মুসলমানরা বিশ্বাস করে, সূরা আল ইসরা (বনি ইসরাইল) শবে মিরাজের ঘটনার পর মক্কায় মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল।
এই সূরায় আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের কয়েকটি মৌলিক অঙ্গীকারের উল্লেখ করেছেন। এই অঙ্গীকারগুলো পূরণ না করে কোনো ব্যক্তি বা দল সফল হতে পারে না। এসব মূল্যবোধের ভিত্তিতে মুসলমানদের জীবনযাপন করতে হয়। আর তাদের মানব জাতিকে এই মূলনীতিগুলোর দিকে আহ্বান জানানো উচিত।
এসব মূলনীতি কেবল বিশেষ একটি গোত্র বা দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং পরিধি ও প্রয়োগের দিক দিয়ে বিশ্বজনীন। এগুলো ‘হিকমাহ’ নামেও অভিহিত, যার অর্থ প্রজ্ঞাপূর্ণ শিক্ষা। যথাযথভাবে অনুসরণ করা হলে এই মূলনীতিগুলো সব মানুষের কল্যাণ ও প্রজ্ঞা বৃদ্ধি করতে সক্ষম। এগুলো হচ্ছে-
শুধু আল্লাহর ইবাদত
‘তোমার প্রভু আদেশ করেছেন, তোমরা তাঁর ব্যতীত আর কারো বন্দেগী বা ইবাদত করবে না (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ২৩)। এর অর্থ, পরম বাস্তবতা এবং একক উপাস্যরূপে আল্লাহতায়ালার স্বীকৃতি প্রদান, সম্পূর্ণ নিষ্ঠাসহকারে তাঁর ইবাদত করা এবং জীবনের প্রতিটি বিষয়ে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ। একজন মুসলিমের জীবন আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়া ছাড়া কিছু নয়।
আমরা কেবল একত্ববাদীই নই; সেই অদ্বিতীয় স্রষ্টাকেন্দ্রিক জীবন আমাদের। তিনিই আমাদের সার্বক্ষণিক ও চূড়ান্ত ভাবনার বিষয়।
মাতাপিতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও দয়ালু হওয়া
‘আর (যাতে তোমরা দেখাও) মাতাপিতার প্রতি দয়া। যদি তাদের একজন কিংবা উভয়ে তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হন, তাদের ব্যাপারে ‘উহ’ পর্যন্ত বলো না, অথবা তাদের ধমক দিও না; বরং তাদের সাথে শিষ্টাচারপূর্ণভাবে কথা বলো। তাদের প্রতি ভালোবাসার সাথে, অত্যন্ত নম্র ও বিনয়ী আচরণ করো; এবং বলো, হে পালনকর্তা তাদের উভয়ের প্রতি দয়া করো, যেমন তারা শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছেন (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ২৩-২৪)।
সন্তানের জন্য মাতাপিতার দয়া ও দরদের স্বীকৃতি, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং তাদের ভালোবাসার প্রতিদানে যথাসাধ্য করার জন্যই এটা।
মাতাপিতার প্রতি সন্তানের ভক্তি হলো মুসলমানদের দ্বিতীয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও দয়া আমাদের জন্য নিছক সামাজিক দায়িত্ব নয়। এটা আমাদের ধর্মীয় দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতাও বটে।
আত্মীয়, দরিদ্র ও মুসাফিরের প্রতি সদয় হওয়া
আত্মীয়স্বজনকে তাদের প্রাপ্য দাও, আর অভাবী ও মুসাফিরকে তাদের প্রাপ্য (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ২৬)।
মনে রাখা দরকার, এই পৃথিবীতে আমরা পরস্পর সম্পর্কিত। আমাদের দায়িত্ব কেবল নিজের প্রতি নয়, কিংবা শুধু পরিবারের প্রতিও নয়। অন্যান্য আত্মীয় এবং বৃহত্তর পর্যায়ে, সমাজের প্রতিও আমাদের কর্তব্য রয়েছে।
আমরা একে অপরের মুখাপেক্ষী এবং এই জীবনপথে আমরা সবাই সহযাত্রী। অন্যের জন্য আমরা কী করতে পারি, সেদিকে অবশ্যই আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। মুসলমানদের জীবন অবশ্যই সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল হতে হবে। এই দায়িত্বের সূচনা হয় পরিবারে এবং অন্যান্য আত্মীয়ের ক্ষেত্রে। যারা অভাবগ্রস্ত, যাদের প্রয়োজন সাহায্য, এমন সবার প্রতি দায়িত্ব রয়েছে।
