যে ব্যক্তি কোন খতীবকে বিভ্রান্তির দিকে অথবা বিদআতের দিকে আহ্বান করতে শুনে সে কি করবে
প্রশ্ন: আমাদের স্থানীয় ইমাম মানুষকে কতিপয় বিদআতের দিকে আহ্বান করেন। কিছু দ্বীনদার ভাই দলিল-প্রমাণসহ এ ব্যাপারে তাঁকে সাবধান করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি এ বিদআতগুলোর পক্ষে অটল অবস্থানে রয়েছেন। যদি জানা যায় যে, আজকের খোতবায় খতীবসাহেব বিদআতের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করবেন যেমন- মিলাদ, শবে বরাত, ইত্যাদি সেক্ষেত্রে আপনারা কি এ পরামর্শ দিবেন যে, সে ব্যক্তি জুমার খোতবা শুনতে যাবে না। কেউ যদি মসজিদে গিয়ে শুনতে পায় যে, খতীবসাহেব বিদআতের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করছেন তখন সে ব্যক্তির করণীয় কী? সে কী খোতবার মাঝখানে উঠে বাড়ীতে এসে যোহরের নামায আদায় করবে? অন্যথায় সে কী করবে? এ ধরণের খোতবা শুনায় হাজির থাকলে ব্যক্তি কি গুনাহগার হবে? কারণ কিছু ভাই নসিহত করার পরও খতীবসাহেব তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির উপর অটল অবস্থানে রয়েছেন। কেউ যদি খোতবার মধ্যে দুর্বল ও বানোয়াট হাদিস উল্লেখ করে তার ক্ষেত্রেও কি একই হুকুম প্রযোজ্য? আল্লাহ আপনাদেরকে উত্তম প্রতিদান দিন।
এক:
যে ব্যক্তির এলাকার মসজিদে কোন বিদআতপন্থী ইমাম ইমামতি করেন: তার বিদআত হয়তো কুফরি বিদআত হবে অথবা সাধারণ কোন বিদআত হবে। যদি কুফরি বিদআত হয় তাহলে ঐ ইমামের পিছনে সাধারণ নামায কিংবা জুমার নামায কোনটা পড়া জায়েয হবে না। আর যদি ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয় এমন কোন বিদআত না হয় তাহলে অগ্রগণ্য মতানুযায়ী- তার পিছনে জুমা পড়া ও জামাতে নামায পড়া জায়েয। এ হুকুমটি এত বেশি প্রচার পেয়েছে যে, এটা এখন সুন্নাহ অনুসারীদের নিদর্শনে পরিণত হয়েছে। বিশুদ্ধ মতানুযায়ী, যদি কেউ এমন ইমামের পিছনে নামায আদায় করে ফেলে তাহলে তাকে সে নামায শোধরাতে হবে না। এ বিষয়ক নীতি হচ্ছে- “যে ব্যক্তির নিজের নামায শুদ্ধ; সে ব্যক্তির ইমামতিও শুদ্ধ”।
আর যদি সেই বিদআতী ইমামকে বাদ দিয়ে অন্য কোন ইমামের পিছনে নামায পড়ার সুযোগ থাকে তাহলে সেটাই করতে হবে। বিশেষতঃ আলেম শ্রেণী ও তালিবুল ইলমকে সেটা করতে হবে। তা করা সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ তুল্য। কিন্তু এ ইমামের পিছনে নামায বর্জন করতে গিয়ে ঘরে নামায পড়া জামাতযুক্ত নামাযের ক্ষেত্রে জায়েয নেই। সুতরাং জুমার ক্ষেত্রে জায়েয না হওয়া আরও বেশি যুক্তিযুক্ত।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন: যদি মোক্তাদি জানে যে, ইমাম বিদআতি, বিদআতের দিকে আহ্বান করে অথবা এমন ফাসেক (কবিরা-গুনাহগার) যার মধ্যে গুনাহর আলামত প্রকাশ্য এবং সেই-ই নির্ধারিত ইমাম; নামায পড়লে তার পিছনেই পড়তে হবে যেমন- জুমার ইমাম, ঈদের ইমাম, আরাফাতে হজ্জের নামাযের ইমাম ইত্যাদি এক্ষেত্রে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল আলেমের অভিমত হচ্ছে- মোক্তাদিকে তার পিছনেই নামায আদায় করতে হবে। এটি ইমাম আহমাদ, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আবু হানিফা ও অন্যান্য আলেমের অভিমত।
