ফতোয়ার ব্যাপারে উচ্চ আদালতের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। তারপরেও চলছে ফতোয়া। আর এসব ফতোয়ার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। তারা প্রতিবাদ করার সাহস রাখেন না। মুখ বুঝে সহ্য করেন সমাজপতি আর ধর্মের অপব্যাখ্যাকারীদের নির্যাতন। এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী জেলা মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার হিজুলিয়া গ্রামে।
ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম ‘নামাজ’ শব্দটিকে ‘সালাত’ বলায় ১৮ বছরের এক দম্পতির ‘ঈমান’ নষ্ট হয়ে গেছে এবং তাদের মধ্যকার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে এমন ফতোয়া দিয়ে একটি মাদ্রাসার সুপার ও সমাজপতিরা জোর করে তাদের ফের বিয়ে দিয়েছেন। অথচ ‘সালাত (একবচন) বা সালাহ (বহুবচন)’ হচ্ছে কোরআনিক আরবি শব্দ। যেটিকে ফার্সি ভাষায় ‘নামাজ’ বলা হয়। বাংলা ভাষাতেও নামাজ বহুল প্রচলিত শব্দ এবং এটির মাধ্যমে সালাতই বোঝায়। এছাড়া পারিভাষিক হিসেবে ফার্সি, উর্দু, হিন্দি ও তুর্কি ভাষাতেও নামাজ শব্দের মাধ্যমে সালাতকেই বোঝানো হয়, যার অর্থ শরীয়াতের নির্ধারিত পদ্ধতির মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ, দোয়া, রহমত, ক্ষমা প্রার্থনা করা। কিন্তু এরই অপব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার হিজুলিয়া গ্রামে ‘নামাজ’ নয় ‘সালাত’ বলায় মামুন বেপারী (৪০) ও শিল্পী বেগম (৩৬) নামে এক দম্পতিকে আবারো কলেমা পড়িয়ে বিয়ে দেয়া হয়েছে। ১৮ বছর দাম্পত্য জীবনে তাদের দুটি ছেলে রয়েছে। ওই গ্রামের মওলানা কাজী ফকরুদ্দিন লোকজন নিয়ে সালিশ বৈঠকে বসে এই ফতোয়া দিয়ে তা কার্যকর করেন। এই ফতোয়ার কারণে এলাকার মানুষের মধ্যে বিভক্তির পাশাপাশি জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ফতোয়ার মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার মামুন ওই গ্রামের সিকিম বেপারীর ছেলে এবং পেশায় নির্মাণ শ্রমিক (রাজমিস্ত্রি)। মামুন বেপারী জানান, গত ২২ এপ্রিল একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত ‘নামাজ নয় সালাত’ প্রবন্ধ পড়ে তিনি এ নিয়ে একই গ্রামের পল্লী চিকিৎসক আলাউদ্দিন ও হাবিবের সঙ্গে কথা বলেন। বিষয়টি নিয়ে তাদের সঙ্গে মামুনের তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে আলাউদ্দিন ও হাবিব বিষয়টি স্থানীয় হিলফুল ফুযুল এতিমখানা ও মাদ্রাসার সুপার মওলানা কাজী ফকরুদ্দিনকে জানান। কাজী ফকরুদ্দিন বলেন, ‘নামাজ’ নয় ‘সালাত’ বলায় মামুনের ঈমান নষ্ট হয়ে গেছে। আর ঈমান নষ্ট হয়ে গেলে তওবা করে স্ত্রীকে পুনরায় বিয়ে করতে হবে বলে ফতোয়া জারি করেন তিনি। মূহূর্তের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে এলাকার মানুষের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। পরের দিন রাতে মামুনের বাড়িতে কাজী ফকরুদ্দিন ও এলাকার লোকজন উপস্থিত হয়ে সালিশ বৈঠকে বসে ওই ফতোয়া কার্যকরের চেষ্টা চালায়। এতে মামুন রাজি না হলে তারা নানা হুমকি-ধামকি দিয়ে চলে যায়। এরপর গত সোমবার দুপুরে হিজুলিয়া জামে মসজিদে বিষয়টি নিয়ে আবারো কাজী ফকরুদ্দিন, মুফতি হান্নান ও স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার রমজান আলীসহ এলাকার লোকজন সালিশ বৈঠকে বসেন। সেখানে মামুন ও তার স্ত্রীকে নানা ভয়-ভীতি দেখিয়ে হাজির করে পুনরায় কলেমা পড়িয়ে বিয়ে দেয়া হয়। মামুনের স্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, তারা এলাকার নিরীহ একটি পরিবার। সমাজপতিরা ও মাওলানারা তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে এই ফতোয়া দিয়েছে। তারা ধর্মের অপব্যাখা দিয়ে তাদের সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন ও অবিচার করেছে। সমাজপতিদের অব্যাহত ভয়-ভীতি দেখানোয় তারা কোনো প্রতিবাদ করতে সাহস পাননি বলেও জানান তিনি। