রবিবার, ২৪ মে, ২০১৫

সবর : কী ও কেন ???

সবর : কী ও কেন



আল্লাহ তা'আলা সবরকে এমন এক যন্ত্র দিয়েছেন যা কখনো ব্যর্থ হয় নাএমন তীর বানিয়েছেন যা লক্ষ ভ্রষ্ট হয় নাএমন বিজয়ী সৈনিক বানিয়েছেন যে কখনো পরাজিত হয় নাএমন সুরক্ষিত দূর্গ বানিয়েছেন যা কখনো ধ্বংস হয় না। এই সবর আর বিজয় দুই সহোদরের মতো। মানুষ তার দুনিয়া ও আখিরাতের বিষয়ে সবরের মতো এমন কোনো অস্ত্রে সজ্জিত হয় না, যা তার নফস ও শয়তানকে নিশ্চিতভাবে হারিয়ে দেয়। সেই বান্দার কোনো শক্তিই নেইযার গুণাবলির মধ্যে সবর তথা ধৈর্য নেই। সেই বান্দা বিজয়ও ছিনিয়ে আনতে পারে না যে সবরকারী বা ধৈর্যশীল নয়। তাইতো আল্লাহ তা'আলা কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেছেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اصْبِرُوا وَصَابِرُوا وَرَابِطُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ (200)
'হে মুমিনগণতোমরা ধৈর্য ধর ও ধৈর্যে অটল থাক এবং পাহারায় নিয়োজিত থাক। আর আল্লাহকে ভয় করযাতে তোমরা সফল হও।'[1]


এই সবর মুমিনের জন্য তার ভাইয়ের মতো। আপন ভাই অনেক সময় রাগ করে ছেড়ে যায়কিন্তু বিপদের সময় সে-ই সবার আগে এগিয়ে আসে। এই সবর ঈমানের শাখা স্বরূপনালা না থাকলে ঈমানের অস্তিত্বই হুমকির সম্মুখীন হবে। যার ধৈর্য নাই তার ঈমান নাই। সবর ছাড়া যদি ঈমান থাকেওতবে তা বড় দুর্বল ঈমান। এমন ঈমানদার আল্লাহর ইবাদত করে দ্বিধা ও সংশয়ের সঙ্গে। এদের সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা সুন্দর বলেছেন,
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَعْبُدُ اللَّهَ عَلَى حَرْفٍ فَإِنْ أَصَابَهُ خَيْرٌ اطْمَأَنَّ بِهِ وَإِنْ أَصَابَتْهُ فِتْنَةٌ انْقَلَبَ عَلَى وَجْهِهِ خَسِرَ الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةَ ذَلِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِينُ (11)
'মানুষের মধ্যে কতক এমন রয়েছেযারা দ্বিধার সাথে আল্লাহর ইবাদত করে। যদি তার কোনো কল্যাণ হয় তবে সে তাতে প্রশান্ত হয়। আর যদি তার কোনো বিপর্যয় ঘটেতাহলে সে তার আসল চেহারায় ফিরে যায়। সে দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি হল সুস্পষ্ট ক্ষতি।'[2]
এ ব্যক্তি আসলে সবর হারিয়ে শুধু তার দুর্ভাগ্যই কামাই করে যাবে। পক্ষান্তরে যে সবর করে। বিপদে ধৈর্য ধারণ করে সে ভাগ্যবান। পৃথিবীতে যারা সৌভাগ্যবান তারা কিন্তু সবর ও ধৈর্য গুণেই ভাগ্যবান। এরা দুঃসময় এলে ধৈর্য ধরে আর সুসময় এলে আল্লাহ তা'আলার শুকরিয়া আদায় করে। এভাবে তারা জান্নাতের নেয়ামতের অধিকারী হয়। সত্যিই এরা সৌভাগ্যবান। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
سَابِقُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أُعِدَّتْ لِلَّذِينَ آَمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ (21)
'তোমরা তোমাদের রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সেই জান্নাতের দিকে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওযার প্রশস্ততা আসমান ও যমীনের প্রশস্ততার মত। তা প্রস্তত করা হয়েছে যারা আল্লাহ ও রাসূলদের প্রতি ঈমান আনে তাদের জন্য। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ। তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।'[3]