এ কারণে আলেমগণ আকিদার কিতাবে লিখেন যে, ইমাম নেককার হোক কিংবা পাপাচারী হোক তিনি ইমামের পিছনে জুমার নামায ও ঈদের নামায আদায় করেন। অনুরূপভাবে এলাকাতে যদি শুধু একজন ইমাম থাকে তাহলে তার পিছনেই জামাতে নামাযগুলো আদায় করতে হবে। কেননা জামাতে নামায আদায় করা, একাকী নামায আদায় করার চেয়ে উত্তম; এমনকি ইমাম ফাসেক (কবিরা-গুনাতেলিপ্ত) হলেও। এটি অধিকাংশ আলেম: আহমাদ ইবনে হাম্বল, শাফেয়ী ও অন্যান্যদের অভিমত। বরং ইমাম আহমাদের প্রকাশ্য অভিমত হচ্ছে- জামাতে নামায আদায় করা ফরজে আইন। ইমাম ফাসেক হওয়ার কারণে যে ব্যক্তি জুমার নামায ও জামাতে নামায পড়ে না সে ইমাম আহমাদ ও আহলে সুন্নাহর অন্যান্য ইমামের মতে- বিদআতী; আব্দুস, ইবনে মালেক ও আত্তারের ‘রিসালা’ তে এভাবে এসেছে।
সঠিক মতানুযায়ী: সে ব্যক্তি নামায পড়ে নিবে; তাকে এ নামাযকে পুনরায় আদায় করতে হবে না। কারণ সাহাবায়ে কেরাম জুমার নামায, জামাতে নামায ফাসেক ইমামদের পিছনেও আদায় করেছেন; তাঁরা তাদের পিছনে আদায়কৃত নামায পুনরায় আদায় করতেন না। যেমন- ইবনে উমর হাজ্জাজের পিছনে নামায পড়তেন। ইবনে মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবী ওয়ালিদ ইবনে উকবার পিছনে নামায পড়তেন। ওয়ালিদ বিন উকবা মদ্যপ ছিল। একবার ফজরের নামায চার রাকাত পড়িয়েছে। এরপর বলল: আরো বাড়াব নাকি? তখন ইবনে মাসউদ বললেন: আজ তো আপনি বেশিই পড়িয়েছেন! এরপর তাঁরা তার বিরুদ্ধে ওসমান (রাঃ) এর নিকট অভিযোগ করেন।
সহিহ বুখারিতে এসেছে- ওসমান (রাঃ) যখন অবরুদ্ধ হলেন এবং জনৈক লোক এগিয়ে গিয়ে নামাযের ইমামতি করল তখন এক ব্যক্তি ওসমান (রাঃ) কে প্রশ্ন করল: নিঃসন্দেহে আপনি সর্বসাধারণের ইমাম। আর যে ব্যক্তি এগিয়ে এসে ইমামতি করল সে ফিতনার ইমাম। তখন ওসমান (রাঃ) বললেন: ভাতিস্পুত্র শুন, নামায হচ্ছে- ব্যক্তির সবচেয়ে উত্তম কাজ। যদি লোকেরা ঠিকভাবে নামায আদায় করে তাদের সাথে ভাল ব্যবহার কর। আর যদি তারা মন্দ আচরণ করে তাদের সে মন্দ আচরণকে এড়িয়ে চল। এ ধরণের বাণী অনেক আছে।
ফাসেক বা বিদআতীর নামায সহিহ। অতএব, মোক্তাদি যদি তার পিছনে নামায পড়ে তাহলে তার নামায বাতিল হবে না। তবে, যারা বিদআতির পিছনে নামায পড়াকে মাকরুহ বলেছেন তারা দিক থেকে বলেছেন: সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ ওয়াজিব। যে ব্যক্তি প্রকাশ্য বিদআত করে তাকে ইমাম হিসেবে নির্ধারণ না করাটা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের অন্তর্গত। কেননা সে শাস্তিযোগ্য যতক্ষণ না তওবা করে। যদি তাকে এড়িয়ে চলা যায় যাতে করে সে তওবা করে সেটা— ভাল। যদি কোন কোন লোক তার পিছনে নামায পড়া ছেড়ে দিলে, অন্যেরা নামায পড়লে সেটা তার উপরে প্রভাব ফেলে যাতে করে সে তওবা করে অথবা বরখাস্ত হয় অথবা মানুষ এ জাতীয় গুনাহ থেকে দূরে সরে আসে এবং সে মোক্তাদির জুমা বা জামাত ছুটে না যায় যদি এমন হয় তাহলে এ ধরণের লোকের তার পিছনে নামায বর্জন করাতে কল্যাণ আছে।
পক্ষান্তরে মোক্তাদির যদি জুমা ও জামাত ছুটে যাওয়ার আশংকা থাকে তাহলে তার পিছনে নামায বর্জন করাটা বিদআত এবং সাহাবায়ে কেরামের আমলের পরিপন্থী।[আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা (২/৩০৭-৩০৮)]।
দুই:
