে তিনি জঘন্য মিথ্যাচার করেছেন। তিনি বলেছেন, অপারেশনের সময় কেউ নিহত হয়নি; কিন্তু হেফাজতের কট্টর সমালোচক প্রথম আলো পত্রিকাও পরদিন তাদের প্রথম পাতায় অপারেশনে ১১ জন নিহতের খবর জানায়! ‘রোববারের সংঘর্ষ ও অভিযান : এক পুলিশসহ নিহত ২২’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে প্রথম আলো বলেছে, ‘২২টি লাশের মধ্যে ১১টি সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে ও মর্গে গেছে সোমবার ভোরের দিকে। ধারণা করা হচ্ছে, রোববার গভীর রাতে মতিঝিল শাপলা চত্বরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের সময় তারা নিহত হয়েছেন। বাকি ১১ জনের লাশ রোববার দুপুর থেকে মধ্যরাতের মধ্যে এসেছে।’ একুশে টিভি ৬ মে ভোর ৪টার খবরে তখন পর্যন্ত ৫ জন নিহত হওয়ার ও অর্ধশতাধিক গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর দিয়েছিল। তার ২০ মিনিটের মাথায় দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভিতে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত হয়ে সম্প্রচার বন্ধ করে দিলে একুশে টিভিসহ শাপলা চত্বর অভিযানে হতাহতের খবর প্রচার বন্ধ করে দেয়। দিগন্ত টিভি বন্ধ করার আগে প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে শত শত লোক হতাহত হওয়ার কথা প্রচার করা হয়েছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক ও হেফাজতকর্মীদের বর্ণনা অনুযায়ী, যৌথবাহিনী ওইদিন রাত ৩টার দিকে শাপলা চত্বরের মূল মঞ্চ দখল করে নিলেও অভিযান চলেছে সকাল প্রায় ৬টা পর্যন্ত। মূল কিলিং হয়েছে দুই পর্যায়ে। হেফাজতকর্মীদের মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য অভিযান শুরুর পর মঞ্চ দখলের আগমুহূর্তে অর্থাত্ যে ১০ মিনিটের কথা বলা হয়েছে, তখন খুব কাছ থেকে সরাসরি হেফাজতকর্মীদের গুলি করা হয়। এতে অনেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ ঘটনার অবতারণা করে যৌথবাহিনী সফল হয়। সহকর্মীদের মাটিতে লুটিয়ে পড়ার দৃশ্য দেখে হেফাজতকর্মীরা ছোটাছুটি শুরু করেন। ১০ মিনিটেই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় সমাবেশ। দ্বিতীয় পর্যায়ে বড় কিলিংগুলো হয় সোনালী ব্যাংক ভবনের সিঁড়ি ও বারান্দা, বাংলাদেশ ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, ডিসিসিআই, আমিন মোহাম্মদ ভবন, পিপলস ইন্স্যুরেন্স ভবন, ইউনুস সেন্টার, সারা টাওয়ার, ঢাকা ব্যাংকসহ ওই এলাকার বিভিন্ন বড় বড় দালানের সিঁড়ি ও বারান্দায়। এসব স্থানে পলায়নপর হেফাজতকর্মীরা আশ্রয় নিয়েছিলেন। পুলিশ মাইকে ইত্তেফাক ও হাটখোলা ধরে যাত্রাবাড়ীর দিকে পালিয়ে যেতে বলেছিল। সে নির্দেশ তারা মানেননি। ভয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন—এই ছিল তাদের অপরাধ। অতিসম্প্রতি আমার দেশ থেকে অন্য পত্রিকায় যোগ দেয়া একজন সাংবাদিক ঘটনার সময় এ এলাকায় ছিলেন। তিনি জানান, বঙ্গভবনের আশপাশ এলাকায় দৌড়ে গিয়ে যারা আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদের অনেককে সরাসরি গুলি করে হত্যা করেছে পুলিশ। পুলিশ ভাবছিল, বঙ্গভবনে আক্রমণ করতে তারা সেদিকে যাচ্ছিল। রাজউক ভবনের আশপাশে তারা পুলিশের নৃশংসতার শিকার হয়। একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের আশপাশে যারা গিয়েছিল, তাদের ওপরও ব্যাপক গুলি চালিয়েছে পুলিশ। এতে অনেকে হতাহত হয়ে রাস্তায় পড়ে ছিল। ভবনগুলোতে যারা আশ্রয় নিতে গিয়েছিল, আক্রমণকারী ভেবে পুলিশ ও র্যাব তাদের ওপর গুলি চালিয়ে তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে গিয়েই বড় ধরনের হত্যাযজ্ঞ ঘটে গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, সরকারের তরফ থেকে মঞ্চ দখলের ১০ মিনিটের কিছু বর্ণনা ও হতাহতের কথা বলা হলেও তার আগে-পরে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের বিষয়টি চেপে যাওয়া হয়েছে।