দান-ছদকার ফযীলত
দান-ছদকার ফযীলত
ধন-সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ তা’আলা। তিনি যাকে ইচ্ছা উহা প্রদান করে থাকেন। এজন্য এ সম্পদ অর্জন ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে তাঁর বিধি-নিষেধ মেনে চলা আবশ্যক। সৎ পন্থায় সম্পদ উপার্জন ও সৎ পথে উহা ব্যয় করা হলেই তার হিসাব প্রদান করা সহজ হবে। কিয়ামতের দিন যে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কোন মানুষ সামনে যেতে পারবে না, তম্মধ্যে দু’টি প্রশ্নই ধন-সম্পদ বিষয়ক। প্রশ্ন করা হবে, কোন পথে সম্পদ উপার্জন করেছ এবং কোন পথে উহা ব্যয় করেছ।
সন্দেহ নেই ধন-সম্পদ নিজের আরাম-আয়েশ এবং পরিবারের ভরণ-পোষণের ক্ষেত্রে ব্যয় করার অনুমতি ইসলামে আছে এবং অনাগত সন্তানদের জন্য সঞ্চিত করে রাখাও পাপের কিছু নয়। কিন্তু পাপ ও অন্যায় হচ্ছে, সম্পদে গরীব-দুঃখীর হক আদায় না করা। অভাবী মানুষের দুঃখ দূর করার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা। অথচ আল্লাহ বলেন:
وَالَّذِينَ فِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ مَعْلُومٌ، لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ
“এবং তাদের সম্পদে নির্দিষ্ট হক রয়েছে। ভিক্ষুক এবং বঞ্চিত (অভাবী অথচ লজ্জায় কারো কাছে হাত পাতে না) সকলের হক রয়েছে।” (মাআরেজ- ২৪-২৫)অধিকাংশ মানুষ দান-খয়রাত করতে চায় না। মনে করে এতে সম্পদ কমে যাবে। তাই সম্পদ সঞ্চিত করে রাখতেই সর্বদা সচেষ্ট থাকে, এমনকি নিজের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেও খরচ করতে কৃপণতা করে।
রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
“মানুষ বলে আমার সম্পদ আমার সম্পদ অথচ তিনটি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সম্পদই শুধু তার। যা খেয়ে শেষ করেছে, যা পরিধান করে নষ্ট করেছে এবং যা দান করে জমা করেছে- তাই শুধু তার। আর অবশিষ্ট সম্পদ সে ছেড়ে যাবে, মানুষ তা নিয়ে যাবে।” (মুসলিম)
দান-ছাদকা করার ফযীলত
দান-ছাদকা করলে সম্পদ কমে না:
আবু কাবশা আল আনমারী (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি শুনেছেন রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
” مَا نَقَصَ مَالُ عَبْدٍ مِنْ صَدَقَةٍ
“ছাদকা করলে কোন মানুষের সম্পদ কমে না।” (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)ক) দান সম্পদকে বৃদ্ধি করে:
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন:
مَثَلُ الَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنْبُلَةٍ مِائَةُ حَبَّةٍ وَاللَّهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ
“যারা আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ ব্যয় করে তার উদাহরণ হচ্ছে সেই বীজের মত যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। আর প্রতিটি শীষে একশতটি করে দানা থাকে। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অতিরিক্ত দান করেন। আল্লাহ সুপ্রশস্ত সুবিজ্ঞ।” (সূরা বাকারা-২৬১)রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
مَنْ أَنْفَقَ نَفَقَةً فِي سَبِيلِ اللَّهِ كَانَتْ لَهُ بِسَبْعِ مِائَةِ ضِعْفٍ
“যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে কোন কিছু ব্যয় করবে তাকে সাতশত গুণ ছওয়াব প্রদান করা হবে।” (আহমাদ, সনদ ছহীহ)রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও বলেন:
“যে ব্যক্তি নিজের হালাল কামাই থেকে- আল্লাহ হালাল কামাই ছাড়া দান কবুল করেন না- একটি খেজুর ছাদকা করে, আল্লাহ উহা ডান হাতে কবুল করেন অতঃপর তা বৃদ্ধি করতে থাকেন- যেমন তোমরা ঘোড়ার বাচ্চাকে প্রতিপালন করে থাক- এমনকি উহা একটি পাহাড় পরিমাণ হয়ে যায়।” (বুখারী ও মুসলিম)
খ) দানকারীর জন্য ফেরেশতা দু’আ করে:
আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
“প্রতিদিন সকালে দু’জন ফেরেশতা অবতরণ করেন। তাদের একজন দানকারীর জন্য দু’আ করে বল,