সবরের গুরুত্ব

সবর বা ধৈর্য আল্লাহর পরিপূর্ণ মুমিন বান্দাদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা'আলা যাকে এই গুণ দেনসেই এই গুণে সুসজ্জিত হয়। আল্লাহ তা'আলা নবী-রাসূল আলাইহিস সালামদের এই বিরল গুণে বিভূষিত করেছিলেন। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. বলেনপবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'আলা নব্বই জায়গায় সবরের কথা বলেছেন। অতএব ভেবে দেখুন সবর কত গুরুত্বপূর্ণ! আল্লাহ তা'আলা বিভিন্নভাবে সবরের গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন। নিচে তার কয়েকটি তুলে ধরা হল :
  • আল্লাহ তা'আলা তাঁর পবিত্র গ্রন্থে সাবের তথা ধৈর্যশীলদের প্রশংসা করেছেন এবং তাদেরকে হিসাব ছাড়া প্রতিদান দেবেন বলে উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে 
قُلْ يَا عِبَادِ الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا رَبَّكُمْ لِلَّذِينَ أَحْسَنُوا فِي هَذِهِ الدُّنْيَا حَسَنَةٌ وَأَرْضُ اللَّهِ وَاسِعَةٌ إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ (10)
'বল, 'হে আমার মুমিন বান্দারা যারা ঈমান এনেছতোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর। যারা এ দুনিয়ায় ভালো কাজ করে তাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ। আর আল্লাহর যমীন প্রশস্তকেবল ধৈর্যশীলদেরকেই তাদের প্রতিদান পূর্ণরূপে দেয়া হবে কোনো হিসাব ছাড়াই।'[4]
  • আল্লাহ তা'আলা বলেছেন তিনি ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন, তাদের জন্য হেদায়েত ও সুস্পষ্ট বিজয় নিয়ে। ইরশাদ হয়েছে
وَاصْبِرُوا إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ (46)
'আর তোমরা ধৈর্য ধরনিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।'[5]
  • আল্লাহ তা'আলা সবর ও ইয়াকিন তথা ধৈর্য ও ঈমানের বদৌলতে মানুষকে নেতৃত্ব দেন। তিনি ইরশাদ করেছেন,
وَجَعَلْنَا مِنْهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا لَمَّا صَبَرُوا وَكَانُوا بِآَيَاتِنَا يُوقِنُونَ (24)
'আর আমি তাদের মধ্য থেকে বহু নেতা করেছিলামতারা আমার আদেশানুযায়ী সৎপথ প্রদর্শন করতযখন তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। আর তারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখত।'[6]
  • আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা'আলা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন সবরই মানুষের জন্য কল্যাণকর। ইরশাদ হয়েছে,
وَلَئِنْ صَبَرْتُمْ لَهُوَ خَيْرٌ لِلصَّابِرِينَ (126)
'আর যদি তোমরা সবর করতবে তাই সবরকারীদের জন্য উত্তম।'[7]
  • আল্লাহ তা'আলা সংবাদ দিয়েছেন যেকারও সাথে যদি সবর থাকে তাহলে যত বড় শত্রুই হোক তাকে পরাস্ত করতে পারবে না। ইরশাদ হয়েছে,
وَإِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا لَا يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا إِنَّ اللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ (120)
'আর যদি তোমরা ধৈর্য ধর এবং তাকওয়া অবলম্বন করতাহলে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছু ক্ষতি করবে না। নিশ্চয় আল্লাহ তারা যা করেতা পরিবেষ্টনকারী।'[8]
  • আল্লাহ তা'আলা বিজয় ও সফলতার জন্য সবর ও তাকওয়া অবলম্বনের শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। ইরশাদ করেছেন 
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اصْبِرُوا وَصَابِرُوا وَرَابِطُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ (200)
'হে মুমিনগণতোমরা ধৈর্য ধর ও ধৈর্যে অটল থাক এবং পাহারায় নিয়োজিত থাক। আর আল্লাহকে ভয় করযাতে তোমরা সফল হও।'[9]
  • আল্লাহ তা'আলা ধৈর্যশীলকে ভালোবাসেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আর একজন মুমিনের জন্য এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে?ইরশাদ হয়েছে,
وَكَأَيِّنْ مِنْ نَبِيٍّ قَاتَلَ مَعَهُ رِبِّيُّونَ كَثِيرٌ فَمَا وَهَنُوا لِمَا أَصَابَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَمَا ضَعُفُوا وَمَا اسْتَكَانُوا وَاللَّهُ يُحِبُّ الصَّابِرِينَ (146)
'আর কত নবী ছিলযার সাথে থেকে অনেক আল্লাহওয়ালা লড়াই করেছে। তবে আল্লাহর পথে তাদের ওপর যা আপতিত হয়েছে তার জন্য তারা হতোদ্যম হয়নি। আর তারা দুর্বল হয়নি এবং তারা নত হয়নি। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন।'[10]
  • আল্লাহ তা'আলা ধৈর্যশীলদের তিনটি বিষয়ে সুসংবাদ দিয়েছেন, যার প্রতিটি পাবার জন্য দুনিয়াবাসী একে অপরের সঙ্গে ইর্ষা করেন। ইরশাদ হয়েছে,
وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ (155) الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ (156) أُولَئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُولَئِكَهُمُ الْمُهْتَدُونَ (157)  
'আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। যারাতাদেরকে যখন বিপদ আক্রান্ত করে তখন বলেনিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। তাদের ওপরই রয়েছে তাদের রবের পক্ষ মাগফিরাত ও রহমত এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত।'[11]
  • ধৈর্যশীলদের জন্য রেখেছেন জান্নাত লাভের কামিয়াবী আর জাহান্নাম থেকে মুক্তির সাফল্য। ইরশাদ হয়েছে,
إِنِّي جَزَيْتُهُمُ الْيَوْمَ بِمَا صَبَرُوا أَنَّهُمْ هُمُ الْفَائِزُونَ (111)
'নিশ্চয় আমি তাদের ধৈর্যের কারণে আজ তাদেরকে পুরস্কৃত করলামনিশ্চয় তারাই হল সফলকাম।'[12]
  • আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনের চার চারটি স্থানে উল্লেখ করেছেন যেতাঁর নিদর্শনাবলি থেকে ধৈর্যশীল ও শুকরগুযার বান্দারাই উপকৃত হয় এবং এরাই সৌভাগ্যবান বটে। যেমন ইরশাদ করেছেন,
أَلَمْ تَرَ أَنَّ الْفُلْكَ تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِنِعْمَةِ اللَّهِ لِيُرِيَكُمْ مِنْ آَيَاتِهِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِكُلِّ صَبَّارٍ شَكُورٍ (31)
'তুমি কি দেখনি যেনৌযানগুলো আল্লাহর অনুগ্রহে সমুদ্রে চলাচল করেযাতে তিনি তাঁর কিছু নিদর্শন তোমাদের দেখাতে পারেন। নিশ্চয় এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীলকৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে।'[13]
আল্লাহ ইরশাদ করেছেন,
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مُوسَى بِآَيَاتِنَا أَنْ أَخْرِجْ قَوْمَكَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَذَكِّرْهُمْ بِأَيَّامِ اللَّهِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِكُلِّ صَبَّارٍ شَكُورٍ (5)
'আর আমি মূসাকে আমার আয়াতসমূহ দিয়ে পাঠিয়েছি যে'তুমি তোমার কওমকে অন্ধকার হতে আলোর দিকে বের করে আন এবং আল্লাহর দিবসসমূহ তাদের স্মরণ করিয়ে দাও।নিশ্চয় এতে প্রতিটি ধৈর্যশীলকৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য রয়েছে অসংখ্য নিদর্শন।'[14]
আরও ইরশাদ করেছেন,
فَقَالُوا رَبَّنَا بَاعِدْ بَيْنَ أَسْفَارِنَا وَظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ فَجَعَلْنَاهُمْ أَحَادِيثَ وَمَزَّقْنَاهُمْ كُلَّ مُمَزَّقٍ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِكُلِّ صَبَّارٍ شَكُورٍ (19)
'কিন্তু তারা বলল'হে আমাদের রবআমাদের সফরের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে দিন'। আর তারা নিজদের প্রতি যুলম করল। ফলে আমি তাদেরকে কাহিনী বানালাম এবং তাদেরকে একেবারে ছিন্নভিন্ন করে দিলাম। নিশ্চয় এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য নিদর্শন রয়েছে।'[15]
অন্যত্র ইরশাদ করেন,
إِنْ يَشَأْ يُسْكِنِ الرِّيحَ فَيَظْلَلْنَ رَوَاكِدَ عَلَى ظَهْرِهِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِكُلِّ صَبَّارٍ شَكُورٍ (33)
'তিনি যদি চান বাতাসকে থামিয়ে দিতে পারেন। ফলে জাহাজগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠে গতিহীন হয়ে পড়বে। নিশ্চয় এতে পরম ধৈর্যশীল ও কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে।'[16]