দুটি টিভি চ্যানেলের এমবেটেড জার্নালিস্টরা যৌথ বাহিনীর সঙ্গে থাকলেও তারা এসব দৃশ্য দেখাননি। এর মধ্যে সময় টিভির দীর্ঘ লাইভ সম্প্রচারে মাত্র দুজন হেফাজতকর্মীকে গুলি ও পরে পিটিয়ে মারার কয়েক সেকেন্ডের দৃশ্য দেখানো হয়। তাদের একাধিক ক্যামেরাম্যান ঘটনার দৃশ্য ধারণ করছিলেন। ফেরার পথেও অনেকের ওপর আক্রমণ হয়েছে। লালবাগে হেফাজতের অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও ৬ মে সকালে নিহত ও গুরুতর আহত শ’দুয়েক লোককে দেখা গেছে বলে পার্শ্ববর্তী একটি স্কুলের একজন শিক্ষক জানিয়েছেন। ঢাকা মেডিকেলে শ’পাঁচেক আহত লোক চিকিত্সা নিয়ে পুলিশের ভয়ে পালিয়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, আল-বারাকা হাসপাতালসহ মতিঝিলের আশপাশের হাসপাতালগুলোতে হতাহত বহু লোককে নেয়া হলেও পুলিশের হুমকিতে তারা নাম প্রকাশ করে বিস্তারিত বলতে অপারগতা জানিয়েছেন। সর্বোচ্চ তিন হাজার লোক নিহত ও নিখোঁজ থাকার কথা জানিয়েছে আয়োজক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে তারা লিখিত বিবৃতিতে এ সংখ্যা ২ হাজার বলেছিল। ৬ মে রাতেই সংশোধিত সংখ্যা ৩ হাজার বলে জানায়। বিএনপির পক্ষ থেকে ব্রিফিংয়ে বলা হয়েছে নিহতের সংখ্যা হাজারখানেক। কোনো কোনো নেতা বলেছেন দুই হাজার। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার শত শত নিহত ও নিখোঁজ হওয়ার কথা বলেছে। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বরাত দিয়ে নিহতের সংখ্যা আড়াই হাজার উল্লেখ করেছে। আমাদের দুজন ফটো সাংবাদিক ও দুজন রিপোর্টার ওইদিন রাতের অভিযান কাভার করতে চাইলেও যৌথবাহিনী তাদের পরিচয় জানার পর তাদের সহযোগী হতে বারণ করে। সময় টিভিতে আমরা সরাসরি অভিযানের অংশবিশেষ দেখেছি। দুজন হেফাজতকর্মীকে প্রথমে গুলি ও পরে পিটিয়ে মারার কয়েক মুহূর্তের দৃশ্য সময় টিভি দেখিয়েছে। বিভিন্ন ধরনের মারণাস্ত্রের গুলির আওয়াজও শুনিয়েছে। শটগানে ছোড়া রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ তো ছিলই।
গত মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে বিশ্বখ্যাত সাময়িকী দি ইকোনমিস্ট এবং ৬ মে এক বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন এ ঘটনাকে গণহত্যা (ম্যাসাকার) বলে উল্লেখ করে। এছাড়া ঘটনার পর তাত্ক্ষণিকভাবে সিএনএন, এএফপি, এপিসহ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোতে বহু হতাহতের খবর প্রচার ও প্রকাশ হয়।
বুধবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের ওপর যৌথবাহিনীর অভিযানে একজনও নিহত হননি বলে দাবি করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার বেনজীর আহমেদ! কন্ট্রোল রুম থেকে অভিযানটির নিয়ন্ত্রণকারী এ পুলিশ কর্মকর্তা আরও দাবি করেন, যৌথবাহিনী সেদিন কোনো ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র’ ব্যবহার করেনি।