অর্থের ব্যাপারে সতর্কতা এবং সম্পদের অপচয় না করা
আর (তোমার সম্পদ) অপচয় করো না। দেখো, অপচয়কারীরা সর্বদাই শয়তানের ভাই আর সে বরাবরই তার প্রভুর প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।… তুমি একেবারে কৃপণ হয়োও না এবং হয়োও না একেবারে মুক্তহস্তও। তাহলে তুমি তিরস্কৃত, নিঃস্ব হয়ে পড়বে। নিশ্চয়ই তোমার পালনকর্তা বা প্রভু যাকে ইচ্ছা দান করেন অধিক জীবনোপকরণ; আর তিনিই তা সঙ্কুচিতও করে দেন। তিনিই তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক অবগত- তিনি দেখছেন সবকিছু (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ২৬-২৭, ২৯-৩০)।
অর্থের ব্যাপারে কেউ কৃপণ বা অপচয়ী, কোনোটাই হওয়া উচিত নয়। অপচয় করা অনুচিত; আবার কৃপণও হওয়া ঠিক নয়। ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপনে মুসলমান অঙ্গীকারবদ্ধ।
হালাল পন্থায় উপার্জন করা চাই। আর সে অর্থ সঠিকভাবেই ব্যয় করা উচিত। আল্লাহতায়ালা আমাদের যত সম্পদ দিয়েছেন, তার সব ক্ষেত্রেই এই মূলনীতি প্রয়োগ করা সম্ভব। দূরদর্শিতার সাথে এবং বিবেকসম্মত উপায়ে সম্পদের সদ্ব্যবহার মুসলমানদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি।
সন্তানের যত্ন নেয়া
‘তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না, দারিদ্র্যের ভয়ে; আমরা তাদের এবং তোমাদের আমিই জীবনোপকরণ দিই। দেখো, তাদের হত্যা করা মহাপাপ’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩১)।
আমরা যেহেতু মাতাপিতার অধিকারের স্বীকৃতি দিচ্ছি, সন্তানের অধিকারও স্বীকার করে নেয়া উচিত। আমাদের সন্তান আমাদের ভবিষ্যৎ। আমাদের অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে, যাতে আমরা সন্তানদের স্বাস্থ্যবান, বুদ্ধিমান এবং নৈতিক দায়িত্বসচেতন হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। তাদের নিরাপদ ও সুস্থ পরিবেশে লালন করার ব্যাপারে আমাদের অঙ্গীকার থাকা দরকার। তাদের জীবনের পাশাপাশি চেতনা, মানসিকতা, নৈতিকতা ও সদাচরণও রক্ষা করতে হবে।
ব্যভিচার ও অবৈধ সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকা
আর অবৈধ যৌন সম্পর্কের নিকটবর্তী হয়ো না। দেখো, এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩২)।
যৌন বিকৃতি ব্যক্তি ও সমাজের সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ। এ ক্ষেত্রে নিয়মকানুন মেনে চললে স্বাস্থ্য ও সুখ এবং নৈতিকতাপূর্ণ সমাজ লাভ করা যায়। বিশুদ্ধ, স্বচ্ছ এবং সামাজিক দায়িত্বশীলতাপূর্ণ জীবনযাত্রার বিষয়ে মুসলমানরা অঙ্গীকারে আবদ্ধ।
ইসলাম শিক্ষা দেয়, ব্যভিচার বা যৌন অনাচারের ধারেকাছেও যাওয়া উচিত নয়। এর তাৎপর্য হলো- নারী-পুরুষের পোশাকের ব্যাপারে যথাযথ বিধিবিধান, মিশ্রসমাজে সঠিক আচরণ এবং সামাজিক সম্পর্ক ও বিনোদনের বেলায় যথার্থ নিয়ন্ত্রণ।
প্রতিটি জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ন্যায়বিচার ব্যতীত হত্যা না করা
‘আর হত্যা করো না সে জীবন, যা আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন সঙ্গত কারণ ব্যতিরেকে’। (বনি ইসরাইল ৩৩ নং আয়াত)