সবর কী?

সবরের আভিধানিক অর্থ বাধা দেয়া বা বিরত রাখা।
শরীয়তের ভাষায় সবর বলা হয়, অন্তরকে অস্থির হওয়া থেকেজিহ্বাকে অভিযোগ করা থেকে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গাল চাপড়ানো ও বুকের কাপড় ছেড়া থেকে বিরত রাখা।
কারো কারো মতেএটি হলো মানুষের ভেতরগত একটি উত্তম স্বভাবযার মাধ্যমে সে অসুন্দর ও অনুত্তম কাজ থেকে বিরত থাকে। এটি মানুষের এক আত্মিক শক্তি যা দিয়ে সে নিজেকে সুস্থ্য ও সুরক্ষিত রাখতে পারে।
জুনায়েদ বাগদাদী রহ. কে সবর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন'হাসি মুখে তিক্ততার ঢোক গেলা।'
জুন্নুন মিসরী রহ. বলেন, 'আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ থেকে দূরে থাকাবিপদের সময় শান্ত থাকা এবং জীবনের কুরুক্ষেত্রে দারিদ্রের কষাঘাত সত্ত্বেও অমুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করা।'
কারও মতে'সবর হলো সুন্দরভাবে বিপদ মোকাবিলা করা।'
আবার কারও মতে, 'বিপদকালে অভিযোগ-অনুযোগ না করে অমুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করাই সবর।'
এক বুযুর্গ এক ব্যক্তিকে অন্যের কাছে তার সমস্যা নিয়ে অনুযোগ করতে শুনলেন। তিনি বললেন, 'তুমি ভাই, স্রেফ যে দয়া করে না তার কাছে দয়াকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছো। এর বেশি কিছু করোনি।'
এ সম্পর্কে আরও বলা হয়, 'তুমি যখন মানুষের কাছে অভিযোগ করোতখন মূলত সদয়ের বিরুদ্ধে নির্দয়ের কাছেই অভিযোগ করো।'
অভিযোগ করাটা দুই ধরনের। একটি হলোআল্লাহ তা'আলার কাছে অনুযোগ করা। এটি সবর পরিপন্থী নয়। যেমন ইয়াকুব আলাইহিস সালাম বলেন,
قَالَ إِنَّمَا أَشْكُو بَثِّي وَحُزْنِي إِلَى اللَّهِ
'সে বলল'আমি আল্লাহর কাছেই আমার দুঃখ বেদনার অভিযোগ জানাচ্ছি। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি যা জানিতোমরা তা জান না।'[17]
অপরটি হলোনিজের মুখের বা শরীরের ভাষায় মানুষের কাছে অভিযোগ করা। এটি সবরের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। এটি সবর পরিপন্থী।