ইতিপূর্বের আলোচনা থেকে জানা যায় যে, যদি কেউ কোন খতীবকে বিদআতের দিকে ডাকে (যেমন যে বিদআতগুলোর কথা আপনি প্রশ্নে উল্লেখ করেছেন) অথবা বিদআতের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে অথবা দুর্বল ও বানোয়াট হাদিসগুলো উদ্ধৃত করতে শুনে তদুপরি তার জন্য মসজিদ ত্যাগ করা, খোতবা না-শুনা জায়েয হবে না। তবে যদি প্রভাবশালী আলেম হন এবং তিনি অন্য কোন খতীবের পিছনে নামায পড়বেন তাছাড়া ইতিপূর্বে ঐ খতীবকে নসিহত করেছেন, সত্যকে তার নিকট সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন- তিনি তার পিছনে নামায বর্জন করতে পারেন। যদি তিনি ইতিপূর্বে তাকে নসিহত না করে থাকেন অথবা অন্য কোন মসজিদে তার নামায পড়ার সুযোগ না থাকে তাহলে অগ্রগণ্য মত হচ্ছে- খোতবাকালে মসজিদ থেকে বেরিয়ে যাওয়া জায়েয হবে না। তবে যদি এমন হয় যে, এ খতীবের পিছনে নামায পড়া জায়েয হবে না এমন পর্যায়ের তাহলে বেরিয়ে যেতে পারেন।
6366 নং প্রশ্নের জবাবে আমরা উল্লেখ করেছি জুমার নামাযের খতীব যদি কোন বিভ্রান্তির কথা বলে অথবা কোন বিদআত সাব্যস্ত করে অথবা শিরকের দিকে আহ্বান করে আমরা সে প্রশ্নের জবাবে খোতবার মাঝখানে প্রতিবাদ করাকে বৈধ উল্লেখ করেছি। তবে শর্ত হচ্ছে- মানুষের মাঝে বিশৃংখলা সৃষ্টি হতে পারবে না এবং জুমার নামায নষ্ট করা যাবে না। যে ব্যক্তি প্রতিবাদ করতে চায় তিনি খোতবা শেষে দাঁড়িয়ে মানুষের কাছে খতীবের ভুল তুলে ধরবেন।
যে ব্যক্তি প্রতিবাদ করতে চায় তার উচিত সত্য তুলে ধরা ও সে খতীবের সমালোচনার ক্ষেত্রে কোমল হওয়া। যাতে করে মন্দের প্রতিবাদ ফলপ্রসু হয়।
• স্থায়ী কমিটির আলেমগণকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে-
যে খতীব তার খোতবার মাঝে অথবা গোটা খোতবা জুড়ে শুধু ইসরাইলী বর্ণনা ও দুর্বল হাদিস উল্লেখ করে এর মাধ্যমে মানুষকে চমকে দিতে চান ইসলামে এর হুকুম কী?
তাঁরা জবাবে বলেন: যদি আপনি সুনিশ্চিতভাবে (ইয়াকীনসহ) জানেন যে, খতীব খোতবার মধ্যে যে ইসরাইলী বর্ণনাগুলো উল্লেখ করেছেন সেগুলো ভিত্তিহীন অথবা হাদিসগুলো দুর্বল তাহলে আপনি তাকে নসিহত করুন যেন অন্য সহিহ হাদিসগুলো উল্লেখ করে, আয়াতে কারীমাগুলো নিয়ে আসে। আর যে ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে জানেন না সেটাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে সম্পৃক্ত করবে না। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“দ্বীন হচ্ছে- নসিহত”। হাদিসটি ইমাম মুসলিম তাঁর সহিহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
তবে নসিহত হতে হবে উত্তম পন্থায়; কর্কশ ও কঠিন আচরণের মাধ্যমে নয়। আল্লাহ আপনাকে তাওফিক দিন ও আপনাকে কল্যাণের ধারক বানান।
“দ্বীন হচ্ছে- নসিহত”। হাদিসটি ইমাম মুসলিম তাঁর সহিহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
তবে নসিহত হতে হবে উত্তম পন্থায়; কর্কশ ও কঠিন আচরণের মাধ্যমে নয়। আল্লাহ আপনাকে তাওফিক দিন ও আপনাকে কল্যাণের ধারক বানান।
শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায, শাইখ আব্দুর রাজ্জাক আফিফি, শাইখ আব্দুল্লাহ গাদইয়ান।
ফাতাওয়াল লাজনাহ দায়িমা (৮/২২৯-২৩০)
সার কথা হচ্ছে- যদি আপনি এমন কোন মসজিদে যেতে পারেন যেখানে বিদআত নেই, যে মসজিদের খতীব বিদআতের দিকে আহ্বান করে না সেটা ভাল। যদি না যেতে পারেন অথবা আপনাদের নিকটে অন্য কোন মসজিদ না থাকে তাহলে উল্লেখিত কারণে জামাত ও জুমা ত্যাগ করা আপনাদের জন্য জায়েয হবে না। আপনাদের কর্তব্য হচ্ছে- নসিহত করা ও আল্লাহর দিকে আহ্বান করা। দাওয়াতের ভাষা যেন কোমল হয় এবং পদ্ধতি যেন সুন্দর হয় সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকা।
আল্লাহই ভাল জানেন।
----------------------------------------------------------------------------------
'' শুধু নিজে শিক্ষিত হলে হবেনা, প্রথমে বিবেকটাকে শিক্ষিত করুন। ''
কোন মন্তব্য নেই:
/>