এর অর্থ হলো, সব জীবনের পবিত্রতা স্বীকার করে নিতে হবে। জীবনকে অচল করে দিতে পারে, এমন কোনো কাজই করা যাবে না। আগ্রাসন ও সন্ত্রাস পরিহার করতে হবে। কারণ, এসব দোষ হত্যাকাণ্ডের দিকে মানুষকে পরিচালনা করে থাকে। প্রতিটি মুসলিমকে শান্তিপূর্ণ পন্থা অবলম্বনের জন্য অঙ্গীকার করতে হবে। সংলাপ ও আলোচনার মধ্য দিয়ে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত নিরসন করতে হবে- হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে নয়। অবশ্য, ন্যায়বিচার বহাল রাখতে হবে। কারণ সঠিকভাবে শাস্তি দিলে নিরাপত্তা লাভ করা যায় এবং রক্ষা পায় জীবন।
ইয়াতিমের যত্ন নেয়া
ইয়াতিমের সম্পত্তির নিকটবর্তী হয়ো না, এর উন্নতি বিধানের উদ্দেশ্য ছাড়া; যে পর্যন্ত না সে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠে (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩৪)।
ইয়াতিমসহ যারা সহজেই বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে, তাদের সবার যত্ন নেয়া জরুরি। তাদের অধিকারগুলো স্বীকার করে নিতে হবে এবং সব ধরনের ক্ষতির হাত থেকে তাদের রক্ষা করতে হবে। তরুণ, গরিব, দুর্বল ও প্রতিবন্ধীদের যত্ন নেয়ার জন্য যেকোনো মুসলমান গভীরভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। দয়া ও করুণা একজন মুসলমানের মৌলিক অঙ্গীকার। সব মানুষ এবং পশু এর অন্তর্ভুক্ত।
অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি পূরণ করা
আর অঙ্গীকার পূরণ করো। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে (বনি ইসরাইল, আয়াত ৩৪)।
ওয়াদা ও চুক্তি মানবজীবনের ও মানব সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ওয়াদা বা অঙ্গীকার পূরণ করা না হলে মানুষ পরস্পরের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং তখন গোটা সমাজ দুর্বল হয়ে পড়ে। মুসলমানদের অবশ্যই নিজ নিজ অঙ্গীকার পূরণ করতে হবে। আমাদের অবশ্য করণীয় অঙ্গীকার হবে সত্য বলা ও সৎ হওয়ার। আর যখন আমরা প্রতিশ্রুতি দেবো, অবশ্যই আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা চালাবো তা পূরণের জন্য।
ব্যবসায়িক লেনদেনে সততা বজায় রাখা মেপে দেয়ার সময়ে পূর্ণ মাপে দেবে এবং ওজন করবে সঠিক দাঁড়িপাল্লায়। এটা উত্তম; এর পরিণাম সবচেয়ে শুভ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩৫)।
সৎ ব্যবসায় আনে উন্নতি, সাফল্য আর রহমত। বাণিজ্যিক, সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক- সব ধরনের কর্মকাণ্ড সুবিচার ও ন্যায়নীতির অনুভূতির সাথে সম্পন্ন করতে হবে। সব ব্যাপারে এবং সবার সাথে সদাচরণ করতে প্রত্যেক মুসলমান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একজন মুসলমানের সাথে কাজকারবার মানে পুরোপুরি আস্থা রাখা যায় তার ওপর। তাই একজন মুসলিম ব্যবসায়ীর সবচেয়ে সৎ ব্যবসায়ী হওয়া উচিত। একজন মুসলিম শ্রমিক হওয়া উচিত সর্বাধিক সৎ শ্রমিক। যেকোনো পেশার মুসলমান তার পেশার জন্য সম্মান বয়ে আনা উচিত।
জ্ঞানের ভিত্তিতে কাজ করা, গুজব বা অর্ধসত্যের ভিত্তিতে নয়
যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই, কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরণ- এগুলোর প্রতিটিকেই জিজ্ঞাসা করা হবে (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩৬)।