সবরের প্রকার

সবর তিন প্রকার। যথা :
প্রথম : আল্লাহ তা'আলার আদেশ-নির্দেশ পালন ও ইবাদত-বন্দেগী সম্পাদন করতে গিয়ে ধৈর্য ধারণ করা। 
দ্বিতীয় : আল্লাহ তা'আলার নিষেধ এবং তার বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে অটুট ধৈর্য রাখা। এবং 
তৃতীয় : তাকদীর ও ভাগ্যের ভালো-মন্দে অসন্তুষ্ট না হয়ে ধৈর্য ধরা।  
এই তিন প্রকার সম্পর্কেই শায়খ আবদুল কাদির জিলানী রহ. তদীয় গ্রন্থ 'ফুতুহুল গায়ব' গ্রন্থে বলেন'একজন বান্দাকে অবশ্যই তিনটি বিষয়ে ধৈর্য ও সংযমের পরিচয় দিতে হবে : কিছু আদেশ পালনেকিছু নিষেধ থেকে বিরত থাকায় এবং তাকদীরের ওপর।'
পবিত্র কুরআনে বর্ণিত লুকমান আলাইহিস সালামের বিখ্যাত উপদেশেও এ তিনটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,
يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ (17)
'হে আমার প্রিয় বৎসসালাত কায়েম করসৎকাজের আদেশ দাওঅসৎকাজে নিষেধ কর এবং তোমার ওপর যে বিপদ আসে তাতে ধৈর্য ধর। নিশ্চয় এগুলো অন্যতম দৃঢ় সংকল্পের কাজ।'[18]
লুকমান আলাইহিস সালাম যে 'সৎকাজের আদেশ দাও' বলেছেনতার মধ্যে নিজে সৎ কাজ করা এবং অপরকে সৎ কাজের উপদেশ দেয়া উভয়টি অন্তর্ভুক্ত। তেমনি অসৎকাজে নিষেধ করার মধ্যেও উভয়টি রয়েছে। এখানে 'সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ' শব্দই আমাদের এমন ধারণা দেয়।তাছাড়া শরীয়তের দৃষ্টিতেও 'সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ' বাস্তবায়িত হয় নাযতক্ষণ না আগে নিজে তা পালন করা হয়। এ দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন
إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ (19)الَّذِينَ يُوفُونَ بِعَهْدِ اللَّهِ وَلَا يَنْقُضُونَ الْمِيثَاقَ (20) وَالَّذِينَ يَصِلُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيَخْشَوْنَ رَبَّهُمْوَيَخَافُونَ سُوءَ الْحِسَابِ (21) وَالَّذِينَ صَبَرُوا ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِمْ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَأَنْفَقُوا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرًّا وَعَلَانِيَةً وَيَدْرَءُونَ بِالْحَسَنَةِ السَّيِّئَةَأُولَئِكَ لَهُمْ عُقْبَى الدَّارِ (22)  
'বুদ্ধিমানরাই শুধু উপদেশ গ্রহণ করে। যারা তাদের রবের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সবর করেসালাত কায়েম করে এবং আমি তাদের যে রিযক প্রদান করেছিতা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে এবং ভালো কাজের মাধ্যমে মন্দকে দূর করেতাদের জন্যই রয়েছে আখিরাতের শুভ পরিণাম। আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেনযারা তা অটুট রাখে এবং তাদের রবকে ভয় করেআর মন্দ হিসাবের আশঙ্কা করে। যারা আল্লাহর অঙ্গীকার পূর্ণ করে এবং প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে না।'[19]