তার হিসাবমতে, ৫ মে (রোববার) সকাল থেকে শুরু করে সোমবার রাতে ‘অপারেশন সিকিউরড শাপলা ওয়াচ’ সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত একজন পুলিশসহ মোট ১১ জন নিহত হন। বেনজীর আহমেদ বলেছেন, এই ১১ জনের কেউ অপারেশনের সময় নয়, রোববার দিনে ও অপারেশনের পরে তাদের বডি উদ্ধার করা হয়েছে। তবে সরকারের ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে গত ১ মে নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল সারওয়ার্দী সাভারে রানা প্লাজায় ওই মুহূর্তে নিখোঁজের সংখ্যা হঠাত্ কমবেশি ১৩শ’ থেকে নামিয়ে ১৪৯ জনে নিয়ে এসেছিলেন। ওই সময় পর্যন্ত মাত্র চারশ’র মতো মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছিল। জিওসি ১৪৯ জন বলার পর বিরোধীদলীয় নেতা লাশ গুমের অভিযোগ আনেন। অবশেষে জিওসির বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণ হয়ে আরও প্রায় পাঁচশ’ লাশ উদ্ধার হয়েছে। এখনও তিনটি তলায় উদ্ধার অভিযান বাকি রয়েছে। এই তিন তলায় এখনও বহু লাশ রয়েছে। বুধবার জিওসি দু-একদিনের মধ্যে অভিযান বন্ধ করে দেয়ার কথা বলেছেন। আগে বলেছিলেন, একটি লাশ থাকা পর্যন্ত তিনি অভিযান চালিয়ে যাবেন।
বুধবার সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদের দেয়া মূল বিষয়গুলো হলো—এক. রাত ২টা থেকে শুরু হয়ে মাত্র ১০ মিনিটে অপারেশন শেষ হয়। দুই. এ সময় বিভিন্ন ধরনের ‘নন-লেথাল অস্ত্র’ এবং ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস লজিস্টিক’ (সারা বিশ্বে স্বীকৃত বিক্ষোভ দমনের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি) ব্যবহার করা হয়। তিন. মিডিয়ার সামনে অপারেশন হয়েছে এবং দুটি টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করেছে। ‘দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দিয়ে অপারেশন চালানো হয়েছে বলে যে কথা বলা হচ্ছে, তা সত্য নয়’(!). চার. কম্পিউটারে ফটোশপ করে বানানো ছবি দিয়ে ইন্টারনেটে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। পাঁচ. হেফাজত পুলিশকে নিহতদের তালিকা দেয় না কেন? ছয়. সচিবালয়ে হামলা ও ব্যাংক লুটের পরিকল্পনা ছিল হেফাজতের। সাত. তিরিশ লাখ টাকা লুট, বায়তুল মোকাররম ও জুয়েলারি মার্কেটে আগুন দেয় হেফাজত।
সরকারের পক্ষে ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদের দেয়া বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার ব্যাপক ফারাক রয়েছে। প্রথমত, নিহতের সংখ্যা নিয়ে তিনি জঘন্য মিথ্যাচার করেছেন। তিনি বলেছেন, অপারেশনের সময় কেউ নিহত হয়নি; কিন্তু হেফাজতের কট্টর সমালোচক প্রথম আলো পত্রিকাও পরদিন তাদের প্রথম পাতায় অপারেশনে ১১ জন নিহতের খবর জানায়! ‘রোববারের সংঘর্ষ ও অভিযান : এক পুলিশসহ নিহত ২২’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে প্রথম আলো বলেছে, ‘২২টি লাশের মধ্যে ১১টি সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে ও মর্গে গেছে সোমবার ভোরের দিকে। ধারণা করা হচ্ছে, রোববার গভীর রাতে মতিঝিল শাপলা চত্বরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের সময় তারা নিহত হয়েছেন। বাকি ১১ জনের লাশ রোববার দুপুর থেকে মধ্যরাতের মধ্যে এসেছে।’ একুশে টিভি ৬ মে ভোর ৪টার খবরে তখন পর্যন্ত ৫ জন নিহত হওয়ার ও অর্ধশতাধিক গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর দিয়েছিল। তার ২০ মিনিটের মাথায় দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভিতে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত হয়ে সম্প্রচার বন্ধ করে দিলে একুশে টিভিসহ শাপলা চত্বর অভিযানে হতাহতের খবর প্রচার বন্ধ করে দেয়। দিগন্ত টিভি বন্ধ করার আগে প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে শত শত লোক হতাহত হওয়ার কথা প্রচার করা হয়েছিল।
কোন মন্তব্য নেই:
/>