তথ্যসংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মিডিয়ার রয়েছে বিরাট দায়িত্ব। ভুল তথ্য দিলে অথবা তথ্যের অপব্যবহার হলে বিরাট অবিচার করা হয়। তথ্যের সত্যতার ব্যাপারে মুসলমানদের অঙ্গীকার থাকা উচিত। যে কারো সম্পর্কে, এমনকি তাদের শত্রুদের ব্যাপারেও, সত্য রিপোর্টিংকে এগিয়ে নেয়া প্রয়োজন। মুসলিম সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে যে রিপোর্ট, তা সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য হওয়া উচিত। একইভাবে, মুসলমানদের সর্বোচ্চ মাত্রায় সতর্ক থাকতে হবে নিজেদের কাজ ও প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে। যথাযথ সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা উচিত নয়।
বিনয়ী হওয়া এবং উদ্ধত না হওয়া
পৃথিবীতে সদম্ভে পদচারণা করো না। নিশ্চয়ই তুমি ভূপৃষ্ঠকে কখনো পারবে না বিদীর্ণ করতে এবং উচ্চতার দিক দিয়ে কখনো পর্বতসম হতে পারবে না (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩৭)।
উদারতা, নমনীয়তা ও ভারসাম্য হচ্ছে মানুষের আচরণের সর্বোৎকৃষ্ট বিষয়। একের প্রতি অন্যের মনোভাবের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। একজন মুসলমান মর্যাদাবান মানুষ; একই সাথে তিনি বিনয়ী। কোনো মুসলিম অহঙ্কারী, দাম্ভিক, উদ্ধত হওয়ার কথা নয়। আল্লাহতায়ালার সব দানের জন্য একজন মুসলমান তাকে ধন্যবাদ দিয়ে থাকেন। প্রতিটি জিনিসের জন্য চূড়ান্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্য এবং প্রকৃত গৌরবও তাঁরই প্রাপ্য।
ব্যক্তিপর্যায়ে এবং সামষ্টিকভাবে এগুলো হচ্ছে মুসলমানদের মৌলিক অঙ্গীকার। এগুলো প্রজ্ঞার মূলনীতি এবং ইসলামের বিশ্বজনীন মূল্যবোধ। এসব মূলনীতির অনুসরণ বিশেষ ন্যায়বিচার, শান্তি ও সুখ প্রতিষ্ঠা করবে। একইসাথে পরকালের সফলতা ও মুক্তিও আনবে। আসুন, আমরা সবাই এগুলোকে আমাদের প্রকৃত প্রতিশ্রুতিতে পরিণত করি।
'' শুধু নিজে শিক্ষিত হলে হবেনা, প্রথমে বিবেকটাকে শিক্ষিত করুন। ''
এই সূরায় আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের কয়েকটি মৌলিক অঙ্গীকারের উল্লেখ করেছেন। এই অঙ্গীকারগুলো পূরণ না করে কোনো ব্যক্তি বা দল সফল হতে পারে না। এসব মূল্যবোধের ভিত্তিতে মুসলমানদের জীবনযাপন করতে হয়। আর তাদের মানব জাতিকে এই মূলনীতিগুলোর দিকে আহ্বান জানানো উচিত।
এসব মূলনীতি কেবল বিশেষ একটি গোত্র বা দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং পরিধি ও প্রয়োগের দিক দিয়ে বিশ্বজনীন। এগুলো ‘হিকমাহ’ নামেও অভিহিত, যার অর্থ প্রজ্ঞাপূর্ণ শিক্ষা। যথাযথভাবে অনুসরণ করা হলে এই মূলনীতিগুলো সব মানুষের কল্যাণ ও প্রজ্ঞা বৃদ্ধি করতে সক্ষম। এগুলো হচ্ছে-
শুধু আল্লাহর ইবাদত
‘তোমার প্রভু আদেশ করেছেন, তোমরা তাঁর ব্যতীত আর কারো বন্দেগী বা ইবাদত করবে না (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ২৩)। এর অর্থ, পরম বাস্তবতা এবং একক উপাস্যরূপে আল্লাহতায়ালার স্বীকৃতি প্রদান, সম্পূর্ণ নিষ্ঠাসহকারে তাঁর ইবাদত করা এবং জীবনের প্রতিটি বিষয়ে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ। একজন মুসলিমের জীবন আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়া ছাড়া কিছু নয়।
আমরা কেবল একত্ববাদীই নই; সেই অদ্বিতীয় স্রষ্টাকেন্দ্রিক জীবন আমাদের। তিনিই আমাদের সার্বক্ষণিক ও চূড়ান্ত ভাবনার বিষয়।
মাতাপিতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও দয়ালু হওয়া