তাই বলে বিপদ কামনা করার বিধান নেই

বিপদে ধৈর্য ধরার ফযীলত অনেক। তাই বলে শরীয়তে বিপদ কামনা করার অনুমতি দেয়া হয়নি। কারণ, মুমিন সচেতন ও বুদ্ধিমান। সে কখনো বিপদ প্রত্যাশা করতে পারে না। তবে বিপদ এসে পড়লে তাতে সে বিচলিতও হয় নাবরং ধৈর্য ধরে। বিপদের সময় দৃঢ়তা ও সহনশীলতার পরিচয় দেয়। যেমন বুখারী শরীফে আব্দুল্লাহ বিন আবূ আওফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছেযুদ্ধের দিনগুলোতে একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপেক্ষায় থাকলেন। যখন সূর্য ডুবে গেল তখন তিনি তাঁদের মাঝে দাঁড়িয়ে বললেন,
أَيُّهَا النَّاسُ لاَ تَتَمَنَّوْا لِقَاءَ الْعَدُوِّ وَسَلُوا اللَّهَ الْعَافِيَةَ فَإِذَا لَقِيتُمُوهُمْ فَاصْبِرُوا وَاعْلَمُوا أَنَّ الْجَنَّةَ تَحْتَ ظِلاَلِ السُّيُوفِ.
'হে লোকসকলতোমরা শত্রুদের সঙ্গে মুখোমুখি হবার প্রত্যাশা করো না এবং আল্লাহ তা'আলার কাছে শান্তি ও নিরাপত্তা কামনা করো। তবে যখন তোমরা তাদের মুখোমুখি হওতখন ধৈর্য ধর এবং সবর করো। আর জেনে রেখোজান্নাত তরবারির ছায়া তলে।'[20]
ইবনে বাত্তাল রহ. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে শত্রু-সাক্ষাতের প্রত্যাশা করতে বারণ করেছেন। কারণসে জানে না সামনে কী ঘটবে আর বিপদে পরিত্রাণইবা পাওয়া যাবে কীভাবে। এ থেকে অপছন্দনীয় বিষয় প্রার্থনা করা এবং অপ্রিয় অবস্থা মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ নিতে চাওয়ার নিষেধাজ্ঞা বুঝা যায়। এ জন্যই পূর্বসূরী নেককার ব্যক্তিগণ আল্লাহ তা'আলার কাছে বিপদাপদ ও পরীক্ষা থেকে মুক্তি প্রার্থনা করেছেন। কেননা সবাই সবসময় ধৈর্য ও সহনশীলতা দেখাতে পারে না।
আমরা তো সেই সাহাবীর কথা শুনে থাকবো যিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিয়ে আহত অবস্থায় যন্ত্রণা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেনএ জন্যই কিন্তু আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন,
لأَنْ أُعَافَى فَأَشْكُرَ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ أَنْ أُبْتَلَى فَأَصْبِرَ
'সুস্থ থাকবো আর শুকরিয়া আদায় করবো- এটাই আমার কাছে প্রিয় বিপদে থেকে সবর করার চেয়ে।'[21]
একজন প্রকৃত মুমিন কিন্তু সর্বাবস্থায় দৃঢভাবে এ কথা বিশ্বাস করে যেসে যে অবস্থায় আছেতাতে কোনো কল্যাণ নিহিত রয়েছে। যেমন মুসলিম শরীফে ছুহাইব বিন সিনান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে মারফু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে,
عَجَبًا لأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَاكَ لأَحَدٍ إِلاَّ لِلْمُؤْمِنِ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَخَيْرًا لَهُ.
'মুমিনের অবস্থা কতইনা চমৎকার! তার সব অবস্থায়তেই কল্যাণ থাকে। এটি শুধু মুমিনেরই বৈশিষ্ট্য যেযখন সে আনন্দের উপলক্ষ পায়আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। ফলে তা হয় তার জন্য কল্যাণবাহী। আর যখন সে কষ্টের সম্মুখীন হয়তখন সবর করে এবং ধৈর্যে অটল থাকে। ফলে এটিও তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে।'[22]

বিপদ মুমিনের নিত্যসঙ্গী

আমাদের মনে রাখতে হবেমুমিনের পুরো জীবনই পরীক্ষায় ভরা। আল্লাহ তা'আলা যেমন ইরশাদ করেন,
وَنَبْلُوكُمْ بِالشَّرِّ وَالْخَيْرِ فِتْنَةً وَإِلَيْنَا تُرْجَعُونَ (35)
‌'আর ভালো ও মন্দ দ্বারা আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমার কাছেই তোমাদেরকে ফিরে আসতে হবে।'[23]
আল্লাহ তা'আলা তাঁর বান্দাকে প্রতি মুহূর্তে পরীক্ষা করেন। তিনি দেখতে চান কে ধৈর্যশীলকে মুজাহিদ আর কে সত্যবাদী। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন,
أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللَّهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنْكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ (142)
'তোমরা কি মনে কর যেতোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবেঅথচ আল্লাহ এখনো জানেন নি তাদেরকে যারা তোমাদের মধ্য থেকে জিহাদ করেছে এবং জানেন নি ধৈর্যশীলদেরকে।'[24]
তিনি আরও ইরশাদ করেন,
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّى نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِينَ مِنْكُمْ وَالصَّابِرِينَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ (31)
'আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব যতক্ষণ না আমি প্রকাশ করে দেই তোমাদের মধ্যে কারা জিহাদকারী ও ধৈর্যশীল এবং আমি তোমাদের কথা কাজ পরীক্ষা করে নেব।'[25]
অন্যত্র ইরশাদ করেন,
إِنْ يَمْسَسْكُمْ قَرْحٌ فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِثْلُهُ وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا وَيَتَّخِذَ مِنْكُمْ شُهَدَاءَ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ(140)
'যদি তোমাদেরকে কোনো আঘাত স্পর্শ করে থাকে তবে তার অনুরূপ আঘাত উক্ত কওমকেও স্পর্শ করেছে। আর এইসব দিন আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন করি এবং যাতে আল্লাহ ঈমানদারদেরকে জেনে নেন এবং তোমাদের মধ্য থেকে শহীদদেরকে গ্রহণ করেন। আর আল্লাহ যালিমদেরকে ভালোবাসেন না।'[26]
আল্লাহ তা'আলা আরও সুনির্দষ্ট করে বলেন,
إِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ وَاللَّهُ عِنْدَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ (15)
‌'তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো কেবল পরীক্ষা বিশেষ। আর আল্লাহর নিকটই মহান প্রতিদান।'[27]  