اللَّهُمَّ أَعْطِ مُنْفِقًا خَلَفًا
“হে আল্লাহ দানকারীর মালে বিনিময় দান কর। (বিনিময় সম্পদ বৃদ্ধি কর)” আর দ্বিতীয়জন কৃপণের জন্য বদ দু’আ করে বলেন,
اللَّهُمَّ أَعْطِ مُمْسِكًا تَلَفًا
“হে আল্লাহ কৃপণের মালে ধ্বংস দাও।” (বুখারী ও মুসলিম)গ) দানকারীর দুনিয়া আখিরাতের সকল বিষয় সহজ করে দেয়া হয়:
আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
مَنْ يَسَّرَ عَلَى مُعْسِرٍ يَسَّرَ اللَّهُ عَلَيْهِ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ
”যে ব্যক্তি কোন অভাব গ্রস্তের অভাব দূর করবে, আল্লাহ তার দু’নিয়া ও আখিরাতের সকল বিষয় সহজ করে দিবেন।” (মুসলিম)ঙ) গোপনে দান করার ফযীলতঃ
গোপন-প্রকাশ্যে যে কোনভাবে দান করা যায়। সকল দানেই ছওয়াব রয়েছে। আল্লাহ বলেন:
إِنْ تُبْدُوا الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَ وَإِنْ تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الْفُقَرَاءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَيُكَفِّرُ عَنْكُمْ مِنْ سَيِّئَاتِكُمْ
”যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-খয়রাত কর, তবে তা কতই না উত্তম। আর যদি গোপনে ফকীর-মিসকিনকে দান করে দাও, তবে এটা বেশী উত্তম। আর তিনি তোমাদের পাপ সমূহ ক্ষমা করে দিবেন।” (সূরা বকারা- ২৭১)চ) গোপনে দানকারী কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের নীচে ছায়া লাভ করবে:
নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
“কিয়ামত দিবসে সাত শ্রেণীর মানুষ আরশের নীচে ছায়া লাভ করবে।… তম্মধ্যে এক শ্রেণী হচ্ছে:
وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّى لَا تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ
“এক ব্যক্তি এত গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত কি দান করে বাম হাত জানতেই পারে না।” (বুখারী ও মুসলিম)ছ) দান-ছাদকা গুনাহ মাফ করে ও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচায়:
নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
“হে কা‘ব বিন উজরা! ছালাত (আল্লাহর) নৈকট্য দানকারী, ছিয়াম ঢাল স্বরূপ এবং দান-ছাদকা গুনাহ মিটিয়ে ফেলে যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে ফেলে।” (আবু ইয়ালা, সনদ ছহীহ)
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
اتَّقُوا النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ
“খেজুরের একটি অংশ দান করে হলেও তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা কর।” (বুখারী ও মুসলিম)জ) মানুষ কিয়ামতে দান-ছাদকার ছায়াতলে থাকবে:
উক্ববা বিন আমের (রা:) থেকে বর্ণিত। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
“নিশ্চয় দান-ছাদকা দানকারী থেকে কবরের গরম নিভিয়ে দিবে। আর মু’মিন কিয়ামত দিবসে নিজের ছাদকার ছায়াতলে অবস্থান করবে।” (ত্ববরানী, বাইহাক্বী, সনদ ছহীহ)
লোক দেখানোর জন্য দান
কিন্তু বর্তমান যুগে অনেক মানুষ এমন আছে, যারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে দান করে এবং তা মানুষকে দেখানোর জন্য। মানুষের ভালবাসা নেয়ার জন্য। মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর জন্য। মানুষের মাঝে গর্ব অহংকার প্রকাশ করার জন্য। অনেকে দুনিয়াবি স্বার্থ সিদ্ধির জন্যও দান করে থাকে। যেমন, চেয়ারম্যান বা এমপি নির্বাচনে জেতার উদ্দেশ্য দান করে। কিন্তু দান যদি একনিষ্ঠ ভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য না হয় তা দ্বারা হয়ত দুনিয়াবি কিছু স্বার্থ হাসিল হতে পারে কিন্তু আখেরাতে তার কোন প্রতিদান পাওয়া যাবে না।
হাদীছে কুদসীতে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন আল্লাহ বলেন:
أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ مَنْ عَمِلَ عَمَلًا أَشْرَكَ فِيهِ مَعِي غَيْرِي تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ “
“আমি শির্ক কারীদের শিরক থেকে মুক্ত। যে ব্যক্তি কোন আমল করে তাতে আমার সাথে অন্যকে শরীক করবে, তাকে এবং তার শির্কী আমলকে আমি পরিত্যাগ করব।” (মুসলিম)বরং যারা মানুষের প্রশংসা নেয়ার উদ্দেশ্যে দান করবে, তাদের দ্বারাই জাহান্নামের আগুনকে সর্বপ্রথম প্রজ্বলিত করা হবে।
রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
“সর্বপ্রথম তিন ব্যক্তিকে দিয়ে জাহান্নামের আগুনকে প্রজ্বলিত করা হবে।… তম্মধ্যে (সর্ব প্রথম বিচার করা হবে) সেই ব্যক্তির, আল্লাহ যাকে প্রশস্ততা দান করেছিলেন, দান করেছিলেন বিভিন্ন ধরনের অর্থ-সম্পদ। তাকে সম্মুখে নিয়ে আসা হবে। অতঃপর (আল্লাহ) তাকে প্রদত্ত নেয়ামত রাজীর পরিচয় করাবেন। সে উহা চিনতে পারবে। তখন তিনি প্রশ্ন করবেন, কি কাজ করেছ এই নেয়ামত সমূহ দ্বারা? সে জবাব দিবে, যে পথে অর্থ ব্যয় করলে আপনি খুশি হবেন এ ধরনের সকল পথে আপনার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করেছি। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি এরূপ করেছ এই উদ্দেশ্যে যে, তোমাকে বলা হবে, সে দানবীর। আর তা তো বলাই হয়েছে। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হবে। তখন তাকে মুখের উপর উপুড় করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।” (মুসলিম)
আত্মীয়-স্বজনকে দান করা
সালমান বিন আমের (রা:) থেকে বর্ণিত, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
“মিসকিনকে দান করলে তা শুধু একটি দান হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু গরীব নিকটাত্মীয়কে দান করলে তাতে দ্বিগুণ ছওয়াব হয়। একটি ছাদকার; অন্যটি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার।” (নাসাঈ, তিরমিযী)
দান-ছাদকা করে খোঁটা দেয়া
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُبْطِلُوا صَدَقَاتِكُمْ بِالْمَنِّ وَالْأَذَى
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা খোঁটা দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান-খায়রাতকে বরবাদ করে দিও না।” (সূরা বকারা- ২৬৪)আবু যর (রা:) থেকে বর্ণিত, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
“কিয়ামত দিবসে আল্লাহ পাক তিন ব্যক্তির সাথে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না, তাদেরকে পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণা দায়ক শাস্তি। কথাটি তিনি তিনবার বললেন। আবু যার (রা:) বললেন, ওরা ধ্বংস হোক ক্ষতিগ্রস্ত হোক- কারা তারা হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, “টাখনুর নীচে ঝুলিয়ে যে কাপড় পরিধান করে, দান করে যে খোঁটা দেয় এবং মিথ্যা শপথ করে যে ব্যবসায়ী পণ্য বিক্রয় করে।” (মুসলিম)
কৃপণের পরিণতি
কৃপণতা একটি নিকৃষ্ট বিষয়। কৃপণতা থেকে মনের মাঝে হিংসা সৃষ্টি হয়। এ কারণে মানুষ লোভী হয়। ফলে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং সম্পদের লোভে যে কোন ধরণের অন্যায় ও অবৈধ কাজে পা বাড়ায়। এজন্য নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবিষয়ে উম্মতকে সতর্ক করেছেন।
তিনি বলেছেন:
“তোমরা কৃপণতা ও লোভ থেকে সাবধান। কেননা পূর্ব যুগে এই কারণে মানুষ রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, মানুষকে খুন করেছে এবং নানা প্রকার পাপাচার ও হারাম কাজে লিপ্ত হয়েছে।” (আবু দাউদ, হাকেম) এজন্য নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কৃপণতা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। তিনি দু’আয় বলতেন, “হে আল্লাহ তোমার কাছে কৃপণতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।..” (মুসলিম)
----------------------------------------------------------------------------------
'' শুধু নিজে শিক্ষিত হলে হবেনা, প্রথমে বিবেকটাকে শিক্ষিত করুন। ''
আলহামদুলিল্লাহ্ , অনেক ধন্যবাদ এই গুরুত্বপূর্ণ পোষ্টের জন্য ।
উত্তরমুছুন