‘আর (যাতে তোমরা দেখাও) মাতাপিতার প্রতি দয়া। যদি তাদের একজন কিংবা উভয়ে তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হন, তাদের ব্যাপারে ‘উহ’ পর্যন্ত বলো না, অথবা তাদের ধমক দিও না; বরং তাদের সাথে শিষ্টাচারপূর্ণভাবে কথা বলো। তাদের প্রতি ভালোবাসার সাথে, অত্যন্ত নম্র ও বিনয়ী আচরণ করো; এবং বলো, হে পালনকর্তা তাদের উভয়ের প্রতি দয়া করো, যেমন তারা শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছেন (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ২৩-২৪)।
সন্তানের জন্য মাতাপিতার দয়া ও দরদের স্বীকৃতি, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং তাদের ভালোবাসার প্রতিদানে যথাসাধ্য করার জন্যই এটা।
মাতাপিতার প্রতি সন্তানের ভক্তি হলো মুসলমানদের দ্বিতীয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও দয়া আমাদের জন্য নিছক সামাজিক দায়িত্ব নয়। এটা আমাদের ধর্মীয় দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতাও বটে।
আত্মীয়, দরিদ্র ও মুসাফিরের প্রতি সদয় হওয়া
আত্মীয়স্বজনকে তাদের প্রাপ্য দাও, আর অভাবী ও মুসাফিরকে তাদের প্রাপ্য (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ২৬)।
মনে রাখা দরকার, এই পৃথিবীতে আমরা পরস্পর সম্পর্কিত। আমাদের দায়িত্ব কেবল নিজের প্রতি নয়, কিংবা শুধু পরিবারের প্রতিও নয়। অন্যান্য আত্মীয় এবং বৃহত্তর পর্যায়ে, সমাজের প্রতিও আমাদের কর্তব্য রয়েছে।
আমরা একে অপরের মুখাপেক্ষী এবং এই জীবনপথে আমরা সবাই সহযাত্রী। অন্যের জন্য আমরা কী করতে পারি, সেদিকে অবশ্যই আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। মুসলমানদের জীবন অবশ্যই সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল হতে হবে। এই দায়িত্বের সূচনা হয় পরিবারে এবং অন্যান্য আত্মীয়ের ক্ষেত্রে। যারা অভাবগ্রস্ত, যাদের প্রয়োজন সাহায্য, এমন সবার প্রতি দায়িত্ব রয়েছে।
অর্থের ব্যাপারে সতর্কতা এবং সম্পদের অপচয় না করা
আর (তোমার সম্পদ) অপচয় করো না। দেখো, অপচয়কারীরা সর্বদাই শয়তানের ভাই আর সে বরাবরই তার প্রভুর প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।… তুমি একেবারে কৃপণ হয়োও না এবং হয়োও না একেবারে মুক্তহস্তও। তাহলে তুমি তিরস্কৃত, নিঃস্ব হয়ে পড়বে। নিশ্চয়ই তোমার পালনকর্তা বা প্রভু যাকে ইচ্ছা দান করেন অধিক জীবনোপকরণ; আর তিনিই তা সঙ্কুচিতও করে দেন। তিনিই তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক অবগত- তিনি দেখছেন সবকিছু (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ২৬-২৭, ২৯-৩০)।
অর্থের ব্যাপারে কেউ কৃপণ বা অপচয়ী, কোনোটাই হওয়া উচিত নয়। অপচয় করা অনুচিত; আবার কৃপণও হওয়া ঠিক নয়। ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপনে মুসলমান অঙ্গীকারবদ্ধ।
হালাল পন্থায় উপার্জন করা চাই। আর সে অর্থ সঠিকভাবেই ব্যয় করা উচিত। আল্লাহতায়ালা আমাদের যত সম্পদ দিয়েছেন, তার সব ক্ষেত্রেই এই মূলনীতি প্রয়োগ করা সম্ভব। দূরদর্শিতার সাথে এবং বিবেকসম্মত উপায়ে সম্পদের সদ্ব্যবহার মুসলমানদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি।
সন্তানের যত্ন নেয়া
‘তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না, দারিদ্র্যের ভয়ে; আমরা তাদের এবং তোমাদের আমিই জীবনোপকরণ দিই। দেখো, তাদের হত্যা করা মহাপাপ’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩১)।