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সাহাবীদের সবর শিক্ষা দিয়েছেন

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং তাঁর শীষ্য ও সাহাবীদের সবর শিক্ষা দিয়েছেন। এটি বেশি করা হয়েছে মক্কী জীবনে। যেমন খুবাইব বিন আরাত রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদীসে আমরা এর চিত্র দেখতে পাই। তিনি বলেন,
شَكَوْنَا إِلَى رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَهْوَ مُتَوَسِّدٌ بُرْدَةً لَهُ فِي ظِلِّ الْكَعْبَةِ قُلْنَا لَهُ أَلاَ تَسْتَنْصِرُ لَنَا أَلاَ تَدْعُو اللَّهَ لَنَا قَالَ كَانَ الرَّجُلُفِيمَنْ قَبْلَكُمْ يُحْفَرُ لَهُ فِي الأَرْضِ فَيُجْعَلُ فِيهِ فَيُجَاءُ بِالْمِنْشَارِ فَيُوضَعُ عَلَى رَأْسِهِ فَيُشَقُّ بِاثْنَتَيْنِ وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ وَيُمْشَطُ بِأَمْشَاطِالْحَدِيدِ مَا دُونَ لَحْمِهِ مِنْ عَظْمٍ ، أَوْ عَصَبٍ وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ وَاللَّهِ لَيُتِمَّنَّ هَذَا الأَمْرَ حَتَّى يَسِيرَ الرَّاكِبُ مِنْ صَنْعَاءَ إِلَى حَضْرَمَوْتَلاَ يَخَافُ إِلاَّ اللَّهَ ، أَوِ الذِّئْبَ عَلَى غَنَمِهِ وَلَكِنَّكُمْ تَسْتَعْجِلُون.
'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন কা'বার ছায়ায় বালিশে হেলান দিয়েছিলেন। আমরা তাঁর কাছে অভিযোগ করলামকেন আপনি আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য সাহায্য চাইছেন নাআমাদের জন্য তাঁর কাছে দু'আ করছেন না। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনতোমাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে (এমন বিপদও এসেছে যে) কাউকে ধরা হতো। তারপর গর্ত খনন করে তাকে সেই গর্তে ফেলা হতো। এরপর করাত এনে তার মাথার ওপর রাখা হতো। অতপর তাকে দুই টুকরো করে লোহার চিরুনী দিয়ে তার শিরা-অস্থিসহ আচড়ানো হতো। তদুপরি তারা তাকে দীন থেকে ফেরাতে পারতো না। আল্লাহর শপথ! (এখন আমাদের পরীক্ষা চলছে) আল্লাহ এ দীনকে পূর্ণতা দেবেন। একদিন এমন আসবে যখন আরোহীরা সানআ থেকে হাযারামাউত পর্যন্ত যাবে। চিতা আর ছাগল নিরাপদে থাকবে। এক আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করতে হবে না। কিন্তু তোমরা তাড়াহুড়া করছো।'[28]
অর্থাৎ মক্কার মুশরিকদের আযাব অচিরেই দূর হয়ে যাবে। সুতরাং অতীতের উম্মতের মতো তোমরাও দীনের বিপদে একটু ধৈর্য ধরো।  

সবরের ফযীলত-মর্যাদা
  
সবরের কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহর বান্দা মাত্রেই সবর করতে হবে। কেননা কখনো আল্লাহর আদেশ মানতে হবেতাঁর নির্দেশিত কাজ করতে হবে। আবার কখনো তাঁর নিষেধ মেনে চলতে হবেবিরত থাকতে তা করা থেকে। আবার কখনো অকস্মাৎ তাকদীরের কোনো ফয়সালা এসে পড়বে। নেয়ামত দেয়া হবেতখন শুকরিয়া আদায় করতে হবে। এভাবে নানা অবস্থার মধ্য দিয়ে মুমিনের জীবন অতিবাহিত হয়। সুতরাং মৃত্যু পর্যন্ত এই সবরকে সাথে নিয়েই চলতে হবে। এজন্যই সবরের অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে।

ক. উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,
مَا مِنْ مُسْلِمٍ تُصِيبُهُ مُصِيبَةٌ فَيَقُولُ مَا أَمَرَهُ اللَّهُ إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ اللَّهُمَّ أْجُرْنِى فِى مُصِيبَتِى وَأَخْلِفْ لِى خَيْرًا مِنْهَاإِلاَّ أَخْلَفَ اللَّهُ لَهُخَيْرًا مِنْهَاقَالَتْ فَلَمَّا مَاتَ أَبُو سَلَمَةَ قُلْتُ أَىُّ الْمُسْلِمِينَ خَيْرٌ مِنْ أَبِى سَلَمَةَ أَوَّلُ بَيْتٍ هَاجَرَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم-. ثُمَّ إِنِّىقُلْتُهَا فَأَخْلَفَ اللَّهُ لِى رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم-.
'যে ব্যক্তি কোনো বিপদে পড়ে আল্লাহ যা নির্দেশ দিয়েছেন অর্থাৎ إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ পড়বে এবং বলবেহে আল্লাহআমাকে আমার বিপদের প্রতিদান দিন এবং আমাকে এর চেয়ে উত্তম কিছু দান করুন। আল্লাহ তাকে তার চেয়ে উত্তম কিছু দান করবেন।' উম্মে সালামা বলেনআবূ সালামা মারা গেল। আমি ভাবলাম, আবূ সালামার চেয়ে উত্তম মুসলমান আর কে হতে পারেতাঁর ঘরেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম হিজরত করেছেন। আমি মনে মনে এ কথা ভাবলাম আর আল্লাহ তা'আলা আমাকে স্বয়ং রাসূলুল্লাহকেই স্বামী হিসেবে দান করলেন।'[29]