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার রমজান আলী কিছুই জানেন না বলে জানান। তবে, হিলফুল ফুযুল এতিমখানা ও মাদ্রাসার সুপার মাওলানা কাজী ফকরুদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, ‘ঈমান নষ্ট হলে স্ত্রীর সঙ্গে তালাক হয়ে যায়। তাই তাদের আবারো বিয়ে দেয়ার ফতোয়া কার্যকর করা সঠিক হয়েছে।’ এ ব্যাপারে মানিকগঞ্জ কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ আবু মূছা জানান, ‘নামাজকে সালাত বললে কারো ঈমান নষ্ট হয় না। স্ত্রীর সঙ্গে তালাকও হয় না। এভাবে ধর্মের অপব্যাখা দিয়ে ফতোয়া জারি করা ঠিক হয়নি।’ শিবালয় সার্কেল এএসপি হারুণ-অর রশিদ জানান, বিষয়টি কেউ পুলিশকে জানায়নি। উচ্চ আদালতের নির্দেশে ফতোয়া জারি বন্ধ রয়েছে। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানান তিনি। উল্লেখ্য, ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার হাইকোর্ট বেঞ্চ ফতোয়াকে অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করে রায় দেন। রায়ে বলা হয়, একমাত্র আদালতই মুসলিম বা অন্য কোনো আইন অনুযায়ী আইনসংক্রান্ত কোনো প্রশ্নে মতামত দিতে পারেন। কেউ ফতোয়া দিলে তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য হবে। এরপর আপিল হলে ২০১১ সালের ১২ মে তৎকালীন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ৬ বিচারপতির বেঞ্চ ফতোয়া সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত রায় দেন। চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি প্রকাশিত হয় ফতোয়া সংক্রান্ত আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি। এতে অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে কয়েকটি হলো; ১. ধর্মীয় বিষয়ে যথাযথ শিক্ষিত ব্যক্তিরা শুধু ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কে ফতোয়া দিতে পারবেন। এই ফতোয়া স্বেচ্ছায় গৃহীত হতে হবে। ফতোয়া মানতে কাউকে বাধ্য করা, জোর করা কিংবা অনুচিত প্রভাব প্রয়োগ করা যাবে না। ২. কোনো ব্যক্তির দেশে প্রচলিত আইন দ্বারা স্বীকৃত অধিকার, সম্মান বা মর্যাদা ক্ষুণ্ন বা প্রভাবিত করে, এমন ফতোয়া কেউ প্রদান করতে পারবে না। ৩. ফতোয়ার নামে কোনো প্রকার শাস্তি, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা যাবে না। ৪. তবে ওই নির্দিষ্ট ফতোয়াটি (যা হাইকোর্ট অবৈধ বলেছেন) অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হলো। প্রসঙ্গত, ১৯৯৯ সালে নওগাঁ সদর উপজেলার আম্বিয়া ভাঙ্গাপাড়ার সাইফুল কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে স্ত্রী শাহিদার উদ্দেশে ‘তালাক’ শব্দটি উচ্চারণ করেন। কথাটি প্রতিবেশী মাওলানা আলহাজ আজিজুল হক শুনতে পান। কিন্তু এই ঘটনার পর তারা একসঙ্গে স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন যাপন করতে থাকেন। ঘটনার এক বছর পর, সাইফুলের অনুপস্থিতিতে মাওলানা আজিজুল হক উক্ত তালাকের ঘটনা শরীয়ত মতো ‘শুদ্ধ’ করার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে জনৈক শামসুলের সঙ্গে শাহিদার হিল্লা বিয়ে দেন। এই ঘটনার পর সাইফুল শাহিদাকে গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। বিষয়টি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলে তা হাইকোর্টের দৃষ্টিতে আসে। আদালত এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন এবং ২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে হাইকোর্ট ডিভিশন ফতোয়াকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন।
----------------------------------------------------------------------------------
'' শুধু নিজে শিক্ষিত হলে হবেনা, প্রথমে বিবেকটাকে শিক্ষিত করুন। ''
কোন মন্তব্য নেই:
/>