আমরা যেহেতু মাতাপিতার অধিকারের স্বীকৃতি দিচ্ছি, সন্তানের অধিকারও স্বীকার করে নেয়া উচিত। আমাদের সন্তান আমাদের ভবিষ্যৎ। আমাদের অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে, যাতে আমরা সন্তানদের স্বাস্থ্যবান, বুদ্ধিমান এবং নৈতিক দায়িত্বসচেতন হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। তাদের নিরাপদ ও সুস্থ পরিবেশে লালন করার ব্যাপারে আমাদের অঙ্গীকার থাকা দরকার। তাদের জীবনের পাশাপাশি চেতনা, মানসিকতা, নৈতিকতা ও সদাচরণও রক্ষা করতে হবে।
ব্যভিচার ও অবৈধ সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকা
আর অবৈধ যৌন সম্পর্কের নিকটবর্তী হয়ো না। দেখো, এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩২)।
যৌন বিকৃতি ব্যক্তি ও সমাজের সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ। এ ক্ষেত্রে নিয়মকানুন মেনে চললে স্বাস্থ্য ও সুখ এবং নৈতিকতাপূর্ণ সমাজ লাভ করা যায়। বিশুদ্ধ, স্বচ্ছ এবং সামাজিক দায়িত্বশীলতাপূর্ণ জীবনযাত্রার বিষয়ে মুসলমানরা অঙ্গীকারে আবদ্ধ।
ইসলাম শিক্ষা দেয়, ব্যভিচার বা যৌন অনাচারের ধারেকাছেও যাওয়া উচিত নয়। এর তাৎপর্য হলো- নারী-পুরুষের পোশাকের ব্যাপারে যথাযথ বিধিবিধান, মিশ্রসমাজে সঠিক আচরণ এবং সামাজিক সম্পর্ক ও বিনোদনের বেলায় যথার্থ নিয়ন্ত্রণ।
প্রতিটি জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ন্যায়বিচার ব্যতীত হত্যা না করা
‘আর হত্যা করো না সে জীবন, যা আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন সঙ্গত কারণ ব্যতিরেকে’। (বনি ইসরাইল ৩৩ নং আয়াত)
এর অর্থ হলো, সব জীবনের পবিত্রতা স্বীকার করে নিতে হবে। জীবনকে অচল করে দিতে পারে, এমন কোনো কাজই করা যাবে না। আগ্রাসন ও সন্ত্রাস পরিহার করতে হবে। কারণ, এসব দোষ হত্যাকাণ্ডের দিকে মানুষকে পরিচালনা করে থাকে। প্রতিটি মুসলিমকে শান্তিপূর্ণ পন্থা অবলম্বনের জন্য অঙ্গীকার করতে হবে। সংলাপ ও আলোচনার মধ্য দিয়ে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত নিরসন করতে হবে- হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে নয়। অবশ্য, ন্যায়বিচার বহাল রাখতে হবে। কারণ সঠিকভাবে শাস্তি দিলে নিরাপত্তা লাভ করা যায় এবং রক্ষা পায় জীবন।
ইয়াতিমের যত্ন নেয়া
ইয়াতিমের সম্পত্তির নিকটবর্তী হয়ো না, এর উন্নতি বিধানের উদ্দেশ্য ছাড়া; যে পর্যন্ত না সে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠে (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩৪)।
ইয়াতিমসহ যারা সহজেই বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে, তাদের সবার যত্ন নেয়া জরুরি। তাদের অধিকারগুলো স্বীকার করে নিতে হবে এবং সব ধরনের ক্ষতির হাত থেকে তাদের রক্ষা করতে হবে। তরুণ, গরিব, দুর্বল ও প্রতিবন্ধীদের যত্ন নেয়ার জন্য যেকোনো মুসলমান গভীরভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। দয়া ও করুণা একজন মুসলমানের মৌলিক অঙ্গীকার। সব মানুষ এবং পশু এর অন্তর্ভুক্ত।
অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি পূরণ করা
আর অঙ্গীকার পূরণ করো। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে (বনি ইসরাইল, আয়াত ৩৪)।
ওয়াদা ও চুক্তি মানবজীবনের ও মানব সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ওয়াদা বা অঙ্গীকার পূরণ করা না হলে মানুষ পরস্পরের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং তখন গোটা সমাজ দুর্বল হয়ে পড়ে। মুসলমানদের অবশ্যই নিজ নিজ অঙ্গীকার পূরণ করতে হবে। আমাদের অবশ্য করণীয় অঙ্গীকার হবে সত্য বলা ও সৎ হওয়ার। আর যখন আমরা প্রতিশ্রুতি দেবো, অবশ্যই আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা চালাবো তা পূরণের জন্য।