খ. আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُصِبْ مِنْهُ.
'আল্লাহ যার ভালো চানতাকে বিপদ দেন।'[30]

গ. আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَا مِنْ مُصِيبَةٍ تُصِيبُ الْمُسْلِمَ إِلاَّ كَفَّرَ اللَّهُ بِهَا عَنْهُ حَتَّى الشَّوْكَةِ يُشَاكُهَا.
'মুমিনকে যেকোনো বিপদই স্পর্শ করুক না কেন আল্লাহ তার বিনিময়ে তার গুনাহ মাফ করে দেন। এমনকি (চলতি পথে) পায়ে যে কাঁটা বিঁধে (তার বিনিময়েও গুনাহ মাফ করা হয়।)'[31]

ঘ. আব মুসা আশআরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِذَا مَرِضَ الْعَبْدُ ، أَوْ سَافَرَ كُتِبَ لَهُ مِثْلُ مَا كَانَ يَعْمَلُ مُقِيمًا صَحِيحًا.
'যখন কোনো ব্যক্তি অসুস্থ হয় অথবা সফর করেতার জন্য সে সুস্থ্য ও ঘরে থাকতে যেরূপ নেকি কামাই করতো অনুরূপ নেকি লেখা হয়।'[32]

ঙ. এক বুযুর্গ বলেন,
لولا المصائب لوردنا يوم القيامة مفاليس
'যদি দুনিয়ার বিপদাপদ না থাকতো তাহলে আখিরাতে আমরা রিক্ত অবস্থায় উপনীত হতাম।'[33]

চ. সুফিয়ান বিন উয়াইনা রহ. নিচের আয়াত :  
وَجَعَلْنَا مِنْهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا لَمَّا صَبَرُوا وَكَانُوا بِآَيَاتِنَا يُوقِنُونَ (24)
'আর আমি তাদের মধ্য থেকে বহু নেতা করেছিলামতারা আমার আদেশানুযায়ী সৎপথ প্রদর্শন করতযখন তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। আর তারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখত।' (আস-সাজদাহ : ২৪)-এর ব্যাখ্যায় বলেনযেহেতু তারা সকল কৌশলের মূল তথা ধৈর্য অবলম্বন করেছে তাই আমি তাদেরকে নেতা বানিয়ে দিলাম।[34]

ছ. উরওয়া ইবন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু যুদ্ধে আহত হবার পর যখন সাহাবীরা তার পা কাটতে উদ্যত হলেনতারা বললেন,
لو سقيناك شيئا حتى لا تشعر بالوجع قال إنما ابتلاني ليرى صبري أفأعارض أمره بدفع
আমরা কি আপনাকে কিছু খাইয়ে দেবো যাতে আপনি কষ্ট অনুভব না করেনতিনি বললেনআল্লাহ আমাকে আমার ধৈর্য দেখার জন্যই এ বিপদে ফেলেছেন। আমি কি তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে পারি?![35]

. উমর বিন আবদুল আজীজ রহ. বলেন,
مَا أَنْعَمَ اللهُ عَلَى عَبْدٍ نِعْمَةً فَانْتَزَعَهَا مِنْهُ فَعَاضَهُ مِنْ ذَلِكَ الصَّبْرَ إِلَّا كَانَ مَا عَاضَهُ خَيْرًا مِمَّا انْتَزَعَ مِنْهُ
যাকে আল্লাহ তাআলা কোনো নেয়ামত দিয়ে তা ছিনিয়ে নিয়েছেন এবং তার স্থলে তাকে সবর দান করেছেনতো এই ব্যক্তি থেকে যা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে তার চেয়ে সেটাই উত্তম যা তাকে দান করা হয়েছে।'[36]

ঝ. আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু অসুস্থ হলে তাকে দেখতে গিয়ে সাহাবীরা বললেন,
ألا ندعو لك الطبيب، فقال: قد رآني الطبيب، قالوا: فأي شيء قال لك، قال: قال إني فعال لما أريد.
আমরা কি আপনার জন্য চিকিৎসক ডেকে আনবো নাতিনি বললেনচিকিৎসক আমাকে দেখেছেন। তারা বললেনচিকিৎসক আপনাকে কী বলেছেন?তিনি বললেন, বলেছেন, 'আমি যা চাই তা-ই করি'।[37]