ব্যবসায়িক লেনদেনে সততা বজায় রাখা মেপে দেয়ার সময়ে পূর্ণ মাপে দেবে এবং ওজন করবে সঠিক দাঁড়িপাল্লায়। এটা উত্তম; এর পরিণাম সবচেয়ে শুভ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩৫)।
সৎ ব্যবসায় আনে উন্নতি, সাফল্য আর রহমত। বাণিজ্যিক, সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক- সব ধরনের কর্মকাণ্ড সুবিচার ও ন্যায়নীতির অনুভূতির সাথে সম্পন্ন করতে হবে। সব ব্যাপারে এবং সবার সাথে সদাচরণ করতে প্রত্যেক মুসলমান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একজন মুসলমানের সাথে কাজকারবার মানে পুরোপুরি আস্থা রাখা যায় তার ওপর। তাই একজন মুসলিম ব্যবসায়ীর সবচেয়ে সৎ ব্যবসায়ী হওয়া উচিত। একজন মুসলিম শ্রমিক হওয়া উচিত সর্বাধিক সৎ শ্রমিক। যেকোনো পেশার মুসলমান তার পেশার জন্য সম্মান বয়ে আনা উচিত।
জ্ঞানের ভিত্তিতে কাজ করা, গুজব বা অর্ধসত্যের ভিত্তিতে নয়
যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই, কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরণ- এগুলোর প্রতিটিকেই জিজ্ঞাসা করা হবে (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩৬)।
তথ্যসংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মিডিয়ার রয়েছে বিরাট দায়িত্ব। ভুল তথ্য দিলে অথবা তথ্যের অপব্যবহার হলে বিরাট অবিচার করা হয়। তথ্যের সত্যতার ব্যাপারে মুসলমানদের অঙ্গীকার থাকা উচিত। যে কারো সম্পর্কে, এমনকি তাদের শত্রুদের ব্যাপারেও, সত্য রিপোর্টিংকে এগিয়ে নেয়া প্রয়োজন। মুসলিম সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে যে রিপোর্ট, তা সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য হওয়া উচিত। একইভাবে, মুসলমানদের সর্বোচ্চ মাত্রায় সতর্ক থাকতে হবে নিজেদের কাজ ও প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে। যথাযথ সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা উচিত নয়।
বিনয়ী হওয়া এবং উদ্ধত না হওয়া
পৃথিবীতে সদম্ভে পদচারণা করো না। নিশ্চয়ই তুমি ভূপৃষ্ঠকে কখনো পারবে না বিদীর্ণ করতে এবং উচ্চতার দিক দিয়ে কখনো পর্বতসম হতে পারবে না (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩৭)।
উদারতা, নমনীয়তা ও ভারসাম্য হচ্ছে মানুষের আচরণের সর্বোৎকৃষ্ট বিষয়। একের প্রতি অন্যের মনোভাবের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। একজন মুসলমান মর্যাদাবান মানুষ; একই সাথে তিনি বিনয়ী। কোনো মুসলিম অহঙ্কারী, দাম্ভিক, উদ্ধত হওয়ার কথা নয়। আল্লাহতায়ালার সব দানের জন্য একজন মুসলমান তাকে ধন্যবাদ দিয়ে থাকেন। প্রতিটি জিনিসের জন্য চূড়ান্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্য এবং প্রকৃত গৌরবও তাঁরই প্রাপ্য।
ব্যক্তিপর্যায়ে এবং সামষ্টিকভাবে এগুলো হচ্ছে মুসলমানদের মৌলিক অঙ্গীকার। এগুলো প্রজ্ঞার মূলনীতি এবং ইসলামের বিশ্বজনীন মূল্যবোধ। এসব মূলনীতির অনুসরণ বিশেষ ন্যায়বিচার, শান্তি ও সুখ প্রতিষ্ঠা করবে। একইসাথে পরকালের সফলতা ও মুক্তিও আনবে। আসুন, আমরা সবাই এগুলোকে আমাদের প্রকৃত প্রতিশ্রুতিতে পরিণত করি।
'' শুধু নিজে শিক্ষিত হলে হবেনা, প্রথমে বিবেকটাকে শিক্ষিত করুন। ''
কোন মন্তব্য নেই:
/>