শেষ কথা

জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে আমাদেরকে সবর ও ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। ধৈর্য ধরতে হবে প্রতিবেশির আচরণে। তার দেয়া কষ্ট অম্লান বদনে সহ্য করতে হবে। থাকতে হবে তার কল্যাণে সদা সচেষ্ট। আত্মীয়দের কথা যদি বলেনতারাও কষ্ট দেবে আপনাকে। এতে সবর করুন আর নেকির প্রত্যাশায় থাকুন। আপনার অধীনস্ত যারা আছে তারাও আপনাকে ত্যক্ত-বিরক্ত করবে। তাদের আচরণেও আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে। মনে রাখবেনপৃথিবীটা কিন্তু আপনার-আমার নিয়ম মাফিক চলবে না। জগতের সবাই নিয়ম রক্ষাও করতে পারবে না। স্বামী হলে স্ত্রীর ব্যবহারে আপনাকে সহিষ্ণুতা ও সবরের স্বাক্ষর রাখতে হবে। তার মন্দ দিকগুলো যখন ফুটে হতে থাকেতখন আপনি তার ভালো ও প্রশংসনীয় গুণগুলো সামনে আনবেন। একইভাবে আপনি যদি স্ত্রী হনতবে আপনাকেও ওই সবরের দ্বারস্থ হতে হবে। স্বামীর সব কিছুতেই অভিযোগ আনবে চলবে না। তার ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করুন। ঘরের বাইরে তিনি যে কষ্ট-যাতনা সহ্য করেন তার দিকে তাকিয়ে আপনি ঘরের ভেতরে তার অপছন্দনীয় জিনিসগুলো সহনীয় হিসেবে গণ্য করুন।
মানুষের আচরণে সবর করতেই হবে। সবাই তার দায়িত্ব সুন্দরভাবে সম্পাদন করতে পারে না। সব মানুষের আখলাক-চরিত্রও একরকম নয়। একেকজনের স্বভাব একেকরকম। অতএব সবরের কোনো বিকল্প নেই। সবর করুন আর এর সুফলের কথা মাথায় রাখুন। কারণ, সবরকারী তার সবরের বদৌলতে প্রভূত কল্যাণ অর্জন করেন। যার সবর নেই, সবখানেই তিনি কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হন। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সকলকে সবরের মতো মহৎ গুণের অধিকারী বানান। আমাদেরকে ধৈর্যশীল বান্দা হবার তাওফীক দিন। আমীন।



[1]আলে-ইমরান : ২০০
[2]হজ : ১১।
[3]সূরা আল-হাদীদ : ২১।
[4]সূরা আয-যুমার : ১০।
[5]সূরা আল-আনফাল : ৪৬।
[6]সূরা আস-সাজদাহ : ২৪।
[7]. সূরা আন-নাহল, আয়াত : ১২৬।
[8]. আলে-ইমরান, আয়াত : ১২০।
[9]. আলে-ইমরান, আয়াত : ২০০।
[10]. আলে-ইমরান, আয়াত : ১৪৬।
[11]. সূরা আল-বাকারাআয়াত : ১৫৫-১৫৭।
[12]. সূরা আল-মুমিনুনআয়াত : ১১১।
[13]. সূরা লুকমানআয়াত : ৩১।
[14]. সূরা ইবরাহীমআয়াত : ৫।
[15]. সূরা আস-সাবাআয়াত : ১৯।
[16]. সূরা আশ-শূরাআয়াত : ৩৩।
[17]. সূরা ইউসূফ, আয়াত : ৮৬।
[18]. সূরা লুকমানআয়াত : ১৭।
[19]. সূরা আর-রা'আয়াত : ১৯-২২।
[20]. বুখারী : ২৯৬৫; মুসলিম : ৪৬৪০।
[21]. তাবরানী, মুজামুল কাবীর : ১৭৬৬; বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান : ৪১২১।  
[22]. মুসলিম : ৭৬৯২।
[23]. সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত : ৩৫।
[24]. সূরা আলে-ইমরান, আয়াত : ১৪২।
[25]. সূরা মুহাম্মদ, আয়াত : ৩১।
[26]. সূরা আলে-ইমরান, আয়াত : ১৪০।
[27]. সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত : ১৫।
[28]. বুখারী : ৩৬১২।
[29]. মুসলিম : ২১৬৫।  
[30]. বুখারী : ৫৬৪৫; আহমদ, মুসনাদ : ৭২৩৪।
[31]. বুখারী : ৫৬৪০; মুসলিম : ৬৭৩০।
[32]. বুখারী : ২৯৯৬; আহমদ, মুসনাদ : ১৯৬৯৪।
[33]. শায়খ মুনাজ্জিদ, ইলাজুল হুমূম।
[34]. ইবন কাছীর : ৬/৩৭২।
[35]. আল-মারযু ওয়াল-কাফফারাত, ১/১৩৯।
[36]. বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান : ৯৫৬৫; মুসান্নাফ, ইবন আবী শাইবা : ৩৬২৪২।
[37]. আহমদ, আয-যুহদ : ২/১০৪।

                   ----------------------------------------------------------------------------------

                      '' শুধু নিজে শিক্ষিত হলে হবেনা, প্রথমে বিবেকটাকে শিক্ষিত করুন। ''

কোন মন্তব্য নেই:

Comment here />

Widget ByBlogger Maruf
Widget ByBlogger Maruf